আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২
সমসাময়িক
বিদায় বিশ্বায়ন?
১৯৭০-এর দশক থেকে বিশ্ব-পুঁজিবাদ একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে, যেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর নির্ভরশীল না হয়ে, পুঁজির বৃদ্ধির জন্য গোটা দুনিয়াকেই তার আঙিনা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী পুঁজির চলাচলের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়, সরকারী খরচ বাড়িয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির আর্থিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিও পরিকল্পনা নির্ভর অর্থব্যবস্থা নির্মাণ করে, উপনিবেশবাদের সময়কার আন্তর্জাতিক পুঁজির উপরে নির্ভরশীলতা হ্রাস করার চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকে এই কাঠামোকে আন্তর্জাতিক পুঁজি নিপুণভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। বিশ্বায়নের মাধ্যমে আবারও পুঁজির অবাধ চলাচলকে আন্তর্জাতিক স্তরে সুনিশ্চিত করা হয়। আমাদের মতন দেশগুলিকে বলা হয় যে পুঁজির চলাচলের উপরে নিয়ন্ত্রণ তুলে দাও, অবাধ পুঁজিই মানব সভ্যতার সর্বোচ্চ সোপান।
এই বিশ্বায়ন, পূর্বের উপনিবেশবাদী বিশ্বায়নের থেকে কাঠামোগতভাবে ভিন্ন। কারণ উপনিবেশবাদ নেই, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির উপনিবেশ আপাতত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাই নতুন বিশ্বায়িত পুঁজির প্রয়োজন হয় নতুন মতাদর্শের, যা হল নব-উদারবাদ। এই নব-উদারবাদী অর্থব্যবস্থার কিছু দাবি ছিল। এই দাবি করা হয়েছিল যে বিশ্বায়িত পুঁজির হাত ধরে সমস্ত স্তরের মানুষের উন্নতি হবে। প্রাথমিকভাবে তা না হলেও, ধনীদের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির পরে, সেই উন্নয়ন চুঁয়ে পড়বে গরীবের দিকে। অতএব, হে গরীব ধৈর্য ধরো। একদিন তোমারও উন্নতি হবে। আবার উপনিবেশবাদী সময়ের বিপরীতে হেঁটে আন্তর্জাতিক পুঁজি উন্নয়নশীল দেশের সস্তা শ্রমের সুবিধা নেওয়ার জন্য কারখানা স্থাপন করে চিন, কোরিয়ার মতন দেশে। ভাবা হয় যে এর ফলে পণ্য সস্তায় তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করে পুঁজির মুনাফা বাড়বে। অন্যদিকে, চিনের মতন দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং এর মাধ্যমে গোটা পৃথিবী ধীরে ধীরে পুঁজির হাত ধরে এক স্বর্ণকালে উপনীত হবে।
বাস্তব চিত্র এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফাকচারিং শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়েছে। সেখানে বহু মানুষ বেকার। গোটা পৃথিবীতে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চিনের মতন দেশ কিছুটা উন্নতির মুখ দেখেছে, কিন্তু সেখানেও আর্থিক বৈষম্য বিপুলভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বিপুলাকার ধারণ করেছে। একের পর এক সংকটের শিকার হয়েছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত বাম-গণতান্ত্রিক ডেমোক্রাটিক পার্টি এই সমস্ত সমস্যার কোনো নিরসন করার আশা মানুষকে দেখাতে পারেনি। বরং আরও বেশি করে কীভাবে এই নীতিগুলিই প্রচলন করলে মানুষের সমস্যার সমাধান হবে সেই কথা বলার চেষ্টা করেছে।
বাড়তে থাকা আর্থিক সংকট, বেকারত্বের জ্বালা, অন্য দেশের পণ্যের উপর নির্ভরশীল অর্থব্যবস্থায় দক্ষিণপন্থী ঝোঁক আসাই স্বাভাবিক। অনেকে মনে করেন যে আর্থিক সংকট বামপন্থীদের হাত শক্ত করে। কথাটি কতটা ভ্রান্ত বুঝতে হলে তাকান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সেখানে চরম দক্ষিণপন্থী ট্রাম্প সরকার জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেওয়ার পর থেকে ট্রাম্প একটার পর একটা ভয়াবহ আর্থিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন। যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিপুল হারে আমদানি শুল্ক লাগু করা। বিশেষ করে চিন থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর বিপুল হারে আমদানি শুল্ক বসানো হয়েছে। চিনও চুপ করে বসে নেই। তারাও পালটা আমদানি শুল্ক বসাচ্ছে আমেরিকার পণ্যের উপর। অন্যদিকে, বেশ কিছু সামগ্রী যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের উৎপাদনের জন্য জরুরি, তা আমেরিকায় রপ্তানি করার উপর চিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য গোটা পৃথিবীর শেয়ার বাজারে ধ্বস নেমেছে। লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শেয়ার বাজার থেকে।
ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে এই সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকা আর আগের মতন ম্যানুফাকচারিং শিল্পের অগ্রণী দেশ নয়। সেই দেশ মূলত পরিষেবা শিল্প নির্ভর। কিন্তু ম্যানুফাকচারিং পণ্য ব্যতিরেকে মানুষের জীবন চলতে পারে না। এই বিপুল আমদানি শুল্ক আমেরিকার সাধারণ মানুষের ক্ষতি করবে, কারণ প্রায় সমস্ত পণ্যের দাম বাড়বে। অন্যদিকে, চিনেও আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে সেখানকার পণ্যের দামও বাড়বে। শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর কথা কেউ বলছেন না। অতএব, শ্রমিকের মজুরি অপরিবর্তিত থেকে যদি পণ্যের দাম বাড়ে তাহলে প্রকৃত মজুরি বা ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। তার ফলে গোটা পৃথিবীতে মন্দা দেখা দেবে। সেই আশংকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যার ফলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন, যার ফলে শেয়ারের দামের বিপুল পতন দেখা দিয়েছে।
আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতির একটি উলটো পিঠ রয়েছে। কোনো দেশের যদি বাণিজ্য ঘাটতি থাকে, অর্থাৎ তার আমদানি যদি রপ্তানির থেকে বেশি হয়, তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ধার নিতে হবে। আমেরিকা পৃথিবীর বৃহত্তম বাণিজ্য ঘাটতির দেশ। বহু বছর ধরে তারা এই বাণিজ্য ঘাটতি বজায় রাখতে পেরেছে, কারণ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ডলার একটি আকর্ষণীয় মুদ্রা। যেহেতু সবাই মনে করে যে ডলারের মূল্য বজায় থাকবে, তাই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি সত্ত্বেও বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণে আমেরিকান বন্ড বা সরকারী ঋণপত্র কেনে, যার মাধ্যমে সেই দেশ তাদের বাণিজ্য ঘাটতি মেটানেোর প্রয়োজনীয় অর্থ পায়। কিন্তু ট্রাম্প বর্ণিত এই নীতির ফলে ডলারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যদি আমেরিকা তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চায়, তাহলে বিশ্বের মানুষের ডলার ধরার প্রয়োজনীয়তা ফুরোবে। তা যদি হয়, তাহলে ডলারের দাদাগিরি কমতে পারে। ট্রাম্প তথা আমেরিকার প্রশাসন যে তা জানে না, তা নয়। ডলারের দাদাগিরি বজায় রাখার জন্য আমেরিকার সামরিক শক্তি আসলে শেষ কথা বলে। তাই বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে যেই টালমাটাল পরিস্থিতি বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে তা সামরিক যুদ্ধের দিকে যেতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে পূর্বে তাই হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, চিন বা ভারতের মতন দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আঙিনায় পৌঁছিয়েছে মূলত সস্তা শ্রমের হাত ধরে। এই সস্তা শ্রমের লোভে বিশ্বপুঁজি বিনিয়োগ করেছে এই দেশগুলিতে। কিন্তু এই বিনিয়োগের ফলে আমেরিকার মতন দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। বর্তমানে ট্রাম্প বর্ণিত আমদানি শুল্ক বাড়ানোর নীতি, বিশ্ব পুঁজির উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ করার এই নীতির উলটো পথে হাঁটবে। এর ফলে যদি আবারও পুঁজি আমেরিকায় ফিরে যায়, তাহলে চিনের মতন দেশ সংকটাগ্রস্ত হবে। কিন্তু আমেরিকায় ফিরলেই রাতারাতি তো আর পুঁজির পক্ষে শিল্প স্থাপন করে রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। অতএব, গোটা বিশ্ব এই নীতির ফলে সংকটের দিকে ঢলে পড়তে পারে।
এই সমস্ত আর্থিক নীতির নেপথ্যে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। বাইরে থেকে আগত পণ্য তথা শ্রমিক দুইয়ের বিরুদ্ধেই তাই ট্রাম্প যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আসলে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মানুষের উগ্র বর্ণবৈষম্যের নেতা হলেন ট্রাম্প। তাই আমেরিকাকে আবার মহান করার নীতি আসলে সেখানকার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। ট্রাম্প চাইছেন শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে গঠিত এক নতুন আমেরিকা, যেখানে মুসলমান, হিসপানিক, আফ্রিকান অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কোনো জায়গা নেই।
আমেরিকা বিশ্বপুঁজিবাদের নেতা। সেখানে এই অস্থির এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী ঝোঁক গোটা পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থীদের হাত শক্ত করবে। ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি, আমদানি কর, অনুপ্রবেশের নামে অ-শ্বেতাঙ্গ মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা, এলন মাস্কের মতন ধনী শিল্পপতির মাধ্যমে সেখানকার সরকারী প্রশাসনকে ধ্বংস করার নীতি, সবই এক মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা তথা গোটা বিশ্বকে। ট্রাম্পের এই ভয়াবহ নীতির নেপথ্যে সমর্থন রয়েছে সেখানকার প্রায় সমস্ত বৃহৎ পুঁজিপতির। আসলে ট্রাম্প সাধারণ মানুষদের দোহাই দিয়ে এই পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র অধিপতি বানানোর নীতি নিয়ে চলেছেন।
এই অস্থির সময়ে ভারতের মতন দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারের বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল রপ্তানি নির্ভর আর্থিক মডেলকে বাতিল করে দেশীয় চাহিদা নির্ভর আর্থিক বৃদ্ধির মডেলের দিকে যেতে হবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। মোদী সরকার সেই পথে হাঁটার চেষ্টা করবে না। ট্রাম্পের আমদানি শুল্কের বিরুদ্ধে ভারত খুব বেশি কথা খরচ করেনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে। চিনের ক্ষতির ফলে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা রপ্তানি তথা বিনিয়োগ যদি ভারতের কপালে জোটে সেই আশায় বুক বাঁধছে মোদী সরকার। কিন্তু সার্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে ভারত কি আন্তর্জাতিক বাজারের খড়কুটো ধরে বাঁচার আশা করবে, নাকি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়ে আর্থিক বৃদ্ধির পথে হাঁটবে? এই প্রশ্নের উপরে নির্ভর করবে ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎ।