আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২
সম্পাদকীয়
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার গঙ্গাযাত্রা
স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ২০১৬ সালের প্যানেলে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ, গ্রুপ সি-ডি মিলিয়ে প্রায় ২৬ লক্ষ পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন তবে এদের মধ্যে ২২ লক্ষ পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
এদের মধ্যে এসএসসি ইস্যু করে ২৫,৮৪৪ জনের নিয়োগপত্র। তবে প্রকৃত নিয়োগ হয় সামান্য কম। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিল হয়েছে প্রকৃত নিযুক্ত ২৫,৩২৭ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর। এদের মধ্যে -
• ওএমআর কারচুপি ও র্যাঙ্ক উল্লম্ফনের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন ৪,৩২৭ জন,
• এসএসসি-র সুপারিশ ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন ২,৮২৩ জন,
• প্যানেল-এর মেয়াদ শেষের পর চাকরি পেয়েছেন ১,১৭৪ জন।
অর্থাৎ ৮,৩২৪ জন ‘প্রমাণিত দুর্নীতিগ্রস্ত’। মামলা চলাকালীন, তদন্তকারী সংস্থা, আইনজীবীরা কিছু জনের খাতা, ওএমআর শিট জোগাড় করে আদালতে দেখিয়েছিল কীভাবে সাদা খাতায় চাকরি হয়েছে, শূন্য পেয়ে চাকরি হয়েছে, অতিরিক্ত পদ তৈরি করে চাকরি হয়েছে। এরাই হচ্ছেন ‘চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত’। এই ‘চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত’-রা চাকরি বেনিয়মে পেয়েছিলেন, এদের চাকরি তো গেছেই সঙ্গে এখন টাকা ফেরত দিতে হবে বাৎসরিক ১২ শতাংশ সুদ সমেত। এরা এসএসসি প্যানেল-এর ৩৩ শতাংশ।
বাকি ১৭,০০৩ জনের মধ্যে ‘অচিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘নিষ্কলুষ ও স্বচ্ছ’ শিক্ষক মিশে আছেন। যেহেতু কমিশন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ওএমআর শিট বা অন্য তথ্য-প্রমাণ দেয়নি তাই প্রমাণ করা সম্ভব নয় কে 'দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং কে ‘নিষ্কলুষ ও স্বচ্ছ’।
সবচাইতে অসহায় অবস্থা এর বাইরের একটি দলের। তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন, অনেকে ছিলেন ‘নিষ্কলুষ এবং যোগ্য’, কিন্তু দুর্নীতির জন্য তাঁদের নামই ওঠেনি লিস্টে। তাঁরা দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আছেন। তাঁরা কোর্টে গেলেন - তাদের উকিল হলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
পুরো নিয়োগ সংবিধানের ১৪ ও ১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৈধ নয়, কারণ পুরো প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতিতে কলুষিত।
এসএসসি নিয়োগে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে জানা গেল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগ কমিটির রিপোর্টে। সিবিআই তদন্তের আদেশ হবার পরে তারা শিক্ষামন্ত্রীর পরিচিতের ঘর থেকে ৫০ কোটি উদ্ধার করল। শিক্ষামন্ত্রী এবং গোটা শিক্ষা দপ্তর আজ জেলে বসে আছে।
সিঙ্গেল বেঞ্চ বলেছে, ৬ হাজারের কাছাকাছি চাকুরিরত টাকা দিয়ে চাকরি কিনেছে, তাদের চাকরি বাতিল করে দেওয়া হল - বাকিরা নিষ্কলুষ। রাজ্য সরকার কিন্তু তা মানল না। তারা সুপ্রিম কোর্টে গেল। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা ফেরানোর পরে ডিভিশন বেঞ্চ প্যানেল বাতিল করে দিল - মামলা আবার গেল সুপ্রিম কোর্টে।
হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ থেকে ডিভিশন বেঞ্চ হয়ে সুপ্রিম কোর্ট - সবাই এসএসসিকে বলেছে, সঠিক তথ্য দিন কত জন টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। এসএসসি বলেছে, সঠিক লিস্ট দেওয়া অসম্ভব - ওএমআর শিট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, স্ক্যান কপিও সংরক্ষণ করা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট সম্ভবত কোনো উপায় না দেখে প্যানেল বাতিল করে।
মধ্যবিত্ত ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘ ৯ বছর পরে জানতে পারলেন তারা চাকরিচ্যুত। এখন তাদের বয়স যৌবনের প্রান্তসীমায়!
আর পথে বসে থাকা নিষ্কলুষরা জানেন না তারা পরবর্তীকালে কী করবেন।
এ দায় কার!
এসএসসি সব নিয়মনীতি শিকেয় তুলে ওএমআর স্ক্যান করার একচ্ছত্র দায়িত্ব 'NYSA' নামক একটি সংস্থাকে দিয়েছিল। NYSA কোনো অধিকার ছাড়া এই কাজের দায়িত্বভার 'Data Scantech' নামে আরেকটি সংস্থাকে দিল।
• এসএসসি পরীক্ষার সমস্ত ওএমআর এমনকি সার্ভারে থাকা 'মিরর ইমেজ' ধ্বংস করে ফেলেছে। কেন?
• সেসব পুড়িয়ে টাকা নিয়ে ২০১৬ সালের প্যানেলে ক্রমতালিকা তৈরি করেছে। কেন?
• সম্পূর্ণ ফাঁকা ওএমআর জমা দিয়েও লোকজন চাকরি পেয়েছে। কেন?
যোগ্য শিক্ষকদের এই পরিণতির জন্য প্রধান দায়ী নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার। এটি একটি সংগঠিত দুর্নীতি এবং এই প্রক্রিয়ায় কয়েকশো কোটি টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয়েছে।
এর দায় যারা তথ্যপ্রমাণ লোপ করে সাচ্চা শিক্ষককে পথে বসিয়েছেন তাদের। এর দায় মুখ্যমন্ত্রীর।
৮ এপ্রিল এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যোগ্য’ শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের একজনেরও চাকরি তিনি যেতে দেবেন না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এঁদের উদ্দেশে স্কুলে গিয়ে ‘ভলান্টারি সার্ভিস’-এর আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে শিক্ষক ভলান্টিয়ার। আজকের পশ্চিমবঙ্গে ভলান্টিয়ার দিয়ে শিক্ষা থেকে আইন রক্ষা সবটাই চলবে। এটাই এদের মূল লক্ষ্য।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে বলেন, ওঁদের দাবিগুলি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। আমরা আইনি পরামর্শ নেব। প্রথম যেটা ওঁরা দাবি করেছেন, যোগ্য এবং অযোগ্য-র তালিকা এসএসসি যেন প্রকাশ করে। এসএসসি-র কাছে অবশ্যই তথ্য আছে, মন্তব্য শিক্ষামন্ত্রীর।
তথ্য আছে। মিরর ইমেজ আছে। এসএসসি জানে। জেনেশুনেই স্বশাষিত সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতাদের মতো পুরো পর্যায়টায় মিথ্যা আচরণ করে গিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত রাজ্যের বেহাল শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেহাল হবে। স্কুলে থাকবে না শিক্ষক, স্কুলগুলি প্রথমে মার্জড হবে, তারপরে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।
দু’একটি উদাহরণ দেওয়া যাক -
মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান বালিকা বিদ্যালয়ে মোট ছাত্রী ১,৯২৬ জন। ২৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৫ জনের চাকরি বাতিলের পরে দু'জন শিক্ষক রয়েছেন। সেখানে পড়ুয়া পিছু শিক্ষকের অনুপাত ৭১:১ বদলে এক লাফে বেড়ে ৯৬৩:১ হয়ে যাবে। একই অবস্থা আলিপুরদুয়ারের কালচিনি ব্লকের হ্যামিল্টন স্কুলে। ছ'জনের মধ্যে তিনজনের চাকরি চলে যাওয়ায় বিজ্ঞান পড়ানোর একজনও শিক্ষক থাকবেন না। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছোট মোল্লাখালি মঙ্গলচন্দ্র বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলে ৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮ জনেরই চাকরি চলে গিয়েছে। ফলে একজন শিক্ষক পড়ে আছেন। উত্তর ২৪ পরগনা হাজিনগর আদর্শ হিন্দি বিদ্যালয়ে (এইচএস) ৪৮ জন শিক্ষকের মধ্যে আদালতের রায়ে ৩১ জন শিক্ষক ছাঁটাই হলে মাত্র ১৭ জন শিক্ষক থাকবেন। স্কুলে মোট পড়ুয়া ১,০৪৩ জন। জলপাইগুড়ির বানারহাট স্কুলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর উচ্চ মাধ্যমিকে গণিত, রসায়ন এবং অর্থনীতির মতো মূল বিষয় পড়ানোর কোনো শিক্ষকই নেই। মুর্শিদাবাদের গোথা এ. আর. উচ্চ বিদ্যালয়, ৪৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩১ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল করা হয়েছে। স্কুলে ২,২৩২ জন পড়ুয়া আছে।
শেষ পর্যন্ত সরকারি তিন-চারটি করে স্কুল একত্রিত হবে, তারপরে একদিন নিঃশব্দে আমাদের চোখের আড়ালে বন্ধ হবে।
এক ভয়ানক অন্ধকার দিনের অপেক্ষায় আমরা আছি।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার গঙ্গাযাত্রা সম্পন্ন হতে চলেছে।