আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

রাজেশ্বরী দত্তকে যেটুকু দেখেছি

অমিয় দেব


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ছাত্র হিসেবে যখন প্রথম রাসেল স্ট্রীট যাই তখনই প্রথম রাজেশ্বরী দত্তকে দেখি। ১৯৫৬ সাল সেটা। তুলনামূলক সাহিত্যে প্রথম এম.এ. পাঠরত ক'জনকে সুধীন্দ্রনাথ চা-য়ে বলেছিলেন। আমরা বসেছিলাম ওঁদের প্রশস্ত বৈঠকখানায়। চোখের সামনে প্রায় দেয়ালজোড়া এক যামিনী রায় - ‘কীর্তনীয়া সম্প্রদায়'। গৃহস্বামিনী রাজেশ্বরী দত্ত আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। কথাবার্তাও কি হচ্ছিল একটু? যাই হোক আমরা চা শেষে বৈঠকখানা থেকেই বিদায় নিই, রাসেল স্ট্রীটের প্রাণকেন্দ্র ‘দক্ষিণের বারান্দা’-য় আমাদের সেবার পা পড়েনি।

পরে পড়েছিল। তরুণ (মিত্র) ও আমি মাঝে মাঝেই চলে যেতাম। উপলক্ষ ছাড়াই। তখন টেলিফোনের বালাই ছিল না। গিয়ে ঘণ্টা বাজালেই হল। সেই ঢাকা-বারান্দার গল্প আগে করেছি। অবশ্য আমরা যেতাম সুধীন্দ্রনাথের কাছে, তাঁর কথা শুনতে। রাজেশ্বরীও এসে কখনও কখনও বসতেন আমাদের সঙ্গে। তবে আমাদের সম্ভাব্য পরিচর্যার ভার ছিল যে পরিচারকের উপর তাকে ডাকতেন সুধীন্দ্রনাথই। ডিভানে হয়তো-বা ফরাসি বা ইতালীয় বই ছড়ানো থাকত। একবার এক নবীন ছাত্র, যে আমার সঙ্গে রাসেল স্ট্রীটে গিয়েছিল, ও-নিয়ে একটু অনর্থক কৌতূহল দেখাতে সুধীন্দ্রনাথ তাকে বলেছিলেন, ওগুলো বোধহয় রাজেশ্বরীর। রাজেশ্বরী দত্ত মুখ্যত এক প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক হিসেবে পরিচিত হলেও (তিনি রেডিওতে গাইতে গেলে সুধীন্দ্রনাথও ট্রানজিস্টারে কান পেতে শুনতেন) তিনি যে বিদূষীও ছিলেন তার নানা পরিচয় আমরা পেয়েছি। 'কবিতা' শততম সংখ্যায় (পৌষ, ১৩৬৬) - যা International English-Language Number হয়ে বেরোয় - তিনি সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে চারটি ফরাসি, তিনটি ইতালীয় ও পাঁচটি জর্মন কবিতার অনুবাদ করেন।

সুধীন্দ্রনাথ যাদবপুরে পড়ান (সপ্তাহে দু'দিন আসতেন) দুই দফায় - ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষ ও ১৯৯৫৯-এর শারদ অবকাশের পর থেকে ১৯৬০-এর গ্রীষ্মাবকাশ পর্যন্ত (২৫ জুন তো তিনি চলেই গেলেন)। এর মধ্যে একবারই রাজেশ্বরী দত্তকে সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে যাদবপুরে দেখি। এক বক্তৃতা সভায়। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, আমন্ত্রিত হয়ে, আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ-এর তৎকালীন অধ্যক্ষ পিয়ের(?) আমাদো। শুনতে শুনতে বোধকরি সুধীন্দ্রনাথ একবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন; রাজেশ্বরীকে দেখলাম তাঁকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। তখন যাদবপুরে কোনো সভাঘর তৈরি হয়নি, এই সভাটা হয় এঞ্জিনীয়ারিং বিভাগে হাইটেনশন ল্যাবরেটরির একটা ঘরে। আমাদেরকে বোধহয় রাজেশ্বরী দত্ত চিনতেন, তাই এসেছিলেন।

সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যে রাজেশ্বরী কী শোকার্ত হয়েছিলেন তা বলবার নয়। সাক্ষী আমার মতো আরও দু-একজন যারা রাসেল স্ট্রীটে বসে সুধীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধের চিঠিতে নাম, ঠিকানা লিখছিলাম। তাঁর নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে বুদ্ধদেব বসুর একবার এমনও মনে হয়েছিল, আমি কি কিছুদিন অতিথি হয়ে রাসেল স্ট্রীট গিয়ে থাকতে পারিনা! বলা বাহুল্য তা সম্ভব ছিল না। এই সময়ই একবার ইংরেজ কবি স্টিফেন স্পেন্ডার কলকাতা আসেন। রাসেল স্ট্রীট গিয়ে তিনি রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে দেখা করেন (তাঁর সম্পাদিত ‘এনকাউন্টার’ পত্রিকায়, অনুরুদ্ধ হয়ে, ‘ওয়ার্ল্ড সিটি সিরিজ’-এ সুধীন্দ্রনাথ ‘ক্যালকাটা’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন)।

১৯৬১-তে রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষে লন্ডনে আমন্ত্রিত হন রাজেশ্বরী। সেখান থেকে প্যারিস ও রোম। তিনি প্যারিসে বেশ কিছুদিন ছিলেনও। প্যারিস থেকে ৮.১২.৬১-তে তিনি আমায় একটা চিঠি লিখেছিলেন যাতে তাঁকে লেখা আমার দুটো চিঠির উল্লেখ আছে। আমি ঠিক কী লিখেছিলাম মনে ছিল না। আমার এক তরুণ বন্ধু যাদবপুরের 'স্কুল অব কালচারাল টেক্সট্‌স এন্ড রেকর্ডস'-এ রক্ষিত রাজেশ্বরীর কাগজপত্র থেকে সেই দুটো খুঁজে বের করে, প্রতিলিপি করে, আমায় দিয়ে যান। প্রথমটি লেখা ১ অক্টোবর (১৯৬১), দ্বিতীয়টির তারিখ নেই, তবে ডাকঘরের ছাপ থেকে মনে হচ্ছে ডিসেম্বরের একেবারে গোড়ায়। প্রথমটিতে রাজেশ্বরীর শুরু করা একটা অনুবাদ ও তার সম্ভাব্য প্রকাশের কথা আছে। দ্বিতীয়টিতে আছে এক কাজ-এর কথা। কাজ মনে হচ্ছে ওই অনুবাদই। তাঁর চিঠিতে ওই অনুবাদ নিয়ে কিছু বলেননি রাজেশ্বরী, তবে তা যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’-র ফরাসি অনুবাদ তা আমরা ফরাসি প্রকাশক গালিমার-এর রবীন্দ্র অনুবাদের তালিকা থেকে জানি। 'Souvenirs d’enfance' বেরোয় ১৯৬৪-তে আর তার অনুবাদক বলা হয় ক্রিস্তিন বসনেক ও রাজেশ্বরী দত্ত। বোঝাই যাচ্ছে তাঁর প্যারিসবাস-কালে বন্ধু(?) ক্রিস্তিন বসনেকের সঙ্গে এই ‘কাজ’ই করছিলেন রাজেশ্বরী।

আমার দুই চিঠি দুই ঠিকানায় পাঠানো। ঠিকানা দুটো কার কাছে পেয়েছিলাম মনে নেই। বুদ্ধদেব বসু, বাসন্তী মিত্র, না আর কেউ? প্রথম চিঠিতে বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধে আক্রমণের (৭ জুন, ১৯৬১-তে রবীন্দ্রনাথের উপর প্যারিসে দেওয়া বক্তৃতা নিয়ে) কথাও আছে - বলা হচ্ছে তা এখন মন্দীভূত। আক্রমণ তো হয়েছিল দেশে। রাজেশ্বরী কি তখনো দেশে, না বিদেশে বসেই শুনেছিলেন? যাই হোক, যে-চিঠিটা আমায় তিনি লিখেছিলেন তা এইঃ

13 rue de Presles
Paris 15e

------------
8.12.1961

My dear Amiya,

How very good of you to write to me even before I could manage to answer your first letter. Thank you so much for your Bijoya greetings; it helps so much to know that one is remembered still. I think of you all so much and have at times a mad desire to be back in Calcutta, in our flat, both of us - Sudhin and me - to receive friends like you, Buddhadeva, Jyoti and others and spend many more of those very happy evenings we had together on that lovely verandah of ours. But, alas, that chapter is finished, and here, though it is Paris, a place which had the charm of magic for me before, it no longer attracts me; and though some people think that just being here is such bliss that one can forget everything else, I am afraid it does not apply to me. The wound is too fresh and the shock is so great that my eyes seem to have got blind to the beauty all round. There are moments when I seem to suddenly wake up to everything that surrounds me - the beautiful river and the bare trees lining the two edges and the lovely avenues and buildings, but the feeling lasts for so short a while that it is almost as if I was not here in Paris. The flat is mine - here I can sit and think of him and feel I am with him and he is with me. Today I received also the few books Buddhadeva has sent me and on one of these, the date 30th October on which he pencilled them to me has moved me to tears. That was the date when he so often found a book near his pillow on waking up and was always so happy to have it from me and promised it would be the next book he would read. So, this is life! What more shall I say? Write again if you can. Love to you & all other friends.

Rajeshwari

এই চিঠিটা আমি ঢাকার ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় আমাকে লেখা প্রতিভা বসুর কয়েকটা চিঠির সঙ্গে ছাপিয়েছি। আমার এই নিবন্ধের পাঠকেরা কেউ কেউ হয়তো তা দেখে থাকবেন।

।। ২ ।।

এরপর রাজেশ্বরী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান পড়েন, সেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এই ক-বছর আগেই তিনি কয়েক মাস কাটিয়ে গেছেন সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে - সুধীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে তাঁর আত্মজীবনী লিখছিলেন। এবার তিনি ছাত্র। এখানেই ১৯৬৫-তে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমি তখন কাছেই ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানাতে, ছাত্র। বন্ধু দীপক মজুমদার ও ছাত্র, আয়ওয়াতে। তাও শিকাগো থেকে দূরে নয়। আমাদের দুজনের কথা হয়, আমরা শিকাগো এসে এক ছুটির দিন দুপুরে রাজেশ্বরীর সঙ্গে খাব। ও কিছুটা সময় তাঁর সঙ্গে কাটাব। সেই মর্মে আমিই রাজেশ্বরীকে টেলিফোন করি। রাজেশ্বরী খুশি হন। দীপক রাজেশ্বরীর বাড়ির কাছে আমাদের উভয়ের চেনা এক জায়গায় (কলকাতায় আমরা যেমন অনেক সময় করে থাকি বা থাকতাম) নির্দিষ্ট সময়ে আসতে বলল। যথাসময়ে এসে আমি অপেক্ষা করছি, দীপকের দেখা নেই; আরো আরো অপেক্ষা, দীপক আসছে না। রাজেশ্বরীকে টেলিফোন করে দেরির কারণ বলি। দীপককে যাঁরা চেনেন বা চিনতেন (দীপক অনেকদিন চলে গেছে), তাঁদের কাছে এই দেরি খুব অপ্রত্যাশিত নয়। তবু, কতক্ষণ বসে থাকবেন রাজেশ্বরী? শেষ পর্যন্ত আমি একাই রাজেশ্বরীর বাড়ি যাই। মনে পড়ছে না, আমি কি খাবার কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম, না রাজেশ্বরীই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, নাকি আমরা বেরিয়ে কোথাও খেয়েছিলাম? স্মৃতির স্লেট থেকে সে গল্প মুছে গেছে। রাসেল স্ট্রীটের পর এই দেখা। একটু কেমন এবড়োখেবড়ো হয়ে গেলেও দেখা তো। ভালো লাগল। তাঁর স্নেহের স্পর্শ পেলাম।

১৯৬৫-র ডিসেম্বর-শেষে কলকাতা থেকে আমায় লেখা বুদ্ধদেব বসুর এক চিঠিতে আছেঃ "সেদিন শুনলাম রাজেশ্বরী কেম্ব্রিজ (ইং) বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে একটা খুব ভালো কাজ পেয়েছেন - জানুয়ারির মাঝামাঝি শিকাগো ছাড়বেন। এটা বিশেষ সুখবর, কেননা তিনি যে আমেরিকার চাইতে য়োরোপে অনেক বেশি আরাম পাবেন তাতে সন্দেহ নেই - ইংল্যান্ডের সুদীর্ঘ ও সুতীব্র শীত সত্ত্বেও।" সত্যিই কেম্ব্রিজে এসে রাজেশ্বরী অনেকটা আত্মস্থ হয়েছিলেন। যশোধরা বাগচী তখন কেম্ব্রিজে, তাঁর গবেষণা শেষ করছেন। তাঁর সাক্ষ্য মেনেই বলছি। আবার গান গাইছেন রাজেশ্বরী। আর তার এক বিশেষ মূল্য ছিল যশোধরার কাছে। কারণ গান তিনিও গাইতেন। কনকেন্দ্রনাথ দত্ত আয়োজিত এক রাজেশ্বরী-স্মরণে যশোধরার মুখে রাজেশ্বরীর গল্প শুনি। আবার, জ্যোতির (জ্যোতির্ময় দত্ত) স্মৃতিতে পড়েছি মীনাক্ষী ও সে যখন ৬৬-তে অক্সফোর্ডে অসীম ও উমা দাশগুপ্তের অতিথি, তখন রাজেশ্বরী কেম্ব্রিজ থেকে এসে তাদের সঙ্গে দু'দিন কাটিয়ে যান। তারপর কেম্ব্রিজের কাজ চুকিয়ে যখন লন্ডনের সোআস (SOAS)-এ (স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) এলেন রাজেশ্বরী, আর্নল্ড বাকে-এর জায়গায় প্রাচ্য সংগীত শিক্ষকের কাজে, তখন বাংলার অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো অনেক গান টেপ করে রাখেন। তার একটা কপি কলকাতায় নবনীতার (দেবসেন) কাছে পৌঁছয়। আমার সৌভাগ্য, তা আমিও শুনি।

আমি রাজেশ্বরী দত্তকে শেষ দেখি ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে। শুনলাম সদ্য দেশে এসেছেন সোআস থেকে ‘ফিল্ড ওয়ার্ক’-এর দায়িত্ব নিয়ে। আমার তরুণ বন্ধু বাপ্পা তথা প্রবীরচন্দ্র বসু মল্লিকের পুত্র দীপঙ্কর বসু মল্লিকের বিবাহসভায় তিনি এসেছিলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে দাঁড়াবার আগেই তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন।

পরে শুনলাম তিনি বারাণসী গেছেন। সেখানে শাস্ত্রীয় সংগীতের নানাবিধ নমুনা ও তদ্বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করছেন। বারাণসীতেই বোধকরি কোনো অপঘাতে পড়েন। কলকাতা ফিরলেন অসুস্থ হয়ে। চিকিৎসাও হচ্ছিল। লন্ডন থেকে এসে উঠেছিলেন লী রোডে সুধীন্দ্রনাথের সেজোভাই রণেন্দ্রনাথের কাছে। হঠাৎ শুনলাম রাজেশ্বরী আর নেই। মৃত্যুসংবাদ পাইওনি। জ্যোতি পেয়েছিল ‘স্টেটসম্যান’ থেকে বন্ধু হামদি বে-র টেলিফোনে। কিন্তু রণেন্দ্রনাথের বাড়ি গিয়ে শোনে মরদেহ শ্মশান চলে গেছে। শ্মশানে গিয়ে শোনে দাহ হয়ে গেছে। কখন যে বসন্ত গেল, এবার হল না গান। ১০ এপ্রিল, ১৯৭৬। জন্মের তারিখ ছিল ১৭ এপ্রিল, ১৯১৮।