আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩১
প্রবন্ধ
বাঙলা ভাষার ভবিষ্যৎ
গৌতম সরকার
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর একটি ক্লাসে জনৈক এক অধ্যাপিকা একটা কথা বলেছিলেন, তার গূঢ়ার্থ সেই সময় সেভাবে না বুঝলেও পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে সেই কথার অর্থ মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছি। তিনি বলেছিলেন, "আজকাল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠানো বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা সন্তানেরা কতটা ইংরেজি শিখছে তার চেয়ে তারা বাংলা কতটা ভুলছে সেই ব্যাপারে বেশি সচেতন"। এখানে উল্লেখ্য, সেই অধ্যাপিকা বনেদি ঘরানার ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া এক স্বনামধন্যা অধ্যাপিকা। তাই বলা যেতে পারে, ইংরেজির প্রতি বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ থেকে কথাটা তিনি বলেননি। অতএব সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির অবজ্ঞা বেশ কয়েক দশক ধরেই শুরু হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করা, ইংরেজি ভাষায় কথা বলা বা ওই ভাষায় সাহিত্যচর্চা মোটেই খারাপ কিছু নয়, কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা বা ভুলে যাওয়াটা অপরাধ।
এমতাবস্থায় আগামী ২৫-৩০ বছর পর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা ভাবলে শঙ্কা জাগে বই কি! এই শঙ্কার কারণ দ্বিমুখী, এক, বাংলা বই পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া এবং দুই, আধুনিক প্রজন্মের মুখে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে এক খিচুড়ি ভাষার জন্মলাভ। আমাদের প্রজন্মে বইপড়াটা ছিল নেশার মতো। বেশিরভাগ বাড়িতেই থাকতো বাংলা বইয়ের সম্ভার, আর পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি। ক্লাসের বন্ধু, পাড়ার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদেরদের মধ্যে বই দেওয়া-নেওয়া সম্পর্কের বাঁধনকে আরও পোক্ত করত। আজকের দুনিয়ায় সবটাই দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন। ওই একরত্তি যন্ত্রের মধ্যে বিনোদনের সাত-সতেরো রসদ মজুত। বিজ্ঞানের এ এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার!
একজন লেখকের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হল মৃত্যুর পর পাঠকদের মধ্যে বেঁচে থাকা। বাংলা ভাষায় আস্ত একজন রবীন্দ্রনাথ থাকা সত্ত্বেও এই ভাষার দৈন্যদশা একই সাথে লজ্জার, কষ্টের এবং চিন্তার। প্রায় একশো বছর আগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বাংলা সাহিত্যের দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, "লেখকদিগের মনে যতই অভিমান থাক, একথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে, আমাদের দেশে পাঠক সংখ্যা অতি যৎসামান্য, এবং তাহার মধ্যে এমন পাঠক 'কোটিকে গুটিক' মেলে কিনা সন্দেহ যাহারা কোনো প্রবন্ধ পড়িয়া, কোনো সুযুক্তি শুনিয়া, আপন জীবনযাত্রায় লেশমাত্র পরিবর্তন সাধন করেন, নির্জীব নিঃস্বত্ব লোকের পক্ষে সুবিধাই একমাত্র কর্ণধার, সে কর্ণের প্রতি আর কাহারো কোনো অধিকার নেই।" এই প্রবন্ধে 'পাঠক' শব্দটি সার্বিক অর্থে ব্যবহৃত হলেও, রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের পাঠকগণকেই উল্লেখ করেছেন সেটা বলাই বাহুল্য। প্রশ্ন জাগে এটাই কি কারণ, যার ফলশ্রুতিতে গত একশো বছরে আমরা সেভাবে সাড়াজাগানো কোনও বাঙালি লেখক পেলাম না! সরকারি তরফেও কি সেভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? তাহলে আজও বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মান্যতা পেলনা কেন? অথচ প্রতিবেশী ভাষা 'অসমিয়া' ও 'উড়িয়া' সেই মর্যাদা পেয়ে গেল। কয়েকদিন আগের খবর, বিশ্ব মানচিত্রে মাতৃভাষার নিরিখে হিন্দিকে টপকে গেল বাংলাভাষা। বাঙালী হিসেবে অতি বড় গর্বের বিষয়। মাত্র একবছর আগে ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০ কোটি ৫০ লক্ষ, যেখানে বাংলায় কথাবলা লোকের সংখ্যা ছিল ২৭ কোটি ২৮ লক্ষ। হিন্দির স্থান ছিল তৃতীয়, বাংলার সপ্তম। ২০২৪ সালে 'ইউনেস্কো'র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত 'গ্লোবাল পপুলেশন রাঙ্ক' জানাচ্ছে বাংলা ভাষার সাফল্যের খবর। কিন্তু কথা হল, এই খবরে বাঙালী হিসেবে সত্যিই কি উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু আছে! কেন এই সংশয়, বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা যাক। যত দিন যাচ্ছে কথ্য বাংলার মান নামতে নামতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিদিনের চর্চায় এর কাঠামোগত, প্রক্ষেপণ, উচ্চারণ এবং নান্দনিক বিচ্যুতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত বাঙালিও বাংলাকে নিম্নবর্গীয় ভাষা বলে ভাবতে শুরু করেছে। একটা দলে যদি একজন অবাঙালি এবং পাঁচজন বাঙালি থাকে তাহলে তারা পরস্পরের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা চালাচালি করে। বাংলা নৈব নৈব চ। একজন শিক্ষিত বাঙালি ভুল করে দুটো বাক্য বাংলায় বলে ফেললে হঠাৎ করে চেতনায় ফিরে ইংরেজিভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে। এরা মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়, এই লজ্জা পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষার নেই। অথচ বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্য, বাংলা ভাষায় গাওয়া গান, বাংলা ভাষায় সৃষ্ট চলচ্চিত্র শুধু ভারতীয় কেন, পৃথিবীর যেকোনও ভাষার সৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
১৯৫১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে 'দেশ' পত্রিকায় 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ' শিরোনামে জীবনানন্দ দাশের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে তিনি একইভাবে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তার আশঙ্কার মূল কারণ ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা উপভাষা হিসেবে থাকলেও ভবিষ্যতে পুরো দেশটিই উর্দুভাষী হয়ে উঠতে পারে। ফলে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা যেমন একদিকে কমবে, তার সাথে বাংলা সাহিত্য একটা গোটা দেশে বাজার হারাবে। তাঁর আশঙ্কাকে আরও বিস্তৃত করে জীবনানন্দ বলেছিলেন, মন্বন্তরে আমরা যত বাঙালি হারিয়েছি তার থেকে অনেক বেশি বাঙালি দেশভাগের কারণে হারিয়ে গেছে।
বাংলা ভাষার এই দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক কারণই উঠে আসে। দীর্ঘ দু'শো বছর ব্রিটিশদের কলোনি হয়ে থাকা আর ভারতের রাষ্ট্রভাষা(?) হিন্দি হওয়া, তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু নিজের মাতৃভাষার দিক থেকে মুখ ফেরানোর জন্য এই কারণগুলিই কি সব? নিজ ভাষার অধিকার রক্ষার্থে একটা সময় অসমের বরাক উপত্যকা থেকে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত বিক্ষোভে ও বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল। রাষ্ট্রের পেশীশক্তি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছে, তাদের রক্তে মাতৃভূমির মাটি সিক্ত হয়েছে, সেই ভূমি আঁকড়ে ধরে শবদেহগুলি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করেছে। আজ সেইসব ইতিহাস বইয়ের এক কোণে পড়ে থাকে। আধুনিক প্রজন্ম সেসব খুলেও দেখে না।
যে ভাষায় শিশু প্রথমবার মা'কে 'মা' বলে ডাকে, যে ভাষায় আমরা গান গাই, কবিতা আবৃত্তি করি, কাঁদি-হাসি, প্রেম নিবেদন করি, প্রতিবাদ করি, ধিক্কার জানাই, ব্যাথায় ককিয়ে উঠি, আনন্দে উচ্ছসিত হই; যে ভাষায় অসীম পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠি, "ধ্যান গম্ভীর ওই যে ভূধর...", অসীম সমুদ্রের সামনে গেয়ে উঠি, "সমুদ্র ডাকে একা একা, ঢেউ দিয়ে যায় হাতছানি, ফেনায় ফেনায় ভেসে আসে জলপরীদের কানাকানি।" যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি, যে ভাষায় শোকে সান্ত্বনা দিই, নিজে সান্ত্বনা পাই, সেটাই তো মাতৃভাষা, সেই ভাষা তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে... আমরা চুপ করে বসে বসে সেই ধ্বংসের সাক্ষী থাকবো!