আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

চরের মানুষ কোন রাজ্যের বাসিন্দা?

গৌতম হোড়


মালদহের চরে গেলে আপনি একটা কথা অনেকের মুখে শুনতে পাবেন - তাদের জমি সিকস্তি হয়ে গেছে। আমরা যারা ভাঙন এলাকার বাইরের মানুষ, তাদের কাছে সিকস্তি কথাটা অচেনা লাগবে। আমি যখন প্রথমবার শুনি আমারও লেগেছিল। আসলে এটা ফার্সি শব্দ যার অর্থ জমি নদীতে তলিয়ে যাওয়া। আর বাংলাদেশে তার সঙ্গে পয়ন্তি বলে একটা চালু কথা আছে। তার মানে নদীতে ভেঙে পড়া জমির আবার চরের জমি হিসেবে উঠে আসা। চরের জীবনে এই সিকস্তি ও পয়ন্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। কারণ, চরে যারা আছেন, তারা একসময় ছিলেন মালদহের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা। কিন্তু গঙ্গার ভাঙনে তাদের জমি চলে গেছে জলের তলায়। কেউ বসতবাটি হারিয়েছেন, কেউ চাষের জমি, কেউ দোকান। পথঘাট, স্কুল, অফিস, মাঠ চলে গেছে গঙ্গার তলায়। একসময় যাদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষ-আবাদ সব ছিল, তারা ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারালেন। তাদের জমি সিকস্তি হয়ে গেল। নদীর তলায় চলে গেল জমি।

সমুদ্রের মতো নদীও তো ফিরিয়ে দেয়। তাই শুধু সিকস্তি নয়, পয়ন্তিও হয়, অর্থাৎ নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। এখন যে মানুষগুলি জমি, দোকান, ক্ষেত সব হারালেন, তারা কি ওই জমির মালিকানা পান? এই প্রশ্ন শুনলে মনে হবে, স্বাভাবিকভাবেই ওই মানুষগুলিই চরের জমি পাবেন। সিকস্তি জমি পয়ন্তি হিসেবে যখন ফিরে এল, তখন তাদেরই তো সেই জমির অধিকার থাকা উচিত।

পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের ধারা অনেকবার বদলেছে। আগে ১১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল, সিকস্তি জমি অর্থাৎ গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে যাওয়া জমির অধিকার ২০ বছর পর্যন্ত মালিকের কাছে থাকবে। এই সময়ের মধ্যে চর জেগে উঠলে সেই জমির মালিকানা তিনিই পাবেন। কিন্তু বাম জমানায় ২০০৬ সালে নিয়ম বদলানো হল। ১২ নম্বর ধারায় জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাজ্য সরকারের কাছে চলে গেল।

এই চরের মানুষের ৮০ শতাংশই হলেন দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাদের জমি গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার পর তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। খুব বেশি হলে ত্রিপল, বালতি বা রান্নার জিনিস দিয়েই দায় সেরেছে সরকার। বারবার তাদের ঘর বদলাতে হয়েছে। ১১ বার ভাঙনের কবলে পড়া মানুষের সঙ্গেও কথা বলেছি। শেষ পর্যন্ত তারা চরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই চরও ভাঙছে বা ভবিষ্যতেও হয়ত ভাঙবে।

হামিদপুর চরে তাঁর দোকানে কথা বলছিলেন রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দীর্ঘদিন ধরে চরের মানুষদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। তাঁদের লড়াইয়ের ফলে হামিদপুর চরে থাকা মানুষরা ভোটের অধিকার পেয়েছেন। তাঁদের পঞ্চায়েত আছে। স্কুল হয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাড়ি হয়েছে। রাজেন্দ্রনাথ নিজেও পঞ্চায়েত সদস্য। রাজেন্দ্রনাথের বক্তব্য, তাঁদের নামে জমি ছিল। সেই সব জমি সিকস্তি ঘোষণা করল সরকার। নদীতে চলে গেছে বলে তারা আর জমির অধিকার পেলেন না। অথচ, তারাই এই চরের জমিতে বসবাস শুরু করেছেন। তা চাষযোগ্য করে তুলেছেন। রাজেন্দ্র বলছিলেন, ‘‘আমরা যে এখান থেকে ওই পারে যাই সেখানেও আমাদের জমিজমা ছিল। অথচ নদীতে চলে যাওয়ার ফলে তা সিকস্তি ঘোষণা করে দেওয়া থাকতাম, সেই জমি ভাঙনে জলের তলায় চলে গেল। পরে চর হয়ে জমি উঠে এল। আমরা সব কিছু করলাম, অথচ জমিটা আমাদের নয়।”

এই জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিতে হয় চরের বাসিন্দাদের। যে চরেই যান না কেন, এ নিয়ে বঞ্চনার অভিযোগ শুনবেন। তবে কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। প্রশাসনিক উদাসীনতার আরেক চমকপ্রদ কাহিনি শুনবেন চরের মানুষদের কাছে অথবা চর নিয়ে যারা দীর্ঘদিন কাজ করছেন তাদের কাছে। আমায় এই বিষয়টি প্রথমে বলেছিলেন কেদারনাথ মণ্ডল এবং হাবিবুর রহমান। দুজনেই চরের মানুষের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। মালদহের কাছে গঙ্গায় সাতটি চর আছে যেখানে মানুষ বসবাস করেন। তার মধ্যে তিনটি চরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসন সক্রিয়। বাকি চারটি চরে তারা কিছু করেনি। সেই সব চরের মানুষদের ন্যূনতম পরিষেবা দেয় ঝাড়খণ্ড সরকার। সেখানে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পান মানুষরা, কলকাতা বাজার বলে পরিচিত চরে ঝাড়খণ্ড সরকার সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে। এই সব চরের জমি সরকারিভাবে পশ্চিমবঙ্গের কাছে আছে। চরের মানুষকে জমি সংক্রান্ত কাজ মালদহে এসে করতে হয়। কিন্তু বাসিন্দারা ঝাড়খণ্ডের ভোটদাতা। তাদের স্কুল চালায় ঝাড়খণ্ড। কিছুদিন আগে গিয়েও দেখে এসেছি, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের ছবি দেওয়া ব্যাগে করে তাদের কাছে রেশন পৌঁছে দিয়েছে ঝাড়খণ্ডের সরকার।

পঞ্চানন্দপুর ঘাট থেকে নৌকায় যাচ্ছি হামিদপুর চরে। গঙ্গার চ্যানেলের দিকে হাত দেখিয়ে হাবিবুর রহমান বললেন, ‘‘আগে গঙ্গা এখানে ছিল না। কংগ্রেস আমলে উদয় নালার পর যে বহুডুব্বি আছে, সেটাই ছিল গঙ্গার প্রধান ধারা। কিন্তু যত সময় গেল নদী এগিয়ে আসতে লাগল। বামফ্রন্ট জমানায় নদীর ভাঙন আরও বেড়ে গেল। চরের দিকে যারা বাস করতে লাগল, তারা ঝাড়খণ্ডে চলে গেল। সাতটা চরে দেড় লাখ ভোটদাতা আছে। তার মধ্যে এক লাখেরও বেশি ঝাড়খণ্ডের, পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতা পঞ্চাশ হাজারের কম। ৩৩টা মৌজা, সবই পশ্চিমবঙ্গেরই মৌজা, তা নিজেদের কাছে রাখার কোনো প্রয়াসও নেই। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এই অবস্থা হয়েছে।”

হামিদপুর চরের স্কুলবাড়ি পশ্চিমবঙ্গের অন্য যে কোনো জায়গার স্কুলের মতো। পাকা দোতলা বাড়ি। বাইরে সাদা, নীল রং। সেই স্কুলের শিক্ষক রবিউল ইসলাম। রবিউল সাতবার ভাঙনের ফলে ঘরছাড়া হয়েছেন। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবিউল জানালেন, ‘‘মোট সাতটি চরে মানুষ বসবাস করে। তার মধ্যে তিনটি মালদহের পরিষেবা পায়। চারটি ঝাড়খণ্ডের। ১৯৬৫ সালের পর থেকে যখন ভাঙন শুরু হয়, তখন সব জায়গা ছিল মালদহের অধীনে। এখানে নীলকুঠি ছিল, রেললাইন পাতা ছিল - সবকিছু ছিল। সব ভাঙনের কবলে পড়ল। পূবদিকে নদী সবকিছু ভেঙে দিল। পশ্চিমদিকে চর হতে শুরু করল। যাদের পয়সা ছিল, তারা মালদহের ভিতরে জমি কিনে চলে গেলেন। গরিবরা গিয়ে আশ্রয় নিলেন চরে। মালদহ প্রশাসনের অনীহার জন্য তারা কোনো পরিষেবা পেল না। তারা দীর্ঘদিন থাকার পর ঝাড়খণ্ডের মানুষ ও প্রশাসন সেখানে যায় - তারা ন্যূনতম পরিষেবা দিতে শুরু করে। তারা মালদহের মানুষ, থাকছেন ঝাড়খণ্ডে।‘”

তবে চরের মানুষের জীবনে সমস্যা থাকবে না তা তো হয় না। ২০২৩ সালের ১ জুন 'ইটিভি ভারত'-এর রিপোর্ট বলছে, ঝাড়খণ্ড সরকার জানিয়েছে, চরের মানুষকে তাদের পরিষেবা পেতে হলে ১৯৩২ সাল থেকে তারা ঝাড়খণ্ডে থাকছেন, সেই প্রমাণপত্র দিতে হবে। না হলে পরিষেবা পাওয়া যাবে না। চরের বাসিন্দাদের কাছে এই পরিচয়পত্র নেই। তারা তো আদতে মালদহের বাসিন্দা। তাই তারা এখন চাইছেন, ওই চরগুলি মালদহের প্রশাসনের অধীনে আসুক। 'গঙ্গা ভাঙন নাগরিক অ্যাকশন প্রতিরোধ কমিটি'র তারিকুল ইসলাম বলেছেন, ২০০১ সালের জনগণনায় ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের আধিকারিকরা চরের গণনায় অংশ নেন। কিন্তু ২০১১-তে শুধু ঝাড়খণ্ডের আধিকারিকরা চরের জনগণনায় অংশ নেন। এই চরে ভাঙন-উদ্বাস্তুরা থাকেন। তাদের কাছে নথি কোথায় থাকবে? ১৯৩২ সালে তো চর ছিল না। তারা পশ্চিমবঙ্গে যাতে থাকতে পারেন, তার জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

'ইটিভি ভারত-এর রিপোর্ট বলছে, মালদহের জেলাশাসক নীতিন সিংঘানিয়া জানিয়েছেন, চরের নতুন করে সার্ভে হচ্ছে। সার্ভে শেষ হলে তারা ঝাড়খণ্ডের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। চরগুলিতে 'দুয়ারে সরকার' ক্যাম্প করা হয়েছে। দুই রাজ্যের সরকার মিলে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আশা করছেন, খুব তাড়াতাড়ি চরগুলি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এসে যাবে।

এরপর বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। গত ডিসেম্বরে আবার ঝাড়খণ্ডের দু’টি চরে গেছিলাম। সেখানে মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছেন সমীক্ষার জন্য, তারা শেষ পর্যন্ত কোন রাজ্যে থাকবেন সেই সিদ্ধান্ত জানার জন্য। কিন্তু সরকারি কাজ কি আর এত তাড়াতাড়ি হয় না হয়েছে! তারপর আবার বিষয়টি চর নিয়ে, চরের মানুষদের নিয়ে, যারা না ঘরকা, না ঘাটকা। তারা গঙ্গা-ভরসায় দিন কাটান। কবে যে গঙ্গা আবার তাদের ঘরছাড়া করবে কে জানে! তারপর যখন তাদের জমি আবার গঙ্গা ফিরিয়ে দেয়, তখন দুই সরকার, তাদের প্রশাসন, তাদের গয়ংগচ্ছ মনোভাব, লালফিতের শক্ত বাঁধন, আমলাদের উদাসীনতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করেই তো চরের মানুষদের বেঁচে থাকতে হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি ভাঙনের পর ঝাড়খণ্ডের মানুষ হয়ে যান, পশ্চিমবঙ্গের এলাকা যদি ঝাড়খণ্ডে ঢুকে যায়, তাতেই বা অসুবিধা কীসের! ও তো চরের জমি, চরের মানুষের কাহিনি। তারা মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা একসময় ছিলেন - এখন তো নেই। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কলকাতার বাইরে তাকাতেই পারে না, খুব বেশি হলে শিলিগুড়ি বা জেলা শহর। চরের সমস্যা কেনই বা তাদের আলোড়িত করবে, গঙ্গার ভাঙনের ভিডিও পেলে তারা খুব বেশি হলে ফরোয়ার্ড করে লিখে দেবেন, কী ভয়ঙ্কর। তার থেকে বেশি কি আর তাদের কাছ থেকে আশা করা যায়? তারা এবং প্রশাসন মেলা, খেলা, আমরা-ওরা, সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাক।

চরের মানুষ গঙ্গার ভরসাতেই থাকবেন, গঙ্গাই তাদের সবকিছু নিয়ে নেবে, আবার ফিরিয়েও দেবে। ছিন্নমূল করবে, আবার সেই জমি গজিয়ে উঠবে গঙ্গার বুকে। এই চক্র চলতেই থাকবে।