আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

নারী অধিকার ও জনবাদী উন্নয়ন

মৃন্ময় সেনগুপ্ত


কেউ করছেন একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা নেতাদের নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। কেউ আবার বলছেন, 'লক্ষীর ভাণ্ডার' নয়, সম্মান আর জমি ফিরে পেতে চান। সন্দেশখালিতে একের পর এক মহিলার অভিযোগ বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম ও নানা সমাজমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। পড়ছি মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমে। ভয়ঙ্কর নারী নির্যাতনের পাশাপাশি উঠে আসছে ভাতে মারার কথা। চাষের জমি জোর করে ভেড়ি করা হয়েছে। বর্গাদার, পাট্টাদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। অভিযুক্তরা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বললে কম বলা হয়, রীতিমতো মাতব্বর। এক বছরও হয়নি পঞ্চায়েত নির্বাচন গেছে। সেখানে সিংহভাগ আসনেই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। কিন্তু, সেই জেতার সঙ্গে জনসমর্থনের যে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, তা আজ প্রমাণিত। মহিলারা অভিযোগ করেই ক্ষান্ত থাকছেন না। রীতিমতো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। পুড়ছে অত্যাচারের প্রতীক ভেড়ির আলাঘর। পুলিশের সঙ্গে দুষ্কৃতিদের সখ্যের অভিযোগও মহিলারা সোচ্চারে তুলছেন। আতঙ্ক কাটিয়ে অধিকার রক্ষা ও আদায়ের লড়াই লড়ছেন। গণআন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান বাংলা, এক দশক যে লড়াই প্রায় ভুলতে বসেছে।

'লক্ষীর ভাণ্ডার', 'স্বাস্থ্যসাথী', একশো দিনের কাজ, স্বনির্ভর গোষ্ঠী - এইসবের মাধ্যমে নাকি মহিলা ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রেখেছে রাজ্যের শাসকদল। যদিও একশো দিনের কাজ যেমন কেন্দ্রীয় আইন অনুসারে চলে, তেমন স্বনির্ভর গোষ্ঠীও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অংশ। দুটিই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল বাম আমলে। প্রচারে সেসব ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী পক্ষও হতাশ হয়ে প্রায়শই বলে থাকেন, নানা প্রকল্পের অনুদানে নাকি ভোটাররা সব অন্যায় ভুলে শাসককে ভোট দিচ্ছেন। অধিকার কেড়ে নানা প্রকল্পের নামে কিছু সুযোগ সুবিধে দেওয়ার এই রাজনীতিকে বলা হচ্ছে, জনবাদী রাজনীতি। দারিদ্র ও ক্ষুধা দূরীকরণ, সকলের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলাদের ক্ষমতায়ন - এইসব শব্দবন্ধ রাজনীতিতে এখন খুবই প্রচলিত। কেবল এই রাজ্য বা দেশে নয়। সারা বিশ্বে।

‘জনবাদী উন্নয়নে’ জনগণের মতামতের দাম নেই। প্রান্তিক বা নিম্নবর্গের মানুষের উন্নয়নের শর্ত শাসকের প্রতি আনুগত্য। তাই তাদের প্রতিনিয়ত আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে বাঁচতে হয়। আর্থিক দূরবস্থায় কোণঠাসা মানুষের সরকারি নানা প্রকল্পে যৎসামান্য কিছু সাহায্যই অগতির গতি। যা পাওয়া যাচ্ছে তা হারানোর ভয় দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে পাওয়ার আশা দিয়ে এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের প্রতিবাদী সত্তাকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। মানুষের ন্যায্য পাওনা ও অধিকারকে রাষ্ট্র হাজির করছে দান রূপে। অধিকারের দাবি থাকে, দানের থাকে না। সব মেনে নিতে হয়। সরকার, শাসকদল, নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট সংস্থা এবং এদের অর্থে চলা এনজিও’র কাছে মানুষ শুধুই বেনিফিসিয়ারি। তাঁদের ‘উপকার’ করে কৃতার্থ করা হচ্ছে। বঞ্চনা নিয়ে প্রতিবাদ করা বা অধিকারের কথা বলা মহাপরাধ। অধিকার কেড়ে নিয়ে মানুষকে অনুদান নির্ভর, প্রতিষ্ঠানের একান্ত অনুগত প্রজায় পরিণত করার চেষ্টা চলছে।

নয়া উদারনীতিতে রাষ্ট্র সামাজিক, আর্থিক দায় ঝেড়ে যত কর্পোরেট সংস্থাগুলির তল্পিবাহকে পরিণত হচ্ছে, তত ‘জনবাদী’ রাজনীতির শিকড় শক্ত হচ্ছে। সসম্মানে বাঁচার, সাম্যের অধিকার ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধান সেই অধিকার দিয়েছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খাদ্যের, স্বাস্থ্যের অধিকার। আমাদের দেশে খাদ্য সুরক্ষা আইন রয়েছে। তবুও বিস্তৃত হচ্ছে ক্ষুধার ভারত। প্রত্যেক মানুষকে পেটভরা পুষ্টিকর খাবার দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। অথচ, ভর্তুকি কমিয়ে, খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে, রেশন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সরকার সেই অধিকার বিপন্ন করছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আট কোটি মানুষকে খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের কথা। মানুষ কত পরিমাণ খাদ্যশস্য পাচ্ছেন, কী কী খাদ্যশস্য দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে কিন্তু দুই সরকারই বিশেষ কিছু বলে না। ২০২৪-২৫ সালের অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য ও গণবন্টন দপ্তরের বরাদ্দ চলতি বছরের (২০২৩-২৪) সংশোধিত বরাদ্দের থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। রেশনের জন্য খাদ্যশস্য কেনার পরিমাণও বছরের পর বছর সরকার কমাচ্ছে। চলতি বছরে সরকার রেশনের জন্য গত বছরের থেকে ২৭ মিলিয়ন টন কম খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেছে। আর রাজ্যের খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় তো চাল ছাড়া কিছু মেলে না। নানা ধরনের ডিজিটাল রেশন কার্ডের মাধ্যমে আনা হয়েছে বিভাজন। কে কোন রেশন কার্ড পাবেন তার জন্য ভরসা সেই সরকারি কত্তা আর শাসকদলের মাতব্বরেরা। খাদ্যের অধিকার এইভাবেই আজ অনুদানে রূপান্তরিত হয়েছে।

স্বাস্থ্যের অধিকার না দিয়ে, অবাধে বেসরকারীকরণের সুযোগ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার 'আয়ুষ্মান ভারত' বনাম 'স্বাস্থ্যসাথী' প্রকল্প নিয়ে নির্লজ্জের মতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। 'মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন'-এ প্রাপ্ত একশো দিনের কাজের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র অনুদান বন্ধ করায় দীর্ঘদিন এই রাজ্যে একশো দিনের কাজ বন্ধ। এখন রাজ্য সরকার নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে। আইনি অধিকার পরিণত হল প্রকল্পে। কেন্দ্র ও রাজ্যের তরজার আড়ালে চলে গেল অধিকার কেড়ে নেওয়ার আসল ঘটনা। কেন্দ্রের অন্তর্বর্তী বাজেটে গতবারের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুর্নীতি করেছে এই অভিযোগ এনে কেন্দ্র কর্ম নিশ্চয়তা আইনের অধিকার থেকে রাজ্যবাসীদের বঞ্চিত করছে। পাশাপাশি রাজ্য সরকারও যথাযথ হিসেব না দিয়ে বঞ্চনার অভিযোগে বাজার গরম করে রাজ্যবাসীকেই আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।

এখন আবার রাজ্যে বকেয়া মজুরি মেটানোর কাজ শুরু হয়েছে। তাও সরকার নয়, শিবির খুলেছে শাসকদল। জনবাদী রাজনীতির মহিমায় বকেয়া মজুরি পেতে হত্যে দিতে হবে শাসকের কাছে। অথচ, আইন অনুসারে একশো দিনের কাজে মজুরি বকেয়া রাখা যায় না। কাজ না দিলে ভাতা দিতে হয়। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সেই আইন না মেনে অনুদানের রাজনীতিতে মত্ত। ‘জনবাদী’ নানা প্রকল্পের একটা বড় লক্ষ্য হলেন মহিলারা। প্রধানমন্ত্রীর উজ্জলা গ্যাস যোজনা থেকে এই রাজ্যের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি তারই উদাহরণ। এমন উদাহরণ ছড়িয়ে আছে অন্যান্য রাজ্য সরকারেরও নানা প্রকল্পে।

দেশের আইনসভায় এক তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি সবেতেই নাকি মহিলাদের ক্ষমতায়ন হবে। আইনসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে কি আদৌ সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলানো গেছে? মহিলা পঞ্চায়েত সদস্য বা প্রধানের হয়ে পরিবারের বা দলের কোনো পুরুষের মাতব্বরি তো আমাদের কাছে অতি পরিচিত দৃশ্য। গ্রাম সংসদ, গ্রাম সভাতেই বা মহিলাদের মতামত জানানোর সুযোগ বাস্তবে কতটুকু থাকে? সহভাগী উন্নয়নে মহিলারা বাস্তবে অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কমই পান। তারপর তিনি আর্থিকভাবে দুর্বল বা সামাজিক দিক থেকে ‘পিছিয়ে পড়া’ শ্রেণির হলে তো কথাই নেই।

তপশিলী জাতি, উপজাতির মহিলাদের ক্ষেত্রে লক্ষীর ভাণ্ডারে দেওয়া অর্থের পরিমাণ বেশি। কিন্তু জাতিগত শংসাপত্র পেতে হয়রানিও কম হয় না। দুয়ারে সরকার, পাড়ায় সরকারের পরেও সরকারি কত্তা আর শাসকদলের মাতব্বরদের ওপর নির্ভর করতে হয়। একবার অনলাইনে জমা, আবার নথি নিয়ে সরকারি দপ্তরে ছোটা। তার আগে বংশ তালিকা, পঞ্চায়েত কত্তার সই আরও কত কি। বিবাহিত মহিলাদের বেলায় হয়রানি আরও বেশি। মহিলাদের জাতিগত শংসাপত্র পেতে নির্ভর করতে হয় তাঁদের বাবার বংশের পরিচয়ের ওপর। তার নথি জোটানোর ঝামেলাও কম নয়। সরকারি নিয়মের পরতে পরতে এইভাবে জাঁকিয়ে বসে আছে পুরুষতন্ত্র। তফশিলী জাতি, উপজাতির মহিলাদের অধিকাংশকেই খেটে খেতে হয়। ভূমিহীন কৃষক বা দিনমজুর এইসব পরিবারেরই বেশি। তাই শংসাপত্র পেতে এত দৌড়ঝাপের সময় অনেকেরই হয় না।

কেবল অনুদান নির্ভর সরকারি প্রকল্পেই নয়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে শুরু করে বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং অব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণের কারবার সবেতেই মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন কোনো সরকারি প্রকল্প নয়। মহিলারা নিজেরাই তা করতে পারেন। কিন্তু, গোষ্ঠী চালাতে পঞ্চায়েত, সরকার, ব্যাঙ্ক, সমবায় সমিতির সাহায্য দরকার। সরকারের বেঁধে দেওয়া ছকেই গোষ্ঠীকে চলতে হয়। নিজেদের মত জানানোর সুযোগ বা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বাস্তবে থাকে না। খাতায় কলমে সরকার বা শাসকদলের মাতব্বরি নেই। বাস্তবে আছে প্রায় ষোলো আনা।

নিয়ম অনুসারে, গোষ্ঠীগুলির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ভূমিকা অনেক। পঞ্চায়েতের সামাজিক নিরীক্ষা, পাড়া বৈঠক, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভা থেকে পঞ্চায়েতের উপসমিতিতে গোষ্ঠীগুলির মতামত দেওয়া ও উদ্যোগ গ্রহণের অধিকার রয়েছে। একশো দিনের কাজেও তাদের উদ্যোগ নেওয়ার অধিকার রয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সত্যিই যদি এই অধিকার পেত, তাহলে গণ উদ্যোগের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির মেলবন্ধন ঘটত। খাতায় কলমে সবই হয়। বাস্তবে গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও অধিকার নির্ভর করে শাসক পক্ষের মর্জির ওপর। তাই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদেরও অনেক সময়ে শাসকদলের রাজনৈতিক সভায় ভিড় জমাতে হয়। বিরোধী পক্ষে থাকলে পদে পদে হয়রানির আশঙ্কা।

মহিলাদের ক্ষমতায়নের নামে ঋণের কারবার আজ লাভজনক ব্যবসা। সেই বাজার দখল করছে বিভিন্ন বেসরকারি মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানি ও ব্যাঙ্ক। রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ঋণ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের দেশেও একই চিত্র। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এইসব কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেক শিথিল করেছে। চলছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিধি না মেনে কোম্পানিগুলির ঋণগ্রহীতাকে ঠকানো, অর্থ পেতে নির্যাতন। ঋণ পেয়ে আর্থিক ক্ষমতায়নের বদলে দেনার দায়ে ডুবছেন মহিলারা। রুজি, রোজগারের নিশ্চয়তা না দিয়ে সরকার ব্যস্ত ঋণ দিতে।

কেন্দ্রের অন্তর্বর্তী বাজেটেও স্বনির্ভর ও স্বনিযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাজেট ভাষণে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ‘জ্ঞান পর ধ্যান’ স্লোগানের উল্লেখ করেছেন। ইংরেজি GYAN, আসলে চারটি হিন্দি শব্দের আদ্যক্ষরে তৈরি। যেখানে N মানে নারী। বাজেট ভাষণে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, দেশের এক কোটি মহিলা নাকি স্বনির্ভর প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষপতি হয়েছেন। এই ‘লাখপতি দিদি’ কারা, তাঁরা কীভাবে লক্ষপতি হলেন, তার হিসেব নেই। বাজেটে ‘লাখপতি দিদি’দের সংখ্যা তিন কোটি করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ঋণ দিলেই যদি সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে মাইক্রোফিন্যান্সের কারবার লাটে উঠত। মহিলারা যত দেনার দায়ে জড়াচ্ছেন, তত ক্ষুদ্র ঋণের কারবার জমে উঠছে।

মহিলাদের জন্য অনুদান প্রকল্প, ঋণের সুযোগের পরেও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতির বদলে অবনতিই ঘটেছে। সরকারি প্রকল্প, নানা বেসরকারি সংস্থা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলারা সস্তা শ্রমের বড় যোগানদার। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে মিল প্রকল্পের মতো মহিলা নির্ভর কাজে কর্মীদের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনা, তাঁদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি না দেওয়া থেকেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কতটা নারী দরদী বোঝা যায়। স্বনিযুক্ত প্রকল্পের বড় অংশ জুড়ে মহিলারা শ্রমের মূল্য পান না। পারিবারিক কোনো ব্যবসা বা উদ্যোগে বিনামূল্যে শ্রম দেন। সুপ্রিম কোর্ট বহুকাল আগে সম কাজে সম বেতনের কথা বললেও, মজুরির লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য কমেনি। বরং অসংগঠিত ক্ষেত্রে বেড়েছে।

মহিলাদের ক্ষমতায়নের নামে নানা প্রকল্পে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতা যত না বাড়ে, তার চেয়ে বাড়ে প্রতিষ্ঠান ও শাসকের প্রতি আনুগত্যের বাধ্যবাধকতা। জনবাদী রাজনীতিতে নারীদের গুরুত্ব দেওয়ার এটা অন্যতম কারণ। নয়া উদারনীতি অধিকার যত খর্ব করে তত স্থিতাবস্থার স্বার্থে আনুগত্য কিনে নিতে চায়। শাসকদলের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হয়। না হলেও, শাসকের রঙ বদলায় মাত্র। বঞ্চিত মানুষের বিস্ফোরণ রোধ করা যায়। নানা প্রকল্পের নামে মহিলাদের শ্রমের বাজারেও টেনে আনা যায়।

ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে মাতামাতি। এই কারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থ যোগায় বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা। এনজিও বা নানা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ দেওয়া হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও ঋণ দেয়। আসলে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নয়া উদারনীতির অর্থনীতি-রাজনীতি। বেসরকারিকরণ, সরকারি প্রকল্পের এনজিও করণ যার হাতিয়ার।

বাংলাদেশের মহ. ইউনুস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'গ্রামীণ ব্যাঙ্ক'কে ক্ষুদ্র ঋণের পথিকৃৎ হিসেবে প্রচার করা হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাঙ্ক, ২০০১ সালে গ্রামীণ ২ প্রকল্পের নামে কার্যত কর্পোরেট সংস্থায় রূপান্তরিত হয়। দারিদ্র দূর করা, মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়গুলি গৌণ করে, বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হল। মহিলাদের ঋণ মেটানোর প্রবণতা বেশি, তাই মহিলাদের টার্গেট গ্রুপ করে শুরু হয় ঋণের কারবার। মহ. ইউনুসকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছিল তার আগেই। ১৯৯৪ সালে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল 'বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার'। মনস্যান্টো, কার্গিলের মতো কোম্পানি এই পুরস্কারে আর্থিক সাহায্য দেয়। ক্ষুদ্র ঋণের কারবারে এদের স্বার্থ কী? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে ক্রমবর্ধমান কৃষি সঙ্কট ও কৃষি ব্যবস্থার কর্পোরেটকরণের মধ্যে। ক্ষুদ্র ঋণের একটা বড় অংশ ব্যয় করা হয় কৃষিকাজে। যত ঋণের যোগান বাড়বে, তত মনস্যান্টো, কার্গিলের মতো কোম্পানিগুলির বীজ, কীটনাশক সহ নানা কৃষি উপকরণের কারবার বাড়বে। ২০০০ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে ক্ষুদ্র ঋণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালকে রাষ্ট্রসংঘ 'আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ বর্ষ' হিসেবে ঘোষণা করে। আর তার পরের বছরেই মহ. ইউনুসকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। অর্থনীতিতে নয়, শান্তির জন্য। দরিদ্র মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করে, তাঁদের দারিদ্রকে মূলধন করে ঋণের কারবারের পথে শ্মশানের শান্তি প্রতিষ্ঠার মডেল হল ক্ষুদ্র ঋণ।

ক্ষুদ্র ঋণ হল, উন্নয়নের নামে বেসরকারিকরণ, সামূহিক চেতনার বদলে ব্যক্তিগত উন্নতির সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করার হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রকল্প বাস্তবায়ন, সরকারি প্রকল্পগুলির এনজিও করণ গণতান্ত্রিক, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা খর্ব করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করা হয়। ঋণ নির্ভর অর্থনীতিকে একেবারে গরিব মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হয়। গরিব মানুষ ধার নিয়ে ভোগ্য পণ্য কিনতে প্রলোভিত হন। পরিণামে আয় বৃদ্ধি নয়, দেনার দায়ে ডুবে যাওয়াই যেন তাঁদের ভবিতব্য। যার ভয়ঙ্কর পরিণতি আত্মহত্যা। গরিব মানুষের এই চূড়ান্ত সর্বনাশের বিনিময়ে, লগ্নি পুঁজি খুঁজে পায় প্রায় ঝুঁকিহীন মুনাফার এক লোভনীয় ক্ষেত্র।

মহিলাদের উপকারের নামে নানা অনুদানের অর্থনীতি-রাজনীতির সঙ্গে এই ঋণের কারবারকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না। এইভাবেই নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা, কর্পোরেট, এনজিও এবং কেন্দ্রীয়, রাজ্য সরকার থেকে তৃণমূল স্তরের পঞ্চায়েত, পৌরসভার তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প চলে পুঁজির যুক্তি মেনে। উন্নয়নের কাজে মানুষের অংশগ্রহণ, সহভাগী উন্নয়নের অধিকার থেকে যায় খাতায় কলমে।

তবুও, ক্ষোভ প্রশমিত হয় না। অধিকার আদায়ের লড়াইও খুঁজে নেয় নতুন পথ। বর্তমান শতকের শুরু থেকে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা জমি অধিগ্রহণ, উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন বা পরিবেশ আন্দোলনে তাই মহিলাদের দেখতে পাওয়া যায় সামনের সারিতে। বীরভূমের কয়লাখনি প্রকল্প বা পুরুলিয়ার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন, আবাস যোজনায় বাড়ি পেতে গ্রামসভায় ক্ষোভ থেকে আজকের সন্দেশখালি - গণআন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে আসেন মহিলারা।