আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

'ছাওয়া' ক্রিয়া, নাগপুর প্রতিক্রিয়া


ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া - এটিই এখন ভারতবর্ষের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। কোনো একটি ক্রিয়া ঘটলে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটবেই - রাজনীতি ব্যতিরেকে এটিই এখন ভারতবর্ষে কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসক প্রায় সমস্ত দলেরই অমোঘ যুক্তি। যদিও এখন কেন্দ্রের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া উভয়ের দায়িত্বই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ক্রিয়া তারাই ঘটাচ্ছে আর প্রতিক্রিয়াও তারাই দিচ্ছে। অতি সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের ঘটনাবলী এই পরম্পরার সর্বশেষ নিদর্শন। কিছুকাল আগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে 'ছাওয়া' নামক চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। মারাঠা রাজ ছত্রপতি শিবাজীর সন্তান সম্ভাজিকে নিয়ে কল্প-কাহিনী নির্ভর এই চলচ্চিত্রকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে। যথারীতি মহারাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় থাকা বিজেপি ও তার শরিক দলরা এই দাঙ্গাকে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আজ থেকে ৩০০ বছর আগের কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিজেপি এবং আরএসএসের রাজনীতিতে যুক্তিবোধের অভাব চিরকালই প্রকট। কিন্তু এখন তারা এই বিষয়ে এক অভূতপূর্ব নিদর্শন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের ইতিহাসে ভারতবাসী সম্ভবত প্রথম জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে যারা ৩০০ বছরের আগের ঘটনার প্রেক্ষিত টেনে ২০২৫ সালে বিভিন্ন কাণ্ডকারখানা ঘটানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

এই সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় মারাঠি লেখক শিবাজী সাওয়ান্তের উপন্যাস ‘ছাওয়া’ অবলম্বনে। সম্ভাজি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বয়ান বিভিন্ন সময়ে বদলাতে বদলাতে গিয়েছে। সম্ভাজি সম্পর্কে প্রাচীন ইতিহাস যে বিবরণ দেয় পরবর্তীকালে সাবিত্রীভাই ফুলের এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'সত্য সেবক সমাজ'-এর গবেষণায় উঠে আসে যে - এই ইতিহাস মূলত ব্রাহ্মণদের দ্বারা লিখিত এবং জাতপাতের বিষয়গুলিকে এড়িয়ে লেখা। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যশোবর্ধন চৌহান-এর নির্দেশে ভি. এস. বেন্দ্রে সম্ভাজির ইতিহাস খতিয়ে দেখেন। এই সময়ের গবেষণাতেই উঠে আসে সম্ভাজি কেবল একজন যোদ্ধা নয় কবি, লেখক এবং বহুভুজ ছিলেন। মূলত এই ইতিহাসের উপরে নির্ভর করে ‘ছাওয়া’ নামক সাওয়ান্তের এই উপন্যাসটি লিখিত। বেন্দ্রের গবেষণাতেই উঠে আসে সম্ভাজিকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে সম্ভাজির সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের লড়াইকে দক্ষিণপন্থী ইতিহাসবিদরা সবসময় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। সম্ভাজির ভয়াবহ নির্যাতন ও নির্মম শিরচ্ছেদকে তারা তাঁর ধর্মের জন্য দেওয়া সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বলে বর্ণনা করেছেন। মহারাষ্ট্রে বিজেপি সর্বদাই সম্ভাজিকে 'ধর্মবীর' বা ধর্মের রক্ষক বলে অভিহিত করে। স্বাভাবিকভাবেই, ‘ছাওয়া’ চলচ্চিত্রটি এমন এক সময়ে মুক্তি পেয়েছে, যখন দক্ষিণপন্থীদের মুসলিমবিরোধী প্রচারণা তীব্র আকার ধারণ করেছে, এবং এই সিনেমা জনমানসে সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে সামনে আনার একটি কৌশল হিসেবে কাজ করছে। এটির বিরোধিতায় প্রগতিশীল চিন্তাবিদরা হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতীক ভি. ডি. সাভারকর ও দ্বিতীয় আরএসএস প্রধান এম. এস. গোলওয়ালকরের লেখা তুলে ধরছেন। দুজনেই সম্ভাজির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। সাভারকর তার ‘হিন্দু পদ পাদশাহী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সম্ভাজি রাজত্ব পরিচালনার জন্য অযোগ্য ছিলেন। তিনি স্বল্পমেধার, বদমেজাজি, মদ্যপ ও লম্পট ছিলেন, যা তার অযোগ্যতাকে আরও প্রকট করে তুলেছিল।” গোলওয়ালকরও তার ‘বাঞ্চ অব থটস’ বইয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।

সুতরাং 'ছাওয়া' সিনেমাটিকে ঘিরে যে বিতর্কিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা পরিকল্পিত এবং অনুমানযোগ্য। একদিকে মোটা দাগে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব যা বরাবরই বিজেপি তথা আরএসএস-এর সবচাইতে পছন্দের বিষয়, এবং অন্যদিকে ঐতিহাসিক তথ্যের স্বল্পতা জনমানসে সহজেই এক অবিশ্বাসের জন্ম দেয় যার সূত্র ধরে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবার পরিস্থিতি অনুকূল হয়। মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পরিচালিত জোট যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তার অধিকাংশই তারা এখনও পূরণ করতে পারেনি। মহারাষ্ট্রে বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার পর থেকে, অর্থাৎ ৩ মার্চ থেকে, শাসকপক্ষের দক্ষিণপন্থী দলগুলো একনাগাড়ে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ঐতিহ্যকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে। এক মধ্যযুগীয় শাসক বারবার সমসাময়িক রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে, যা একদিকে শাসনব্যবস্থার ভুল অগ্রাধিকারকে স্পষ্ট করে তুলছে, অন্যদিকে সন্দেহ জাগায় যে এই বিতর্কগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবিকা-সংক্রান্ত জরুরি সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি সরানো যায়। বিশেষত গ্রামীণ মহারাষ্ট্র বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি, কৃষক আত্মহত্যা এবং অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। তবুও এসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে মনোযোগ না দিয়ে, বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার উত্তেজনাকর বক্তব্য ছড়িয়ে জনমানসে বিভেদ উসকে দিচ্ছে, এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে নির্বাচনী সুবিধার জন্য কাজে লাগাচ্ছে। এই কৌশলটি সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারের সময়ও স্পষ্ট ছিল, যেখানে বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বারবার ঔরঙ্গজেবের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এর পেছনের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট  এক ধরনের ‘ডগ হুইসেল’ বা গোপন সংকেতের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের আবেগকে উসকে দেওয়া, যাতে মুসলিমদের এক বিলুপ্ত শাসকের উত্তরাধিকারী হিসেবে চিত্রিত করা যায়। যেখানে আন্তঃধর্মীয় সামাজিক সম্প্রীতি দৃঢ়, সেখানে দাঙ্গার সম্ভাবনা কম থাকে। অথচ নাগপুরের মতো ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অভাব এবং তার সূত্র ধরে গড়ে ওঠা মুসলিম ভীতির রাজনীতির ফল।

বর্তমানে মহারাষ্ট্রের সরকার আবারও এই একই কৌশল নিচ্ছে যাতে নাগপুরের দাঙ্গা সম্বলিত বিতর্কিত প্রশ্নগুলো থেকে মানুষের নজর অন্যদিকে ঘোরানো যায়। এখন তারা কৌতুক শিল্পী কুনাল কামরার সাম্প্রতিক একটি কৌতুক আলেখ্য নিয়ে একইভাবে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগে কৌতুক শিল্পী কুনাল কামরা একটি অনুষ্ঠানে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের নাম না করে একটি সমালোচনামূলক গান পরিবেশন করেন। এই ঘটনাকে অজুহাত করে শিন্ডের অনুগামীরা কামরার অনুষ্ঠানস্থলে ব্যাপক ভাঙচুর করে এবং তারা এখনও শিল্পী কামরাকে ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলেছে। কিন্তু মজার বিষয় কেবল রাজনৈতিক অনুগামীরা নয় বরং এবারে মহারাষ্ট্রের সরকারটাই নেমে পড়েছে এই কৌতুকশিল্পীর বিরুদ্ধে। মহারাষ্ট্র পুলিশ শিল্পীর বিরুদ্ধে একাধিক থানায় এফআইআর দায়ের করেছে। পরিস্থিতি এখানে পৌঁছেছে যে কামরাকে তামিলনাড়ুর হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিতে হয়েছে।

এখানেও লক্ষ্যনীয় যে গোটা একটি রাজ্য সরকার জনগণের সমস্ত সমস্যা এক পাশে সরিয়ে রেখে একজন কৌতুকশিল্পীকে শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর। প্রশ্ন হল শাসকের এই অসহিষ্ণুতা কেন? কৌতুক অনুষ্ঠানে এমন কি ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে যেখানে একটি রাজ্যের সরকারকে বাকি সমস্ত দায়িত্ব সরিয়ে শিল্পীকে গ্রেফতার করতে নেমে পড়তে হয়েছে। আসলে এখানেও বিষয়টি সেই একই - নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করতে পারার ভয়। গোটা দেশজুড়ে দলনির্বিশেষে প্রায় সমস্ত শাসকেরই এই পরিচালনভঙ্গী জনগণের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। যখনই নির্বাচিত সরকারকে মানুষের কাছে জবাবদিহি করবার মুখোমুখি হতে হয় তখনই তারা নির্বাচিত শাসকের খোলস ছেড়ে রাজা এবং প্রজার সম্পর্কটিকে আঁকড়ে ধরে। নির্বাচিত সরকার নিজেকে জনগণের দ্বারা মনোনীত নয় বরং জনগণের ঊর্ধ্বে থাকা শাসকের অবতার হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে থাকে। ফলে তারা নির্দ্বিধায় প্রজারা কি খাবে, কি পড়বে, কিভাবে ভাববে আর কি প্রশ্ন করবে এই সব কিছুরই একটি নির্দেশনামা তৈরি করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়ে।

বর্তমানে বিজেপি এবং আরএসএস এই রাজনীতিকেই আরো উচ্চগ্রামে তুলে নিয়ে যেতে পেরেছে। দেশভাগের যন্ত্রনায় জর্জরিত একটি দেশে আরএসএস এবং বিজেপি একটি উর্বর জমি পেয়েছে তাদের মিথ্যা ভাষণ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার। ইতিহাসের তথ্য সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ জনতাকে তারা সহজেই কিছু কাল্পনিক তথ্য মিশ্রিত ইতিহাস পরিবেশন করে গোটা দেশজুড়ে এক সাম্প্রদায়িক জিগির গড়ে তুলতে পেরেছে। এর যোগ্য সঙ্গত করেছে আধুনিক প্রযুক্তি, মূলত সস্তার ইন্টারনেট। বিজেপি পরিচালিত তথাকথিত আইটি সেল সুচারুভাবে বিভিন্ন মিথ্যা মিশ্রিত ঐতিহাসিক তথ্য আজ বিপুল অংশের ভারতবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। এটি সম্ভব হচ্ছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে তার দ্বারা। এছাড়া বিভিন্ন দেশীয় পুঁজিপতিদের অনুদান তাদের তহবিলকে স্ফীত করেছে। ফলে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে তারা যথেচ্ছভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এবং এর মধ্যে দিয়ে বিকৃত ইতিহাস মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিতে পারছে। এরই ফলশ্রুতি নাগপুরের সাম্প্রতিক দাঙ্গা এবং কৌতুক শিল্পীর বাকস্বাধীনতা হরণের চেষ্টা। এই পরিস্থিতিকে যদি রুখতে হয় তাহলে বিরোধী রাজনৈতিক দল, দেশের সচেতন মানুষ এবং শিক্ষিত সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে বিজেপি-আরএসএস নির্মিত এই মিথ্যার দুনিয়াকে তথ্য দিয়ে বিনির্মাণ করতে। নয়ত এই হিংসার ধারা চলতেই থাকবে। যে ভারতবর্ষকে আপামর মানুষ ‘জনগণমন অধিনায়ক’ হিসেবে চেনে, তার স্মৃতিটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না।