আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৫ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪৩১

সমসাময়িক

বিশ্বরাজনীতির নতুন চালচিত্র


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা ছিল একেবারে দুধে আমে মাখোমাখো অবস্থায়। কমিউনিস্ট হটাবার প্রতিজ্ঞায় দুই জনের ছিল গভীর প্রেম। আমেরিকা বা ইউরোপে বারবার ভোটের রাজনীতির প্রেক্ষাপট পাল্টালেও, তাদের বৈদেশিক নীতির আঁতাতে কোনো চোনা পড়েনি। এমনকী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও অতলান্তিক মহাসমুদ্রের দুই পাড় জুড়ে সমঝোতা দৃঢ়ভাবে চলতে থাকে। এই তো সেদিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-এর সঙ্গে একই সুরে ইউ ও ব্রিটেন কথা বলেছে - ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য করতে হবে, আক্রমণকারী রাশিয়াকে জব্দ করতে হবে।

‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা ন্যাটো ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সামরিক সহযোগিতার জোট। ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা দেওয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ওই সময়ে জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল - বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, গ্রিস, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে ন্যাটো চুক্তিবদ্ধ দেশগুলি থেকে নিজেদের বাঁচাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বেশ কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি হয় - তাকে বলে ওয়ারশ চুক্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ১৯৯১ সালে এই চুক্তি বাতিল হয়েছে। আর তারপর থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে পাইকারি হারে ঢোকানো হয়েছে ন্যাটো-তে। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩২। পূর্ব ইউরোপে ক্রমাগত সামরিক শক্তি সংগঠিত হবার ফলে স্বভাবতই রাশিয়া আতঙ্কিত হয়েছে।

এক মেরু বিশ্ব উত্যক্ত করেছে, করে চলেছে পূর্বতন বৃহৎ শক্তি, রাশিয়াকে - যে শক্তির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার অন্যতম কারিগর, যে দেশ আকারে বিশ্বের বৃহত্তম। তাকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব’ জার্মানির মত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেওয়ালে ঠেসে ধরা রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা নয়! বর্তমানে সে দেশের নেতৃত্বে আছেন এক চরম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেন-এর ন্যাটো-তে যোগ দেবার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করবার উপরে ভরসা রাখতে না পেরে ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করেন।

তারপরে মিসিসিপি, টেমস, ভোলগা ও নীপার দিয়ে লক্ষ লক্ষ কিউসেক জল প্রবাহিত হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি রিপাবলিকান পদপ্রার্থী হিসেবে মার্কিন নির্বাচন জিতলেও রিপাবলিকানদের ঘরের মানুষ নন। তাঁর এজেন্ডা আজ আর ইউরোপের সঙ্গে মিলছে না। আজকের চীন তাঁর কাছে অনেক বড়ো প্রতিযোগী - রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে তো বটেই।

রাশিয়া এই মুহূর্তে আমেরিকার শত্রু নয়। তিনি চাইছেন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ মিটিয়ে দেশের সম্পদ ভরাতে। এই অবস্থায় ইউরোপ আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা তড়িঘড়ি করে একত্রিতভাবে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে থাকবার বার্তা দিলেও আড়ালে বলছে, তোমাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প-কে অবশ্যই সন্তুষ্ট রাখতে হবে। সে হল পৃথিবীর দাদা। সেই ফাঁকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন নিবিষ্ট মনে তার দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছেন। চীন পিছন থেকে আছে তাঁর সঙ্গে। পুতিন বুঝে গেছেন, ট্রাম্প যে শর্তে যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় তাতে তাঁর ১০০ শতাংশ লাভ।

ট্রাম্প সাধারণ মানুষের স্নায়ু স্পর্শ করেছেন। বারবার বলছেন, যুদ্ধে প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২,০০০ রুশ ও ইউক্রেনীয় তরুণ। তারা মার্কিন নয়, কিন্তু তারা তরুণ, তারা যুবক। যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।

আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট গাইছেন যুদ্ধ বিরোধী গান, আর ইউরোপ চাইছে যুদ্ধ।

অবশ্য ট্রাম্প সাহেব বিনি পয়সায় শান্তিবারি দেবেন না, বিনিময়ে ইউক্রেন থেকে নেবেন বিরল খনিজ।

ইউক্রেন-এর পক্ষে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি মেনে নেওয়া একটু কঠিন। এতদিন তাকে বোঝানো হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে যাবে, ইউক্রেনকে শুধু কিছু তরুণ প্রাণ বলিদান দিতে হবে - তাহলেই রাশিয়া ইউক্রেন-এর কাছে হেরে যাবে। তবে এই প্রচার করা হয়েছে ইউক্রেনকে ধ্বংস করে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে গিয়ে রাশিয়ার উপরে চাপ সৃষ্টি করে রাখার জন্য। আজকে ইউরোপ ও ইউক্রেনকে মেনে নিতে হবে - 'যা গেছে তা যাক’। দেশের অন্তত ২০ শতাংশের দখল চলে যাবে রাশিয়ার হাতে, এই অংশ ইতিমধ্যে রুশ তত্ত্বাবধানে চলে গেছে। ন্যাটোতে ইউক্রেন কস্মিনকালেও ঢুকতে পারবে না। এই যুদ্ধে আসলেই কেউ ইউক্রেন-এর কথা ভাবেনি। তাকে সামনে রেখে, তাকে ধ্বংস করে আটলান্টিকের পূর্ব ও পশ্চিম পাড় অস্ত্র শানিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।

বেচারা জেলেনস্কি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে শেষমেশে ইউক্রেন-এর হাতে থাকবে পেন্সিল।