আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৫ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

হিন্দি ভাষার আগ্রাসন


কেন্দ্রের শাসকদল আবার পুরোনো খেলা শুরু করে দিয়েছে। ইশকুলে নতুন শিক্ষা নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে হিন্দি ভাষাকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়মে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের দু’টি ভাষা শিখতে হবে। একটি স্থানীয় ভাষা অন্যটি ভারতের সংবিধান স্বীকৃত কোনো ভাষা। নবম শ্রেণিতে যুক্ত হবে একটি তৃতীয় ভাষা। এখানেই গোলমালের সূচনা। সব ইশকুলে তো আর সব ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ নেই, কাজেই তৃতীয় ভাষা হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের পছন্দ হিন্দি। শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে 'ত্রিভাষা শিক্ষা' আবশ্যিক না-করলে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ মিলবে না। শিক্ষামন্ত্রীর লক্ষ্য ছিল তামিলনাড়ু। নীতি অনুযায়ী, সেখানে স্থানীয় ভাষা তামিল ও দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজির সঙ্গে 'তৃতীয় ভাষা' হতে হবে হিন্দি।

স্বভাবতই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে তামিলনাড়ু। আগামী বছর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। হিন্দি সেখানে চিরকালীন কেন্দ্রবিরোধী হাতিয়ার। কাজেই হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে তার অভিঘাত শুধু তামিলনাড়ু নয়, গোটা দাক্ষিণাত্যেই মারাত্মক অনুরণন সৃষ্টি করবে।

সংবিধান প্রণেতারা শিক্ষাকে রেখেছিলেন রাজ্য তালিকায়। ১৯৭৫ সালে তা চলে আসে যুগ্ম তালিকায়। ২০২০ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নতুন 'জাতীয় শিক্ষা নীতি' রূপায়ণ করায় স্থিতাবস্থা টলে যায়। নীতি বাস্তবায়নে সরকার 'ত্রিভাষা শিক্ষা' বাধ্যতামূলক করতে চাইছে। অন্যথায় কোনোরকম কেন্দ্রীয় সহায়তা পাওয়া যাবে না।

অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদলের জুড়ি মেলা ভার। নোটবন্দি থেকে শুরু করে তড়িঘড়ি অপরিকল্পিত জিএসটি রূপায়ণ কতটা উপকারে এসেছে সবার কম বেশি জানা। 'নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন' (সিএএ) কিংবা 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' (ইউসিসি) দেশের কতটা উপকারে আসবে অথবা আদৌ আবশ্যিক কি না - তা নিয়ে বিতর্ক অন্তহীন। রাজ্যে রাজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি। মানুষের মধ্যে ভয় গেড়ে বসেছে। সন্দেহ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম এবং ক্রোধসঞ্চার করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অথচ সরকার নির্বিকার। এই মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে 'ত্রিভাষা শিক্ষা' আবশ্যিক করার আধিপত্যবাদী সিদ্ধান্তে।

হিন্দি ভাষাকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে হিন্দি আগ্রাসনের অসুখটি প্রাচীন। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সরকারি ইশকুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তিন বছর পর সেই নির্দেশ প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে মাদ্রাজে শান্তি ফিরেছিল।

১৯৪৯-এর ১৪ সেপ্টেম্বর সদ্য 'ডমিনিয়ন স্টেটাস' প্রাপ্ত ভারতের গণপরিষদ বা কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি হিন্দিকে ভারতীয় ইউনিয়নের সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তখনই এর বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছিলেন তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মানুষ। শেষ পর্যন্ত 'রাষ্ট্র ভাষা' না হয়ে হিন্দি 'সরকারি' বা 'দাপ্তরিক' ভাষার স্বীকৃতি পায়। তবে তারই সঙ্গে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য পাশাপাশি ইংরেজি-ও চিহ্নিত হয়েছিল 'সরকারি ভাষা' হিসাবে। সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আগুপিছু না ভেবে কেন্দ্রীয় সরকার আরও একবার ১৯৬৫ নাগাদ হিন্দিকে একমাত্র 'সরকারি ভাষা'-র মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ফের অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল মাদ্রাজ। সামাল দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মুশকিল আসানের সূত্র তাঁর প্রয়াত পিতা-ই দিয়ে গিয়েছিলেন। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, যত দিন না অ-হিন্দি রাজ্যগুলি রাজি হবে ততদিন হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিও সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে।

রাজকীয় ঐতিহ্যের দেশ ভারত 'সুয়োরানি'র মর্যাদা রক্ষায় সর্বদাই সচেতন। সংবিধানের অষ্টম তফশিলে স্বীকৃত বাইশটি সাংবিধানিক ভাষার মধ্যে হিন্দি সব সময়ই বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সেই সুবাদে প্রত্যেক বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের দফতর সমূহে 'হিন্দি দিবস' উদযাপিত হয়। ১৪ সেপ্টেম্বরের আগে পনেরো দিন ধরে 'হিন্দি পখওয়ারা' (পক্ষ) পালিত হয়। এর ফলে ভাষা হিসাবে হিন্দি কতটুকু বিকশিত হয় বলা মুশকিল, তবে উদার হাতে সরকারি অর্থ খরচ করা হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রতি বছরই ফিরে ফিরে আসে, দেড়শো কোটি বেশি মানুষের দেশ ভারতে কিন্তু তারিখটির তাৎপর্য অজানাই থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সারা দেশজুড়ে ভারত সরকারের দফতরগুলিতে যান্ত্রিকভাবে পালিত হয়ে যায় সরকারি উৎসব। কোথাও 'হিন্দি দিবস', কখনও 'রাজ-ভাষা দিবস' নামে এই সরকারি উৎসব উদযাপিত হয়। প্রতি বছর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে।

১৯৭৫-এর জুন মাসে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে 'রাজভাষা বিভাগ' বা 'ডিপার্টমেন্ট অব অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ' প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব ২০২৫-এ যে কোনও মুহূর্তে রাজভাষা বিভাগের ‘সুবর্ণজয়ন্তী' উদযাপনের সূচনা হতে পারে। হয়তো সেই জন্যই রাজভাষা বিভাগের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ভারত সরকারের কর্মচারীদের হিন্দি শেখানোর জন্য উপযোগী কেন্দ্রীয় হিন্দি শিক্ষণ সংস্থা, কেন্দ্রীয় অনুবাদ সংস্থা (অবশ্যই হিন্দি অনুবাদ) প্রভৃতি খাতে রাজভাষা বিভাগের বরাদ্দকৃত অর্থ সংবৎসর ব্যয় করা হয়। তাতে হিন্দি ভাষার কতটুকু প্রসার ঘটে তার কোনো হিসাব নেই।

রাজভাষা বিভাগের মতো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সরকারি বিভাগ থাকা সত্ত্বেও 'শিক্ষা' মন্ত্রকের অধীনে আছে 'হিন্দি কৃত্যক' বা 'ডায়রেক্টরেট অব হিন্দি'। এ ছাড়াও ওই একই মন্ত্রকের অধীনে আছে 'কেন্দ্রীয় হিন্দি শিক্ষণ মণ্ডল’। তা ছাড়াও 'হিন্দি শিক্ষক নিয়োগ এবং তাঁদের শিক্ষণ' বাবদ ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক প্রতিটি আর্থিক বর্ষে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করে চলেছে।

এখানেই শেষ নয়। প্রতিটি মন্ত্রক-বিভাগের বাজেট বরাদ্দের একটা নির্দিষ্ট অংশ হিন্দি ভাষার প্রসারের কাজে ব্যয় করা হয়। ভারত সরকারের প্রতিটি মন্ত্রক-বিভাগে একটি করে হিন্দি শাখা আছে। এবং প্রতিটি মন্ত্রক বিভাগের বার্ষিক বিবরণীতে হিন্দি সংক্রান্ত একটি অধ্যায় আবশ্যিকভাবে মুদ্রিত হয়। আর বার্ষিক বিবরণীর হিন্দি সংস্করণ ছাপানো যে বাধ্যতামূলক সে কথা আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে কি? বিদেশের যে কোনও গ্রন্থাগারে গেলে দেখা যায়, ভারতীয় দূতাবাস যেসব বই দান করেছে তার প্রায় সবকটাই হিন্দি ভাষায় রচিত। আবার দূতাবাসের গ্রন্থাগারে যেসব বই রাখা আছে তার অধিকাংশই হিন্দিতে রচিত। এমনকি সেনাবাহিনীর জন্য যে বই প্রতি বছর কেনা হয় তার নব্বই শতাংশই হিন্দি ভাষায় রচিত।

হিন্দি ভাষার প্রতি কোনও বিদ্বেষ বা অসূয়ার বশবর্তী হয়ে উল্লিখিত তথ্যসমূহ পরিবেশিত হল, এমন নয়। বাইশটি সাংবিধানিক ভাষার মধ্যে বিশেষ একটিকে বেছে নিয়ে যে ভাবে অ-নিরপেক্ষ আচরণ চালানো হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে একটা সাধারণ রূপরেখা আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত ভাষা সমূহ ছাড়া আরও অনেক ভাষা আছে যা বহু জনজাতি বা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা।

এতকিছুর পর প্রশ্ন ওঠে হিন্দিভাষী রাজ্যের কতজন মানুষ দ্বিতীয় আর একটি ভাষায় স্বচ্ছন্দ? এই অঞ্চলের ইশকুল পড়ুয়ারা নবম শ্রেণিতে কোন ভারতীয় ভাষাকে তৃতীয় ভাষা হিসেবে বেছে নেবে? অতএব চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূলত হিন্দিভাষী মানুষ। হিন্দি ভাষার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এমন উদারতার জন্য কেন্দ্রের শাসকদলের সমর্থনে তারা খুশি হয়ে ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটালেও অষ্টম শ্রেণির পর তাদের পড়াশোনার জগৎ যে সীমিত হয়ে যাবে সেই বিষয়ে তারা অবগত আছে কি?

উত্তর ভারতের বহু ভাষাকেই (হরিয়ানভি, বুন্দেলা প্রভৃতি) হিন্দি ভাষার সঙ্গে একই বন্ধনীতে জোর করে রেখে দেওয়া হয়েছে। হিন্দি ভাষাভাষী হিসেবে নিজেকে নথিভুক্ত করলে কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় বলে তাঁরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন না। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে অন্তত পঁচিশটি স্থানীয় ভাষাকে হিন্দির সঙ্গে একই বন্ধনীতে রাখা হয়েছে। বন্ধনমুক্ত হলে দেশের জনসংখ্যার নিরিখে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।

শুধুমাত্র ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ শ্লোগান দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা যায় না। কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার করে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য রক্ষার জন্য সকলের সহযোগিতা দরকার। তার জন্য দরকার বৈষম্যহীন আচরণ। পক্ষপাতিত্ব করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অসমদর্শী প্রতিপোষকতা অথবা বদান্যতা কি সমৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে?