আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৫ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

লোকসভা আসন বন্টন


কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে যে আগামী ২০২৬ সালে লোকসভা আসনের পুনর্বন্টন হবে। ১৯৭১ সালের পর ২০২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই আসন পুনর্বন্টন হওয়ার কথা। বিতর্ক তৈরি হয়েছে যেহেতু কোভিড অতিমারীর অজুহাতে ২০২১ সালে জনগণনাই হয়নি। এই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে সেই প্রক্রিয়া হবে, এজাতীয় কোন ইঙ্গিতও কেন্দ্রীয় বাজেটে নেই। অথচ সরকার বলছেন তারা ২০২৬-এই লোকসভার আসন পুনর্বন্টন করবেন। কীভাবে? তারা ২০২৬ সালের অনুমিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই কাজ সম্পন্ন করবেন। বিজেপি সরকার অবশ্য তার এই ১৫ বছরে সাংবিধানিক দায়িত্ব, রীতিনীতি অবজ্ঞা করে চলার ধারা রপ্ত করে ফেলেছে। কিন্তু এখন তাদের এই প্রবণতা গোটা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডকেই বিপদে ফেলছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোকেই ভেঙে ফেলে কেন্দ্র পরিচালিত একটি ফ্যাসিস্টসুলভ সরকারি ব্যবস্থা লাগু করতে চায়।

স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যগুলি, মূলত অ-বিজেপি দলের সরকার যেখানে আছে তাঁরা এই নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁরা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে এই প্রক্রিয়া ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে বদলে দেবে। তাঁদের এই আশঙ্কা নেহাত অমূলক নয়। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কেন জনগণনা ছাড়াই এই পুনর্বন্টন শুরু করতে উৎসাহী। কেবলমাত্র হিন্দি বলয়ের জোরেই যদি দেশের সরকার চালানোর চাবি হাতে পাওয়া যায়, তাহলে বিজেপির মত দল, যারা কেবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই প্রতিনিধিত্ব করে, যারপরনাই খুশি হবে। ফলে বারবার বিজেপির সরকার, এবং ভারতকে তাদের মনমত একটি হিন্দুত্ববাদী দেশে পরিণত করার কাজ সহজ হবে। কেউ বলতেই পারেন এই আসন পুনর্বন্টন তো সংবিধানের ধারা মেনেই হচ্ছে। তাহলে বিরোধীরা এত চিৎকার জুড়েছেন কেন? কিন্তু এর মাঝে কিছু তথ্য কেন্দ্রের সরকার চেপে যাচ্ছে, যা দেশের প্রতিটি মানুষ, যাঁরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন এবং সেটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাদের সামনে আসা প্রয়োজন।

বিজেপি সরকার দাবি করেছে যে সংবিধানের ৮২ ও ১৭০ ধারা অনুযায়ী প্রতি জনগণনার পর জনসমষ্টির অনুপাতে বিধানসভা ও লোকসভা এলাকার আয়তন এবং সংখ্যা নির্ধারিত করে আসনের পুনর্বন্টন করা হবে। এরজন্য একটি পুনর্বন্টন কমিটি তৈরী করা হয় সংসদীয় আইন মোতাবেক। এ যাবৎ ১৯৫১, ১৯৬১ এবং ১৯৭১-এ জনগণনার পরে এই আসন পুনর্বন্টন হয়। এর ফলে সংসদের আসন সংখ্যা বেড়ে যথাক্রমে ৪৯৪, ৫২২ এবং সর্বশেষ ৫৪৩ হয়। ১৯৭১-এ ভারতে জনসংখ্যা ছিল ৫৪.৮ কোটি। ফলে লোকসভা আসন পিছু গড় জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি। কিন্তু এরপর পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আসন বন্টন ১৯৭১-এর হিসাবেই স্থির রাখা হয়। এর পিছনে যুক্তি ছিল যে আগামী ৫০ বছরে রাজ্যগুলি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে ২০২১ সালে যখন জনগণনা হবে তখন আসন পুনর্বন্টন হবে। এই মধ্যবর্তী সময়ে সমস্ত রাজ্যই নিজেদের রাজ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সমস্ত রাজ্যগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একই রকম আগ্রহী হয়নি। একদিকে যখন দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো যেমন কেরল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে জন্মহার জাতীয় গড়ের চেয়ে কম, অন্যদিকে উত্তর ভারতের রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশে জন্মহার জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশী। ফলে এখন কেবল জনসংখ্যার অনুপাতে আসন পুনর্বন্টন হলে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর আসন কমবে, এবং উত্তর ভারত তথা হিন্দি বলয়ের আসন সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। ফলে প্রতিবাদ বেশি দক্ষিণ ভারত থেকেই আসছে।

এই হিসাবের গরমিলটা একবার দেখলে বোঝা যায়, বিজেপির আসল পরিকল্পনাটি কী। যদি ২০২৬-এর অনুমিত জনসংখ্যা হিসাবে মোট লোকসভা আসন ৫৪৩ রেখেই আসন পুনর্বন্টন হয় তাহলে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর লোকসভা আসন কমবে ২৬টি, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড ও হিমাচলের আসন কমবে ১টি করে। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের আসন বাড়বে ৩১টি। এই তথ্য নিয়ে বিরোধী রাজ্য সরব হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন এই আশঙ্কা অমূলক। রাজ্যগুলির আসন অনুপাত একই থাকবে। আর এখানেই সবচেয়ে বড় চালাকিটি বিজেপি করতে চাইছে। তারা চাইছে লোকসভার মোট আসন বাড়াতে। এর ফলে লোকসভার মোট আসন হবে ৮৪৮টি। এই হিসাবে কেবল হিন্দি বলয়ের আসন বাড়বে ১৫০টি, আর দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে আসন বাড়বে মোট ৩৫টি। ফলে বোঝা যাচ্ছে দুই পদ্ধতিতেই বিজেপি উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে বাড়তি আসন পাবে। প্রথম হিসাবে উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের আসনের তফাৎ হবে ৫৭টি আর দ্বিতীয় হিসাবে এই পার্থক্য হবে ১১৫টি। ফলে কেন্দ্রের সরকার গঠনে উত্তর ভারতের ভূমিকাই নির্ণায়ক হবে। শুধু তাই নয় কেবল এই ৪টি রাজ্যের নির্বাচনের ফলে ঠিক হয়ে যাবে কেন্দ্রে কার সরকার হবে। আর দক্ষিণ ভারতে দুর্বল বিজেপি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না।

কিন্তু এই বিতর্ক কেবল কিছু পদ্ধতিগত নয়। বরং এই প্রক্রিয়া গোটা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই আক্রমণ করছে। বিজেপি এমন একটি ব্যবস্থা চাইছে যেখানে দেশের অর্ধেক জনসমষ্টির কোনও ভূমিকাই থাকবে না দেশের সরকার গঠনে। শুধু তাই নয়, কেবল একটি মুষ্টিমেয় ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ গোটা দেশের ক্ষমতার চাবিকাঠি হাতে পাবে। এমন ব্যবস্থা যে কেবল অগণতান্ত্রিক তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোকেই অস্বীকার করা। 'হিন্দি, হিন্দু হিন্দুস্থান'-এর রাজনীতি দিয়েই যদি দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যায়, তাহলে মানুষের জীবন-জীবিকার দাবি রাজনীতিতে আর ছাপ ফেলবে কীভাবে? ফলে এই আসন পুনর্বন্টন দেশের রাজনৈতিক অভিমুখকেই চিরতরে বদলে দেবে। অন্যদিকে বর্তমান পদ্ধতিতে এই আসন পুনর্বন্টন হলে তা সংবিধানের প্রণেতাদের উদ্দেশ্যকেই খর্ব করে। যে সমস্ত রাজ্যগুলো জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে সদর্থক ভূমিকা নিল তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল। অন্যদিকে যে রাজ্যগুলো ঠিক এর বিপরীতে গেল তারা কেবল পুরস্কৃতই হল না, বরং দেশের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল। ফলে এই ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে মূলেই আটকাতে না পারলে দেশের রাজনীতির অভিমুখের যে পশ্চাদপসরণ ঘটবে, সেই আবর্ত থেকে বেরোতে বহু প্রজন্ম ব্যয় হয়ে যাবে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক জোটকে অবিলম্বে এই প্রশ্নে একটি সংঘবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে। কিন্তু নিজ কায়েমী স্বার্থে বিভাজিত বিরোধী শিবির কি দেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে? তামিলনাড়ু এই প্রশ্নে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। কিন্তু বাকি আঞ্চলিক দল, যারা বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে খানিক রুখে দিতে পেরেছিলেন তারা এখনও কোন স্পষ্ট অবস্থান নেননি। এমনকি জাতীয় কংগ্রেসও বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো জনমত তৈরি করে উঠতে পারছে না। ফলে ভারতের রাজনীতি কতদূর গণতান্ত্রিক থাকবে তা এক গভীর প্রশ্নের মুখে।