আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৫ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪৩১
প্রবন্ধ
কুম্ভস্নান, পুণ্যস্নান!
সুগত ত্রিপাঠী
প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভস্থলে এবং উক্ত স্থানে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রেল স্টেশনে পদপিষ্ট হওয়ার এবং চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি নজরে এসেছে দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর। এ-জাতীয় ঘটনা দেশের একশ্রেণির মানুষের আশ্চর্য মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। বলা বাহুল্য, এ পরিচয় বড় লজ্জার। কিছু মানুষের ধর্ম-উন্মাদনা এবং সংস্কার-আবদ্ধতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এসব ঘটনা তারই প্রমাণ। নির্দিষ্ট এই ক'টা দিনের মধ্যে - যা শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে এবং শেষ হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে - স্নান করলে সর্বপাপমুক্তি এবং অসীম পুণ্য সঞ্চয়ের বাসনায় একশ্রেণীর মানুষ অন্ধের মতো ছুটেছেন ওই জায়গায় যাওয়ার জন্য। ১৪৪ বছর পরে নাকি এই 'মহাযোগ' এসেছে। আবার আসবে ১৪৪ বছর পরে, অর্থাৎ ২১৬৯ সালে। অতএব এখন যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁরা কেউ আর ওই সময়ে থাকবেন না এটা ধরে নেওয়াই যায়। "বহু ভাগ্যবলে যখন এই সময়সীমার মধ্যে জন্ম নিয়েছি, এই সুবর্ণ সুযোগ কখনও হাতছাড়া করা উচিত নয়, সেটা করা চরম মূর্খামি" - এটাই অধিকাংশ কুম্ভযাত্রীর মনে ক্রিয়া করেছে বোধ হয়। তাই এত হুড়োহুড়ি, যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা, মরিয়া চেষ্টা।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, "লোকে গঙ্গাস্নান করলে স্নানটা করার সময়ে পাপগুলো গঙ্গা-তীরবর্তী গাছে উঠে বসে থাকে; যেই স্নান শেষ হয়ে যায় অমনি আবার এসে লোকের কাঁধে ভর করে।" গঙ্গাস্নানও পুণ্যস্নান, মহাপুণ্যস্নান; আর প্রয়াগের কুম্ভস্নানও পুণ্য-মহাপুণ্যস্নান। ফল একই। অতএব ওখানে গিয়ে কতখানি কী পাপক্ষালন হতে পারে, সেটা ভেবে দেখার বিষয় বইকি! যেহেতু উপরোক্ত কথাটি বলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, যিনি প্রায় সর্বজনস্বীকৃত আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসাবে স্বীকৃত। এক মহামানব।
একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রয়াগরাজে পদপিষ্টের ঘটনায় যেসব মানুষ তথা পুণ্যার্থী মারা গিয়েছেন, তাঁদের মৃত্যুর জন্য কিন্তু দায়ী অপরাপর পুণ্যার্থী। পায়ের নীচে পতিত লোকগুলিকে উদ্ধারের চেষ্টা না করে তাঁরা এগিয়ে গিয়েছেন পুণ্য-অর্জনের আশায় ত্রিবেণীসঙ্গমের দিকে। তাহলে কি পুণ্যলাভের সঙ্গে মানবিকতার সম্পর্ক নেই? এটা মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্বের সর্বজনস্বীকৃত প্রায় সমস্ত অধ্যাত্মপুরুষেরা মানব তথা জীবকে ভালোবাসার কথা বলেছেন। এবং উক্ত মহাপুরুষেরা এইসব পুণ্যার্থীদের দ্বারা পূজিতও হন। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? কিছুটা ভণ্ডামি, নিন্দনীয় মানসিকতা, কিছুটা ভাবের ঘরে চুরি নয় কি?
প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা কেউ কেউ বলছেন। বলছেন, উত্তরপ্রদেশ সরকার যদি সচেতন থাকত এই দুর্ঘটনা হয়তো ঘটত না; আর ঘটলেও অল্পের উপর দিয়ে যেত, এতগুলি প্রাণ যেত না। কথাটি আংশিক সত্য, পূর্ণ নয়। কারণ ধর্মাচরণের অধিকার প্রতিটি মানুষের আছে। কুম্ভমেলায় যার খুশি তিনি যেতেই পারেন, বাধা দেওয়া যায় না। তবে স্নানের ঘাটে একটা নিয়ম অবশ্যই রাখা এবং মানা উচিত ছিল। এক্ষেত্রে তা যথাযথ রক্ষিত হয়নি। তবে এক্ষেত্রেও একটা কথা আছে। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড় সামাল দেওয়া যে-কোনও প্রশাসনের পক্ষেই কার্যত অসম্ভব। কেউ বলছেন, ওই দুর্ঘটনার দিন মহাকুম্ভে দশ কোটি থেকে পঞ্চাশ কোটি লোক জড়ো হয়েছিলেন। এতজনকে নিয়ন্ত্রণ করা দেশ বা রাজ্য-সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীতে যত মানুষ রয়েছেন, তাঁদের সবাইকে এ কাজে লাগালেও (অর্থাৎ ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার কাজ) তা সম্ভব হতো না; পুণ্যার্থীদের সংখ্যা তাঁদের তুলনায় এত বেশি ছিল।
দুর্ঘটনা-বিষয়ে অন্যরকম ব্যাখ্যাও শোনা যাচ্ছে। অনেকে বলতে শুরু করেছেন, যাঁরা ওই দিন মারা গিয়েছিলেন তাঁদের আত্মার মুক্তি ঘটে যাবে; অথবা তাঁদের অক্ষয় স্বর্গবাস বাঁধা। এসব বলার মানুষ এখনও আছেন ভেবে ভারতবাসী হিসাবে লজ্জিত হতে হয়।
কুম্ভস্নান চলবে আর সমাজমাধ্যম চুপ করে থাকবে, তা তো হতে পারে না! সর্বত্র মাথা গলানোর মতো এখানেও সে প্রবেশ করেছে। বিবিধ সমাজমাধ্যম-প্ল্যাটফর্ম এই কুম্ভের মাহাত্ম্য নিয়ে রাশ রাশ লেকচার ঝেড়ে যাচ্ছে, অধিকাংশই বোগাস। কিন্তু ধর্মপাগল-ধর্মান্ধ মানুষেরা ধর্মবিষয়ক যে-কোনও কথাকেই অভ্রান্ত বলে মেনে নেয়। কে বলছে, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বলছে - সেসব দিকে তাদের খেয়াল থাকে না। পতঙ্গ যেভাবে আগুনের দিকে যায়, এরাও ঠিক একইভাবে ভণ্ড-অভণ্ড, সাধু-দুর্জন সবার 'ধর্মবিষয়ক' আলোচনাকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেয়।
এমন কিছু মানুষকে দেখেছি কুম্ভে স্নান করতে যাঁদের ভাবমূর্তি অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, বহু অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত এসব লোক। এঁরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। সংবাদমাধ্যম এঁদের স্নানরত ছবি ফলাও করে প্রচার করেছে। কিন্তু এঁদের কলঙ্ক ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান করলে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে, এমন নিশ্চয়তা আছে কি? এঁরা অবশ্য সেই আশাতেই (সম্ভবত) ডুব দিয়েছেন।
যাই হোক, যে যাই করুক, বাস্তব যা তা হল - পৃথিবীতে এমন কোনও জলাশয় নেই যা কারও পাপস্খালনে কিছুমাত্রও সহায়তা করতে পারে। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে কুম্ভে স্নান আর অন্য যে-কোনও স্থানে যে-কোনওভাবে (অর্থাৎ অবগাহন ব্যতীত অন্যভাবে) স্নান একই ব্যাপার, ফল একই - শরীর পরিষ্কার হয়। মাঝখান থেকে ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জলে চরম অসময়ে স্নান করলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনেকে এভাবে অসুস্থ হয়েও পড়েন, কেউ কেউ মারাও গিয়েছেন। এমন অনেক অসুখ আছে অবগাহন স্নান নিষিদ্ধ। তাঁরা ওই জলে ডুব দিলে বিপদে পড়তে পারেন। তখন কিন্তু রক্ষা করতে কোনও ভগবান আসবেন না। কারণ ভগবান যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন (যাঁরা এই মতে বিশ্বাসী তাঁদের কথাই এখানে বলা হচ্ছে), তেমনই তিনি মানুষকে বোধবুদ্ধিও দিয়েছেন। মানুষ তার প্রয়োগ না ঘটালে দোষটা তার, ভগবানের নয়।
দেহকুম্ভ তথা মন বা মানসকুম্ভ পুণ্য দিয়ে পূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই মানুষ কুম্ভে যাত্রা করে। মেলার 'কুম্ভ' নামকরণের তাৎপর্যও তাই। কীভাবে সেই পুণ্য অর্জন সম্ভব? অনেক রকম ভাবেই তা করা যায়। একটা বড় উপায় হল - সাধুসঙ্গ করা। বহু সাধক-সাধিকার আগমন হয় ওখানে, তাঁদের কাছ থেকে ধর্ম-উপদেশ শোনার, দীক্ষাগ্ৰহণ করার এক মস্ত সুযোগ পাওয়া যায়। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখি? ওখানে সত্যিকারের সাধুদের তো প্রায় দেখাই যায় না। দেখা মেলে এমন একশ্রেণীর মানুষদের - যারা গৈরিকধারী, অর্থাৎ 'সন্ন্যাসী'; কিন্তু দেখায় নানান ভেল্কি - যেন সন্ন্যাসী নয়, ম্যাজিসিয়ান। পুণ্যার্থী নামধারী আর একশ্রেণীর মানুষ ওখানে যান ভক্তি গদগদ চিত্তে ওদের কারসাজি দেখতে - হাত ঘুরিয়ে শূন্য থেকে জিনিস আনা, বিনা দেশলাইতে আগুন জ্বালানো, নিজের লিঙ্গ নিয়েও অশালীন কার্যকলাপ করেন অনেকে। নিরীহ ভক্তকুল (এঁরা নির্বোধ, মাথামোটাও বটে) ওই গেরুয়াধারীদের পায়ে লুণ্ঠিত হন, 'বাবা' 'বাবা' করে অস্থির হয়ে চোখের জলে নাকের জলে একশা হয়ে যান। বিনিময়ে বাবাদের পকেট ভালোই ভর্তি হয়।
পরমপুরুষ আদি শঙ্করাচার্য সাধু-সন্ন্যাসীদের পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে এই মেলার সূচনা করেছিলেন - এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। এখন ভাব নেই, আছে বিশেষ নেশাদ্রব্য - ওটারই আদান-প্রদান চলে তথাকথিত সাধুদের ভিতরে।