আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
আজকের বাংলাদেশ
গৌতম লাহিড়ী
কয়েকদিন আগে কলকাতার এক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সফিকুল আলম সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। তাঁর কথায় ‘ফ্যাসিবাদী’ হাসিনা সরকারের সময়ে গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। ৫ আগস্ট ‘গণআন্দোলনের’ পরে এখন মিডিয়া স্বাধীন।
দু’দিন পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ভোরের কাগজ’ দৈনিক সংবাদপত্র আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ সরকারপন্থী রাজনৈতিক দল পত্রিকাটির ক্ষমতা দখল নিতে চায়। প্রকাশক ভয়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। শতাধিক সাংবাদিক ও কর্মী কর্মচ্যুত হলেন ‘নয়া গণতন্ত্রের’ পরিবেশে। ‘ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত আগেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। তখন রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল শ্যামলের কন্যা শশী অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। তার নামে বিপুল সম্পত্তি রয়েছে। শশী এখনও ছাত্রী। একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকেন। শশী সকল আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন-এর কাছে করুণ আবেদন জানিয়েছেন হস্তক্ষেপের জন্য। ‘কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ সম্প্রতি বাংলাদেশের জার্নালিস্টদের দুর্দশা নিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে।
এখনও পর্যন্ত শতাধিক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যার মধ্যে শ্যামল দত্ত ছাড়াও জনপ্রিয় ‘একাত্তর’ টিভি সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, টিভি অ্যাংকর রূপা ফারজানা এবং তাঁর সাংবাদিক স্বামী শাকিল আহমেদ রয়েছেন। বহু সাংবাদিককে খুনের মামলায় আটক করা হয়েছে। এরা জামিন পাচ্ছেন না। আদালতে বিচারের কোনো সুযোগ নেই।
শশী লিখেছেন, "যারা জেলে বন্দী তাদের এই শীতের সময় মাটিতে শুতে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। আমার মা দু’মাস চেষ্টা করার পর বাবার ওষুধ দিতে পেরেছে। জেলের মধ্যেই তাকে দু’বার হাসপতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।"
মোজাম্মেল বাবু ক্যান্সার আক্রান্ত। তাঁর ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। শশী এও লিখেছে, "আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম ৬ জানুয়ারি জামিনের জন্য হাইকোর্ট যাব, তখন তার আগের দিন হঠাৎ একটা খুনের মামলা দেওয়া হল। আশ্চর্যের বিষয়, ৮২ জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে একই ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে। ঘটনা ২০১৩ সালের।"
সম্প্রতি লন্ডনে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সেখানে 'কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন' কর্মসমিতির সদস্য রিচার্ড বোর্ন বলেন, "কমনওয়েলথ সরকারের প্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ উপস্থিত ছিল। তারা যৌথ বিবৃতিটির স্বাক্ষরকারী। এতে বলা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুশাসন দিতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।" 'কমিটি ফর প্রটেকশন অফ জার্নালিস্ট' - একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান৷ তারা বলেছে, "বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে।" প্যারিসের আরএসএফ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস-কে চিঠি লিখে প্রতিকার চেয়েছেন। 'ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্ট' বলেছে, "বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত।"
প্রেস সচিব বলছিলেন, এখন গণমাধ্যমে কোনো হস্তক্ষেপ হয় না। বাস্তবতা কী? ‘একাত্তর টিভি’-র কার্যকরী সম্পাদক শাকিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর দায়িত্ব পেলেন এক বিএনপিপন্থী। বাংলাদেশে গণমাধ্যমে সবসময় মেরুকরণ হয়। একদল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে। অন্যরা তার বিরোধী। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন - এটা সত্য। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই হাসিনার নীতির সমালোচনা করেছেন। তবুও এরা যদি হাসিনা সরকারকে সমর্থন করে থাকেন সেটা কি অপরাধ? দেশের আইন ভঙ্গ করলে অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। তাই বলে হত্যা মামলা!
এরপর একের পর এক টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধানদের চাপ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি', 'ডিবিসি চ্যানেল'-এর সম্পাদককে হটিয়ে দেওয়া হয়। 'সময় টিভি'র ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এর পর ইউনূস সরকারের এক উপদেষ্টা টিভি দপ্তরে গিয়ে হুমকি দেন, কয়েকজন সাংবাদিককে বরখাস্ত করতে হবে। 'এএফপি' সংবাদ সংস্থা এটা রিপোর্ট করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে 'এটিএন নিউজ'-এর 'এটিএন বাংলা'য়। 'নিউজ ২৪'-এর প্রধান রাহুল রাহাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে। সংবাদপত্রও ব্যতিক্রম নয়। সর্বাধিক প্রচারিত 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর সম্পাদক নঈম নিজাম, 'যুগান্তর'-এর সাইফুল আলম, 'সমকাল'-এর সম্পাদক আলমগীর হুসাইনকে পদত্যাগ করানো হয়। এটাই কি স্বাধীনতা?
১৭ বছরের মনফুল। চোখের সামনে দেখেছে পুলিশ বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করেছে। আজ সে একাকী। বাবা-মায়ের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। এমনই ঘটেছে বহু সাংবাদিক পরিবারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এক প্রহসন চলছে। কেবলমাত্র সাংবাদিক নয়। সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও চাপে। তাদের ব্যবসায় বাধা তৈরি করা হচ্ছে।
শত শত মনফুলের নিঃশব্দ ক্রন্দন একদিন বিস্ফারিত হবে এটা অনেকের বিশ্বাস। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মনফুল-শশীদের সংখ্যা বাড়ছে। ওদের নীরব প্রতিবাদ সরব হয়ে ওঠা সময়ের অপেক্ষা।