আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

টুকরো লেখা

অমিয় দেব


১.

শান্তিনিকেতনেই যাইনি কতদিন। আর পৌষমেলায়? কে জানে কবে শেষ গেছি! কবে শেষ বাউলদের তাঁবুতে গিয়ে একটু আড্ডা দিয়েছি। বা মেলামঞ্চে তাদের সঙ্গে সার বেঁধে বসে থেকে, হঠাৎ উঠে, নিজেদের কাছেই গাইতে-নাচতে দেখেছি। কিংবা মেলামাঠে কালোর দোকানের সামনেকার কোনো টেবিলে বসে থেকেছি, যদি তেমন চেনামুখ চোখে পড়ে। তবে একটা স্মৃতি আজও হানা দেয়। আমরা কোপাই বেড়িয়ে ফিরছি। অদূরে মন্দির। এগোতেই ভেসে আসে খ্রিস্টোৎসবের বাণী ও সুর। মন স্তব্ধ হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ি। যীশু, তুমি শুনছিলে?

২.

আশ্চর্য! কিছুতেই মনে পড়ছে না তার মুখ। অথচ খবর এল সে চলে গেছে। একান্নতে। নাকি ঘুমের মধ্যেই হৃদ্‌স্পন্দনে যতিপাত ঘটেছে। স্মৃতি, [বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছি] ‘তোমাকেই দেবী বলে মানি’, কিন্তু মাঝে মাঝেই তুমি বড়ো মুশকিলে ফেল। শোক তো পরের কথা, মানুষটাকেই তো তুমি তোমার আঁচলে ঢেকে রেখেছ! একটু দয়াও কি তোমার হয় না এই নব্বুই-পেরোনো বৃদ্ধটির জন্য - তুমিই যার মুখ্য সম্বল? দেখিয়ে দাও তাকে। ভেসে উঠুক তার মুখটা তোমার আননে। অন্তত একবার তার যৌবনের কাছে মাথা নত করি।

৩.

আমারই বয়সী ছিলেন তিনি - শ্যাম বেনেগাল। চলে গেলেন। তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু একসময় আমার মানসবৃত্তে তিনি ছিলেন। তাঁর করা ছবি দেখেছিঃ ‘অঙ্কুর’, ‘মন্থন’, ‘মান্ডি’, ‘নিশান্ত’। কথায় কথায় অনিল আচার্য বললেন, শ্যাম বেনেগালকে তিনি চিনতেন। আমি বললাম, একটু লিখুন ‘অনুস্টুপ’-এ ওঁকে নিয়ে। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ্‌, স্মিতা পাতিলকে তিনি বারবার তাঁর ছবিতে নিয়েছেন। তখনই কি তাঁদের উত্থান ঘটল? গিরীশ কারনাডও আছেন তাঁর ছবিতে, তবে তিনি যতটা নট তার চেয়ে বেশি নাট্যকার। শঙ্খ ঘোষের অনুবাদে তাঁর ‘হয়বদন’ তো ভুলবার নয়।

৪.

চলে গেলেন এম. টি. বাসুদেবন নায়ারও। স্বনামধন্য মালয়ালম লেখক। আমার চাইতে একবছরের বড়ো। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তিরুরের থুঞ্চন প্রাঙ্গণে। তিনি তার অধিকর্তা। গিয়েছিলাম সাহিত্য অকাদেমি আহূত এক আলোচনাসভায়। সেই সভায় কী শুনেছিলাম বা বলেছিলাম তার কিছুই মনে নেই। মনে যা আছে তা ওই প্রাঙ্গণ। তার কথা লিখেওছি। তবে লেখার অবকাশ পাইনি যে, ব্যক্তিগতভাবে এম. টি.-র সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লেগেছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল ‘চেম্মিন’ ও ‘কয়ার’-খ্যাত তাঁর পূর্বসূরি তাকাঢ়ি শিবশঙ্কর পিলেই-এর সঙ্গে এক চিলতে দেখা হওয়ার কথাও - ত্রিসুরে, কেরল সাহিত্য আকাদেমি ভবনে।

৫.

কুকুরটা কিন্তু ডেকেই চলেছে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। অদূর কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে। বাড়িই বোধহয়, কারণ কোনো পশুচিকিৎসালয় তো এপাড়ায় নেই। পোষা হলেও নিশ্চয়ই বাঁধা। নইলে অমন ডেকে যাবে কেন? পাগলা? কিন্তু পাগলা কুকুর কেউ পোষে? তবে হতে পারে কোনো পাগলা কুকুর তাকে কামড়ে দিয়েছিল। এখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। মাঝখানে তিনদিন তার ডাক শোনা যায়নি। ভাবলাম, মারা গেল নাকি? না। সম্ভবত চিকিৎসার্থে কোথাও নীত হয়েছিল। চতুর্থ দিন থেকে আবার যে-কে-সেই। তবে তার ডাকে মাঝে মাঝে বিরাম থাকে - আহার-নিদ্রা? অন্তত আমি যখন শুতে যাই তখন তাকে ডাকতে শুনি না। কিন্তু আজ তার ডাক বুঝি শুনিইনি। কী জানি কী হল!

৬.

পায়রাদের বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। কেবল এখানে ওখানে ওদের খুঁটে খেতে দেখেছি। আমার ধারণা ছিল ওরা নিরীহ পাখি। মানুষের মতো নিজেদের মধ্যে মারদাঙ্গা করে না। ওদের যখন আমরা খাবার দিতে শুরু করি, তখনো আমি কিঞ্চিৎ রোমান্টিক। আস্তে আস্তে আমার জ্ঞানোদয় হল। দেখলাম, ক্বচিৎ কদাচিৎ বিনা প্রতিযোগিতায় একটি বা দুটি খেয়ে গেলেও, বেশির ভাগ সময়ই ওরা একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের খামচাখামচি দেখে মনে হয় ওরা যুদ্ধ করছে। তখন ওদের ‘কোঁকর-কোঁ’ শুনে বোধ হয় ওরা বলছে, ‘নিরস্ত্রের যুদ্ধে যাই, শস্ত্র হয় মন’। আর জয় হয় অকুতোভয় সবলেরই। তার মানে, জয়তু ডারউইন! তবে দুর্বল সর্বদা পিঠটান দেয় না। হার মানলেও তক্কে তক্কে থাকে, কখন সবলের মনোযোগ একটু শিথিল হয়। অর্থাৎ ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বোধকরি একটি প্রক্রিয়া। রণক্ষেত্র বহাল থাকে।

৭.

কাফকা থেকে এক টুকরো, বাংলায়, নাম ‘সাইরেন’ (হোমারের ‘ওদুসি’-র দ্বাদশ সর্গে ওদের আমরা দেখি): ‘এসব হল রাত্রির প্রলুব্ধকারী স্বরঃ সাইরেনরাও এমনি গাইত; তাদের প্রতি অবিচার হবে, যদি ভাবা হয়, তারা প্রলুব্ধ করতে চাইত। তারা জানত তাদের নখর আছে, তাদের গর্ভ অফলবতী, তা নিয়েই তারা উচ্চরবে শোক করত; তাদের কিছু করার ছিল না যে, তাদের শোক এত মধুর শোনাত।’

৮.

বসি যত সহজে তত সহজে উঠতে পারি না। আমার ক্ষেত্রে তা বার্ধক্যজনিত। কিন্তু এর কি এক সাধারণীকরণও হয় না? সেদিন সন্ধ্যের যিনি তরুণতম অতিথি ছিলেন তিনি চোখ টিপলেন। তাই তো! চেয়ারে বসা যত কাঙ্ক্ষণীয় চেয়ার ছেড়ে ওঠা তত কাঙ্ক্ষণীয় নয়। চারদিকে কি তা-ই দেখি না? ব্যতিক্রম বড়ো কম। অথচ যথাসময়ে বসে যথাসময়ে ওঠাই তো ধর্ম।

৯.

হঠাৎ পেয়ে যাওয়া একটা অসমাপ্ত পুরোনো লেখার কয়েক অণুচ্ছেদ এখানে জুড়ে দিলাম। আশা করি এতে নিবন্ধ পাঠকের অমত হবে না।

মিগেল দে উনামুনো-র ‘নিয়েব্লা’ বেরিয়েছিল ১৯১৪-তে, আর তার বাংলা অনুবাদ ‘কুয়াশা’ বেরোল একশো বছর পার করে, ২০১৮-তে। অথচ এমন নয় যে হিস্পানি লেখক-দার্শনিক উনামুনোর নাম আমরা আগে শুনিনি। ইউরোপীয় আধুনিকতার বার্তা এসে যখন পৌঁছল এদেশে তখন এই উনিশ শতকে বেড়ে ওঠা (১৮৬৪-১৯৩৬) বিশ শতকী মননের প্রতিভূর সঙ্গেও আমাদের চেনা হয়। তবে যে খুব বেশি চেনা হয় তা বলব না। তাঁর আধবয়সী লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬) আমাদের মন কেড়ে নিয়েছিলেন। এবং বয়ঃকনিষ্ঠ হিমেনেসও (১৮৮১-১৯৫৮) বেশ খানিকটা কাছের হয়েছিলেন, শুধু [সেনোবিয়া কামপ্রুবি অনুপ্রাণিত] রবীন্দ্র-অনুবাদের জন্য নয়, তাঁর নিজের লেখার জন্যও। কিন্তু উপন্যাসে উনিশ শতকী বাস্তবতার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রথম যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের একজন উনামুনো। তাছাড়া যে-অস্তিত্ববাদী দর্শন বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপে শেকড় গাড়ে, তারও পূর্বাভাস কি উনামুনোতে ছিল না? ‘নিয়েব্লা’ পড়ে নিয়ে সার্ত্রের ‘নোসে’ বা কাম্যুর ‘লেত্রাঁজের’ পড়লে কি একটু চেনা গন্ধ পাওয়া যায় না?

‘নোসে’ বা ‘লেত্রাঁজের’ আমরা বাংলায় আগেই পড়ে ফেলেছি। এতদিন পরে যে আমরা ‘নিয়েব্লা’-র বাংলা পড়তে পারছি, তার জন্য আমরা ঋণী অনুবাদক অশেষ রায়ের কাছে, যাঁর হিস্পানি-জ্ঞান ঈর্ষণীয়। সেইসঙ্গে অনুবাদ পরিমার্জনার জন্য ভারতীয় হিস্পানি-চর্চার বর্তমান নায়ক শ্যামাপ্রসাদ গাঙ্গুলীর কাছেও। ‘কুয়াশা’-র চাইতে ভালো নাম আর হতে পারত না। ইংরেজি অনুবাদের নাম, হয় ‘মিস্ট’ নয় ‘ফগ’; ‘কুয়াশা’-র বিকল্প নেই। ছেপেছেন হিস্পানি সরকারের অনুদানে কলকাতার র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। উভয় প্রতিষ্ঠানকে সাধুবাদ। কিন্তু মুদ্রণে আরও যত্ন নেওয়া উচিত ছিল প্রকাশকের।

৩৩টি পরিচ্ছেদ + উপসংহার - এই নিয়ে এ-উপন্যাস তথা হিস্পানি ‘নোভেলা’ বা উনামুনোর ‘নিভোলা’। ‘নোভেলা’ থেকে ‘নিভোলা’-ই তাঁর বিপ্লবের ধ্বজা। গল্প আউগোস্তকে নিয়ে (আউগোস্ত নামে কি একটু ঠাট্টা আছে?)। প্রথম বাক্যেই দেখা গেল সে তার বাড়ির বাইরে যাবার দরজায়, তার ডান হাত বাড়ানো, খোলা, চেটো নিম্নমুখী, চোখ আকাশপানে তোলা, মুহূর্তের জন্য স্থির, এক মূর্তিসম দণ্ডায়মান, সম্ভ্রান্ত। দস্তয়েভস্কিতে রাস্কলনিকভের নির্গমন একেবারে আলাদা - চরিত্রসম্মত, কিন্তু দেশকালের বাইরে নয়। এখানে দেশকালের বালাই নেই। কোনো বিবরণ নেই রাস্তাঘাটের। বা বাড়িঘরের। আউগোস্তর গন্তব্য? কোনো কুকুর হাঁটলে তার পিছন পিছন যাওয়া যেত। বদলে, এক যুবতীর দুই মোহিনী চোখের টানে এ-রাস্তা ও-রাস্তা করে শেষ পর্যন্ত তার বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেল সে। এবং সেই বাড়ির তত্ত্বাবধায়িকাকে ঘুষ দিয়ে যুবতীর খোঁজখবরও নিয়ে নিল। ‘প্রেম’? ধরা যাক তা-ই। যুবতীর নাম, এউখেনিয়া, যেন এক মন্ত্র এখন তার কাছে। বাড়ি ফিরে এক প্রেমপত্রও লিখে ফেলল। এবং তা ওই তত্ত্বাবধায়িকাকে পৌঁছে দিতে যখন সেই সন্ধ্যেয় যুবতীর ঠিকানায় হাজির হচ্ছে, তখন খেয়ালও করল না যে যুবতীটি তার পাশ দিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কেন এই অনবধান?

এই প্রশ্নের উত্তরে এক রহস্য লুকিয়ে আছে এ-উপন্যাসে, তথা তার মুখ্য চরিত্রে। আউগোস্ত যত না কথা বলে অন্যের সঙ্গে, তার চেয়ে বেশি কথা বলে নিজের সঙ্গে। এই স্বগতোক্তিপ্রবণতা তার চরিত্রলক্ষণ। তার স্বাভাবিক অবস্থাই এক আচ্ছন্নের।

১০.

এমনি আরেক হঠাৎ পাওয়া পুরোনোর প্রথম অণুচ্ছেদ।

আজ তিরিশে নভেম্বর, আমার দুই শ্রদ্ধাভাজন, বুদ্ধদেব বসু ও রাধারানী দেবীর জন্মদিন। তাঁরা দুজনেই তাঁদের জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে এসেছেন - বুদ্ধদেব বসু ২০০৮-এ, রাধারানী দেবী তার কয়েক বছর আগে, ২০০৩-এ। আর এ-বছর, মানে ২০১৮-তে যিনি জন্মশতবর্ষ পেরোচ্ছেন তিনি রাজেশ্বরী দত্ত। তবে তাঁর শতবর্ষপূর্তি হয়ে গেছে ১৭ এপ্রিল। যাঁরা রবীন্দ্রসংগীত মন দিয়ে শোনেন তাঁরা কেউ কেউ হয়তো সেদিন তাঁকে স্মরণ করেছিলেন। সভা বা বক্তৃতার কথা বলছি না, বলছি তাঁর রেকর্ড শোনার কথা, তাঁর গায়নে ডুব দিয়ে থাকার কথা। ধরা যাক, যে-সিডি শুরু হচ্ছে ‘এ কী করুণা করুণাময়’-তে তার সব গান কি বার বার শুনতে ইচ্ছে করে না - বিশেষ করে শেষ গান, ‘এ মোহ-আবরণ’? এবং কেউ কেউ হয়তো তাঁর স্বামী সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও স্মরণ করেছেন সেই সঙ্গে। রেডিওতে তাঁর গান থাকলে যে সুধীন্দ্রনাথ ট্রানজিস্টর খুলে নিয়ে তা শুনতেন চুপ করে, সেই স্মৃতিও হয়তো তাঁর কাছে আসা স্নেহার্থী কারো কারো মনে জেগে উঠেছে।