আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
শুশ্রূষা যেখানে ব্যবসা
পারমিতা গোস্বামী ও শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
শুনছেন? শুনতে পারছেন কি?
শোনা যাচ্ছিল বটে। কিন্তু শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। অবশ লাগছিল। একটা কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন বেরোতে কিঞ্চিৎ দেরি হয়। একটু তাড়াহুড়োয়, অসাবধানে এই কান্ড।
যখন তুলে ধরে হেল্থ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দেখা যায় পালস খানিক দুর্বল। কিন্তু জ্ঞান হারাইনি আমি। সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ডাক্তার সিটি স্ক্যান করতে বলেন মাথায় ব্লাড-ক্লট হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তার জন্য যেতে হবে বড়ো হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে জানা গেল ওষুধ দিয়ে চব্বিশ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখবেন তারা।
পরে জিজ্জেস করে জানা গেল, যে ওষুধটি দেওয়া হয়েছে, সেটির নাম লেভিপিল। গুগল করে দেখলাম সে তো অ্যান্টি-এপিলেপ্টিক ড্রাগ। জানলাম তার ভয়ানক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া - আত্মহত্যাপ্রবণতা ও শ্বাসরুদ্ধতা। যদিও সে ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো সন্ধান-বার্তা দেননি। তারা কেবলই জানিয়েছিলেন যে স্বাস্থবীমার সুবিধে পেতে গেলে হাসপাতালে অন্ততপক্ষে একদিন থাকা বাধ্যতামূলক এবং এই ওষুধটি চ্যানেল বানিয়ে ইঞ্জেক্ট করতে হবে।
না আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম, না আমার মৃগীরোগের কোনো ইতিহাস আছে। তাহলে এত কিছু কেন? কথা বললাম এক ডাক্তারবন্ধুর সাথে। তিনিও উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন যে অ্যান্টি-এপিলেপ্টিক ড্রাগ প্রতিষেধক হিসেবে দেওয়া উচিত নয়। তিনি উপদেশ দিলেন বন্ড সই করে বাড়ি ফিরে আসতে। এক সহকর্মীর পরিচিত এক ব্যক্তিকে অযথা এইসব ওষুধ দেওয়ার মারাত্মক বিফল সম্বন্ধে পরিচিত ছিলাম।
এক বছর আগে, অন্য একটি স্বাস্থ্যজনিত কারণে বহু ডাক্তার আমাকে হিস্টেরেক্টমি করার পরামর্শ দেন। অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বিয়োগ করার প্রণালী হিস্টেরেক্টমি। মহিলাদের শরীর একটি বয়সের পর প্রজননের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে - পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে তেমনটাই বুঝিয়ে এসেছে। যদিও এ ক্ষেত্রে ডাক্তাররা এই অপ্রয়োজনীয়তার সাথে জুড়ে দেন আরেকটি কারণঃ ক্যান্সারের ভয় ও সম্ভাবনা। যদিও হিস্টেরেক্টমি করার পর অন্যান্য জটিলতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ডাক্তাররা এড়িয়ে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রুগীকে কোনো বিকল্পই দেওয়া হয় না। ভয় ও অনিশ্চয়তা বপন এখানে পুরোদস্তুর ব্যবসার খাতিরে, যেমন আরও বহু অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।
সমীক্ষা বলছে, ভারতে প্রায় সত্তর শতাংশ হিস্টেরেক্টমি করা হয় বেসরকারি হাসপাতালে আর তার মধ্যে পঁচানব্বই শতাংশ অপ্রয়োজনীয় - অর্থাৎ না করলেও চলে। বিশ্বে চল্লিশ শতাংশ মহিলার হিস্টেরেক্টমি করা হয় পঁয়ষট্টির আগে। এর মধ্যে মাত্র দশ শতাংশের উদ্দেশ্য ক্যান্সার দমন।
যাইহোক, বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসি। আমি ডাক্তারকে স্পষ্ট করে জানালাম যে আমি ইঞ্জেক্ট করা ওষুধ আর নেবো না। তিনি রেগেমেগে উত্তর দিলেন - আমরা যা করছি আমাদের করতে দিন, নচেৎ যা বিল উঠবে আপনাকে দিতে হবে। স্বাস্থ্য-বীমা থেকে এক পয়সা পাবেন না। হাসপাতাল ইতিমধ্যেই আমাকে দু' দফায় অ্যান্টি-এপিলেপ্টিক ইনজেকশন দিয়ে ফেলেছিল চ্যানেল করে। তৃতীয়বার দেওয়ার সমস্ত জোগাড়ও করে ফেলেছিল। আমি এবার নিতে অস্বীকার করি। এই অপকর্মে সায় দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। না আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম; না আমার মৃগীর কোনো পূর্ব ইতিহাস আছে; না অ্যান্টি-এপিলেপ্টিক ইনজেকশন প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাহলে হচ্ছেটা কী?
যেটা হচ্ছিল সেটা খোলাখুলি লোক ঠকানো। সমস্যা হল এই যে, এই জোচ্চুরির পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও আছে। রয়েছে বড়ো মাপের বাণিজ্যিক স্বার্থ। আমাকে ভর্তিই রাখা হয়েছে যাতে স্বাস্থ্য-বীমার টাকা অযথা শুষে খেতে পারে হাসপাতাল। নিছক মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি - তার জন্য এতো কিছু করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। সজ্ঞানে থেকে যদি এই লুন্ঠন ও শোষণের শিকার হতে হয়, তাহলে যে সজ্ঞানে নেই, যে কোনোরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থাতেই নেই - তার কথা বলাই বাহুল্য। একবার এই চক্রে প্রবেশ করলে আর নিস্তার নেই কারণ প্রতিষ্ঠান ও তার স্বার্থরক্ষীরা আপনার হয়ে সকল সিদ্ধান্ত নেবে। আপনার আমার কিছুই করার থাকবে না - অর্থের যোগান দিয়ে যাওয়া ছাড়া। তারাই ঠিক করবে আপনাকে কতদিন ধরে আটক করে রাখা হবে, আপনার ওপর কি ওষুধ বা অস্ত্রোপচার চলবে। এক কথায় আপনার শরীর আপনার এবং আপনার পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এ কথা আমাদের সকলেরই জানা বা এমন অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের সকলেরই হয়েছে, কম বেশি।
আমাদের অনেকের জীবনেই এমন বহু অভিজ্ঞতা আছে এই শোষণ প্রক্রিয়ার। এমন বহু নিদর্শন যেখানে মানুষের জীবনের শেষ ক'টা দিনের মূল্য আদায়-কাঁচকলায় বুঝে নিয়েছে হাসপাতাল। প্রায় মৃতকে দিনের পর দিন ভেন্টিলেটারে রেখে দিয়েছে হাসপাতাল অযথা বিল বাড়াবার তাগিদে। শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে দেয়নি। স্বাস্থ্য-বীমার শেষ কানাকড়ি চুষে তারপর মৃত ঘোষণা করেছে। অথবা বিলের সবটা মেটাতে না পারলে মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়নি পরিবারের হাতে। পাইপ টিউব মেশিনের দ্বারা পরিবৃত হয়ে কেটেছে অবচেতনে।
বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোটা পরিকাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে ধনতন্ত্রের মূল মন্ত্র মেনেঃ আরও আরও মুনাফা। সেখানে রোগী মাত্রেই সে এক ক্রেতা ভিন্ন কিছু নয়। যার সেই ক্রয় করার আর্থিক সামর্থ নেই, তার জন্য হাসপাতালের দ্বার রুদ্ধ। সেবা সেখানে প্যাকেজ মাত্র। ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্ক মাঝে বিস্তর সংঘাত, অনাস্থা, বিবাদ ও বচসা। সম্পর্ক ও ক্ষমতার বাটখারাটি অসাম্যের। অধিকাংশ ডাক্তারি বিদ্যা ও পদ্ধতি সাধারণ মানুষের অগোচরে আর সেই অজ্ঞাত পরিসরের মুনাফা লুঠতে ওঁৎ পেতে রয়েছে একটা গোটা ব্যবস্থা। অসুখ হলে আপনি প্রকৃত অর্থেই অসহায় সেই ব্যবস্থার সামনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা বলা হবে, আপনি তা শুনতে বা করতে বাধ্য। তাছাড়া আর কোনো বিকল্প আপনার সামনে নেই।
ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের অপকর্মের ওপর। ডাক্তার, তাদের প্রশাসন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি - সবার শেয়ার সেখানে আগে থেকেই ভাগ করা রয়েছে। সকলেরই রয়েছে টার্গেট কমিশন কাট। অযথা এটা সেটা করিয়ে বিল বাড়িয়ে যাওয়া, বেশি দিন হাসপাতালে রেখে দেওয়া, ক্রমাগত ভয় ঢুকিয়ে আরও টেস্ট বা অপারেশন করিয়ে নেওয়া - এ সকলই সিস্টেমের মজ্জাগত। অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের পদোন্নতিও পুরস্কারের চাবিকাঠি - রোগ নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে শুশ্রূষা আপসেল বা আপস্কেল করার ওপর। তারা যা করতে বলছে ও যা যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, নেই শুধু সেগুলোর ওপর যথেচ্ছ আইনি নিয়ন্ত্রণ ও অডিট। সেবার মানবিকতা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও না। মাথাব্যথা রয়েছে পুঁজি বৃদ্ধির খাতিরে আরও আরও টেস্ট, স্ক্যান, ওষুধ, অস্ত্রোপচার ও প্রেসক্রিপশন হাঁকানো। গোটা ব্যাপারটাই প্যাথোলজিকাল, দুস্প্রবেশ্য, একতরফা - খরচ বাড়িয়ে আপনাকে নিংড়ে নেওয়ার জোগাড়। সেখানে সাধারণ মানুষ ব্যবস্থার সামনে অসহায়।
সেখানে একবার ভর্তি হওয়া মানেই ওদের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আইসিইউ-র কাঁচ স্বচ্ছ হলেও সিস্টেমটা বেজায় অস্বচ্ছ। আপনার জ্ঞান সেখানে সীমিত। পরিবারের প্রবেশাধিকার নিমিত্তমাত্র বা নিষিদ্ধ। লোভী সেই সিস্টেম চাইলে আপনাকে সবরকমভাবে অপদস্থ করতে পারে। আপনার প্রতিরোধ করার বা পালাবার বিশেষ জায়গা নেই। শুশ্রূষা যেখানে ব্যবসা, সেবা বা সমতা সেখানে প্রাধান্য পেতে পারে না।