আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
২০২৪ সালের পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
২০২৪ সালের পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের খবরটি বিজ্ঞানীদের দুনিয়া ছাড়িয়ে আম জনতার দরবারে ক্ষুদ্র সুনামি না হোক, বিরাট টাইফুন-এর জন্ম দিয়েছে। এর পেছনে অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত সেই বাজারের 'অদৃশ্য হাত'-এর যাদুদন্ডের ছোঁয়াকে আজ আর অস্বীকারের স্থান নেই। ব্রহ্মাণ্ডকে দেখার, জানার ও তার পর সাম্যান্যায়নের মাধ্যমে তত্ত্বে উপনীত হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বের পর এত বড় এক ওলটপালট সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায় নি।
ওয়াল স্ট্রিট, দালাল স্ট্রিট, টোকিও, বেজিং প্রভৃতি লগ্নি পুঁজির পীঠস্থানগুলি, পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি জগতের 'হার্ডওয়ার' এবং 'সফটওয়ার' ব্যবসার ব্যারনবৃন্দ একযোগে বৃন্দগান মারফৎ সারা পৃথিবীকে এই 'বিশেষ তথ্যটি' জানান দেওয়ার মহান ব্রত নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানে প্রচার করেছে যে এবারের পুরস্কারটি আসলে 'কৃত্রিম বুদ্ধি ও তৎসংক্রান্ত তাদের কাজের স্বীকৃতি'!
আমরা দেখি, রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি যে দুজন বিজ্ঞানীকে ২০২৪-এর নোবেল প্রাইজ প্রদান করেছেন, তাঁরা ঠিক কী কারণে এই দুজন বিজ্ঞানীকে প্রাপক হিসেবে বেছে নিলেন। তাঁদের প্রদত্ত 'নোবেল সাইটেসন'-এর স্বচ্ছন্দ অনুবাদ হতে পারে এইরকমঃ এ বছরের (২০২৪) নোবেল পুরষ্কার প্রাপকদের দুজন, জন হপফিন্ড, মার্কিন দেশের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জিওফ্রে হিনটন, কানাডা-র টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের, তাঁরা যুগ্মভাবে 'মেশিন লার্নিং' বিষয়টির তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে জন হপফিল্ড দেখিয়েছেন কীভাবে একটি কাঠামোর মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ করা এবং সেই সংরক্ষণ থেকে তথ্যের পুনর্নিমাণ করা সম্ভব। আর জিওফ্রে একটি সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে এক বৃহৎ ও অতি বৃহৎ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা তথ্যাদির ধর্মগুলিকে আবিষ্কার করা সম্ভব।
একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যার নিরীক্ষামূলক অঢেল প্রমাণ মিলেছে, তাকে আজকের যুগের ব্যবসার ফল হিসেবে দেখানোর পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণকে বেপর্দা না করলে প্রতি বছর মানবজাতির শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলির ফল, মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডারে যুক্ত না হয়ে তা বহুজাতিক ব্যবসায়িক সংস্থার পেটেন্ট দলিলে চিরকালের জন্য আবদ্ধ থেকে সামাজিক ফসলকে ব্যক্তিগত মুনাফার ক্ষেত্র করার চক্রান্তটি অব্যাহত থেকেই যাবে।
পদার্থবিজ্ঞান এই মেশিন লার্নিং নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাক্ষেত্রটিকে গাণিতিক অনুমান, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাশির মান নির্ধারণ করা সহ তাত্ত্বিক কাঠামো সরবরাহ করেই আসছে সেই ১৯৪৬ সাল থেকেই - এই কথাগুলি ব্যবসায়ীদের বর্তমান আলোচনায় ঊহ্য থেকেই যাচ্ছে। অতীতেও নিউরাল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক কাজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘটনা বিরল নয়। যেমন ধরা যাক, কয়েক বছর আগে সাড়া জাগানো হিগস্ বোসন-এর অনুমানের পক্ষে নিরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের কথাটি। বিপুল পরিমাণ তথ্যের অরণ্য থেকে অন্যান্য অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলিকে বর্গীকরণ করে, আলাদাভাবে সাজিয়ে এবং ভবিষ্যতে বিশ্লেষণের জন্য সরিয়ে রেখে কেবল হিগস্ বোসনের অস্তিত্ববাহী তথ্যাদি এক জায়গায় করে সেই তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে হিগস্ কণার অস্তিত্ব ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছিল একটি অতি বৃহৎ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতার সাহায্য নিয়েই। আরও অনেক আগে জোসুয়া লেডারবার্গ সেই সময়ে লভ্য বোধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা আসলে আজকের এই নিউরাল নেটওয়ার্কের 'রকমফের' ভাবা যেতে পারে, বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগের জটিল কাঠামো যথাযথভাবে অনুমান করেন এবং সেই অনুমান বাস্তবে বিদ্যমান যৌগগুলির কাঠামোর সঙ্গে প্রায় খাপে খাপে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনে ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব, মহাজাগতিক পাড়ি জমানো, ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়গুলিকে ২০২৪ সালের নোবেল পুরষ্কার প্রাপক এই দুই বিজ্ঞানীর নির্মিত কাঠামো এবং সেই কাঠামো নির্মাণের পদ্ধতি ব্যাপকহারে ব্যবহৃত একটি হাতিয়ার।
বিষয়টি কয়েকটি ঘরোয়া উদাহরণ দিয়ে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করা যাক। আপনার হাতে আপনার দিদিমার সেই পুরোনো দিনের ফিকে হয়ে আসা একটি সাদা-কালো ছবি এসেছে। সেই ছবির কপালের দিকের একটা অংশ একেবারে খেয়ে গেছে। পাড়ার স্টুডিও-তে গেলেন। যে তরুণটি তার কম্পিউটারের সামনে ঝুঁকে পড়ে পর্দাজোড়া একটা ছবিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করার চেষ্টা করছে, আপনি তার হাতে আপনার দিদিমার ছবিটা দিলেন। তিনি আপনার ছবিটি স্ক্যান করে সেই নমুনাটি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে খুলে এদিক ওদিক করে, ছবিতে রং-এ প্রায় আগের জেল্লা এনে, দিদিমার কপালের অন্তর্হিত অংশটিও প্রায় ফিরিয়ে আনলেন। এই কাজটি সম্পন্ন হল যে প্রক্রিয়া ও কাঠামো ব্যবহার করে, তাকে আজকে আমরা তথ্য থেকে চিত্র পুনর্নির্মাণ বলে থাকি, যেটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর কাঠামো ও পদ্ধতি ব্যবহার করে; এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আজকে 'ফেস রিকগনাইজার' বানানো হয়েছে। ঠিক যেমন আমাদের মস্তিস্ক আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে থাকা অস্পষ্ট ছবিটি আমরা স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়সাধন করে মুখ এবং সেই মুখের ছবির অধিকারী ব্যক্তির পরিচয় পুনর্নির্মাণে সক্ষম হই, ঠিক তেমনি এই নিউরাল নেটওয়ার্ক বলে বর্ণিত কাঠামোটি সংরক্ষিত তথ্যের জন্য এই একই কাজ করে থাকে - অর্থাৎ এই কাঠামোটি তার আগাম তথ্য হিসেবে এই তথ্যগুলিকে গ্রহণ করে, তারপর সেই তথ্যের ওপর প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, অন্যথায় বিষয়টি 'শিখে যায়' - যেমন আমরা অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে শিখতে থাকি!
এই প্রক্রিয়ার ইতিহাস খানিকটা প্রাচীন। ওয়ারেন ম্যাককুলো এবং ওয়াল্টার পিটস এই জাতীয় একটি কাঠামোর কথা সেই ১৯৩৯-এ প্রস্তাব করেন এবং তার পর গত শতকের চারের দশকে এই ধারনাকে একটি তাত্ত্বিক ও গাণিতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। বিষয়টি একটি চিত্তাকর্ষক নামও নেয় - 'প্যাটার্ন রিকগনিশন' বা 'ছক খোঁজার কাজ'। এই কাজের থেকে আমরা আগে থেকেই জানা তথ্য, যা অন্যান্য তথ্যের অরণ্যে গা-ঢাকা দিয়েছিল, সেগুলিকে প্রকাশ্য করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এর থেকে 'জ্ঞান', অর্থাৎ নতুন কিছু জানা সম্ভব ছিল না। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল জন হপফিল্ড-এর জন্য, যখন তিনি তাঁর 'হপফিল্ড নেটওয়ার্ক'-এর ধারণা প্রস্তাব করেন (১৯৮২ সালে)।
এই কাঠামোটি নির্মাণের পেছনে গত দুই শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কাঠামোর ইতিহাসটি লুকিয়ে রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যাকে 'স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিক্স' বলা হয়, যেখানে অসম্পূর্ণ তথ্যভাণ্ডার থেকে তার পেছনে সার্বজনীন মূলনীতি অনুমান করার প্রমাণিত পদ্ধতিটির নানান রূপ আজকের 'মেশিন লার্নিং', 'নিউরাল নেটওয়ার্ক' ইত্যাদি বিষয়গুলির ভিত্তিপ্রস্তর। হপফিল্ড-এর আগে যেসব এই ধরণের নিউরাল নেটওয়ার্ক নির্মিত হয়েছিল, সেগুলি লুকিয়ে থাকা তথ্য খুঁজতে দক্ষ ছিল। হপফিল্ড নেটওয়ার্কটি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে যে বিষয়টি আমরা অনুমান করতে চাইছি তার একটি সম্ভাব্য অনুমান হাজির করতে পারে। যেমন আমরা আগে দিদিমার চিত্রের পুনর্নির্মাণের যে উদাহরণটি দিয়েছিলাম, সেখানে ফিরে যেতে পারি। এই উদাহরণে আমরা যদি হপফিল্ড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতাম, তাহলে এই কাঠামোটি আমাদের নিজে থেকেই, মানুষের খবরদারী ছাড়াই দিদিমার চিত্রের একটি পূর্ণ, অর্থাৎ খেয়ে যাওয়া অংশটি নিজে থেকেই পুনর্নির্মাণ করে আমাদের ফেরত দিত! এই দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা জ্ঞানার্জনের দৃষ্টিকোণ থেকে এক বিরাট পদক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছি। এই বিষয়টিকে এআই, বা 'আর্টিফিসিয়াল ইনটালিজেন্স' কাঠামোর অন্তর্গত করার তাত্ত্বিক দিক থেকে রূপায়ণের বাস্তব সমস্যার সমাধান সহজে করা যায় নি।
এই কাজটি সম্পন্ন করলেন ২০২৪ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার প্রাপক অন্য বিজ্ঞানী, জিওফ্রে হিনটন। এআই-এর অন্যতম স্থপতি, অ্যালান টুরিং যেমন একটি তাত্ত্বিক যন্ত্র, টুরিং মেশিন-এর প্রস্তাব দিয়ে বিজ্ঞানের এই বিশেষ বিভাগের সূচনা করেন, হিনটন তেমনি এক অনন্য যন্ত্রের ধারণা আনলেন, যার নাম 'বোল্টজম্যান মেশিন' (চিত্র-১ দেখুন)।
চিত্র ১:
চিত্রঋণঃ © Johan Jarnestad/The Royal Swedish Academy of Sciences.
উপরের ছবিতে, যেটি হপফিল্ড নেটওয়ার্ক বলা হয়েছে, সেখানে কতকগুলি গোলাকৃতি ও কতকগুলি রেখা রয়েছে, যে রেখাগুলি এই গোলাকৃতি বস্তুদের জুড়ে দিয়েছে। এই ছবির চেহারা জালের মতো, যেখান থেকে এই নেটওয়ার্ক নামটি এসেছে। এই গোলাকৃতি বস্তুগুলিতে আমরা তথ্য জোগান দিই এবং এই জালের মতো কাঠামোটি আমাদের প্রক্রিয়াকৃত তথ্য ফেরত দেয় সেই গোলাকৃতি বস্তু মারফৎ। স্পষ্টই এই 'যন্ত্র'টি একটি নক্সা, কোনও আসল যন্ত্র নয়। কিন্তু এই চিত্রের সুবিধা হচ্ছে একটি গোল বস্তু যদি একটি ডিজিটাল সঙ্গীত প্লেয়ার হয় এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত অন্য একটি গোল বস্তু যদি একটি হেডফোন হয়, তবে এই চিত্রটির সাহায্যে আমরা একটি 'অডিও নেটওয়ার্ক' নির্মাণ করলাম। এইভাবে গোলাকার বস্তু এবং রেখাগুলির চরিত্র আমরা যদি ঠিক করে দিতে পারি, তাহলে এই একই নক্সা ব্যবহার করে আমরা অন্যান্য নেটওয়ার্ক নির্মাণ করে নিতে পারব।
দ্বিতীয় ছবিটি আসলে এই জাতীয় একটি নেটওয়ার্কের নক্সা, যা হিনটন এঁকেছিলেন, যার নাম 'বোল্টজম্যান মেশিন'। এই মেশিন-এ তিনি একটি লুকোনো বা 'হিডেন' স্তরের প্রস্তাব দেন, যার মাধ্যমে তথ্যকে অনেক ব্যাপ্তভাবে, অনেক দিক থেকে বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। এই মেশিন আমাদের বলে দিতে পারে কেবল দিদিমা কেমন দেখতে ছিলেন তাই নয়, এই মেশিন দিদিমার ছবির হারিয়ে যাওয়া অংশকে যথাযথভাবে তার প্রায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, দিদিমাকে অন্য পরিবেশে, অন্য সাজে কেমন দেখাতে পারে তার এক সম্ভাব্য চিত্র হাজির করে দেবে। অর্থাৎ, চিত্রতে যা নেই, সেই তথ্যও এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। আমরা অভিজ্ঞতা খাটিয়ে এই অনুমান করে থাকি, এটাই আমাদের জ্ঞানের প্রকাশ। এখন এই মেশিনটি আমাদের হয়ে সেই জ্ঞানের 'অধিকারী' হয়ে উঠল। এটা প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি জ্ঞানতত্ত্বের বিষয়, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে রূপায়িত হচ্ছে।
আমরা যখন আমাদের জানা, কিন্তু ঠিক তক্ষুনি স্মরণে না আসা কোনও একটি শব্দের সন্ধানে আমাদের জানা এবং মনে পড়া শব্দের কাছাকাছি শব্দভাণ্ডার হাতড়ে, অর্থাৎ খোঁজাখুঁজি করে এক সময়ে অভিপ্রেত শব্দটিকে স্মরণে এনে ফেলি, তখন আমরা যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করি তাকে আজকে বলা হয় 'অ্যাসোসিয়েটেড মেমরি' বা সংযুক্ত স্মৃতি। এটি হপফিল্ড-এর অবদান, যা তিনি ১৯৮২ সালে প্রস্তাব করেন। কীভাবে নিয়মিত দূরত্ব বজায় রেখে সজ্জিত আধান-যুক্ত কণার ঘূর্ণন একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে, সেই তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধানের সময় তিনি তাঁর এই সংযুক্ত স্মৃতির ধারনায় উপনীত হন। তাঁর এই ধারনার ব্যাখ্যার জন্য আমরা চিত্র-২-এর সাহায্য নেব। পরের পর পাহাড় আর মাঝের উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে নদী যেমন পথ খুঁজে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপত্যকায় পৌঁছে তারপর ভূমির স্বাভাবিক ঢাল বরাবর প্রবাহিত হয়, হপফিল্ড জানালেন এই কাজটিই করে আমাদের সংযুক্ত স্মৃতি। চিত্র-২ থেকে আমরা যে কথাগুলি বলতে চাইছি, সেগুলি ১, ২, ৩... করে সাজিয়ে ফেলি। আমরা আমাদের তক্ষুণি তক্ষুণি মনে করতে না পারা শব্দটির কথা এই উদাহরণে ব্যবহার করব।
চিত্র ২:
চিত্রঋণঃ পূর্বোক্ত সূত্র।
১) আমার কাছে স্মৃতিতে যে শব্দভাণ্ডার রয়েছে, তা দিয়ে যেন এক পর্বতমালা আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে।
২) অতীতে আমি এই পর্বতমালা-রূপ স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে নানারকম শব্দ হাতড়ে বের করেছি। এই প্রক্রিয়ার নাম 'প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া'।
৩) এর রূপায়ণ হচ্ছে, আমি এমন এক সংযুক্ত উপত্যকার সন্ধানে ফিরছি, যার একটার পর একটা অতিক্রম করে আমি আমার অভীষ্ঠ শব্দটিতে উপনীত হবো।
এইবার আমি একটি বাস্তব উদাহরণ বেছে নিতে পারি, আমাদের সেই পরিচিত 'প্যাটার্ন রিকগনিশন' সমস্যাটি থেকে। আমার হাতে অসম্পূর্ণ তথ্য সম্বলিত একটি বিন্যাস বা প্যাটার্ন রয়েছে। ধরা যাক সেটি ইংরাজি বর্ণমালার অক্ষর J. কিন্তু সেই বিন্যাসটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটি 'জে' হওয়া সম্ভব। এবার আসি রূপায়ণের বিষয়টিতে। আমার হাতে একটা গোল বল রয়েছে (মনে করুন হপফিল্ড নেটওয়ার্কের সেই গোলাকৃতির বস্তু), যেটি আসলে আমার সেই অসম্পূর্ণ বিন্যাসের চেহারাটি। এখন আমি এই গোল বলটিকে ওপর থেকে আমার নির্মিত সেই পাহাড় ও উপত্যকার মডেলের ওপর নিক্ষেপ করলাম। গোল বলটি গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পাশে যে উপত্যকাগুলি রয়েছে, সেই বরাবর, ঠিক নদীর বা ঝর্ণার জলের পথ বেয়ে পাড়ি জমাবে, যতক্ষণ না বলটি আমার চারদিকে পাহাড় ঘেরা আর একটি অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে যায়। এইখানে পৌঁছে গেলে আমরা তখন সেখানে যে বিন্যাসটি সংরক্ষিত আছে, সেটি তুলে নেবো, এবং সেই বিন্যাসটি আদতে পর পর নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত স্মৃতিতে রক্ষিত বিন্যাসগুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানে পৌঁছে গোল বলটির গতি রুদ্ধ হল, সেটি আমাদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত ওই বিন্যাসের সর্বোত্তম রূপ, সেটি চিত্র-২-তে দেখানো হয়েছে, যে চিত্রটি থেকে বর্ণটি যে ইংরাজি বর্ণমালার অক্ষর J, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
হিনটন শুরু করলেন যেখানে হপফিল্ড থেমে গিয়েছিলেন। তিনি এখানে পদার্থবিজ্ঞানের 'স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিক্স'-এর ধারণা আনলেন। এই স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের মূল কথা খুবই সহজ, কিন্তু সেই 'সহজ' কথাটি বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য বিশেষ গাণিতিক নৈপুণ্য লাগে। এই বিজ্ঞানটির সবচেয়ে সফল প্রয়োগ হয়েছিল গ্যাসীয় পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে অনুমান প্রসঙ্গে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ও চাপে একটি বদ্ধ প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ গ্যাসের কণাগুলির সামগ্রিকভাবে ছুটে বেড়ানোর একটি গড় বর্ণনা এই বিজ্ঞানমতে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এইরকম গ্যাসের ক্ষেত্রে পরিমাপযোগ্য রাশির মান, যেমন তাপমাত্রা-আয়তন-চাপ, তার নির্ভরযোগ্য অনুমান নিরীক্ষালব্ধ মানের খুব কাছে ছিল। অথচ এটাই স্বাভাবিক যে একটি বদ্ধ প্রকোষ্ঠে বিভিন্নভাবে গ্যাসের কণাগুলি ছড়িয়ে পড়তে পারে, কতভাবে তারা ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই সংখ্যাটি গুণলে দাঁড়াবে একটি প্রকাণ্ড রাশি। এই ছড়িয়ে পড়া ধরলে প্রতিটি আলাদা আলাদা বিভিন্নতার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর থাকলেও তাদের পরিমাপযোগ্য রাশিগুলির গড় মান একই হবে। এটাই স্ট্যাটিটিক্যাল মেকানিক্স পদ্ধতির সার্বজনীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা। এই রকম প্রতিটি ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটার একটা সম্ভাবনা আছে, যার মান রাশিবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুমান করা যায়। এই কাজটি আমরা করতে পারি লুডভিগ বোল্টজম্যান প্রস্তাবিত একটি সমীকরণ থেকে। যেহেতু সমীকরণটির সার্বজনীনতা প্রতিষ্ঠিত, তাই হিনটন তাঁর নেটওয়ার্কের জন্য এই সমীকরণটি ব্যবহার করে তাঁর বোল্টজম্যান মেশিন-এর প্রস্তাব রাখেন, গবেষণাপত্রটি তিনি ১৯৮৫ নাগাদ প্রকাশ করেন।
এই দুই বিজ্ঞানীর কাজ আমাদের এআই এবং তার রূপায়ণ হিসেবে নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে নতুন জ্ঞান আহরণের তাত্ত্বিক ভিতটি গড়ে দিয়েছেন। এই তত্ত্বের সত্যতা গত তিন দশকের নিরীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে বলা যায় যে এআই-ভিত্তিক কোম্পানিগুলির মুনাফা-কেন্দ্রীক গবেষণা-ব্যবসা নয়, তা বিস্তৃত অর্থে সমগ্র মানবজাতির জ্ঞান ভাণ্ডারে এক অমূল্য সংযোজন হিসেবে দেখাই ঠিক হবে। ঠিক যেমন নিউক্লিয়ার বিভাজন আর নিউক্লিয়ার বোমা সমার্থক নয়, ঠিক তেমনি হপফিল্ড নেটওয়ার্ক ও হিনটন মেশিন আর এআই ব্যবসার মুনাফার তাড়নায় কর্মসংকোচন সমার্থক নয়। ব্যবসায়িক জগতের ঢক্কানিনাদে আমরা যেন এই প্রভেদটি বিস্মৃত না হই।