আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

পাঠক-পাঠিকা এবার সাম্মানিক চাইবেন

শুভময় মৈত্র


মোটের ওপর দুনিয়া জুড়ে পঁচিশ কোটি বাঙালি আছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত এক কোটি দিনে একশোটি শব্দ কোনো না কোনো মাধ্যমে আকাশপাতায় ভাসিয়ে দেন। অর্থাৎ ন্যূনতম একশো কোটি শব্দ। এর মধ্যে লাখখানেক শব্দ আপনার কাছে ঠুসে দেবেই জগৎ জোড়া জাল। চাইলে আপনি পুরোটাই খুঁজে পড়তে পারেন। তবে কোন অঙ্কেই তা সম্ভব নয়। দিনে ৮৬,৪০০ সেকেন্ড, ফলে তাত্ত্বিক অঙ্কে লাখটা বড়জোর সম্ভব।

আগে মোট লেখা পরিমাণে অনেক কম ছিল। চাইলে খাতায় কলমে লিখতে হতো। তারপর সেই লেখা ছাপানোর জন্যে সম্পাদক বা প্রকাশকের কাছে পাঠাতে হতো। কেউ না ছাপালে নিজের ইচ্ছায় বাড়ির সামনে বড় পোস্টার টাঙানো যেত - কিন্তু তাতে কত আর শব্দ বসাবেন? নিজের লেখা উপন্যাস কত ফটোকপি করবেন? রাস্তার মোড়ে ওত পেতে দাঁড়িয়ে কত পরিচিতকে চটজলদি দুটো সদ্য উদ্গীরিত কবিতা শোনাবেন? অর্থাৎ নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার সুযোগ আগে সীমিত ছিল। এখন গণকযন্ত্র এবং যোগাযোগের বৈদ্যুতিন মাধ্যম যে গণতন্ত্রীকরণ ঘটিয়ে দিয়েছে, তার মুখ্য উৎপাত হল কোনো ছাঁকনি ছাড়া লেখা ছাপা হওয়া। গান বা নাচের ভিডিও-ও একই অঙ্কে কষা যায়। অন্য সব ভাষাতেই এই ঘটনা ঘটে। যেহেতু মূলতঃ বাংলা ভাষায় নিজে লেখালিখি করি, অর্থাৎ নিজেই এই অপ্রয়োজনীয় শব্দ উৎপাদন প্রক্রিয়ার এক বড় অপরাধী, তাই এই রম্য রচনায় হুকোমুখো হ্যাংলার ভাষা নিয়েই আলোচনা জারি থাকছে।

এইখানে স্ববিরোধিতার মাত্রাটা বুঝতে হবে। নিজে লিখছি এমন একটা বিষয় নিয়ে, যেন আবোল তাবোল উৎপাদন করায় আমার বেদম আপত্তি। এদিকে লিখছি ছাইপাঁশ। স্ববিরোধিতা দুই হল একেবারে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। মাসের মাঝামাঝি সম্পাদক যদি লেখাটা আকাশপাতায় গ্রহণ করেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই লিংক আমি ছুঁড়ে মারবো চেনা পরিচিত লোকজনকে। তার উত্তরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকজন আদৌ না পড়ে সাধুবাদ জানাবে। সে আর এক মিথ্যে। বলুন তো এই লেখার মধ্যে প্রশংসা করার কী থাকতে পারে? অর্থাৎ এইরকম বকধার্মিকতা, সত্যের অপলাপ এবং প্যারাডক্স-এর সিকোয়েন্স চলতেই থাকবে। বিষয়টা যেহেতু একাধিক বৃত্ত দ্বারা আবৃত, তাই এখান থেকে বেরোনোর পথ নেই।

এইখানে ঠিকানা নিয়ে আর একটু কথা বলা যাক। এক তো হল, আপনি দুই দিস্তা লিখলেন। আগে হলে কার্বন বা ফটোকপি। তারপর না হয় আন্তর্জালের মাধ্যমে কাট পেস্ট করে ইমেইল। তাও তো কন্টেন্ট যেত। এখন তো হাইপারটেক্সট-এর দৌলতে শুধুই লিঙ্ক। লিখলেন কয়েক হাজার শব্দ। কিন্তু তার ঠিকানা মাত্র কয়েকটি অক্ষরে শেষ। ফলে সহজ হয়ে গেল পাঠানোর কাজটাও। সুতরাং শব্দ উৎপাদন হবে হাজার-লক্ষ-কোটি আর পাঠানোর কাজটা ছোট্ট ঠিকানার মাধ্যমে। এবার প্রশ্ন হলো কন্টেন্ট পড়বে কে?

পড়বে সেই মানুষই। তবে দিনকাল যা আসছে তাতে এরপর আমার নামে গণকযন্ত্র লিখে দেবে, আর আমার বন্ধুদের নামে তাদের মুঠোফোনগুলো হাততালি দিয়ে দেবে কিংবা বুড়ো আঙুলের কাঁচ-কলা। আমার যন্ত্র তারপর গুণে বলবে ক-হাজার জন পড়লো, এবং বিভিন্ন চিহ্ন দিল। আমি সেটা শুনেই খুশি। অর্থাৎ বিষয়টার মধ্যে সত্যিকারের লেখা পড়া কিছু থাকল না। সবটাই করল যন্ত্র। একটু খুঁটিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন, সঠিক অর্থ দিলে আপনার আঁকা ছবি যে অনেকে দেখেছে, আপনার গাওয়া গান যে অনেকে শুনেছে, আপনার লেখা কবিতা যে অনেকে পড়েছে এটুকু আত্মপ্রসাদ আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া আদৌ শক্ত নয়। সঙ্গে এক ঝুড়ি প্রশংসা তো থাকবেই।

এবার প্রশ্ন হল যে তাতে ভালো লেখা কি হারিয়ে যাবে? অবশ্যই তার সম্ভাবনা বেশি। বহু বছর ধরে যে লেখক নামী হয়েছেন, তিনি তো জীবন বিজ্ঞানের নিয়মে গত হবেনই। আর এই মেটাভার্সের বাজারে নতুন কোন ভালো লেখার স্টাইল সাধারণভাবে থিতু হতেই পারবে না। ফলে মুজতবা আলী, তারাপদ রায়, নবনীতা দেবসেন এদের ধারাটাই আর তৈরি হবে না। স্টাইলে শুধু এঁনাদের নাম নিলাম কেন? তার একটা বিশেষ কারণ আছে। এঁনাদের লেখার ফাঁকে ফাঁকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান মজার কথা আসত, ইংরিজিতে যাকে 'উইট' বলে। অর্থাৎ স্টাইলের সঙ্গে মিশে থাকা উইট। আজকের দিনে অসংখ্য লেখার মধ্যে মজার কথা থাকে। দিনে যদি একলক্ষ মানুষ নিজের পারিপার্শ্বিক কোনো মজার কথা পঞ্চাশ অক্ষরে লিখে ভাসিয়ে দেন, তার মধ্যে সম্ভাবনার সাধারণ নিয়মেই খান দশেক অনবদ্য হবে। সেগুলো একেবারে সঠিক কারণেই ভাইরাল, এবং যেহেতু প্রত্যেকটা আলাদা মানুষের লেখা, তাই স্টাইল মিলবে না। ফলে আজকের দিনে বাংলায় আর ধারাবাহিকভাবে কোনো মজার লেখক আমরা খুঁজে পাই না। সত্যি করে পড়তে গেলেও খুঁজে পাই না। কারণ জনগণের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভিড়ে একক তিনি হারিয়ে যেতে বাধ্য।

এর একটা হাতে গরম উদাহরণ দিই। এই লেখাটি লিখছি মুঠোফোনে। কলকাতা থেকে মুম্বাই পৌঁছনোর পথে। "আমাদের দেশে এখন প্রায় সবটাই ইন্ডিগো। এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগেই জানিয়ে দিলো গেট ১০১। আমি প্রস্তুত। ছুট্টে যখন যাচ্ছি তখন চিরকুটে গেট বদল হয়ে ১০২। ভালো, নিঃশব্দ এয়ারপোর্ট। এরপর জানালো চল্লিশ মিনিট বিলম্ব। স্বাভাবিকভাবেই বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ কচলে দেখি এসএমএস বলছে ১০৪। আবার ছোটা। বয়স হয়েছে বলে আজকাল ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয়। সেখানেও ধুন্দুমার। কোণের দিকে একটা বড় বাথরুমে ধাক্কা দিলেও কোনো এক যাত্রী আধঘন্টা দরজা খুলছেন না বলে ধাঙর খুঁজে পেতে পুলিশ ডেকে এনেছে। নাটক অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে আসতে হল, কারণ বিমানবন্দর ছাড়বে। ১০৪-এর দিকে হাঁটছি, হঠাৎ এক অল্পবয়সী নেভি ব্লু পোশাক পরিহিতা মহিলা এসে ডাক দিলেন ‘ইন্ডিগো ফর কোচি’। যত বলি আমি কচি নই - বুড়ো, তিনি আমাকে ১০৩ গেটে কোচির প্লেনে তুলবেনই। অনেক কষ্ট করে তাঁকে বোর্ডিং পাস দেখিয়ে তবে ১০৪ অবধি পৌঁছনো গেল।" এবার এইটুকু লিখে বন্ধুদের কাছে পাঠানো মাত্রই তাদের জনা পাঁচেক ভালো বলল। তাদের হয়তো সত্যিই মূল বর্ণনা পড়ে মজা লেগেছে, কারণ এটা তো পাঠযোগ্য শ্লীল অংশ মাত্র। কিন্তু এই মজা এতটাই ক্ষণস্থায়ী যে তাতে সাহিত্যের দায় পূরণ হয় না। অর্থাৎ মোট কথায় ভালো সাহিত্য জারিত হওয়ার ক্ষেত্রে এক অসম্ভব বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ইন্ডিগোর স্যান্ডুইচ বা ইস্টবেঙ্গলের জয় বললে ছোট্ট শব্দবন্ধে বেশ খানিকটা উইট সৃষ্টি হয় সত্যি, কিন্তু তাকে দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে সমাধানের পথ কঠিন।

এইবার একটু ইতিবাচক উদাহরণে আসতে হয়। এখনও তো বাংলা ভাষায় বেশ কিছু ভালো পত্রপত্রিকা আছে যেখানে লেখা ছাপানো খুব সহজ নয়। তার মানে এটা বলতে চাইছি না যে ভালো জায়গায় ছাপা হওয়া মানেই লেখাটি ভালো। যেমন এই লেখাটি প্রকাশিত হতে চলেছে 'আরেক রকম'-এর ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ সংখ্যায়। এবারের বাকি লেখাগুলির মধ্যে রাজনৈতিক বা সামাজিক বিশ্লেষণের যে গভীরতা তা এই লেখায় নেই। ফলে এই লেখাটির মান খারাপ, হয়তো বা লেখাটির মানেও নেই। তবুও সেটি একটি পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হতে চলেছে। লেখাটি প্রকাশিত না হলে আরও ভালোভাবে নির্বাচন পদ্ধতির যথার্থতা বোঝানো যেত, তবে সে যুক্তি প্যারাডক্সিকাল।

এইখানে একটি বিষয় অনুপস্থিত তা হল আর্থিক লেনদেন। এই লেখাটি লেখার জন্যে কোন সাম্মানিক নেই, এবং এই লেখাটি অন্তর্জালে পড়ার জন্যেও কাউকে পয়সা খরচ করতে হচ্ছে না। আশা করি কোনো পাঠিকা বা পাঠক প্রতিযুক্তিতে নাক কুঁচকে "টাইম ইজ মানি" বলে লেখককে অপদস্থ করবেন না। কিন্তু সাহিত্যের সাধারণ হিসেব এমনটা নয়। সেখানে লেখিকা বা লেখক লিখে পারিশ্রমিক পান, এবং পাঠিকা বা পাঠক অর্থব্যয় করে পত্রপত্রিকা কেনেন। এই মডেল বিপদের মুখে, কারণ ভালো গান থেকে ভালো লেখা প্রায় সবটাই বিনামূল্যে জুটে যায় - কপিরাইট-এর জলাঞ্জলি। বিজ্ঞাপনের জোরে হয়তো কিছু পত্রপত্রিকা এখনও ঘটমান বর্তমান, যদিও ভবিষ্যত সুবিধের নয়। অর্থাৎ লেখার তুমুল গণতন্ত্রীকরণ পেশাদার লেখকের বৃত্তিকে প্রাগৈতিহাসিক করে দিতেই পারে। সেক্ষেত্রে সুনীল, শক্তি, সমরেশ, সঞ্জীব, শীর্ষেন্দুদের যে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা বলাই বাহুল্য।

এইখানেই উল্টো দিকটা আসবে। এমন মডেল কি তৈরি হতে পারে যেখানে লেখক লিখবেন, এবং পাঠককে সাম্মানিক দেবেন পড়ার জন্যে? কারণ লেখকের আনন্দ তো তাঁর লেখা পঠিত হচ্ছে এটা জেনেই। এই মডেল আংশিক বাস্তবায়িত হয় বই ছাপার ক্ষেত্রে। অনেকেই নিজে অল্প কিছু খরচ করে বই ছাপেন। মোটের ওপর কমবেশি বিক্রি হয়েও যায়। হয়তো বা কিছু বই চেনা লোকেদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। লেখকের নিজের তৃপ্তি আহরণের এটা একটা পথ এবং এই পথের কিছুটা বাণিজ্যিক মূল্য আছে। বিশেষ করে আজকের দিনে বইমেলার আগে প্রকাশকদের আয়ের একটা উৎস এটা, সে যতই সীমিত হোক না কেন। লেখকের দিক থেকেও নিজের সৃষ্টি গুছিয়ে আস্ত বই প্রকাশ করার মধ্যে যে ধৈর্য আছে, তা আন্তর্জালের মুহূর্তভিত্তিক সাময়িকতাকে অতিক্রম করার একটা বড় অস্ত্র। এইখানে পাঠক তো নিজে বই হাতে পেলেন, এবং ধরা যাক বিনামূল্যে। কিন্তু তিনি না পড়তেও পারেন। তাহলে লেখকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। সেইখানেই এমন মডেল আসতে পারে কি যে পাঠক পড়তে বাধ্য হবেন? ভয় দেখিয়ে পড়ানো যেতেই পারে, তবে সেক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই তৃপ্তি কম। তাই পাঠক যদি পড়ে কিছু সাম্মানিক পান, এবং কন্টেন্ট নিয়ে লেখকের সঙ্গে আলোচনা করেন, তাহলে মন্দ কী? মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে পুস্তক সমালোচনা করে সাম্মানিক পাওয়ার বিষয়টি কিন্তু প্রচলিত। অর্থাৎ ভালো পাঠক বা পাঠিকা হয়ে সারাদিন পড়লে এবং যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিলে রোজগার হতেই পারে, যদি না আবার সেই কাজটিও চ্যাট জিপিটি করে দেয়!

যেহেতু এই লেখা বিনির্মাণের, তাই সত্যকথনেই শেষ করা যাক। যদিও আমি মিথ্যে কথা বলি না এমন দাবি করছি না। এই লেখা পুরোটাই মুঠোফোনে, এবং সম্ভব হল প্রযুক্তি এবং সেই প্রযুক্তিকে আত্মীকরণের মাধ্যমে। লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠুক বারবার, কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ছাড়া এতটুকু সময়ের মধ্যে বারো তারিখের এই লেখা ষোলো তারিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, অবশ্যই যদি সম্পাদকের পছন্দ হয়। বিমান অবতরণের অব্যবহিত পরেই নেটওয়ার্ক পাওয়া মাত্র সম্পাদকের কাছে এই লেখা পৌঁছে গেছে। যারা পড়লেন, তাঁদের নিয়ে একটাই দুশ্চিন্তা - সাম্মানিক চাইবেন না তো?