আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

নদী সংযুক্তি যোজনা নিয়ে কিছু ভাবনা

অনিতা অগ্নিহোত্রী


২০২৩-এর ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের বড়বাণিতে ‘নর্মদা বচাও আন্দোলন’-এর অফিসে বসে মেধা পাটকরের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। পরিবেশের উপর সর্দার সরোবর বাঁধের প্রভাব, কোনো পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মাণ আরম্ভ, সেই প্রসঙ্গে মেধা বলছিলেন, প্রকল্প মানেই উন্নয়ন নয়। অথচ দুটোকে সমার্থক করে দেখানোর একটা চেষ্টা থাকে সরকারের পক্ষে। এই প্রবণতা গত এক দশকে বিশাল চেহারা নিয়েছে। পরিকাঠামো মুগ্ধতা যেন এক নব্য নার্সিসিজম। ফোর লেন বা সিক্স লেন হাইওয়ে, জঙ্গল নষ্ট করে তীর্থযাত্রীদের মোটর হাঁকানোর পথ তৈরি, বড়ো বাঁধ, দুর্গম দুই পাহাড়ি অঞ্চলকে যুক্ত করে সুড়ঙ্গ সহ পথ - এ সবই এখন বিনিয়োগের রাস্তা আর উন্নয়ন বিপণনের অ্যাভেন্যু।

এই সব উদ্যোগের প্রতিকূল প্রভাব আছে পরিবেশের উপর কিন্তু সে সব নিয়ে আলোচনা করার সময় সরকারের নেই। পরিবেশ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে থাকে পরিকাঠামোর বিপরীতে। কাজেই যাঁরা এ বিষয়ে কথা বলেন, তাঁরা প্রকারান্তরে দেশদ্রোহী। কর্মজীবনের গোড়ার দিকে ঊনিশ’শো আশির দশকে প্রথম শুনি নদী সংযুক্তি যোজনার কথা। মনে হয়েছিল, সহজ নয় এ কাজ। এবং যথারীতি সম্ভবত নানা দিক পর্যালোচনার পর জনসমক্ষে বিশেষ কিছু আসেনি। কেন ও বেতোয়া - মধ্যপ্রদেশের এই দুই নদী সংযুক্তির কথা আবার শোনা গেল ২০০৫ ও ২০০৮ সালে। ২৫ ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মশতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে এই প্রকল্পের শিলান্যাস হল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কেন ও বেতোয়া, দুটি নদীই যমুনার উপনদী এবং একই এলাকার। সংযুক্তির ফলে কেন-এর জল গিয়ে পড়বে বেতোয়াতে। ২২১ কিলোমিটার লম্বা, দুই কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল সহ মেইন ক্যানালের জলে ১১.৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে সেচের জল পাওয়া যাবে, বেশি মধ্যপ্রদেশে, কম উত্তরপ্রদেশে - পুরোটাই ২৩টি জেলায় ছড়ানো বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল। বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, এছাড়া সৌর শক্তি প্লাবিত হবে ১০টির মতো গ্রাম। স্বভাবতই তাদের পক্ষে জমির বদলে জমি পাওয়া কঠিন হবে এবং নর্মদাতে যেমন হয়েছে, প্রান্তিক আদিবাসী বর্গের মানুষজন ভূমিহীন শ্রমিকে পরিণত হবে। আপাতত প্রকল্পের প্রথম অংশটি অনুমোদিত হয়েছে। পান্না জেলার অরণ্যের মধ্যে তৈরি হবে দুধওয়া বাঁধ। তার জন্য ভূপতিত হবে কয়েক লক্ষ গাছ, প্লাবিত হবে অরণ্যভূমি। প্রকল্প বিষয়ে শুনলে বোঝা যায়, নদী সংযুক্তির কাজটিকে ঐশ্বরিক ক্ষমতায় করার আগ্রহে পরিবেশের উপর তার প্রভাব সরকার বিশেষ অনুধাবন করেননি। কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে দুটি রাজ্য সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। সর্দার সরোবর বাঁধ নির্মাণের সময় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পক্ষ থেকে ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’ এই প্রশ্নটি তুলেছে। যদি একটি নির্দিষ্ট আয়তনের এলাকায় জলসেচন করতেই হয়, তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কি আছে? তার জন্য কি এত এলাকা নিমজ্জিত করা জরুরী? কেন-বেতোয়া সংযুক্তি প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচ ২০২১ সালের মূল্যে ৪৪ হাজার কোটিরও বেশি। শেষপর্বে এসে এই খরচ কোথায় দাঁড়াবে আর প্রস্তাবিত জলসেচের লক্ষ্য পূর্ণ হবে কিনা সবই অনিশ্চিত। স্বাধীন ভারতের যে কোনো জলসেচন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি আর সময় কম পড়ে যাওয়া অবধারিত ভাবে ঘটে চলেছে। এত বৃক্ষনিধন ঘটবে কেন বেতোয়ার অববাহিকায়, তাও কাউকে ভাবায়না।

গতবছর ডিসেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে বার বার আসছিল বিনষ্ট এক প্রাচীন অরণ্যের ছবি। বনের সবুজ উপড়ে তুলে ফেলে যন্ত্রে পাথর মাটি বার করে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাগ - যেন হিংস্র দানবের নখের আঁচড়। ছত্তিশগড়ের তিনটি জেলায় ছড়ানো অতি প্রাচীন, জীববৈচিত্র্য ভরপুর হাসদেও অরণ্যের ৯১ একর জমিতে ছড়ানো ১৫,০০০ হাজার গাছ কাটা হল পুলিশ ও আধিকারিকদের প্রহরায়, শ্রমিকদের দিয়ে, বৈদ্যুতিক করাতে। স্থানীয় জনজাতিদের দ্বারা পূজিত শতাধিক বছর প্রাচীন এই সব গাছ উপড়ে ফেলা কি সহজ কথা! এই জঙ্গলের মধ্যে আছে পারসা ইস্ট ও কান্তা বাসন কোল ব্লক, যার সংক্ষিপ্ত নাম PEKB. এই ব্লকের কয়লা বরাদ্দ করা হয়েছিল রাজস্থানের রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কম্পানিকে। এটা তো এক নিছক সমাপতন যে, ভারতের অন্যতম ধনী শিল্পপতির কোম্পানি এর মাইন অপারেটর ও ডেভেলপার।

প্রথম ফেজ-এ ২০১২ পর্যন্ত ৯০ হাজার গাছ কাটা হয়েছিল, অরণ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেই স্বেচ্ছাসেবীদের মতে এই সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে পাঁচগুণ বেশি। দ্বিতীয় ফেজ চালু করার নামে বনের মধ্যে জমির উপর অসংখ্য বৃক্ষছেদন কি এতই জরুরি ছিল? এই অরণ্য সংহারের পর হাতিদের চলার পথ নষ্ট হওয়ায় ক্রুদ্ধ হাতিদের আক্রমণে ঘর ভেঙেছে, প্রাণ গেছে মানুষের। আদিবাসি সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ। তাদের প্রতিবাদে কোনো ফল হয়নি। তাঁরা মনে করেন আগের ও এখনকার দুই সরকারই, যথাক্রমে রাজস্থান সরকার এবং শিল্পগোষ্ঠীকে খুশি করতে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

হাসদেও অরণ্যে কয়লা উত্তোলনের জন্য বর্তমান খনি অঞ্চলগুলি নিয়েই শিল্পের কাজ চলত, অরণ্যের বৃহদংশ রেখে দেওয়া যেত ধ্বংসের নাগালের বাইরে। এই নিরন্তর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে জনজাতি জীবন, উচ্ছিন্ন হয়েছে মানুষ। জীববৈচিত্র্য ও মানব জীবনধারার বিপুল ক্ষতির প্রশ্ন মুছে গেছে শিল্পোদ্যোগী, শাসক রাজনীতিক ও ঠিকাদার গোষ্ঠী এবং তাদের লোভের সামনে। তবে পাথরেও ফাটল ধরে। জানা গেছে, ২০২৩-এর আগস্টেই কেন-বেতোয়া প্রকল্পের দুধওয়া বাঁধের জন্য টেন্ডার ডেকেছিল জাতীয় জল বিকাশ নিগম। একটিও কোম্পানি দাবিপত্র জমা করেননি, জমা দেওয়ার তারিখ বাড়ানোর পরেও না। অর্থাৎ, তাঁদের মনেও সংশয় আছে পরিবেশ ছাড়পত্রের বিষয়টি নিয়ে। বনের মধ্যে খনন ও লক্ষ লক্ষ বৃক্ষছেদনের অভিজ্ঞতা কারো জন্যই ভালো নয়। আজকাল বৃক্ষরোপন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দৃশ্য-শ্রাব্য বিনোদন, যার ফলে এক দিনে লাখ লাখ গাছের চারা লাগিয়ে রেকর্ড বইতে নাম তুলতে পারে প্রশাসন। কে তাদের বোঝাবে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি একশো বছরের পুরোনো গাছ আর কয়েক হাজার চারাগাছের মধ্যে কোনো তুলনাই সম্ভব নয়। লাগানো চারাগাছগুলির কত শতাংশ শেষ পর্যন্ত বাঁচে, সে হিসেব জনমানসে আসে না। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত 'Central Empowered Committee' উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এই প্রকল্পে ঘন অরণ্যের মধ্যে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা ডুবে যাবে। তাতে বিপন্ন হবে এলাকার জীববৈচিত্র এবং পান্না বনাঞ্চলের ৩০টির মত বাঘের বসত। এই অব্যবহিত প্রভাবগুলির কথা যদি নাও ধরা যায়, তাহলেও দুটি নদী জোড়ার মতো কারিগরির প্রভাব অনেক দূর বিস্তারী হতে পারে। নদী সংযুক্তি মাস্টার প্ল্যানে এমন ষোল-সতেরটি প্রকল্পের কথা বলা আছে। ২০২১-এ একটি কারিগরি সমীক্ষা করে আইআইটি বম্বে জানায়, নদী সংযুক্তির ফলে ভূমি ও বায়ুমণ্ডলের জঙ্গম সম্পর্ক যেভাবে বিচলিত হবে, তার জন্য কেন-বেতোয়া অববাহিকায় ১২ শতাংশ বৃষ্টির জল কম পাওয়া যাবে।

পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়া একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। তারও মধ্যে লুকিয়ে থাকে নানা তথ্যের ফাঁক। রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি।কিন্তু সেই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প মঞ্জুর করিয়ে নেবার মধ্যে আছে পরিমাপহীন ঔদ্ধত্য। গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি পরিবেশের উপর পরিকাঠামোর অত্যাচারের ভয়াবহ পরিণতি। সিকিমে জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু হয়েছে সেনা কর্মী ও সাধারণ পর্যটকদের। নর্মদার বুকে পাহাড় কেটে বসেছে পৃথিবীর উচ্চতম ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’। এর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। সর্দার সরোবর বাঁধ যা পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম, তৈরি হয়েছিল পরিবেশ মন্ত্রকের অন্তিম ছাড়পত্র ছাড়াই।সর্দার সরোবরের উচ্চতম লেভেল রাখার জন্য বর্ষায় খুলে দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশের অসংখ্য বড়ো মাঝারি বাঁধের গেট। প্রতিবছর বর্ষা ও তার পরবর্তী সময়ে সন্নিহিত গ্রামগুলিতে চলে প্লাবন জলের উচ্ছ্বাস। উত্তরকাশীর বরকোট সিল্কিয়ারা টানেলে ৪১ জন শ্রমিকের ১৭ দিন টানেল বন্দী অবস্থায় দিন কাটানোর পর্বে উৎকন্ঠিত থেকেছে সারা দেশ। কিন্তু এই ঘটনার বহু গাফিলতি নজরে আসা সত্ত্বেও শাস্তি হয়নি ঠিকাদার সংস্থাটির। কেন-বেতোয়া সংযুক্তির পরিবেশগত প্রভাব ও তাৎপর্য অনেক গুরুতর। সুপ্রীম কোর্ট নিযুক্ত CEC-র বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল। এক বার নির্বাচনে জিতে সিংহাসনে বসলে বিজয়ী দলগুলির কোনো প্রয়োজন নেই জনমতের। গণতন্ত্রে জনগণের এই রকম পরিহার্যতা দেখলে চিন্তা হয়, আশংকাও হয়।