আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

ব্রহ্মপুত্র

তুষার মুখার্জি


ব্রহ্মপুত্র, ব্রহ্মের পুত্র, একমাত্র পুংলিঙ্গ নদ। অন্য সব হল স্ত্রীলিঙ্গ, নদী।

ব্রহ্মপুত্রের নদ-এর নাম 'ব্রহ্মপুত্র' হল কেন? প্রাচীন নাম কী ছিল? আগেকার নাম বদলে গেছে? কেন বদলে গেল?

প্রায় প্রতিটি মানব সভ্যতার জন্ম হয়েছে নদীর পাড়ে। কাজেই প্রাথমিকভাবে কল্পনা করাই যেতে পারে এই ব্রহ্মপুত্রের পাড়েও প্রাচীন লোকবসতি ছিল। মানচিত্রে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে নদটি নানা ভৌগোলিক বৈচিত্রে ভরা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত। ফলে স্বভাবতই নদটির পাড়েও বসতি ছিল নানা জাতি-উপজাতির। আর প্রতিটি জাতি-উপজাতি তাদের নিজস্ব ভাষায় নদীর নামকরণ করবে। বাস্তবে হয়ত সবার নাম আলাদা হবে না - ভাষাগুলোর নৈকট্য থাকলে অন্যের দেওয়া নাম গ্রহণ করে নেবে।

নিখাদ সত্য হল ব্রহ্মপুত্রেরও একাধিক নাম ছিল এবং আছে। না গোটা নদের নাম নয়। বিশাল নদের গতিপথে যে জাতি বসবাস করেছে তারা যে নাম রেখেছে সেই নাম। সেইরকম নামও অনেক।

দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতের, ৫,৩০০ মিটার উচ্চতায় ‘রাকে কাংগেন তসো’ হ্রদের দক্ষিণে কৈলাশ পর্বতমালার, আগেকার জানা মতে ‘সিমায়াঙ দাঙ’ হিমবাহ থেকে এর উৎপত্তি। অবশ্য সর্বশেষ উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখে বলা হচ্ছে, ‘আঙসি’ হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্রের যাত্রা শুরু। উৎসের কাছাকাছি এটি 'মুতসুং সাংপো' নামে পরিচিত। তারপরে অবশ্য 'মোঘুং সাংপো', তারও পরে শুধু 'সাংপো' নামে পরিচিত। তবে চীনা মানচিত্রে এটিকে ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর চেয়েও প্রাচীন নামের খোঁজ পাওয়া গেছে।

তিব্বতি ভাষায় আগে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন নাম পাওয়া গেছে - নারিচু সাংপু, তানজু খাম্পা, এরেচুম্বা, তাম্যক কোম্বো, মার্তসাঙ্গি-চু, কোবেই-চু, সাংচেন, সাংপো-চিম্বো। এই সব নামই নদীটি যখন তিব্বতে আছে সেই অংশটির।

তিব্বত থেকে নদীটি ঢুকবে ভারতের অরুণাচলে।

তখন নাম হবে 'সাংপো সিয়াং'। বেশ খানিক নামার পরে আবার নাম বদল হবে। ‘সেমা’ বা ‘সেংলাই’ নামে এবার পরিচিত হবে। এরই কাছের আরেকটি নদীর নাম ছিল সেয়েম। অনেকের গোলমাল হয় বলে উল্লেখ করে রাখা হল।

‘সেংলা’ খানিক বয়ে প্রায় সমতলে যাবার পরে আবার নাম বদল হবে।নতুন নাম হবে ‘দিহাং’।

খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন ‘সিয়াং’, 'সেংলাই’ থেকে ‘দিহাং’ অনেকটাই আলাদা নাম। আসলে আগেরগুলো ছিল তিব্বতি নাম। লোকালয় ছিল উঁচু পাহাড়ি তিব্বতি। আর ‘দিহাং’ হল তিব্বতি-বর্মি নাম - অসমের বোড়ো জাতির দেওয়া নাম। নদী তখন প্রায় সমতলে।

এই অরুণাচলেই ‘দিহাং’ নদের সঙ্গে যোগ হবে ‘দিবাং’ নদী। এই নামও তিব্বতি বর্মি-বোড়োদের দেওয়া। বোড়োরা গোটা ব্রহ্মপুত্রেরও একটা নাম দিয়েছিল ‘বুরলুং-বুথুর’। বোড়ো জাতির ক্ষমতা অবসানের সঙ্গে সেই নামও লুপ্ত হয়ে গেছে।

এবার আরেকটি নদী যোগ হবে ‘দিহাং’-এর সঙ্গে।

লোহিত নদী। এখানে অসমের সমতল শুরু হল।

লোহিত নদীতে যুক্ত হবার পরেই দিহাং নাম বদলে সংস্কৃত নাম নেবে। দিহাং হয়ে গেল 'লৌহিত্য'। স্থানীয় অসমিয়া ভালোবাসার ডাক নাম 'লুইত'। ভূপেন হাজারিকার গানে - লুইত, বুড়া লুইত... তুমি বইছা কিয়?

সংস্কৃত নাম এল অথচ সেই নামকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তার সঙ্গে পুরাণ-কথা থাকবে না এমনটি সাধারণত উত্তর-পূর্ব ভারতে ঘটেনি। শোনা যাক সেই কাহিনি।

দুটো কথা আগে বলা হয়নি। প্রথমত, ব্রহ্মপুত্র হল ব্রহ্মার মানসপুত্র, দ্বিতীয়ত, কাহিনির প্রধান উৎস 'কালিকাপুরাণ' ও তার সঙ্গে আছে কিছু লৌকিক উপাখ্যান।

পিতা ঋষি জমদগ্নির কথামতো পরশুরাম তাঁর মাতা রেনুকাকে বধ করেন। তারপর মাতৃহত্যাজনিত পাপস্খালনের জন্য তিনি যান তীর্থ ভ্রমণে। কিছু ঋষির পরামর্শে তিনি আসেন অরুণাচলের একটি বিশেষ কুণ্ডে। গোটা ভ্রমণকালে পরশুরামের হাতে আটকে ছিল সেই রক্তমাখা অভিশপ্ত কুঠারটি। যখন সেই কুঠারের রক্ত ধুয়ে যাবে, যখন সেই কুঠার হাত থেকে আলগা হয়ে যাবে, কেবল তখনই বোঝা যাবে তাঁর মাতৃহত্যাজনিত পাপস্খালন হয়েছে।

ভ্রমণ করতে করতে তিনি উপস্থিত হলেন অরুণাচলের গভীর বনের মাঝে এক কুণ্ডে। না তখন এখানকার নাম অরুণাচল ছিল না। কী নাম ছিল জানা নেই। এই কুণ্ডের সৃষ্টি কাহিনি ভিন্ন স্বাদের।

প্রথমে এই কুণ্ড ছিল এক শুষ্ক গহ্বর মাত্র। ব্রহ্মা কোনো এক কালে মনস্থ করলেন তিনি এই গহ্বর জলপূর্ণ করবেন। সেই ইচ্ছাপূরণের জন্য দরকার জাগতিক পদার্থ - জল। তাই ব্রহ্মা মুনি শান্তনুর ভার্যা অমোঘার গর্ভে এক মানসপুত্রের জন্ম দিলেন। সে পুত্র আদতে কেবল একটি জলময় অস্তিত্ব। সেই জলময় পুত্রের ঠাঁই হল সেই গহ্বরে। সৃষ্টি হল এক পবিত্র জলপূর্ণ কুণ্ডের।

পরশুরাম সেখানে এলেন। ঝোপ জঙ্গলের বাধা পরিস্কার করে সেই কুণ্ডে এসে হাতের কুঠার ধুতেই সেই কুণ্ডের জল রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তারই সঙ্গে পরশুরামের কুঠার পরিস্কার হয়ে গেল। তাঁর হাত থেকে মাতৃহত্যার অভিশপ্ত কুঠারটি আলগা হয়ে গেল - পরশুরাম মাতৃহত্যাজনিত পাপমুক্ত হলেন। কুণ্ডটির নাম তখন থেকেই পরশুরাম কুণ্ড।

পরশুরাম সেই কুণ্ড থেকে জলমগ্ন ব্রহ্মার মানসপুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন কামরূপে। কুণ্ড থেকে দিহাং নদী অবধি সমগ্র পথ হয়ে গেল রক্তবর্ণ এক নদী কারণ সে নদী রক্তবর্ণ কুণ্ডের জলে থেকে সৃষ্ট, তাই সেই নদীর নাম হল লোহিত নদী।

অবশ্য এটা নেহাতই পৌরাণিক কাহিনী।

লোহিত নদীর উৎপত্তি তিব্বতে। তার তিব্বতি নাম 'জায়ু'। নদীর জল লাল - কারণ নদীর গতিপথের মাটিতে লোহা আর অ্যালুমিনিয়াম আকরিকের উপস্থিতি। আর পরশুরাম কুণ্ড এই নদীরই নীচের দিকে। তবে আগের কুণ্ডটি ১৯৫০-এর ভুমিকম্পে পাথরের আড়ালে চলে গিয়ে নতুন আর একটি কুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। এই কুণ্ডে পৌষ সংক্রান্তিতে বিশাল উৎসব হয়।

অরুণাচলেরই মিশমি পাহাড় থেকে বের হয়ে আরেকটি নদী ‘দিবাং’ বয়ে গেছে অরুণাচলের মধ্যে দিয়ে। এটিও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে।

‘দিবাং’ নদী আর ‘লৌহিত’ নদী দুটোই মূল দিহাং নদীর সঙ্গে মিশেছে। দিহাং তখন লৌহিত্য/লোহিত নদী। তেজপুরের কাছে সদিয়াতে দুটি শাখা নদী সঙ্গে নিয়ে পথ চলা শুরু ব্রহ্মপুত্র নদের।

কেন ব্রহ্মপুত্র নাম হল! তার পেছনে আছে ওই পরশুরাম কুণ্ডের জলাশয়। এটি ব্রহ্মার মানসপুত্র। যেহেতু সেই নদীর জলরাশির উৎস ব্রহ্মার মানসপুত্র, তাই নদের নাম হল ব্রহ্মপুত্র। সম্ভবত এই নামকরণের সময় ভাবা হতো, বা বলা হতো, লোহিত নদীর উৎস পরশুরাম কুণ্ড, এবং সেটাই আসলে ব্রহ্মপুত্র নদ। মূল নদী দিহাং-কে শাখা নদী ভাবা হতো। আর দিবাং তো শাখা নদীই। সেই লোহিত নদীর সূত্রেই দিহাং নদীকে শুরুতে লৌহিত্য নদী বলা হতো। পরে ব্রহ্মপুত্র নামটি ব্যবহার হতে থাকে।

বোড়োদের দেওয়া নাম ‘বুরলুং-বুথুর’ বদলে হল ব্রহ্মপুত্র। বোড়োরা ‘বুরলুং-বুথুর’ নাম দিয়েছিল কারণ এই নদীর স্রোতে গড়ড়গুড় গড়ড়গুড়ড় শব্দ হতে থাকে। শব্দের উৎস নদীর তলদেশে থাকা বড়োবড়ো পাথরের সঙ্গে জলের ক্রমাগত ধাক্কা।

ধুবড়ির কাছে ব্রহ্মপুত্র ঢুকবে বাংলাদেশে। সেখানেও তার নাম বদলে যাবে। নাম হবে যমুনা। নদ এবার নদী হয়ে গেল। যমুনা গঙ্গার সঙ্গে মিলে হবে পদ্মা। তারপরে আবার পদ্মাকে ছেড়ে নিজ পথে চলে সাগরে মেশার আগে মেঘনা নাম নেবে।

১৭৮৭-তে প্রবল ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় গোটা অসমে বন্যার প্রকোপ বহুগুণ বেড়ে যায়। তারই সঙ্গে বাংলাদেশে-এর গতিপথও বদলে যায়। আগে এটি ময়মনসিংহের মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি বয়ে যেত।

সুদূর অতীতের বোড়োদের একটি কবিতায় পাওয়া যায় তারা দেখেছিল লাল রঙের সমুদ্র। অনুমান করা হয় তিব্বতের পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা বোড়োদের চোখে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের লালচে ঘোলা জলে বন্যাপ্লাবিত বিশাল এলাকা দেখে তারা সেটাকে লাল সমুদ্র বলেই ভেবেছিল।

গোটা অসমে ব্রহ্মপুত্র বয়ে গেছে চুলের বিনুনির মত পাক দিয়ে দিয়ে। এমনি এক পাক দেবার ফলে অসমের লক্ষ্মীপুর জেলায় নদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে চলে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। প্রধান স্রোত ব্রহ্মপুত্র, আর অন্যটি 'খেরকুটিয়া' নামে পরিচিত। এরই ফলে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী দ্বীপ ‘মাজুলি’। মাজুলি এতটাই বড়ো যে প্রশাসনিকভাবে সেটি একটি জেলা। যেমন বৃহত্তম দ্বীপের জন্ম দিয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ তেমনি দিয়েছে ক্ষুদ্রতম দ্বীপের জন্মও। গুয়াহাটির কাছে এই দ্বীপ 'উমাচল পাহাড়' নামে বিখ্যাত।

পাহাড়ের মাথায় আছে মন্দির। ব্রহ্মপুত্রের অনেক শাখা নদী। তার মধ্যে কয়েকটি বেশ বিখ্যাত - সুবনসিরি, ধানসিরি, জিয়াভরলি, বুরহি দিহিং, দিসাং, কপিলি, মানস, সঙ্কোশ, জলঢাকা, তিস্তা।

২,৮৫০ কিমি লম্বা এই নদটি পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীর একটি। এই নদের গতিপথেই আছে গভীরতম গিরিখাত। অনেকে বলেন ভৌগোলিকভাবে এই নদ হিমালয় পর্বত সৃষ্টিরও আগে থেকে ছিল। ব্রহ্মপুত্রের নদীখাতের গভীরতা ৩৮ মিটার থেকে ১২০ মিটার। আর প্রস্থে অনেক জায়গায় ২০ কিলোমিটার অবধি চওড়া। ঢোলা-সদীয়ার কাছে এই নদের উপর আছে ভারতের দীর্ঘতম সেতু ৯.৪ কিমি লম্বা। আর আছে সরাইঘাট সেতু, নতুন সরাইঘাট সেতু, কলিয়া ভোমরা সেতু, ঢোলা সদীয়া সেতু, বগিবীবল সেতু। শেষ হতে সামান্য বাকী উত্তর ও দক্ষিণ গুয়াহাটি সংযোগকারী সেতু। ধুবড়ী-ফুলবাড়ি সেতু, আছে নরনারায়ণ সেতু, যমুনা সেতু ইত্যাদি।

এই নদের উপরেই চীন বানাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বাঁধ। ইতিমধ্যে চীন বানিয়েছে ছয়টি বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।

ভারত বানিয়েছে দু'টি বাঁধ ও জলবিদ্যুত প্রকল্প। আরও দু'টির কাজ নানা কারণে এখন স্থগিত আছে। এছাড়া আরও দুটি পরিকল্পনার স্তরে আছে।


তথ্যসূচীঃ

1. The Brahmaputra: by Arup Kumar Dutta. Via 'Times of India'. Nov. 4, 2001.
2. Wikipedia (English)
3. Wikipedia (Bengali)
4. Wiki (Assamese)
5. Copilot.