আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

বিশেষ জ্ঞান-ই বিজ্ঞান

অম্বিকেশ মহাপাত্র


প্রসঙ্গতঃ

জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, ২৬ বছর বয়সে, একটি বছরে আইনস্টাইনের ৪টি যুগান্তকারী আবিষ্কার! বিজ্ঞানের অগ্রগতির যাত্রাপথে অবশ্যই বিরলতম ঘটনা।সেই কারণেই ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ ‘আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান বর্ষ' (World Year of Physics) হিসেবে চিহ্নিত। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, ৪২ বছর বয়সে, আইনস্টাইন আন্তর্জাতিক 'নোবেল পুরষ্কার'-এ ভূষিত হয়ে বিশ্বখ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান। স্বাভাবিক কারণেই সেই সময়কালে বিজ্ঞানাকাশে আইনস্টাইন এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে, ৫২ বছর বয়সে, আইনস্টাইন 'ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি'র আমন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে। সেই সময়কালে ৪২ বছর বয়েসি চার্লি চ্যাপলিনও নির্বাক চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং বিশ্বের বিস্ময়কর ‘ভবঘুরে’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রমোদী দর্শকদের কাছে বিশ্বখ্যাতির শিখরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে, আইনস্টাইন চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছে প্রকাশ করেন এবং তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। এমনকি চার্লি চ্যাপলিনের নির্মিত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইটস’-এর প্রিমিয়ার শো-তে আইনস্টাইন উপস্থিত থাকেন। প্রিমিয়ার শো-এর পর দু’জনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল, তার একটি অংশ ঐতিহাসিক এবং আজও প্রাসঙ্গিক।

Einstein said -What I admire most about your art is its universality. You do not say a word and yet the world understands you!” (“তোমার শিল্প সম্পর্কে আমি খুবই প্রশংসা করি, তার কারণ হল এর সর্বজনীনতা। তুমি একটি কথাও বলনা, তবুও পৃথিবী তোমাকে বোঝে!”)

Chaplin replied -It’s true but your fame is even greater! The world admires you when nobody understands you!” ("এটা সত্য কিন্তু আপনার খ্যাতি আরও বেশি! যখন কেউ আপনাকে বোঝে না, তখন বিশ্ব আপনাকে প্রশংসা করে!")

বিজ্ঞানের দুরুহ তত্ত্ব, সূত্র, জটিল গণনা, বিমূর্ত গণিতের প্রয়োগ সর্বসাধারণের পক্ষে বোধগম্য না হলেও, বিজ্ঞান প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রতি মুহূর্তে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর কোনো ব্যতিক্রম সম্ভব-ই নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের ছাত্র তথা শিক্ষক হিসেবে বিজ্ঞান বিষয়ের একটি ক্ষুদ্রাংশকে সাধারণের বোধগম্য করে তোলার জন্য এই বিনম্র প্রয়াস।

সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে

আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু চোখে দেখি নতুবা কোন-না-কোন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করি, যেমন জীব-জন্তু, পশু-পাখি, ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছালি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আকাশ-বাতাস এই সব; এই সব কী দিয়ে তৈরি? এককথায় আপনার আমার চারপাশের ‘প্রকৃতি’ কী দিয়ে তৈরি? একবিংশ শতাব্দীর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এই প্রশ্ন কি অবান্তর? বিজ্ঞান চর্চায়, বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা রসায়নবিদ্যা চর্চা থেকে আমরা যা জেনেছি, তা হল আমাদের চারপাশের সবকিছুই ‘রাসায়নিক পদার্থ’ দিয়ে তৈরি। যেমন ধরুন খাদ্য লবণ যাকে সাধারণ কথায় আমরা ‘নুন’ বলি, সেই নুন সম্পর্কে নানান প্রবাদবাক্য চালু রয়েছে, যেমন - ‘যার নুন খাই তার গুণ গাই’; ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’; ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়!’ ইত্যাদি। এই ‘নুন’ ছাড়া পৃথিবীর কোনো রান্নাঘর ভাবা যায়? যায় না, সেই ‘নুন’ হচ্ছে একটি ‘রাসায়নিক পদার্থ’। যার রাসায়নিক নাম ‘সোডিয়াম ক্লোরাইড’। আবার ধরুন ‘জল’, জলের অপর নাম জীবন। শুধু-ই কথার কথা নয়। যেখানেই জল সেখানেই প্রাণের স্পন্দন, সেখানেই প্রাণীর প্রাণ বাঁচে, সেখানেই প্রাণীর বিবর্তন, সেখানেই প্রাণীর বিচরণ। সেই ‘জল’ কী? ‘জল’ অবশ্যই একটি রাসায়নিক পদার্থ। আবার জলে নুন, চিনি (চিনি অপর একটি রাসায়নিক পদার্থ) এবং সাইট্রিক অ্যাসিড (অপর রাসায়নিক পদার্থ, যা লেবুর রসে থাকে) মিশিয়ে আমরা তৈরি করি প্রয়োজনীয় পানীয়; নুন-চিনি-লেবুর সরবৎ। পরিশ্রুত জল এবং নুন মিশিয়ে তৈরি হয় স্যালাইন, যা রুগীর চিকিৎসায় অপরিহার্য।

অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ তার পারিপার্শ্বিক পর্যবেক্ষণ থেকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি, জৈব এবং অজৈব পদার্থ; সব‌ই প্রকৃতি-সৃষ্ট শতাধিক ‘মৌলিক পদার্থ’ দিয়েই তৈরি। এবং নানাপ্রকারের রাসায়নিক পদার্থের নির্দ্দিষ্ট অনুপাতের মিশ্রণে মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি হয়। এই প্রেক্ষিতে প্রকৃতি-সৃষ্ট কয়েকটি মৌলিক পদার্থের নাম উল্লেখ করা-ই যায়। যেমন - হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন, ক্লোরিন, আয়োডিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, ফসফরাস, সালফার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, কপার, সিলভার, গোল্ড, লেড, প্লাটিনাম ইত্যাদি। এবং আমরা এও জেনেছি, জল হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন, খাদ্যলবণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন, তেমনই চিনি কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের রাসায়নিক সংশ্লেষণে উৎপাদিত রাসায়নিক পদার্থ।

পরবর্তী সময়কালে রসায়ন বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার হয়, আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখছি, সব-ই প্রকৃতি-সৃষ্ট শতাধিক মৌলিক পদার্থ দ্বারাই উৎপাদিত পদার্থ তথা রাসায়নিক পদার্থ অথবা রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ। পরের প্রশ্ন যা স্বাভাবিকভাবে চলে আসে, মৌলিক পদার্থগুলি কী দিয়ে তৈরি? এর উত্তরের সন্ধানে ঊনিশ শতকের প্রথম দশকে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে জন ডালটন (১৭৬৬-১৮৪৪) একটি তত্ত্ব, যাকে আমরা 'Dalton’s Atomic Theory' বা 'পারমাণবিক তত্ত্ব' হিসেবে জানি, সেই তত্ত্বে ডালটন জানালেন - সমস্ত মৌলিক পদার্থ-ই নিজ নিজ অবিভাজ্য অতি ক্ষুদ্র ‘মৌল কণা’ দ্বারা সৃষ্ট। একই মৌলিক পদার্থের সকল মৌল কণার আয়তন এবং ধর্মাবলী এক-ই। মৌল কণা-র নাম দেওয়া হয় ‘Atom’ বা ‘পরমাণু’। এবং এই পরমাণু-ই সকল রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। সেই কারণে পরমাণু-ই সকল মৌলিক পদার্থের মৌল কণা হিসেবে চিহ্নিত।

মানুষের চাহিদার সঙ্গে বিজ্ঞান চর্চার ওতপ্রোত সম্পর্ক। সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞানের চর্চা গবেষণা পর্যায়ে উন্নীত। গবেষণায় নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে নানান অজানা তথ্য সামনে আসে। ঊনিশ শতকের শেষ দশকে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে নোবেলজয়ী জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী যোশেফ জন থমসন (১৮৫৬-১৯৪০) ক্যাথোড রে (cathode ray) এক্সপেরিমেন্টের পর্যবেক্ষণ থেকে নতুন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। কী সেই সিদ্ধান্ত? পরমাণুই মৌল কণা নয়। পরমাণুর অভ্যন্তরে আরও অতি ক্ষুদ্রকণা লুকিয়ে আছে। এবং তিনি এও জানালেন - পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিপারমাণবিক ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণা বর্তমান। তার নাম দেওয়া হয় ‘ইলেকট্রন’। যে ইলেকট্রন ঘিরে নতুন গবেষণা। ফলশ্রুতিতে Electricity, Electrical Energy, Electronic Science, Electrical Engineering, Electronics, Electronics and Telecommunication, Electronic Mail, Electronic Transfer ইত্যাদি শব্দ এবং শব্দবন্ধ সহ এক নতুন বিশ্ব, ইলেকট্রনিক বিশ্ব সামনে আসে।

জানার কোনো শেষ নাই

পরমাণুবাদের জনক জন ডালটন পরমাণু সম্পর্কে স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, পরমাণু নিস্তড়িৎ। পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিপারমাণবিক তড়িৎ ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন কণা আবিষ্কারের পর, স্বাভাবিক কারণে খোঁজা শুরু হয় পরমাণুর অভ্যন্তরে তড়িৎ ধনাত্মক আধানযুক্ত কণার অস্তিত্ব। ফলশ্রুতিতে ইলেকট্রন আবিষ্কারের প্রায় ১২ বছর পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে নোবেল জয়ী রসায়ন বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (১৮৭১-১৯৩৭) তড়িৎ ধণাত্মক আধানযুক্ত অতিপারমাণবিক অপর কণা ‘প্রোটন’ আবিষ্কার করেন। প্রোটন আবিষ্কারের আরও ২৩ বছর পর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রোটন আবিষ্কর্তা রাদারফোর্ডের ছাত্র নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক (১৮৯১-১৯৭৪) পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিপারমাণবিক নিস্তড়িৎ তৃতীয়কণা ‘নিউট্রন’ আবিষ্কার করেন। ফলে পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে শতাধিক মৌলিক পদার্থের অবদান শেষ কথা নয়। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে পরমাণু এবং অতিপারমাণবিক ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের অস্তিত্ব জানা যায়। ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশক থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখছি, সবকিছুই আদি মৌল কণা ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়েই তৈরি। বিজ্ঞান গবেষণায় আমরা এও জেনেছি - হাইড্রোজেন পরমাণু একটি ইলেকট্রন এবং একটি প্রোটন; কার্বন পরমাণু ছয়টি ইলেকট্রন, ছয়টি প্রোটন এবং ছয়টি নিউট্রন এবং অক্সিজেন পরমাণু আটটি ইলেকট্রন, আটটি প্রোটন এবং আটটি নিউট্রন দিয়ে তৈরি। হাইড্রোজেন, কার্বন এবং অক্সিজেন পরমাণুর মধ্যেকার ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন-দের মধ্যে ধর্মের কোনো পার্থক্য নেই। সকল মৌলিক পদার্থের পরমাণু এক-ই আদি মৌল কণা ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে গঠিত। এদের সংখ্যার তারতম্য এবং বিন্যাসের তারতম্য হেতু প্রত্যেক মৌলিক পদার্থের পরমাণু সহ পদার্থের ধর্মে তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে।

পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন কণা আবিষ্কারের পর ইলেকট্রন নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এটাই স্বাভাবিক। সেই পথে আলোকতড়িৎ প্রভাব অর্থাৎ Photoelectric Effect, Electronics, Atomic Structure অর্থাৎ পরমাণুর গঠন এইসব বিষয়ে গবেষণার গতি বৃদ্ধি পায়। এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক ছিল। এরপর বিজ্ঞানীদের ধারণায় বিশেষ এবং অবশ্যই বৈপ্লবিক অঘটন ঘটল। তড়িৎ ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন কণা আবিষ্কারক জোসেফ জন থমসনের পুত্র পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ প্যাগেট থমসন (১৮৯২-১৯৭৫) অপর বিজ্ঞানী ক্লিনটন জোসেফ ড্যাভিসন (১৮৮৮-১৯৫৮)-এর সঙ্গে 'ইলেকট্রন ডিফ্র্যাকসন এক্সপেরিমেন্ট'-এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করতে গিয়ে জানালেন - "ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আছে"। এর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানী মহলে স্থির সিদ্ধান্ত ছিল - পদার্থের হয় কণাধর্ম, না হয় তরঙ্গধর্ম থাকবে। পদার্থের যুগপৎ কণা এবং তরঙ্গধর্ম অসম্ভব। নোবেল জয়ী পিতা জোসেফ জন থমসন ইলেকট্রনের কণাধর্ম আবিষ্কারের পর, নোবেল জয়ী পুত্র জর্জ প্যাগেট থমসন সেই ইলেকট্রনেরই তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার করেন। অর্থাৎ ক্লাসিক্যাল বিজ্ঞানীদের ক্লাসিক্যাল ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এবং পরীক্ষালব্ধ ফলাফল জানিয়ে দেয়, পদার্থের দু’টি ধর্ম‌ই যুগপৎ অর্থাৎ একসাথেই রয়েছে। ‘হয় কণাধর্ম, না হয় তরঙ্গধর্ম’, এই ধারণা বাতিল হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, যুগপৎ দুই ধর্ম অতি ক্ষুদ্র কণা অর্থাৎ অতিআণুবীক্ষণিক বা ultramicroscopic কণা; যেমন অণু, পরমাণু, প্রোটন, ইলেকট্রন, নিউট্রন ইত্যাদি; যাদের খালি চোখে দেখা যায় না, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু বৃহদাকার অর্থাৎ macroscopic পদার্থের ক্ষেত্রে যুগপৎ দুই ধর্ম থাকলেও কোনো একটি ধর্ম বিশেষ গুরুত্বলাভ করে, তখন অপর ধর্ম নগণ্য হয়ে যায়। যেমন ক্রিকেট বলের তরঙ্গধর্ম নগন্য; কিন্তু অতিপারমাণবিক ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম নগন্য নয়; ইলেকট্রনের কণাধর্মের পাশাপাশি তরঙ্গধর্মও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পদার্থের, বিশেষ করে অতিআণুবীক্ষণিক কণার ক্ষেত্রে যুগপৎ দ্বৈতধর্মের উপর নির্ভর করে নতুন তত্ত্ব সামনে আসে, যাকে আমরা বলি 'কোয়ান্টাম তত্ত্ব'। কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর গড়ে ওঠা 'কোয়ান্টাম মেকানিক্স' গবেষণায় বিশেষ গুরুত্বলাভ করে। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববাসীর চোখে দেখা macroscopic জগতের বাহিরে ultramicroscopic জগতের সদস্য, যা কেবলমাত্র মানুষের তৃতীয় নেত্র অর্থাৎ নলেজ অফ আই (অসুরনাশিনী ত্রিনয়নী দশভুজা দুর্গার কপালের তিন নং নেত্রের সমতুল) দিয়েই দেখা যায়, তাদের ধর্মাবলী সম্পর্কে বিশদে জানতে পারা যায়। সেখানেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রাসঙ্গিকতা, যা আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্তারলাভ ঘটায়।

চর্মচক্ষে অদৃশ্য জগৎ

আচ্ছা, যে পদ্ধতিতে আমরা একটি ঘরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাপ করি; চাল, ডাল, তরিতরকারির ভর পরিমাপ করি, সেই পদ্ধতিতে নিশ্চয়ই মানুষের চোখে অদৃশ্য একটি হাইড্রোজেন ক্লোরাইড অণুর ভর এবং ঐ অণুর মধ্যে হাইড্রোজেন এবং ক্লোরিন পরমাণুর দূরত্ব, যাকে 'bond distance' বা বন্ধন দূরত্ব বলি, তা পরিমাপ করি না। তাহলে কীভাবে পরিমাপ করি? একইভাবে ইলেকট্রন কণার ভর এবং ইলেকট্রনের তড়িতের আধান কীভাবে পরিমাপ করা হয়?জানতে ইচ্ছে করে না? নিশ্চয়ই করে।

Ultramicroscopic পদার্থের ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্যাল পদ্ধতির সাহায্যে উপরোক্ত পরিমাপগুলি সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল পদ্ধতি অপরিহার্য।কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আলোচনার আগে একটি জাগতিক ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা মেঘলা আকাশে কখনও কখনও রামধনু দেখতে পাই। সাতরঙা রামধনু। পাশাপাশি কাঁচের প্রিজমের মধ্য দিয়ে সূর্যের সাদা আলো অতিক্রম করালে সাতটা রঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা পেয়ে থাকি, এক ধরণের বর্ণালী বা Spectrum। এর থেকে আমরা জানতে পেরেছি, সাদা আলো সাতটি ভিন্ন; বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল মৌলিক আলোর সমষ্টিমাত্র। এবং প্রত্যেক মৌলিক আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। Spectrum সংক্রান্ত নতুন গবেষণা, বিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ স্থান অর্জন করে ফেলেছে, যাকে আমরা বলি 'Spectroscopy'। Spectrum ভালো করে বুঝতে এবং বিশ্লেষণ করতে অবশ্যই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য অপরিহার্য।

বিভিন্ন ধরনের Spectrum বিশ্লেষণ করে নির্ভুল বিভিন্ন তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। যেমন সূর্যের তাপমাত্রা (প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), রাসায়নিক অণুর ত্রিমাত্রিক গঠনকাঠামো, অণুর মধ্যে কতগুলি বন্ধন, বন্ধন দূরত্ব, বন্ধন কোণ, একটি বন্ধনকে ভাঙতে কত শক্তি লাগবে, এরকম নানান তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। গবেষণার মাধ্যমে পরমাণুর গঠন এবং অতিপারমাণবিক কণা ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের ধর্মাবলী জানতে গিয়ে জানা যায়, প্রোটন এবং নিউট্রন সমন্বিত ধণাত্মক তড়িৎ আধানযুক্ত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন দুই ধরনের গতির সাহায্যে নিরন্তর আবর্তিত হয়ে চলেছে; ঠিক যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে নিরন্তর বার্ষিক গতি এবং আহ্নিক গতির সাহায্যে পৃথিবী আবর্তিত হয়ে চলেছে। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে একটি অরবিটাল গতি এবং অপরটি স্পিনিং গতি। অনুরূপে নিউক্লিয়াসেরও স্পিনিং গতি রয়েছে। নিউক্লিয়াসের স্পিনিং গতির কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল আলোচনায় এক ধরনের Spectrum, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (Nuclear Magnetic Resonance) Spectrum পেয়ে থাকি। যার ব্যাবহারিক এবং ব্যবসায়িক প্রয়োগে তৈরি হয়েছে MRI (Magnetic Resonance Imaging)। যা চিকিৎসাশাস্ত্রে রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে অনেক কিছুই ব্যবহৃত হয়, যার আবিষ্কার এবং বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পেছনে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভূমিকা অপরিহার্য। এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স সেই জগতের জন্য ব্যবহৃত হয়, যে জগৎটি হচ্ছে আমাদের দু’টি চর্মচক্ষে অদৃশ্য ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র কণার জগৎ। যে কণাসমূহের আচরণ-বিচরণ ধর্ম ইত্যাদির উপরে আমাদের শারীরবৃত্তীয় লক্ষণগুলি সরাসরি যুক্ত।

শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?

এই পর্বে, একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পৌঁছে, বেঁচে থাকার তাগিদে বিজ্ঞান সহ রসায়ন চর্চা এবং গবেষণার ফলে আমরা জানতে পেরেছি, আমরা যে গ্রহে বসবাস করি, সেই গ্রহকে ঘিরে যে প্রকৃতি, সেই প্রকৃতি অতিপারমাণবিক মৌল কণা ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দ্বারা গঠিত। উদাহরণস্বরূপ ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে সমস্ত মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলি গঠিত। ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের সংখ্যা এবং বিন্যাসের তফাৎ হেতু বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের ধর্মের তফাৎ হয়ে থাকে। আবার বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক সংশ্লেষণে যৌগিক পদার্থ তৈরি হয়। ফলে যৌগিক পদার্থের ধর্ম মৌলিক পদার্থের ধর্ম থেকে আলাদা হয়। যৌগিক পদার্থের বিভিন্ন অনুপাত মিশ্রনে নতুন মিশ্র পদার্থ তৈরি হয়। মিশ্র পদার্থের ধর্ম, যৌগিক পদার্থের ধর্ম থেকে আলাদা হয়ে থাকে। ঠিক যেমন মুড়ি এবং ঝাল আর ঝালমুড়ির স্বাদে তফাৎ আমরা সহজে বুঝতে পারি। তেমনই ডাল-ভাতের স্বাদ ডাল ও ভাতের স্বাদ থেকে আলাদা হয়।