আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
প্রবন্ধ
জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার - বৈজ্ঞানিক সাহসিকতার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত
আশীষ লাহিড়ী
জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার (১৯৩৮-২০২৫) ছিলেন একজন বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। ভারতের বহু বিজ্ঞানী সম্বন্ধে একথাটা বলা যাবে না। তাঁরা অনেকেই বিজ্ঞানী, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক নন। বিজ্ঞান তাঁদের অনেকের কাছে একটা জীবিকা মাত্র, জীবন নয়। নারলিকার এজন্যই আমাদের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি বিজ্ঞানের উচ্চতম মার্গে বিচরণ করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে বিজ্ঞানকে দেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা সমাজের কাছ থেকে যে-সুযোগ-সুবিধা পান, সেই ঋণ কিছুটা অন্তত শোধ করতে পারেন সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার জন্য সক্রিয় হয়ে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য, বিজ্ঞান বিরোধিতাকে প্রতিহত করবার জন্য, বিজ্ঞানীদেরই এগিয়ে আসতে হবে, এই বক্তব্যে অবিচল ছিলেন তিনি।
[ছবি]
ট্রেকিং-এ গুরুশিষ্যঃ নারলিকার ও ফ্রেড হয়েল।
বহু আগে যখন বিজেপি সরকার ফলিত জ্যোতিষকে 'বিজ্ঞান' বলে চালাতে চেয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ পড়াতে চেয়েছিল, তখন সেই অশ্লীল প্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নারলিকার। অনেকেই তখন তাঁর পাশে ছিলেন। তাতে দীর্ঘমেয়াদি ফল হয়নি, সম্ভবত যথেষ্ট সংখ্যক সক্রিয় বিজ্ঞানী এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি বলে। আজ বিজেপি-আরএসএস পক্ষই জয়ী। সেদিন কিন্তু শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রয়াত শহিদ ডাক্তার নরেন্দ্র দাভোলকরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুণেতে নারলিকার পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে প্রমাণ করেছিলেন, জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসম্মত সেই সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল 'কারেন্ট সায়েন্স' কাগজে।
আমাদের অবধারিতভাবেই মনে পড়ে যায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কথা। একশো দশ বছর আগে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, রাশিতাত্ত্বিক পদ্ধতি মেনে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বিচার করা হোক। তিনি আরও উচ্চাশী ছিলেন, জাতকের জন্মকালে ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলিকে জাতকের জীবনের পরবর্তী কুড়ি বছরের ঘটনাবলীর সঙ্গে মিলিয়ে ফলিত জ্যোতিষের বৈজ্ঞানিকতার দাবি যাচাই করার কথা বলেছিলেন। আমরা বাঙালিরা তাতে কর্ণপাত করিনি; কিছুটা অন্তত করেছিলেন মরাঠি বিজ্ঞানী নারলিকার আর মরাঠি ডাক্তার নরেন্দ্র দাভোলকর - যদিও প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাঁরা কেউই রামেন্দ্রসুন্দরের ওই লেখা পড়েননি। বিজ্ঞানের কল এভাবেই নড়ে।
কয়েক বছর আগে, মূলত চারটি শহর জুড়ে ছড়ানো তাঁর জীবনের অতি সুস্বাদু কাহিনি তিনি লিখেছিলেন ‘এ টেল অব ফোর সিটিজ’ বইতে। লক্ষণীয়, এটিও তিনি প্রথমে লিখেছিলেন মরাঠিতেই। মরাঠি বইটির অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেখে প্রকাশক বলেন ইংরিজি করতে, তখন লেখেন ইংরিজিতে। এ বই থেকে তাঁর বিজ্ঞানীজীবন শুধু নয়, তাঁর ধ্যানধারণার, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের, তাঁর বিশ্ববীক্ষার এক চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানজগতের অনেক বেদনাদায়ক কু-রাজনীতির খবরও এখানে নিজস্ব মৃদুভাষণে পেশ করেছেন। অবশ্য একথাও স্বীকার করেছেন যে তাঁর দেখা কেম্ব্রিজ, আঁস্তিতুত দাস্ত্রোফিজিক (পারি), ক্যালটেক প্রভৃতি কোনো তীর্থক্ষেত্রই কূট কু-রাজনীতি থেকে মুক্ত নয়। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তাঁর গুরু হয়েলকে রাজনীতি করেই তাড়ানো হয়েছিল কেম্ব্রিজ থেকে। তাঁর কথায়, “ক্ষমতা আর গরিমার আকাঙ্ক্ষা সব ধরণের মানুষের মধ্যেই আছে, অতি সাধারণ থেকে শুরু করে অতি উৎকৃষ্ট কাউকেই তা ছাড়ে না”।
বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্য, ভাষাচর্চা এবং অন্যান্য বিষয়ের কোনো মৌলিক বিরোধের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি তিনি। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মনে করতেন, অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়ানো উচিত মাতৃভাষায়। তা নাহলে বিজ্ঞান কখনও চেতনার গভীরে প্রবিষ্ট হবে না। সে-বিজ্ঞানে শিক্ষিত বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ভারবাহী হয়ে থাকবেন, প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানের ধারক হয়ে উঠতে পারবেন না। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজটাও হোক মাতৃভাষায়, এই ছিল তাঁর মত। নিজে মরাঠি ভাষায় অনেক বই লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন।
আধুনিক বিশ্বতত্ত্বে (কসমোলজি) তাঁর কাজ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচিত হয়। প্রথমে কোলাপুরের ইস্কুল, তারপর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর কেম্ব্রিজ, অবশেষে পুণে (দ্য ফোর সিটিজ!), এই চারটি শহর ঘিরে তাঁর জীবন আবর্তিত হয়েছিল। বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পিতা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার ছিলেন গণিতের স্বনামধন্য অধাপক। জয়ন্তবিষ্ণুর মতে তাঁর পিতাই ভারতে প্রথম সার্বিক আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। তাঁর মা-ও ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যে বিদূষী। আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, মা-র কল্যাণেই তাঁর সাহিত্যপ্রীতি। এরপর কেম্ব্রিজে কিংবদন্তিসম বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলের অন্যতম প্রিয় ছাত্র রূপে তিনি সর্বজনপ্রসিদ্ধ। প্রসঙ্গত, মনে পড়ে হয়েলের অতিপ্রিয় আর এক ক্ষণজন্মা পদার্থবিজ্ঞানীর কথা, তিনি হলেন অবিভক্ত ভারতের লাহোরের আবদুস সালাম। হয়েলের কাছে পড়তে পড়তেই তিনি হয়ে যান ‘পাকিস্তান’ নামক এক নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক। একেবারে অল্প বয়সে সালামের উপস্থিতিতে পেপার পড়েছিলেন নারলিকার। কেম্ব্রিজে আর একটু হলেই স্টিফেন হকিং তাঁর সহপাঠী হতে পারতেন। হকিং-ও চেয়েছিলেন হয়েলের কাছে কাজ করতে। কিন্তু হয়েলের তখন হাত ভর্তি, আর ছাত্র নেওয়া সম্ভব নয়। খানিকটা বাধ্য হয়েই ডেনিস সায়ামার ক্লাসে ভর্তি হন হকিং। দুজনের পথ দু'দিকে বেঁকে যায়। হয়েলের প্রভাবে নারলিকার বিগ ব্যাং-বিরোধী হয়ে ওঠেন, আর হকিং বিগ ব্যাং-এর জন্যই প্রসিদ্ধ হন। এমনকি কেম্ব্রিজে হয়েলের পক্ষ সমর্থনে হকিংয়ের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নারলিকার! একদা-বিখ্যাত 'স্টেডি স্টেট থিওরি'র প্রবক্তা ফ্রেড হয়েল-এর সঙ্গে যৌথভাবে উপস্থাপিত হয়েল-নারলিকার তত্ত্ব বহু-আলোচিত। এ তত্ত্বে বিগ ব্যাং-এর পালটা মত পেশ করেন তাঁরা, যাতে বলা হয়, একটা মাত্র আদি মহা-বিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ডর সৃষ্টি হয়নি; ব্রহ্মাণ্ডে অজস্র ছোটো ছোটো বিস্ফোরণ হয়েই চলেছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো আদি নেই, অন্ত নেই - ‘স্টেডি স্টেট’ কথাটার এই তাৎপর্য। বলা বাহুল্য, ইদানীং অধিকাংশ বিজ্ঞানী এই মত মানতে নারাজ। নারলিকার কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত মনে করতেন, বিগ ব্যাং-এর সপক্ষে যথেষ্ট অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ না-থাকা সত্ত্বেও, খানিকটা অন্যায়ভাবে অন্য বিকল্প তত্ত্বগুলোকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে হয়েল-নারলিকার তত্ত্বর সত্যতা প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি বলে তিনি মনে করতেন। এই অভিযোগ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রর নৈর্ব্যক্তিকতার দাবি সম্বন্ধে আমাদের ভাবিয়ে তোলে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, "যেসব সম্মান, পুরস্কার আর স্বীকৃতি আমি পেয়েছি, সবই অযাচিত। আমি এও বুঝি যে এ বাবদেও আমি আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম, যদি আমার কাজগুলো সংখ্যাগুরুর প্রিয় মতবাদগুলির দ্বারা সমর্থিত হতো"। তাঁর কথায়, "আজ বেশিরভাগ লোকেরই মত এই যে ব্রহ্মাণ্ডর সৃষ্টি হয়েছিল একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা ভোটাভুটি যদি হয়, দেখা যাবে, বিপুল গরিষ্ঠাংশই ওইদিকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু ওই তত্ত্বানুমানের সপক্ষে একেবারে অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ ক'জন হাজির করতে পারবেন? বস্তুত উক্ত তত্ত্বানুমানের সপক্ষে যেসমস্ত পর্যবেক্ষণ পেশ করা হয়ে থাকে সেগুলোকে সমর্থনের জন্য আবার প্রয়োজন হয় আরও অনেক 'উপচক্রিকা'র (এপিসাইক্ল) - অর্থাৎ অপ্রমাণিত অনুমানের"। তাঁর মতে এটা স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রর ব্যত্যয়।
বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে বিচারের অধিকারী আমরা নই। আমাদের মতো লোকেদের যেটা মুগ্ধ করে তা হল তাঁর স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার দুর্দম সাহস। সেটা ফলিত জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে চালাবার অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই হোক, পুজো দেওয়া কিংবা মানত করার ছলে ঘুষ দেওয়া-নেওয়াকে ‘পবিত্র’ বলে মান্যতা দেওয়ার বিরুদ্ধেই হোক, কিংবা তাঁর বিবেচনায় অযৌক্তিকভাবে বিগ ব্যাং তত্ত্বকে সর্বজনসিদ্ধ বলে মান্যতা দেওয়ার বিরুদ্ধেই হোক। অথচ কখনোই তিনি উচ্চকিত নন। শান্ত, নম্র, যুক্তিনিষ্ঠতাই তাঁর চরিত্রলক্ষণ। এক কথায়, বিজ্ঞানের যা নিখাদ বৈশিষ্ট্য, তারই অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন তিনি।
আইনস্টাইনের মত অনুসরণ করে তিনি 'পার্সোনাল গড' ধারণাটির ঘোর বিরোধী ছিলেন। জাগতিক কোনো লাভের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা বা মানত করাকে তিনি সোজাসুজি ঘুষ দেওয়া বলে অভিহিত করেছেন। আমাদের মনে পড়ে যায় অক্ষয়কুমার দত্তর সেই ১৭০ বছরের পুরোনো সমীকরণের কথাঃ
শ্রম = শস্য; শ্রম + প্রার্থনা = শস্য; অতএব প্রার্থনা = ০।
আবার, মানুষের তৈরি গণিত আর বিজ্ঞানের সূত্রগুলি কী করে মহাবিশ্বের অতিদূর জ্যোতিষ্কদের গতিপ্রকৃতির এত নির্ভুল হদিশ দেয়, সেটা অনেক বিজ্ঞানীর মতো তাঁকেও অবাক করেছিল। এর পিছনে বর্তমান বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতীত কোনো শক্তির ক্রিয়া আছে কিনা, এ প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর মনে। এটা স্বাভাবিক; দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আশ্রয় না-নিলে, একরৈখিক যান্ত্রিক যুক্তিপ্রণালীর সাহায্য নিলে এ-হেঁয়ালি চিরকাল হেঁয়ালিই থেকে যাবে। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ কিংবা নারলিকারদের মতো নিবেদিতপ্রাণ, মুক্তমনা বিজ্ঞানীরা যে কেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দর্শন নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন না, সেটা ভাবলে আক্ষেপ হয়। এই আক্ষেপটুকু নিয়েই আমরা সদ্যপ্রয়াত এই সজ্জন, নম্র, দৃঢ়চেতা, বৈজ্ঞানিক নীতিনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।