আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

সিঁদুরের মহিমা সিঁদুরের মাহাত্ম্য

অর্ধেন্দু সেন


কাশ্মীরে পর্যটকের সংখ্যা ইদানীং ভালই বেড়েছিল। সরকারও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সেই প্রচারে আশ্বস্ত হয়ে পর্যটকরা আরও বেশি সংখ্যায় যেতে শুরু করেছিলেন কাশ্মীর উপত্যকায়। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সন্ত্রাসবাদীরা। ২২ এপ্রিল পহেলগামে অতর্কিতে আঘাত হেনে তারা ২৬ জন পর্যটককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল হবার পর থেকেই সরকার বলে আসছিল কাশ্মীরের উন্নয়নে আর বাধা রইল না। এবার বিনিয়োগ হবে, চাকরি হবে, উন্নয়ন হবে। সর্বত্র শান্তি বজায় থাকবে। সন্দেহ নেই যে, এই ন্যারেটিভকে খণ্ডন করাই ছিল হামলাকারীদের উদ্দেশ্য।

ঘটনার দিন পিএম মোদী ছিলেন বিদেশে। সফর কাটছাঁট করে তিনি ফিরে আসেন দিল্লি। দেশজুড়ে শুরু হয় অধীর প্রতীক্ষা। কবে কোথায় কীভাবে প্রত্যাঘাত করেন তিনি। শেষমেশ ৭ মে ভোর হবার আগেই ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানে ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ৯টি জঙ্গি ঘাটি বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়। ২০১৯-এ পুলওয়ামা কাণ্ডে আমরা দেখেছিলাম একই ধরনের অ্যাকশন যদিও তার তীব্রতা ছিল অনেক কম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আগেই বলেছিলেন মোদীর নেতৃত্বে প্রত্যাঘাত হবে দেশবাসীর মনের মতো। হলও তাই। ভক্তেরা অবশ্য করাচি ও ইসলামাবাদ দুইই চেয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য সরকার সে কথায় কর্ণপাত করেনি।

পিএম মোদী যে শুধু প্রত্যাঘাত সংগঠিত করলেন তাই নয়। সেই অভিযানের নামকরণও করলেন নিজেই - 'অপারেশন সিঁদুর'। কী তাৎপর্য এই নামের? আজকের আলোচনা কাশ্মীর সমস্যার উৎস বা সমাধান নিয়ে নয়। অপারেশন সিঁদুরের যৌক্তিকতা বা কৌশলগত দিক নিয়ে নয়। শুধুমাত্র অভিযানের নামকরণ নিয়ে। নামের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বার্তাটিকে নিয়ে। আমরা আগেও দেখেছি হিন্দু নারীর সুরক্ষা নিয়ে পিএম মোদী বিশেষ চিন্তিত। সাধারণ নির্বাচনে তিনি আমাদের সাবধান করে বলেছিলেন, কংগ্রেস জিতলে তারা মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে বিলি করে দেবে ‘ওই যাদের বাচ্চা বেশি হয়’ তাদের মধ্যে। সে কথায় ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ ওঠে। পিএম মোদী তখন বলেন তিনি মুসলমানদের কথা বলেননি। তাহলে কাদের কথা বলেছিলেন তিনি? সে প্রসঙ্গ আজকে থাক।

হামলাকারিরা পাকিস্তান থেকে চোরা পথে কাশ্মীরে ঢুকেছে এবং তারা পাকিস্তান সরকারের মদতপ্রাপ্ত। এই কথায় যখন সন্দেহ রইল না তখন নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল যে অপারেশন সিঁদুরের প্রথম লক্ষ্য হবে পাকিস্তানকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া। বেশ কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানকে বলা হচ্ছে ব্যর্থ রাষ্ট্র। যুদ্ধ চালাবার ক্ষমতা তাদের আদৌ নেই। সেই দেশ কিনা ভারতকে আক্রমণ করার সাহস দেখায়? দ্বিতীয়ত খবরে প্রকাশ যে, পহেলগামে আতঙ্কবাদীরা পর্যটকদের মারবার আগে জিজ্ঞাসা করেছিল তারা হিন্দু কিনা। তাই উচিত শিক্ষা দিতে হবে বিধর্মীদের। তৃতীয়ত এই সুযোগে যদি আধুনিকতার টুঁটি টিপে ধরা যায় তাতে মন্দ কী? পুরো ব্যাপারটা তো এনসিইআরটি-র উপর ছাড়া যায়না। এই তিন উপাদান দিয়ে তৈরি হল তাঁর অভিযান।

অভিযান শুরু হতেই তার গতিপ্রকৃতি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হল সংবাদ মাধ্যমকে। দায়িত্ব পেলেন বিদেশ সচিব। সারা বিশ্বই দুই পারমানবিক শক্তির যুদ্ধের পরিণতি জানতে আগ্রহী এবং বিদেশ সচিবই তাদের পরিচিত মুখ। বিদেশ সচিবের দুই পাশে দেখা গেল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দুই প্রতিনিধিকে - স্থলসেনার কর্নেল কুরেশি এবং বায়ুসেনার উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। দুজনেই মহিলা অফিসার।

মহিলা অফিসারদের সামনে আনা হল কেন? মহিলা পুলিস এবং সেনা অফিসার আমাদের দেশে স্ত্রীশক্তির প্রতীক। সে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই হোক বা হিন্দি সিনেমায়। এককালে আমরা দেখতাম দুখিনী মা-কে জামাকাপড় সেলাই করে ছেলেদের মানুষ করতে। সাহসিনীর সেই ছবি পুরোনো হয়ে গেছে। তাছাড়া এই বার্তাও দেবার ছিল যে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা ছাড়াও স্পর্শকাতর কাজেও ভারতীয় নারীরা সমান পারদর্শী। সবশেষে অপারেশন সিঁদুর তো তাদেরই স্বার্থে; তাই না?

সবই ঠিক ছিল কিন্তু দুই মহিলার মাথায় সিঁদুর কোথায়? কর্নেল কুরেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তিনি সিঁদুর পরবেন না। কিন্তু ব্যোমিকা? দুই অফিসার মিলে জাতীয় ঐক্যের যে বলিষ্ঠ ছবি তৈরি করলেন সিঁদুর তার অঙ্গ হতে পারল কই? হিন্দু নারীরা কি সবাই সিঁদুর পরেন? গোটা দক্ষিণ ভারতেই সিঁদুরের প্রচলন নেই। পহেলগামের আক্রমণে নিহত ক্যাপটেন নরওয়ালের শোকস্তব্ধ স্ত্রীকে আমরা দেখেছি। তাঁর কপালেও সিঁদুর দেখিনি। আসলে পিএম মোদী যতই মঙ্গলসূত্র আর সিঁদুরের কথা বলুন, আধুনিক হিন্দু নারীরা এখন পুরুষতন্ত্রের এই প্রতীকগুলোকে মূল্য দিতে চান না।

প্রশ্ন উঠতে পারে হিন্দু নারীরা বিবাহের পরে মাথায় সিঁদুর লাগান কেন? ভারতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মূল খুঁজতে হলে আমাদের ঢুকতে হবে বেদ উপনিষদ এবং পুরাণে। পুরাকাল থেকেই বিবাহিত হিন্দু নারীরা মাথায় সিঁদুর লাগান। শাস্ত্রে বলে এই প্রথা চালু করেন দেবী পার্বতী নিজেই। সীতাদেবী এবং দ্রৌপদীও তাঁদের স্বামীদের মঙ্গলার্থে সিঁদুর পরতেন। সিঁদুরে মিশ্রিত থাকে পারদ যা কিনা তরল ধাতু। এই উপাদানটির জন্যই সিঁদুর দৈব ক্ষমতার অধিকারী হয়। মস্তিষ্কের এত কাছে বহুগুণসম্পন্ন সিঁদুর লাগানোর ফলে মহিলাদের চিন্তাভাবনা স্বচ্ছ হয়। তাঁরা পতিব্রতা হন। মহিলাদের প্রথমবার সিঁদুর পরিয়ে দেন তাঁদের স্বামীরা। সেইসঙ্গেই অঙ্গীকার করেন তাঁরা স্ত্রীদের রক্ষা করবার। বিবাহের ভিত শক্ত হয়। মেকলেপুত্রেরা বলবে এসব ছেলে ভোলানো গল্প। তাদের কথা শুনব কেন?

আন্তর্জালে অবশ্য সিঁদুরের অন্য ব্যখ্যাও পাওয়া যায় যা বাংলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। অসবর্ণ মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করাই ছিল প্রথা। হাতে পায়ে যে বেড়ি পরানো হতো সেটা পরিণত হয়েছে শাঁখা চুড়ি আর মলে। সিঁদুর আর কিছুই নয় মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবার প্রতীক। এককালে মেয়েরা সিঁদুর লাগিয়েছে আত্মরক্ষার তাগিদে। উঁচু জাতের পুরুষকে জানান দিতে যে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। পরে সেটা ষোল শৃঙ্গারের একটা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে উঁচু জাতের ভাষ্যটাই প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। তাই শশী তারুর নির্দ্বিধায় বলতে পারেন ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামটি তাঁর পছন্দের।

সিঁদুর কাকে রক্ষা করে? যিনি সিঁদুর পরেন তাঁকে, তাঁর স্বামীকে অথবা চালককে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ প্যারিসে গিয়েছিলেন র‍্যাফাল বিমান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে। তিনি পরম ভক্তিভরে বিমানে সিঁদুর লাগাচ্ছেন সে ছবি আমাদের মনে এখনও উজ্জ্বল। তা নিশ্চয়ই বিমান এবং বিমান চালক দু'য়েরই সুরক্ষার জন্য। কিন্তু যখন গুজব রটল যে একটি র‍্যাফাল বিমানকে পাকিস্তানের বায়ুসেনা ধরাশায়ী করেছে তখন সরকারিভাবে দুটো কথা বলা হল। এক) কোনো বিমানচালক বিপদগ্রস্ত হননি। দুই) যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েই থাকে। অর্থাৎ বিমানের চেয়ে চালকের মূল্য বেশি।

হিন্দুত্বের অন্যান্য প্রতীকও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক মেয়ে বিয়ে করতে চায়না। পরিবার এবং সমাজের চাপে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেও তারা বিয়ে করাকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন না। অনেকে বাপ মায়ের মত অগ্রাহ্য করে প্রেম-বিবাহ করেন। কতজন বিয়ের পরে সিঁদুর লাগায়? কতজন স্বামীর পদবি গ্রহণ করেন? কতজন স্বামীর মঙ্গলকামনা করে ব্রত রাখেন? এখনও নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমী মহিলাদের সংখ্যা কম কিন্তু, মনে হয়, তা দ্রুত বাড়ছে। জাতির উন্নয়নের স্বার্থে যদি জাতি গণনার প্রয়োজন থাকে তাহলে মহিলাদের প্রগতির স্বার্থে সমীক্ষা চালিয়ে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা জরুরি।