আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

যুদ্ধে নিহত হচ্ছে পরিবেশও

মালবী গুপ্ত


বিপুল হারে, কিন্তু তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। সেই কোন সুদূর অতীত থেকে এই উত্তর আধুনিক যুগেও চলতে থাকা যুদ্ধ-সংঘাত-সংঘর্ষে নিহত ও আহত মানুষের পরিসংখ্যান হয়তো মিলছে।তবে তাতে ধ্বংস হওয়া প্রকৃতি ও পরিবেশের তথ্য বেশির ভাগই অধরা থেকে যাচ্ছে। যার অপরিসীম প্রভাব মানুষের জীবনকেই ধ্বস্ত করে চলেছে। যার আর্থ সামাজিক মূল্যায়ন বোধহয় এক রকম অসম্ভবই।

কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে, সে আমেরিকান সিভিল ওয়ার হোক, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিম্বা ইরাক, আফগানিস্তান ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক, মানুষের পাশাপাশি কোটি কোটি গাছপালা, বন্যপ্রাণ নিহত হচ্ছে। ব্যবহৃত আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, বিস্ফোরক ও রাসায়নিক জল-মাটি-বাতাসের ব্যাপক দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। বিধ্বস্ত হচ্ছে সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ। পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে ১৯১৪-২০২৩ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশে করা ১৯৩ কেস স্টাডি জানাচ্ছে, যুদ্ধে অরণ্য ধ্বংস (৩৪%) ও ভূমিক্ষয় (২৩%) ঘটেছে সব থেকে বেশি। যুদ্ধজাহাজ থেকেও ব্যাপক সামুদ্রিক দূষণ ঘটে চলেছে। যার ফলে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

দেখা যায় অস্ত্রর ব্যবহার ছাড়াও, সেনাবাহিনীর গাড়ি চলাচল, তাদের অস্থায়ী শিবির, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির কারণে পরিবেশের ওপর চাপ পড়ে।সশস্ত্র জঙ্গিদের সংঘর্ষ ও তাদের দমনের জন্য অনেক সময়ই ব্যাপক হারে অরণ্য ধ্বংস করা হয়। বিপদে পড়ে বন্যপ্রাণীরা। আর সংঘাত ও যুদ্ধের কারণে যে পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছেন, গৃহহীন সেই সব মানুষ যে সব শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা জীবনের মৌলিক পরিষেবাগুলি থেকেও বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর।

যেমন, ইজরেইলি হামলায় বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলছে, সেখানে মাত্র ৩ মাসের যুদ্ধেই নথিভূক্ত হয়েছিল ৫ বছরের কম বয়েসি ১,৭৯,০০০ শিশুর মারাত্মক শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ ও ১,৩৬,০০০ শিশুর ডায়েরিয়ার ঘটনা। যা পরিবেশগত কারণেই ঘটে। আসলে যে যুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, সেই যুদ্ধই তো ধ্বংস করে দেয় জীবনের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ। ধ্বংস করে দেয় জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিষেবাও।

কারণ বড় ছোট সমস্ত যুদ্ধ ও সংঘাতে যে সব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, তার প্রভাবে পৃথিবীতে ব্যাপক উষ্ণায়ন ও দূষণ ঘটে চলেছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে জলবায়ু পরিবর্তনেও তার বড় ধাক্কা এসে লাগছে। বর্তমান তার কিছু মূল্য চোকাচ্ছে। ভবিষ্যতকেও নানাভাবে তা অনেক বেশি করে হয়তো চোকাতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে শুধু ২০২৩-এই ১৭০টির বেশি সশস্ত্র সংঘাত ঘটেছে। সেই বছর শেষে পৃথিবীর ১২ কোটি মানুষকে জোর করে উৎখাত করা হয়েছে তাদের বাসভূমি থেকে। এবং সেই সব সংঘাতে সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর বিশাল প্রভাব পড়ছে। ধরা যাক মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে বিনাশী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর কথা। তাতে সেনা ও সাধারণ নাগরিক নিয়ে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এবং সেই যুদ্ধ থেকেই পরমাণু বিস্ফোরক তথা বোমা এবং নানাবিধ রাসায়নিকের যে ব্যবহার শুরু হল, তাতে বিশ্ব পরিবেশের ওপর যে অনিবার্য ও চিরস্থায়ী প্রভাব পড়ে চলেছে, তার মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভবই।

কারণ যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওজন লেয়ার। এবং রাশিয়ার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের ওপর যে আঘাত পড়েছে, তাতে নানা উদ্ভিদ, স্তন্যপায়ী সহ বিপুল বন্যপ্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যার বিরাট প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্রের ওপর। আর স্থানীয় অরণ্যনির্ভর জীবিকা যাঁদের, তাঁরা একাধারে সবই হারিয়েছেন।তবে আশ্চর্য এই যে, নিরবধি কাল ধরে যুদ্ধে সংঘর্ষে মানুষ একাধারে হত্যা করে চলেছে মানুষকে। আবার যুদ্ধে যোগদানকারী সেই মানুষই একই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের মূলে অবিরত কুঠারাঘাতে নিজস্ব বাসভূমিকেও চরম নৃশংসতায় ধ্বংস করে চলেছে।

হয়তো সেই কারণেই 'গার্ডিয়ান'-এর চিত্রগ্রাহক, দু’বারের 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো' উইনার অ্যালেসিও ম্যামো বলেছেন, "যুদ্ধ হল প্রকৃতির ওপর মানুষের হিংসার চরম উদাহরণ।" যিনি দীর্ঘদিন ধরে সিসিলি, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান, ইউক্রেন-এ সেনা, সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে ছবি তুলে চলেছেন। 'গার্ডিয়ান'-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের বৃহত্তম সংঘাত রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে শুধু যে ৪৬ হাজারের বেশি ইউক্রেনিয়ান সেনা নিহত তাই নয় এবং সংখ্যাটি ক্রমবর্ধমান। তাই বহু শহর ও গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনের নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। নাগরিকদের মতোই চরম দুর্দশায় পড়েছে সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশও।

বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠেছে বহু প্রজাতির অস্তিত্বে। 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড'-এর হিসেব অনুযায়ী ৩০ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি অরণ্য সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত। যার মধ্যে ১০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ইউক্রেনের এই সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডঃ বোহদান ভাইকোর জানান যে, "প্রকৃতির কিছু কিছু অংশ আমরা চিরতরে হারিয়েছি। অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বসতিও একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।"

আসলে যুদ্ধে ক্ষমতা প্রদর্শন, আগ্রাসন বা আধিপত্যবাদের চরম ঔদ্ধত্যই পৃথিবীর নানান কোণে প্রাকৃতিক অরণ্য, জলাশয়, নদী, সমুদ্র সবই ধ্বংস করে চলেছে। যাদের পূর্বাবস্থায় আর ফেরানো যাবে না। একেবারে এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ সংঘর্ষের কথায় আসি। ভারতের পহেলগাঁও-এ পাকিস্তানি জঙ্গিদের হাতে ২৬ জন সাধারণ পর্যটকের নৃশংস হত্যার জবাবে পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংসের লক্ষ্যে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার উত্তর প্রত্যুত্তরে দু’দেশেই সংর্ঘষ ঘনিয়ে ওঠে। দু’তরফেই কিছু প্রাণহানি ঘটে। আপাতত সংঘাত বিরতির কথা ঘোষণা করায় ভারত ও পাকিস্তান আর কোনও মিসাইল ছুঁড়ছে না বটে কিন্তু ভারতের পাকিস্তানের প্ররোচনায় সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গি সহিংসতা যতক্ষণ বন্ধ না হচ্ছে, ভারত দু’দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালে হওয়া ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ আপাতত খারিজ করে সিন্ধু নদের জল পাকিস্তানকে সরবরাহ বন্ধ করে রাখছে।

'দ্যকনভারসেশন.কম' থেকে আরও জানতে পারছি, যার ফলে অভূতপূর্ব প্রভাব পড়তে চলেছে হিমালয়ান অঞ্চলের প্রকৃতি পরিবেশ এবং ওই অঞ্চলের ভূরাজনীতির ওপরও। জল নিয়ে ভারতের আপাতত সমস্যা না হলেও পাকিস্তানে সিন্ধুনদের জল না পৌঁছলে সেখানে চাষাবাদে সেচের জল, পানীয় জল, জলবিদ্যুৎ, ভবিষ্যতে খরা ইত্যাদির মতো বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠবে। এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন হুমকির মুখে পড়বে সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্রের ওপর যে কতটা প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ তার ইঙ্গিত দেবে।

সত্য যে, শুধু যুদ্ধ সংঘর্ষই নয়, প্রাকৃতিক কারণেও প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশ নানাভাবে ধ্বংস হয়েছে। নৃতত্ত্ববিদরা এই প্রমাণও পেয়েছেন যে, প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে যখন মাত্র ২ লক্ষ হোমোস্যাপিয়েন পৃথিবীর বুকে বিচরণ করত, তখনও জীবনধারণের তাগিদেই গাছপালা এবং বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল তাদের হাতে।

তবে 'গ্রিনপিস' জানাচ্ছে, পরিবেশগত সচেতনতার উদ্দেশ্যে সেই ৫,০০০ বছর আগেও কিন্তু বৈদিক ঋষিদের স্তোত্রে বন্য প্রকৃতির প্রশংসা উচ্চারিত হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০-এ, গ্রিক দার্শনিক জেনো বলেছিলেন, "জীবনের লক্ষ্যই হল প্রকৃতির সঙ্গে চুক্তি করে জীবনযাপন করা।" তবে কে আর কবে মুনি ঋষি কিম্বা দার্শনিকদের কথায় কর্ণপাত করেছে। তাই সভ্যতার অগ্রগতি মানেই তো নিরবধি কাউকে না কাউকে হত্যা করে, কোথাও না কোথাও ধ্বংসের গাথা রচিত হয়ে চলেছে।

এবং দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে সেনাবাহিনী ও নানা সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনদের যুদ্ধ উন্মাদনা দূষিত করেই চলেছে জল মাটি হাওয়াকে। তবু প্রায়শই পৃথিবীর আমরা অনেকেই কোনও কোনও নৃশংস সংর্ঘষ ও যুদ্ধের দামামায় অতি উৎসাহী হয়ে পড়ছি ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা না ভেবেই। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছি। আবার অনন্যোপায় কেউ কেউ আমরা এই নীল গ্রহের সেই সর্বাত্মক ধ্বংসচিত্রের যেন নির্বাক দর্শকে পরিণত হয়ে যাচ্ছি।