আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

সমসাময়িক

সব মন্তব্য নয় সমান!


দেশের রাজনীতিতে কু-কথা নতুন নয়। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা সেই পরম্পরাকে নিত্যনতুন গহ্বরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে, 'অপারেশন সিঁদুর' নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রচারে ব্যস্ত। অন্যদিকে, বিজেপি-র কিছু নেতা যা সব উক্তি করছেন তা শুনলে ক্ষোভ জন্মায় এই কথা ভেবে যে এদেরকে মানুষ ভোট দিয়ে নেতা বানিয়েছেন!

উদাহরণ একঃ মধ্য প্রদেশে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী কুমার বিজয় শাহ, কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে কদর্য মন্তব্য করলেন। তিনি কর্নেল কুরেশিকে বকলমে 'উগ্রপন্থীদের বোন' বলে বর্ণনা করলেন। ভেবে দেখুন। দেশের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার, যাঁকে সরকারীভাবে প্রেস কনফারেন্সে বয়ান দিতে পাঠানো হয়েছে, তাঁকে তাঁর ধর্মের জন্য এমন কদর্য আক্রমণ করা হল। মন্ত্রীমশাই কি এই বয়ানের পরে মন্ত্রীত্ব পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন? না। তাঁকে কি বিজেপি দল থেকে বহিষ্কার করেছে? না। তাঁকে কি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে? না। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর পেশ করা মাফিনামাকে নাকচ করেছে। কিন্তু বিজেপি এই সাম্প্রদায়িক দেশবিরোধী উক্তির জন্য তাদের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

উদাহরণ দুইঃ বিজেপি রাজ্যসভা সাংসদ রামচন্দ্র জাংড়া বয়ান দিলেন যে পহেলগামে যেই নারী তথা স্ত্রীরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে লড়াকু মনোভাব কম থাকায়, তাঁরা তাঁদের স্বামীদের বাঁচাতে পারেননি, এবং উগ্রপন্থীরা সংখ্যায় কম থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতিহত করা যায়নি। সদ্য বিধবা হওয়া মহিলারা, যাদের জীবন বিধ্বস্ত করে দিয়েছে সেই জঙ্গিরা, যারা তাদের শোক কাটিয়ে ওঠার সময়টুকুও পাননি, তাদেরকেই দোষারোপ করছেন দেশের শাসক দলের সাংসদ। আবারও, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তার বিরুদ্ধে শাসক দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তার সাংসদ পদ বহাল আছে। এবং তিনি জনমতের চাপে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেও বলেছেন যে তার বক্তব্যের নাকি অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।

দেশের শাসক দলের রাজনীতিবিদরা যেখানে কদর্য কথা বলেও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেখানে একজন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক আলি খান মেহমুদাবাদ একটি ফেসবুক পোস্ট করে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেই পোস্টে তিনি লিখেছিলেন যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে 'অপরেশন সিঁদুর'কে তিনি সমর্থন করেন। কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে সামনে নিয়ে এসে সরকার ভালো বার্তা দিয়েছে কিন্তু সেই বার্তা সমাজের সর্বস্তরে যায়নি। ধর্মের নামে গণপিটুনিতে যে সব মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তাদেরকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে। দুই মহিলাকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করানোর দৃশ্য ভালো, কিন্তু তাকে বাস্তবের মাটিতে বাস্তবায়িত না করতে পারলে তা দ্বিচারিতার সামিল হবে। অধ্যাপক খান, একই সঙ্গে বলেন যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপকে তিনি সমর্থন করলেও, তিনি যুদ্ধন্মাদনার পক্ষে নন, যারা যুদ্ধ চাইছে, তাদের সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন।

তিনি যেই মতামত ফেসবুকে লিখেছিলেন তা ভারতের বহু প্রগতিশীল মানুষের মতামত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বয়ানে একই ধরণের কথা বলেছিল। কিন্তু অধ্যাপক খানের বিরুদ্ধে হরিয়ানা মহিলা কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করে, তাঁর কর্মস্থল অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিম যায়। মহিলা কমিশন এবং আরেক বিজেপি নেতা তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেন। যার ভিত্তিতে অধ্যাপক খানকে গ্রেপ্তার করে হরিয়ানা পুলিশ। ফেসবুকে তাঁর মতামত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগ করার জন্য অধ্যাপক খানকে গ্রেপ্তার হতে হল। এটি অত্যন্ত লজ্জার।

সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেন অধ্যাপক খান। সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাপক খানকে জামিন দিলেও মহামান্য আদালতের বক্তব্য বিতর্কের উদ্রেক করেছে। অধ্যাপক খানকে কোর্ট তাঁর পাসপোর্ট জমা করতে নির্দেশ দেয় এবং লেখালেখি করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। বিচারপতিরা একটি তিন সদস্যের সিট গঠন করে তাদের নির্দেশ দেন যে তারা যেন এই পোস্ট পড়ে তাঁর আসল অর্থ নিরূপণ করে!

অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাপক খানের উপরে একপ্রকার নিষেধাজ্ঞা লাগু করে, এবং তাঁর পোস্টের নিগূঢ় অর্থ অনুধাবন করার জন্য পুলিশের টিমকে নির্দেশ দেয়। মহামান্য বিচারপতিরা কেন এই প্রকার নির্দেশ দিলেন তার ব্যাখ্যা তাঁরাই করতে পারবেন। আমরা শুধু বলতে চাই যে পোস্টের অর্থ অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়ছেই বা কেন? ভারতের সংবিধানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা যদি না গণজীবনে কোনো অশান্তির সৃষ্টি করে। যদি অধ্যাপক খানের পোস্ট মত প্রকাশের অধিকারের সীমাকে উল্লঙ্ঘন করে থাকে, তবে তা বোঝার জন্য পুলিশের সাহায্য নিতে হবে কেন? আমাদের দেশের উচ্চতম আদালতের বিচারপতিরাই তো তার অর্থ বোঝার জন্য যথেষ্ট। তাহলে এক কথায় অধ্যাপক খানকে জামিন দিয়ে আবার তার পোস্টের মর্মোদ্ধারের প্রয়োজন পড়ছে কেন?

অনেক আইন বিশেষজ্ঞ মনে করাচ্ছেন যে সুপ্রিম কোর্টের বেশ কিছু মামলার রায়। ২০১৫ সালের শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে এমনকি যেইসব বক্তব্য মানুষের মনে বিরক্তি জাগায়, অথবা রাগের জন্ম দেয় এমনকি যা মানুষের মনে আঘাত করে, সেই সমস্ত বক্তব্য সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারার দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এই বছরের মার্চ মাসেও একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে লিখিত বা উল্লিখিত শব্দের অভিঘাত কেমন হবে তা বুঝতে হবে একজন যুক্তিবাদী এবং সাহসী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কোনো দুর্বল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, যিনি যেকোনো সমালোচনাকেই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন।

সুপ্রিম কোর্ট বিগত বহু মামলায় মত প্রকাশের অধিকারকে সুরক্ষিত করেছেন। অধ্যাপক খানের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে না, এই আশা আমরা রাখি। কিন্তু জামিন দেওয়ার পরেও কোর্টের আরোপ করা শর্তাবলী দেখে অনেকের মনেই নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে, যা সুপ্রিম কোর্টের সুনামের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অধ্যাপক খানের বক্তব্যকে কেউ সমালোচনা করতেই পারেন। এমনকি, তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার অধিকারও মানুষের রয়েছে। কিন্তু তাঁর কথার জন্য তাঁকে জেলে নিক্ষেপ করা গুরুতর অন্যায়। আমরা আশা করব, আগামীদিনে সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাপক খানের উপর থেকে সমস্ত মামলা তুলে নেওয়ার আদেশ দেবেন, এবং তাঁর উপর আরোপিত সমস্ত শর্ত তুলে নেবেন।