আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

সমসাময়িক

পশ্চিমবঙ্গ কোনো মগের মুল্লুক নয়


ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা সরকারি কর্মীদের সাংবিধানিক অধিকার কিনা এই নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সম্প্রতি, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় মহার্ঘ ভাতা দেবার ক্ষেত্রে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট-এর এই নির্দেশ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারি কর্মী, শিক্ষক, বিধিবদ্ধ পঞ্চায়েত কর্মী, পুরকর্মী, পেনশনভোগী এবং পারিবারিক পেনশনভোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের বেতন কাঠামোর একটি অংশ এই মহার্ঘ ভাতা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকারি কর্মীদের জীবনযাত্রায় মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কমাতে মূল বেতনের শতাংশ হিসেবে গণনা করে প্রতি মাসে বেতনের সঙ্গে এটি দেওয়া হয়। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা সমানুপাতিক - মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সরকার তার কর্মীদের কাছে দায়বদ্ধ তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য। আয়কর আইন ১৯৬১-এর বিধান অনুসারে বেতনের এই অংশটি করযোগ্য ‘ভাতা’। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীরা ১৮ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পান, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা পান ৫৫ শতাংশ হারে। ডিএ নিয়ে রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল; এর পরে সুপ্রিম কোর্ট-এ প্রায় ১৮ বার এই মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। তবে এবারে সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তার কর্মীদের বকেয়া ডিএ-র ন্যূনতম ২৫ শতাংশ অবিলম্বে মিটিয়ে দিতে বলেছে।

রাজ্যের তরফে আদালতে যুক্তি দেওয়া হয়, ‘ডিএ সরকারি কর্মীদের সাংবিধানিক অধিকার নয়।’ সুপ্রিম কোর্টের পালটা যুক্তি, ‘মহার্ঘ্য ভাতা সাংবিধানিক অধিকার নয় ঠিকই, তবে তা বলে দিনের পর দিন টাকা না দেওয়াটাও কাজের কথা নয়।’ তাদের আদেশে বলা হয়েছে, রাজ্যকে প্রদেয় মহার্ঘ ভাতার পরিমাণের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ৪ সপ্তাহের মধ্যে কোনো শ্রেণিবিভাজন না করে সকল প্রাপককে দিতে হবে। এই নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে রাজ্যের গুরুতর পরিণতি হতে পারে এবং বিষয়টি ৪ঠা আগস্ট (পরবর্তী শুনানির তারিখ) সুপ্রিম কোর্টের সামনে আনা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, সরকারি কর্মী, পেনশনভোগী এবং পারিবারিক পেনশনভোগীরা ডিএ পাওয়ার যোগ্য।

এই প্রসঙ্গে আরেকটা প্রশ্নও উঠেছে - জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সকল মানুষের জীবনযাত্রাতেই তার প্রভাব পড়ে। তাহলে সরকারি কর্মীরা শুধু মহার্ঘ ভাতা কেন পাবে!

বেসরকারি কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল শ্রম আইন - তাতে মহার্ঘ ভাতা নেই। খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারি চাকরিতে বেতন কাঠামো বিভিন্ন বিষয়ের উপরে নির্ভর করে - এর মধ্যে কোম্পানির আকার ও প্রকার গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কর্মস্থলের উপর নির্ভর করে বেতন কাঠামো ঠিক হয়। এমনকী একই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কলকাতা ও মুম্বাইয়ের কর্মীর বেতন সমান নয়। আবার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা এলটিসি পান, এর ফলে প্রতি চার বছরে তারা তাদের নিজ শহর বা ভারতের যেকোনো স্থানে ভ্রমণ করতে পারবেন। রাজ্য সরকারি কর্মীরা কিন্তু এই ভ্রমণ ছাড় পান না। অর্থাৎ সরকারি বা বেসরকারি - বেতন কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে আছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যার প্রতিটির একটা ইতিহাস আছে। মহার্ঘ ভাতা সেই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সরকারি কর্মীদের বেতনের অংশ। এর হিসেব বিভিন্ন সময়ে মার্জিত হয়েছে কর্মীদের আন্দোলনের ফলে, সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে। মূল্যবৃদ্ধির মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে সারা দেশে ডিএ নির্ধারণ করা হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ দেশের একটি অংশ হয়েও কনজ়িউমার প্রাইস ইনডেক্স কেন মানবে না তার কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই। দেশের অন্য রাজ্যগুলো এই ব্যবস্থার মধ্যেই মহার্ঘ ভাতা দিচ্ছে।

মহার্ঘ ভাতা কেন বেসরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হবে না - তা ভিন্ন প্রশ্ন। মহার্ঘ ভাতা বেতন কাঠামোর একটা উপাদান থাকবে কিনা তা নিয়ে বেসরকারি কর্মীদেরই এগিয়ে এসে উপযুক্ত নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনাতে বসতে হবে। তাই বলে যারা বেতনের অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে মহার্ঘ ভাতা পেয়ে এসেছেন, তাদের হঠাৎ করে সরকারি খামখেয়ালিতে এই ভাতা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। এটা কোনো মগের মুল্লুক নয়।

আরও দুঃখের কথা, ডিএ নিয়ে কর্মচারীরা এই রাজ্যে দাবিদাওয়া করলেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যে ভাষায় তাঁদের আক্রমণ করেছেন, তারপরে মনে হয় হয়তো সত্যিই তিনি মনে করেন এই রাজ্য মগের বা তাঁর নিজের মুল্লুক।