আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৫ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
সম্পাদকীয়
সিঁদুরের রাজনীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার পরে সংঘর্ষ বিরতি ঘোষিত হল? এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা এখনও করে চলেছেন ভারতের জনগণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিগত প্রায় এক মাস ধরে বলে চলেছেন যে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করিয়েছেন, বাণিজ্যের লোভ দেখিয়ে। একাধিকবার তিনি বলেছেন যে দুই দেশের সঙ্গেই তিনি বাণিজ্য করতে চান এবং যুদ্ধ না থামালে তিনি বাণিজ্য করবেন না, এই হুমকি নাকি তিনি দুই দেশের নেতাদের দিয়েছেন, যার ফলে দুই দেশ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। একাধিক মঞ্চে তিনি এই দাবি লাগাতার পেশ করে চলেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করেছেন। বিদেশমন্ত্রী বলেছেন যে হ্যাঁ আমেরিকার সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল, যেমন অনেক দেশের সঙ্গেই চলছিল। তিনি বলেন যে ভারত আমেরিকাকে বলে যে যুদ্ধ থামাতে হলে পাকিস্তানের সেনাকে ফোন করতে হবে ভারতের সেনাকে। তাই হয়েছে, অতএব বিদেশমন্ত্রী মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের কোনো হস্তক্ষেপ এই বিষয়ে দেখতে পাচ্ছেন না। তাহলে কেন আমেরিকাকে বলা হল যে পাকিস্তানের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য? বিষয়টি নিয়ে ভারতের তরফো দ্যর্থহীন ভাষায় ট্রাম্পের বক্তব্যকে খণ্ডন করা হচ্ছে না বলে তিনিও লাগাতার এই বিষয়ে তাঁর অবদানের কথা বলেই চলেছেন।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অন্তত দুটি কারণে। প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অন্য কোনো মধ্যস্থতাকারীকে মেনে নেওয়া হবে না, এই অভিমত বিগত বহু দশক ধরে ভারতের রয়েছে। তাই ট্রাম্প কী করে এই মধ্যস্থতাকারী হয়ে ওঠার দাবি করছেন? যদি তিনি সত্যি কথা বলেন তাহলে ভারতের বহু বছরের আন্তর্জাতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান। কিন্তু তার বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা নিয়ে যথারীতি মোদী সরকারের মুখে কোনো কথা নেই। ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না, তাদের এক বন্ধনীতে রেখে আন্তর্জাতিক কূটনীতি চলতে পারে না। কারণ, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দেশ নয়, তারা গোটা দুনিয়ায় উগ্রপন্থা রপ্তানি করে। ভারত বিশ্বের একটি প্রধান গণতান্ত্রিক দেশ এবং উগ্রপন্থার শিকার। তাই দুই দেশকে এক বন্ধনীতে রাখা উচিত নয়। কিন্তু ট্রাম্প লাগাতার ভারত ও পাকিস্তান শব্দটি এক বন্ধনীতে বসাচ্ছেন, দুই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য করার কথা বলছেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই মহান ও দায়িত্ববান নেতার খেতাব দিচ্ছেন। তাহলে কি আমেরিকা তার পাকিস্তানপন্থী পুরোনো অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে? এই এক বন্ধনীতে আসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই বা কী? ভারতের কোনো মানুষের তা জানা নেই।
আসলে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ভিতরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে চিন। বিগত বেশ কিছু দশক ধরে ভারতের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঢলে পড়ার প্রবণতা চিনকে আরো বেশি করে ঠেলে দিয়েছে পাকিস্তানের দিকে। চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেই ঠাণ্ডা লড়াই চলছে, তার বোড়ে হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চিনের বিরুদ্ধে একটি স্তম্ভ হিসেবে দেখতে চায়। আবার চিন পাকিস্তানকে নিজের মিত্র হিসেবে চায়, ঠিক একই কারণে। ভারত এই জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জোট নিরপেক্ষ অবস্থান ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সরে যাওয়ার নীতির অপর পিঠে রয়েছে চিনের পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ার নীতি। অতএব এই সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার সময়েও দেখা গেল যে পাকিস্তান চিনের তৈরি অস্ত্র দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছে। চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা তাই ভারতের নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদি চিনকে পাকিস্তানের থেকে আলাদা করা যায়, তাহলে ভারত নিজের শর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার পরে দেখা গেল যে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে একই বন্ধনীতে রেখে যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব দাবি করছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি চিনের সমর্থন অটুট রয়েছে। আবার কুয়েতের মতন দেশ, যে পাকিস্তানের সঙ্গে বিগত বেশ কিছু দশক কোনো সম্পর্ক রাখেনি, তারাও আবার সেই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত করেছে। তাই অপেরশন সিঁদুরের পরে ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থান সুদৃঢ় হল না দুর্বল হল, সেই প্রশ্ন অবান্তর নয়।
ভারতের শাসক দল তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অবশ্য এই বিষয়গুলি আপাতত গুরুত্বহীন। অপেরশন সিঁদুর হয়ে গেছে। গোদী মিডিয়া প্রায় পাকিস্তান দখল করে ফেলেছে। এখন কাজ হল ভারতে রাজনীতির ফসল ঘরে তোলা। তাই বিন্দুমাত্র দেরি না করে প্রধানমন্ত্রী তাই করছেন, যেই কাজ করতে এখনও ভারতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি রাজনৈতিক প্রচারে নেমে পড়েছেন। বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সজ্জা পরা ছবি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। যদিও একজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কেন সামরিক সজ্জা পরে ছবি তুলবেন, সেই প্রশ্ন কেউ তুলছে না। কিন্তু যেখানে অপেরশন সিঁদুরের প্রতি দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল সমর্থন জানিয়েছে, সেখানে দেশের সেনাবাহিনীর শৌর্যকে রাজনৈতিক বাজারে পণ্য করে তোলার কদর্য রাজনীতি কেন করা হচ্ছে সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি। যদিও তাতে প্রধানমন্ত্রীর কিছু যায় আসে না। ভোট এবং ক্ষমতাই তাঁর এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। তাই তিনি রোড-শো করছেন, রাজনৈতিক ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতের অবস্থানকে লাগাতার ট্রাম্প যে লঘু করে চলেছেন তা নিয়ে আপাতত ‘বিশ্বগুরু’-র কোনো বক্তব্য নেই।
সামরিক উত্তেজনা কমলেও প্রধানমন্ত্রী এখনও উত্তেজিত রয়েছেন। বস্তাপচা হিন্দি সিনেমার সংলাপ আপাতত তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে শোনা যাচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন যে তাঁর শরীরে আপাতত রক্ত নয়, গরম সিঁদুর দৌড়চ্ছে! বছর কয়েক আগে তাঁর রক্তে টাকা দৌড়চ্ছিল। এখন সিঁদুর ছুটছে। তিনি পাকিস্তানের যুবসমাজকে হুমকি দিচ্ছেন। প্রায় গব্বর সিং-এর ভাষা ধার করে বলছেন যে হয় তারা শান্তিতে থেকে রুটি খাক, নয়ত তাঁর গুলি তো আছেই। একটি দেশের যুবসমাজের প্রতি এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের মর্যাদা কতটা ক্ষুণ্ন করতে পারে, তা নিয়ে তিনি মনে হয় চিন্তিত নয়। আপাতত, তাঁর ভক্তদের উত্তেজিত করা এবং হাততালি কুড়োনোই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তাই বিভিন্ন শহরে রোড-শো হচ্ছে। সেখানে সামরিক অফিসার সোফিয়া কুরেশির বাড়ির লোকদের বলা হচ্ছে যে এসে প্রধানমন্ত্রীর উপরে পুষ্পবর্ষণ করতে। বিহারের নির্বাচন এবং তার পরবর্তী আসন্ন নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর কীর্তি নিয়ে রাজনীতি করতে ব্যস্ত থাকবেন।
উগ্রপন্থী হানার পরে সামরিক হস্তক্ষেপ হবে। তার কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য মোদী গোটা দেশে প্রচার করে বেড়াবেন। এই দৃশ্য আমরা আগেও দেখেছি। আমরা শুধু আশা করতে পারি যে বারংবার একইভাবে প্রধানমন্ত্রী তথা শাসকদলের এই জঘন্য রাজনীতির দেউলিয়াপনা মানুষ বুঝতে পারবেন। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে সেনাবাহিনীকে রাজনীতির আঙিনায় টেনে নামানোর এই সংকীর্ণ স্বার্থপর রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার দায়িত্ব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেই নিতে হবে।