আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৫ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
প্রবন্ধ
বাণিজ্যযুদ্ধ পরবর্তী কোন বিশ্বের পথে আমরা?
অনন্য মুখার্জি
জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস '1984' পড়ে থাকলে পাঠক জানেন, সেখানে পৃথিবীকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি বড় অঞ্চলে - ওসেইনিয়া, ইউরেশিয়া, আর ইস্ট এশিয়া। এই অঞ্চলগুলো একে অপরের সঙ্গে সব সময় যুদ্ধ করছে, কিন্তু সেই যুদ্ধ আসলে জেতার জন্য নয়। যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য হলো নিজের দেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, উদ্বৃত্ত পণ্য-সম্পদ নষ্ট করা, আর কৃত্রিমভাবে অভাব তৈরি রাখা যাতে ক্ষমতা কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। সমাজবিজ্ঞানী চার্লস টিলি যেটাকে বলেছেন "টেকসই বৈষম্য" (durable inequality) অর্থাৎ অভাব আর সংকট তৈরি করে রেখে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা।
আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা মনে হয় কিছুটা সেই দিকেই এগোচ্ছে। ট্রাম্প ট্যারিফ, বাণিজ্য যুদ্ধ, সম্পদের জন্য দ্বন্দ্ব, আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এখন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা। এখানে সমাধান খোঁজার থেকে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাই যেন মুখ্য। এই টানাপোড়েন আরও গভীর হয়েছে বিশ্বজুড়ে সামরিকীকরণ আর বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির ফলে। পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া বা ভারত এদের মধ্যে কারো সঙ্গে 'বন্ধুত্ব' বা 'শত্রুতা'-র বিষয় নেই। এরা সবাই পুঁজির জন্য শুধু বাজার, খনিজ বা শ্রমের উৎস। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আজকের আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বোঝা দরকার। সেই অর্থে বর্তমান ভূরাজনীতি যেমন বাণিজ্য যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, এসব জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বেশি বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন।
অর্থনৈতিক দুনিয়ায় প্রতিটি বড় সংকট এক ধরনের liquidity crisis বা অর্থপ্রবাহ সংকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, একসময় বৈশ্বিক ফিন্যান্স পুঁজির অধিপতি, এখন প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ার পথে। ২০০৮-এর বিশ্ব আর্থিক মন্দার পর থেকে সে তার অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংকট সামলাতে ডলার ছাপিয়ে চলছিল। কিন্তু এতে আমেরিকার দেনার পরিমাণ এই বছরের শুরুতে মোট জাতীয় আয়ের তিনগুন হয়ে যায়। এর আরেকটা কারণ ডলার এখনও বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা যার ফলে আমেরিকা তার ডলার বেশি বেশি ছাপিয়ে তার যোগান মুদ্রাবাজারে যতই বাড়িয়ে চলুক না কেন ডলারের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কারণ বাকি সব দেশ নিজের দেশের মুদ্রাকে স্থিতিশীল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডলার কেনে। ফলে ডলারের যোগান বাড়লেও দাম কমেনা। বাজারে ডলারের যোগান বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সব পণ্য ও আর্থিক সম্পদ যেমন রিয়েল এস্টেটের দাম বাড়িয়েছে, শেয়ার বাজার ফুলে উঠেছে আর সাথে বিশেষ করে বিনিয়োগ হয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স সংক্রান্ত কোম্পানিগুলোতে।
প্রথাগত পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় বড় কোম্পানিগুলো পন্য উৎপাদন করত, বিক্রি করত, তাতে শ্রমিক লাগত, মজুরি দিত। বর্তমান ফিন্যান্স পুঁজির যুগে সবচেয়ে বড়ো কোম্পানিগুলো কোনো পণ্য উৎপাদন সেই-অর্থে করেনা। বরং তারা লাভ করে বিভিন্ন ধরনের 'ভাড়া' আদায় করা থেকে মূলত কারেন্সি বা পণ্যপুঁজির নিয়ন্ত্রণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ এমনকি ডিজিটাল প্লাটফর্মের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের ওপর ভাড়া থেকে। বর্তমান এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে 'রেন্টিয়ার' বা 'ভাড়াভিত্তিক পুঁজিবাদ' বলা হয় যার কেন্দ্রে রয়েছে ফাইন্যান্স পুঁজি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় স্থবির, কারণ এই বিনিয়োগ মূলত অটোমেশনে যাচ্ছে, কাজের সুযোগ বাড়ছে না, প্রতিদিন জীবনযাপনের খরচ বা সামাজিক পুনরুৎপাদনের খরচ ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। এই পারস্পরিক বৈপরীত্যই বিশ্ব অর্থনীতিকে করে তুলেছে আরও অস্থির। অর্থনীতির ইতিহাস বলে, যতক্ষণ ঋণ প্রবাহমান থাকে, ততক্ষণ ব্যবস্থা টিকে থাকে; কিন্তু যখনই এই প্রবাহ স্তব্ধ হয়, তখন শুরু হয় সংকট। বিশ্বজুড়ে আজ আমরা সেই স্তব্ধতার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।
বিশ্ব পুঁজিবাদ আজ এক গভীর সংকটে, যার কেন্দ্রে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীন। দুই দেশের সমস্যাগুলো ভিন্ন হলেও মূলত একে অপরের পরিপূরক। যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিপুল ঋণ কমাতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে, কনসাম্পশন কমাতে হবে, খরচ কমাতে হবে, আর ঘাটতি মেটাতে হবে। আর চীনকে উল্টো দিকে চলতে হবে - তাকে তার উদ্বৃত্ত পুঁজি কমাতে হবে, উৎপাদন কিছুটা কমাতে হবে, ঘরোয়া কনসাম্পশন বাড়াতে হবে, আর ঋণও হ্রাস করতে হবে। অর্থাৎ, দুই বিপরীত মুদ্রা ও বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করেও দুই দেশ একই মূল সংকটে অর্থাৎ ঋণের বোঝা আর অর্থপ্রবাহ (liquidity) সংকটে ভুগছে। এর ফলে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই টলমল করে উঠেছে।
চীনের উদারীকরণ ছিল ধাপে ধাপে, এবং পুরো প্রক্রিয়াটি হয়েছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। প্রথমে তারা নিজেদের সস্তা শ্রমকে কাজে লাগাল যেখানে গ্রামীণ শ্রমিকদের শহরে এনে উৎপাদনে যুক্ত করা হল। শুরুতে এই শ্রম ব্যবস্থাকে চালিত করেছিল চীনের অভ্যন্তরীণ পুঁজি, কিন্তু দ্রুতই তাতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এরপর আসে আবাসন ও জমির উদারীকরণ যা চীনে বিশাল একটি রিয়েল এস্টেট বাজার তৈরি করে, যেখানে ব্যক্তিগত পুঁজি ঢোকার সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে শহরগুলোতে নতুন ধরনের পুঁজির বিন্যাস তৈরি হয়। তারপর আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর 'সংস্কার' অর্থাৎ যেগুলো লাভে ছিল না সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া বা বড় কর্পোরেশনে একীভূত করে ফেলা। পরবর্তী ধাপে খনিজ, শক্তি, ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ওপর থেকে রাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে বেসরকারি পুঁজির প্রবেশাধিকার দেয় চীন। তবে, চীন সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে যায়নি। তারা এখনও কঠোরভাবে পুঁজির চলাচল, বিনিয়োগ ও মুদ্রা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে, আমেরিকার তুলনায় চীনে ফাটকা ফিন্যান্স পুঁজির বুদবুদ ফাটার ঝুঁকি কম, এবং অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অনেক বেশি। এই নিয়ন্ত্রণ চীনকে এমন এক রাস্তায় নিয়ে গেছে, যেখানে তারা এখন রেন্ট-সিকিং ফিন্যান্স পুঁজি নির্ভর রাষ্ট্র থেকেও আরও উন্নততর এক প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের পথে হাঁটছে।
আমেরিকাও একই পথে হাঁটতে চাইছে, যদিও ভিন্নভাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল হলো ডলারের দাম কমিয়ে তার দেনার প্রকৃত মূল্য কমিয়ে ফেলা আর দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা বাড়িয়ে তোলা যাতে অল্পখরচে আরও ঋণ নেওয়া যায়। এতে রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক হয়, বাণিজ্য ঘাটতি কমে, আর সস্তা তেল আমদানি করে মূল্যস্ফীতিও সামাল দেওয়া যায়। এটা অনেকটা চীনের দীর্ঘমেয়াদি বন্ড বেচার মধ্য দিয়ে আর্থিক সংকটকে পেছনে ঠেলবার কৌশলের মতোই, যদিও চীন করে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে, আর আমেরিকা করে বাজার-নিয়ন্ত্রণের কৌশলে। এই দুটি রাষ্ট্রের অবস্থান এবং ব্যবস্থা আলাদা হলেও, উভয়ই প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন পুঁজিবাদী বন্দোবস্তর দিকে এগোচ্ছে। যেখানে রাষ্ট্র নিজেই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মালিক বা মূল নিয়ন্ত্রক যেখানে পণ্য উৎপাদন, ফাইন্যান্স ও তথ্য প্রবাহকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব । এক টেকনো-পুঁজিবাদী surveillance state, যেখানে রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে প্রযুক্তি এবং তথ্য-নিয়ন্ত্রণ যাকে ইয়ানি ভারৌফাকিসের মতো অর্থনীতিবিদ নাম দিয়েছেন 'টেকনো-ফিউডালিজম'।
তবে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে এখনও আছে 'ঋণ' যেটা চাইলেই মুছে ফেলা যায় না, কারণ এটা চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতা। সমাধান করতে হলে হয় ঋণ মাফ করতে হবে (যা বিশ্ব ফাইনান্সিয়াল মার্কেটে বিধ্বংসী প্রভাব ডেকে আনতে পারে), অথবা খুবই কঠোর কোনো চুক্তির মাধ্যমে নতুন করে সমন্বয় তৈরী করতে হবে। ১৯৮৫ সালের 'প্লাজা অ্যাকর্ড' নামের এক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ঠিক একইভাবে আমেরিকা জাপান ও জার্মানিকে বাধ্য করেছিল একই পদ্ধতিতে তাদের দেশের ডলার রিজার্ভ বেচে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম কমাতে - আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ড বা সোজাকথায় আমেরিকার ঋণকে ফাইন্যান্স করতে। এই বন্দোবস্ততা তখন সফল হলেও এর ফলে জাপানের অর্থনীতিতে বড়সড় ফাইন্যান্সিয়াল 'বাবল' তৈরি হয়েছিল। আজ একই রাস্তা ধরে ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য যুদ্ধর পথ বেছে নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশেষত চীনের বিরুদ্ধে। ইতিহাস বলছে, যেমন ব্রেটন উডস ব্যবস্থা বা লাতিন আমেরিকার ঋণ সংকট, এই ধরনের সমন্বয়ে অনেক সময় লাগে এবং বহু রাজনৈতিক দরকষাকষি চলে। আইএমএফ বা ডব্লিউটিও-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত এমন সমঝোতার মধ্যস্থতা করে, কিন্তু সেগুলো গড়েই উঠেছিল আমেরিকার ঋণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া অর্থাৎ দেনা আউটসোর্স করার নীতির ভিত্তিতে। কিন্তু এখন সেই বন্দোবস্তটা উল্টে দেওয়া ছাড়া অর্থাৎ বিশ্বায়নের তথাকথিত মুক্তবাজার থেকে না বেরোলে এই দেশগুলো নিজেদের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরাতে পারবেনা।
ফলে আগামীতে আমরা হয়তো দেখতেই পারি এক নতুন ভূরাজনৈতিক বিভাজন; সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে এমন এক ব্যবস্থাপনার যেখানে আমেরিকা তার আশেপাশের দেশগুলো নিয়ে একটি ব্লক গঠন করবে, রাশিয়া ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার নেতৃত্ব নেবে, চীন পূর্ব এশিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এই প্রত্যেক 'সুপারস্টেট' তাদের পৃথক অর্থনৈতিক গঠন কায়েম করবে, যেখানে পুঁজির প্রবাহ ও ঋণের বোঝা নিজেদের এলাকার মধ্যে ভাগ করে নেবে - যেখানে নিয়ন্ত্রক দেশের দেনা, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি আর সস্তার কাঁচামাল জোগানোর বোঝা চাপবে দুর্বলতর দেশগুলোর ওপর। এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের একচেটিয়া ক্ষমতা আর আগের মতো থাকতে নাও পারে। ঋণের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ইচ্ছাকৃতভাবেই চেষ্টা করছে ডলারের দাম অন্য মুদ্রার তুলনায় কমাতে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে হয়তো ডলারের প্রতি আস্থা ধরে রাখতে একে সোনা আর ক্রিপ্টোকারেন্সি মিলিয়ে একটা কমোডিটি বাস্কেটের মূল্যের সাথে জুড়ে দিতে পারে। আর যদি অন্য দেশগুলো তাতে রাজি না হয় সেক্ষেত্রে নতুন একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে হংকং ডলার বা সিঙ্গাপুর ডলার কার্যকর হতে পারে কারণ এগুলো আপাতত কোনও কোনও সুপারস্টেটের সম্ভাব্য দাবিদারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেই।
এই আপাত কাল্পনিক অথচ সম্ভাব্য দুনিয়ায় সুপারস্টেটগুলো হবে অনেকটা উঁচু দেয়াল ঘেরা মহাদেশীয় দ্বীপের মতো যেখানে অন্য মহাদেশীয় দ্বীপগুলোর সাথে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন হবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। এই এক একটা দ্বীপ মহাদেশের কেন্দ্রে থাকবে একটি শক্তিশালী দেশ আর মহাদেশের বাকি দেশগুলো অনেকটা যেন তার করদ রাজ্য হয়ে থাকবে। আমেরিকা হয়তো ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, সামরিকীকরণ আর জীবাশ্ম জ্বালানি কেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়বে, যেখানে মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলো খাদ্য ও খনিজ সরবরাহ করবে, আর আমেরিকা প্রযুক্তিপণ্য বা অস্ত্র ও নিরাপত্তা দেবে। রাশিয়া তার গ্যাস, তেল ও খনিজ দিয়ে ইউরোপ ও কাছাকাছি দেশগুলোর সঙ্গে বিনিময় চালাবে। চীন তার প্রযুক্তিতে জোর দিয়ে ক্যাপিটাল ইনজেকশন বা অর্থনীতিতে নিজের মুদ্রা ছেড়ে দেশীয় উপভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে চাইবে, যাতে দেশের অর্থনীতির রপ্তানি নির্ভরতা কিছুটা কমে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া - এইসব দেশগুলো হতে পারে চীনের উৎপাদন কেন্দ্র। আর ভারত? তার বিশাল সস্তা শ্রমবাজার ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় ভূমিকা ততটা নেই। ফলে, সে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব পাওয়ার বিনিময়ে নিজের দেশের কৃষি ও দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সাথে যুক্ত কোটি কোটি শ্রমজীবী ভারতীয়র ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে হয়তো আপাতত আমেরিকান ব্লকের অংশ হবে। আমেরিকা তার ফিন্যান্স পুঁজির ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলে ভারতে সেই পুঁজি হয়তো আশ্রয় খুঁজতে চাইবে। যার ফলে স্বল্পমেয়াদি ভাবে শেয়ার মার্কেট ফুলেফেঁপে উঠলেও ভারতের আর্থিক কাঠামোতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতাও বহুগুণ বেড়ে যাবে।
সবচেয়ে ভয়াবহ এবং একক বৈশিষ্ট্য যা এই বিভক্ত বিশ্বে থেকে যাবে, তা হল ব্যাপক সামরিকীকরণ, চিরস্থায়ী সংঘর্ষ ও কৃত্রিম অভাব। এর সঙ্গে জুড়ে যাবে নজরদারি প্রযুক্তি, যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই নতুন বিশ্বে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই হয়ে উঠবে আসল ক্ষমতার ধারক। এরাই হবে সেই 'superstate'-এর প্রকৃত চালক, যেখানে রাষ্ট্রশক্তি আর কর্পোরেট শক্তি মিশে গিয়ে এক ধরনের অরওয়েলিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এই নতুন শাসনের কেন্দ্রে থাকবে প্রযুক্তি। নজরদারির, নিয়ন্ত্রণের এবং তথ্য ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি। চীনে যেমন 'WeChat'-এর মতো অ্যাপে নাগরিকদের প্রতিটি লেনদেন ও কথাবার্তা রেকর্ড হয়, তেমনি আমেরিকার 'Palantir'-এর মতো কোম্পানি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কে কখন বিদ্রোহ করতে পারে। এই প্রযুক্তিগত নজরদারির চূড়ান্ত রূপ হবে এমন এক সমাজ, যেখানে নাগরিক মাত্রই শাসকের চোখে সন্দেহভাজন। এই গোটা ব্যবস্থার পেছনে আছে একটি গভীর উদ্বেগ- বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকা সেই বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা আর উৎপাদন ব্যবস্থার কোনও কাজে লাগে না, এক কথায় 'উদ্বৃত্ত মানুষ'। রাষ্ট্রের চোখে তারাই ভবিষ্যতের 'বিপজ্জনক শ্রেণী' যাদের অভাব, বেকারত্ব আর বঞ্চনা একসময় বিস্ফোরণের রূপ নিতে পারে। এই আশঙ্কাই রাষ্ট্রগুলোকে আরও নিরাপত্তামূলক, আরও প্রযুক্তিনির্ভর, আরও দমনমূলক হয়ে উঠতে বাধ্য করছে । একটি চিরস্থায়ী অভ্যন্তরীণ আতঙ্ক যা জন্মলগ্ন থেকে পুঁজিবাদকে তাড়া করে ফিরছেঃ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেওয়া 'উদ্বৃত্ত'রাই যদি বিদ্রোহ করে ওঠে?