আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৫ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

জাতি গণনার নীতি ও রাজনীতি

অশোক সরকার


কেন্দ্রীয় সরকার জাতি গণনা হবে ঘোষণা করায় বিতর্ক এখন তুঙ্গে। এই সুযোগে আমরাও বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারি। নীতি রাজনীতি-তে ঢোকার আগে সেন্সাসে কী করা হয় আর কী হয় না, আসুন সেটি একবার দেখি।

আমরা সবাই জানি সেন্সাসের একটি অঙ্গ হল সেন্সাস কর্মীরা বাড়ি বাড়ি এসে জেনে নেন বাড়িতে কতজন মানুষ, কতজন মহিলা-পুরুষ, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি। সেইসঙ্গে জিগ্যেস করেন আপানার মাতৃভাষা, ধর্ম, জাতি। ধর্মের বেলায় আমরা যদি বলি আমি নাস্তিক, বা অজ্ঞেয়বাদী, বা ধর্ম জানি না, সেটাই রেকর্ড করা হয়। ভাষার বেলাতেও যা বলি তাই রেকর্ড করা হয়। জাতি-র বেলায় বিষয়টা একটু জটিল। সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি-র মানুষদের রেকর্ড করার কথা। এই দুই জাতি-বর্গের মধ্যে কারা পড়েন, তার রাজ্য অনুযায়ী তালিকা আছে। তাই যদি বলি, আমি তফসিলি জাতি তাহলে সেন্সাস কর্মীরা জিগ্যেস করবেন, কী জাতি? আমার উত্তর তাঁরা তালিকা অনুযায়ী মিলিয়ে লিখে নেন। যদি বলি, আমি ওবিসি, তাহলে সেন্সাস কর্মীরা লিখবেন 'সাধারণ' (General)। যদি বলি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি, সেন্সাস কর্মীরা 'সাধারণ' লিখবেন। কিন্তু যদি বলি আমি তফসিলি জনজাতি তাহলে জিগ্যেস করা হবে কোন জনজাতি। আমি যা বলব, সেন্সাস কর্মীরা তাঁদের কাছে থাকা তালিকা অনুসারে সেই জনজাতি লিখে নেবেন।

এই ব্যবস্থা স্বাধীনতার পরে সব সেন্সাসেই চলে আসছে। জাতি গণনা মানে সব জাতি-র জন্যই ওই গণনা করা।

তাহলে সেন্সাসে কী পালটাবে? পালটাবে সামান্যই। এখন যেমন ওবিসি ও সাধারণ জাতির জন্য শুধুই 'সাধারণ' (General) লিখে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন তার বদলে সবাইকে তার জাতি জিগ্যেস করা হবে। তবে তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতির যেমন তৈরি তালিকা আছে, অন্যান্য জাতিগুলির তা নেই। কাজেই মানুষ যে জাতি বলবে তাই লিখতে হবে, এবং পরে সেই জাতি-নামগুলিকে যাচাই করে মিলিয়ে একটা তালিকা প্রকাশ করা হবে। তাতে তিন-চার বছর সময় লাগবে। এতে চিন্তার কিছু নেই, এমনিতেই সেন্সাসের সব তথ্য প্রকাশ হতে চার-পাঁচ বছর লেগেই যায়।

তাহলে এই নিয়ে এত হট্টগোল কেন? সে কথায় আসব তার আগে জাতি গণনার কথা নীতির দিক থেকে কেন উঠছে, তাই নিয়ে কিছু স্পষ্টীকরণ দরকার। ওবিসি সংরক্ষণ কথাটার সঙ্গে আমরা সবাই এখন কমবেশি পরিচিত। এই কথাটি ভারতের সংরক্ষণ নীতির আঙিনায় হাজির হয়েছিল মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের ফলে। মণ্ডল কমিশন ৫০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষকে সার্ভে করে বলেছিল ওবিসি জাতি বর্গটি জনসংখ্যার প্রায় ৫২ ভাগ, এবং তার মধ্যে ৩,৭৪৩টি জাতির খোঁজ তারা পেয়েছিল।

তার ভিত্তিতে সরকারি শিক্ষা ও চাকরি জগতে ওবিসি সংরক্ষণ চালু হয়। রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারকেই সংরক্ষণ করতে হয়। দাবি ওঠে কোন রাজ্যে কত ওবিসি ও তাদের কী জাতি তা সেন্সাসে আনতে হবে। ১৯৯২ সালে ইন্দ্র সাহানি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যখন বলে দিল যে ওবিসি সংরক্ষণ সংবিধান সম্মত, তখন থেকে এই দাবি আরও জোরদার হল। সেটা অবশ্য শুধুই ওবিসি সেন্সাস, পূর্ণ জাতি গণনা নয়। ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় মন্ত্রক জাতি গণনা চেয়ে ক্যবিনেট নোট পাঠিয়েছিল, তখনকার সেন্সাস অধিকর্তাও জাতি গণনা চেয়ে সরকারের কাছে সওয়াল করেন - গৃহীত হয়নি। ২০১০ সালে লোকসভা এই বিষয়ে দু'দিন টানা আলোচনা করে - বিজেপি সহ প্রায় সব দলই জাতি গণনায় সহমত হয়। তাও হয়নি। ২০১১-এর যে জাতি গণনা করা করা হয়েছিল যার পদ্ধতি প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ছিল, সেই তথ্য সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। এই বিষয়ে অনগ্রসর শ্রেণী কমিশনও একাধিকবার জাতি গণনার সুপারিশ করেছে, তাও হয়নি। অর্থাৎ দল নির্বিশেষে কেন্দ্রীয় সরকার জাতি গণনা এড়াতে চেয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে ২০২২ সালে বিহার সরকার জাতি গণনা করে৷ তাকে সেন্সাস বলা যায় না, কিন্তু জাতি সার্ভে বলা যায়। সেই রিপোর্ট ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে, তারপর একে একে কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা এই জাতি সার্ভে করে ফেলেছে। আর রাহুল গান্ধী এটাকে তার রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগণনার দাবিকে সর্বজনীন করার চেষ্টা করেছেন। মণ্ডল কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলির সবাই জাতি গণনার পক্ষে নানা ভাবে সোচ্চার হয়েছে।

তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি বা ওবিসি সেন্সাস-এর কথা কেন ওঠে? এর উৎস আছে, সংবিধানে। তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি সমুদয় দেশে বহুবিধ বঞ্চনার শিকার এবং তার বীজ সমাজের গভীরে। সংবিধান এই বাস্তবতা স্বীকার করেছিল এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জাতি বঞ্চনা কমাতে গেলে, নির্মূল করতে হলে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। তার একটি হল সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ। ওবিসি সংরক্ষণ ঐ এক সারিতেই পড়ে। সংরক্ষণ করতে গেলে জানতে হয় ঐ বর্গগুলির মধ্যে সত্যিই কারা আছেন, তাঁদের সংখ্যা কত, জাতি-বর্গগুলি (Caste Group) মোট জনসংখ্যার কত অংশ, তাঁদের বর্তমান শিক্ষা কতদূর, কী ধরনের পেশায় তারা যুক্ত, তারা সমাজে কোন স্তরে অবস্থিত ইত্যাদি।

পূর্ণ জাতি গণনার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। পূর্ণ জাতি গণনা মানে শুধু ওবিসি নয়, উচ্চ জাতিগুলিরও জাতিভিত্তিক গণনা। পূর্ণ জাতি গণনা করলে দুটি চিত্র পরিষ্কার হবে। এক উচ্চ জাতিগুলি জনসংখ্যার কত অংশ, উচ্চ জাতি বর্গটি জনসংখ্যার কত অংশ, আর জানা যাবে শিক্ষায়, চাকরিতে, ব্যবসায়, এলিট পেশাগুলিতে (ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট পেশায় নিযুক্ত কর্মী) এঁদের কতটা ভাগ আছে, তখন তফসিলি জনজাতি, তফসিলি জাতি আর ওবিসিদের সঙ্গে এই উচ্চ বর্গের সঠিক তুলনা করা যাবে।

এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার যে তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি সংরক্ষণ সেন্সাসের তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওবিসি সংরক্ষণ যা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই - তারা জনসংখ্যার কত অংশ তা জানা নেই।

কাজেই নীতিগত ভাবে জাতি গণনার প্রস্তাবের কোনো বিরোধ হতে পারে না।

কিন্তু রাজনীতিতে? ১৯৯০-এর পরে ভারতীয় রাজনীতিতে যে সব পরিবর্তন হয়েছে তার অন্যতম হল যাকে হিন্দিতে মণ্ডল বনাম কমণ্ডলের রাজনীতি বলা হয়। মণ্ডল রাজনীতির উৎপত্তি অবশ্য অনেক আগেই হয়েছে, কর্পূরী ঠাকুর, রাম মনোহর লোহিয়া প্রমুখের হাতে, তবে ১৯৯০-এর পরে তা একেবারেই রাজনীতির মূল স্রোতে জায়গা নিয়েছে।

কমণ্ডলের রাজনীতির উৎপত্তি অনেক আগে হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘের হাতে, কিন্তু মূল স্রোতে জায়গা নিয়েছে লালকৃষ্ণ আডবাণী ও অন্যান্যদের হাতে। মণ্ডল রাজনীতির মধ্যে কয়েকটি শাখাস্রোত বর্তমান - এক, সংরক্ষণ, দুই, ধর্মনিরপেক্ষতা, তিন, কমণ্ডল বিরোধিতা, আর চার, রাষ্ট্র ক্ষমতা। কিন্তু মণ্ডল রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা হল, তা ওবিসি, তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতিদের মধ্যে কোনো সামাজিক ঐক্য তৈরি করতে পারেনি। মাঝে মাঝে নির্বাচনী ঐক্য হয়েছে, ভেঙ্গেও গেছে। এর কারণ সামজিক ও দৈনন্দিন স্তরে এই জাতিগুলির মধ্যে অনৈক্য, বৈরিতা, অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ। তাই যাদবরা ক্ষমতায় এলে জাতভদের কোনো সুবিধা হয় না, জাতভ-রা ক্ষমতায় এলে বাল্মীকিদের কোনো সুবিধা হয় না। মণ্ডলের সামাজিক উত্থান উচ্চ জাতি বর্ণের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রাধান্য-য় আঘাত করতে পেরেছে ঠিকই, সমাজে তাতে এক বিশাল মন্থন শুরু হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বৃহত্তর জাতি ঐক্যের অভাবে তা সামাজিক সাম্যের দিকে বেশি দূর এগোয়নি। আদিবাসীদের সঙ্গে দলিত, ওবিসিদের সামান্যতম ঐক্য তৈরি হয়নি। সেই কারণে বিশেষত উত্তর ভারতে মণ্ডলের রাজনীতি উন্নয়নের প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট পথ দেখাতে পারেনি। একাধিক জাতির নিজস্ব দল তৈরি হয়েছে - যাদব, জাঠ, কুশওয়া, নিষাদ, পাশয়ান, মালা, মাদিগা, কামা, কুরমি ইত্যাদি, যার ফলে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটেছে ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্র নির্বাচনী রাজনীতির পাটিগণিতে আটকে গেছে। সমাজের গভীরে ঢোকেনি।

কেন এমন হল? কেন জাতি রাজনীতি দলিত, আদিবাসী, ওবিসিদের বৃহত্তর জাতি ঐক্য তৈরি করতে পারল না?মনে হয় তার কারণ রাজনীতির চরিত্র। রাজনীতি যদি শুধুই সংরক্ষণ আর নির্বাচনী ক্ষমতা নিয়ে কথা বলে তাহলে বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনাটি হারিয়ে যায়। সেই ভাবনার সহজ মূল কথাটি হল ওবিসি, দলিত, আদিবাসী, মুসলমান - এরা সামাজিকভাবে আলাদা হলেও অর্থনীতিতে প্রায় একই জায়গায় - কৃষি অথবা অসংগঠিত ক্ষেত্রের অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমিক বা উৎপাদক। ক্রিমি লেয়ার অংশটি বাদ দিলে বাকিরা রোজগার ও সম্পদের সারণীতে নিচের ২০-৩০ ভাগের মধ্যেই পড়ে। তাই বৃহত্তর ঐক্য তৈরি করতে গেলে শুধু সংরক্ষণ বা নির্বাচনী আসনের পাটিগণিত নিয়ে ভাবলে চলে না, জাতি-র অনৈক্যের মধ্যে শ্রমিক-উৎপাদকের ঐক্য খুঁজতে হয়, তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করতে হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক মূল্যবোধেরও সেচনের দরকার হয়, যা জাতি পরিচয়কে অতিক্রম করে মানবিক পরিচয়ের ভিত্তিতে সামাজিক একতার কথা বলে।

এই প্রসঙ্গে 'সেবা' নামক দুনিয়ার সর্ববৃহৎ মহিলা ট্রেড ইউনিয়নের পথিকৃৎ ইলা ভাটের লেখা এক কাহিনী মনে পড়ছে। তাঁরা আমেদাবাদে মেয়েদের শ্রমিক সমবায় তৈরি করেছিলেন; সেই সমবায় বিভিন্ন সরকারি অফিসের ঘরদোর-টয়লেট সাফ করার কাজ নিত। মহিলা শ্রমিক সমবায়ের সদস্যরা সেই কাজ করতেন। সমবায়ের মধ্যে নানা জাতির মহিলা আছেন। সরকারি অফিসের বাথরুম সাফ করার কাজ সমবায়ের সদস্য ভাঙ্গি জাতি-র মহিলারাই করতেন। কারণ সামাজিকভাবে ময়লা সাফ করাটা তাঁদের পরিচিতি। অন্য জাতির মহিলারা করতে চাইতেন না। এই নিয়ে শ্রমিক সমবায়টি ভেঙ্গে যাবার অবস্থা হয়েছিল। সেবার নেত্রীরা কয়েক মাসের চেষ্টায় শ্রমিক সমবায়ে এক নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন - কাজের ছোটো, বড়ো নেই, সব কাজই সবার।

মূল কথাটি সরল। জাতি ঐক্য তৈরি হওয়া দরকার তার জন্য শ্রমের ঐক্যের কথা রাজনীতিতে আনতে হবে। আজকের জাতি রাজনীতি তার থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে নীতিগতভাবে জাতি গণনার প্রয়োজনকে অস্বীকার না করলেও তার রাজনীতি কোন দিকে গড়াবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

জাতি গণনার বিরোধিতায় মূলত দুই রকমের যুক্তি শুনতে পাচ্ছি। প্রথম যুক্তিটা হচ্ছে জাতি ব্যবস্থা এমনিতেই পিছু হঠছে। শহুরে আধুনিক মানুষ জাতি-তে আগ্রহী নয়, কাজেই যেটা ইতিমধ্যেই পিছু হঠছে তাকে নিয়ে এত মাথাব্যাথা কেন? এই যুক্তির সারবত্তা বিশেষ নেই। জাতি ব্যবস্থার তিনটি অঙ্গের মধ্যে দুটি অঙ্গ কিছুটা পিছু হঠেছে ঠিকই এবং তার জন্য সংরক্ষণ নীতি অনেকটা দায়ী, আর বাকিটা সমাজের মধ্যে বাজার-ব্যবস্থার নিবিড় অনুপ্রবেশের জন্য হয়েছে। এই দুটি অঙ্গ হল ছুঁতমার্গ আর জাতি-শ্রমের অবশ্যম্ভাবী সমন্বয়। সংরক্ষণের ফলে আজ অফিসে, বাসে, থানায়, ট্রেনে সব জাতির মানুষের পাশেই আপনাকে বসতে হচ্ছে, হাত মেলাতে হচ্ছে, দেওয়া-নেওয়া করতে হচ্ছে, পাসওয়ানের ছেলে ব্রাহ্মণকে এয়ারপোর্টে দেহ তল্লাশি করছে, পাশাপাশি কুরমির ছেলে সুইগির ডেলিভারি বয় হয়ে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে অস্পৃশ্যতা কমেছে সন্দেহ নেই। আর সংরক্ষণের ফলেই চামারের মেয়ে স্কুল টিচার হয়েছে, কুরমির ছেলে থানার ইন্সপেক্টর হচ্ছে, সাঁওতাল মেয়েও সরকারি দপ্তরে কলম চালাচ্ছে। ফলে জাতির যে সাবেকি পেশা ছিল শুধুমাত্র সেই পেশাতেই সে আর আবদ্ধ থাকছে না। সংরক্ষণের বলয় বাড়লে জাতি ব্যবস্থার এই দুটি অঙ্গ আরও পিছু হঠবে। আর তাছাড়া শহরের মানুষ যদি জাতি ব্যবস্থা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে থাকে তাহলে সেটা জাতি গণনাতে বেরিয়ে আসবে। শহরের লোকেরা বলে দেবে 'আমাদের জাত নেই' বা 'আমি আমার জাত জানি না' বা 'আমার জাত বলব না'। প্রসঙ্গত বলা কর্ণাটকে যে জাতি সার্ভে হয়েছে তাতে ২.৫ লাখ মানুষ তাদের জাতি বলতে চাননি, সেটাই রেকর্ড হয়েছে।

জাতি গণনার বিরোধিতায় দ্বিতীয় যুক্তিটি হল জাতি গণনা সমাজে ও রাজনীতিতে জাতপাতের প্রভাব কমার বদলে আসলে জাতিকেই রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসবে, আরও বেশি করে পোক্ত করবে। সমাজকে তা বেশি টুকরো করবে। এর বিপরীতে এক ধরনের জাতি ঐক্যের সম্ভাবনা দেশ ইতিমধ্যেই দেখেছে, হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ে, পাশাপাশি মুসলমান বিরোধিতাতেও এক হতে দেখেছে। এই যুক্তির একেবারে কোনো সারবত্তা নেই তা নয়। একাধিক রাজ্যে এই ধরনের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য যে ব্যাপক ও গভীর হয়েছে তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই ধর্মীয় সংস্কৃতির ঐক্যের পিছনে যেটা লুকিয়ে থাকে তা হল এক সামাজিক অনুক্রমের (Hierarchy) ধারণা। এই অনুক্রম জাতিব্যবস্থাকেই ঐতিহাসিকভাবে পোক্ত করেছে, সমাজে এই ধারণা পোক্ত করেছে জাতি ব্যবস্থা ঈশ্বর প্রদত্ত, তাই স্বাভাবিক। যে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, তা সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে ঐক্য নয়, বরং জাতি ব্যবস্থার আধিপত্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। আর অবশ্যই নির্বাচনী পাটিগণিতের উদ্দেশ্যে।

জাতি গণনাকে সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ করতে হলে, একদিকে যেমন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে আঘাত করতে হবে, অন্যদিকে দলিত আদিবাসী ওবিসিদের মধ্যে বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, এবং তার জন্য হাতে একটিই পাথেয় আছে, জাতি রাজনীতির মধ্যে শ্রমিক, উৎপাদকের রাজনীতিকে জায়গা দেওয়া। সেটা করতে গেলে শুধু সরকারি ক্ষেত্রে নয় সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পদক্ষেপ (affirmative action) নীতিকে লাগু করতে হবে।