আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৫ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

সমসাময়িক

কোভিডের সত্য


২০২১ সালের নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থার (CRS) সদ্য প্রকাশিত তথ্য আমাদের সামনে এনে দিয়েছে ভারতের কোভিড পর্বের এক নির্মম অথচ অব্যক্ত অধ্যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দেশে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ২৫.৮ লক্ষ। সাধারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত মৃত্যু অন্তত ১৯.৭ লক্ষ। অথচ সরকারি হিসেব অনুযায়ী কোভিডে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৩.৩ লক্ষ। এই ফারাক কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, বিপর্যস্ত জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো, এবং সর্বোপরি, একটি অদূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তযন্ত্রের নির্মমতা।

কোভিড অতিমারির প্রথম ঢেউ যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, তখন ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকার মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে। এতবড় একটি সিদ্ধান্তের পিছনে না ছিল কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, না ছিল অভিবাসী শ্রমিক, দিনমজুর ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা। শহরগুলোতে কর্মরত কোটি কোটি মানুষ যখন হঠাৎ করেই কাজ হারিয়ে, বাসস্থান হারিয়ে, খাদ্য সংকটে পড়লেন, তখন তাঁরা পায়ে হেঁটে, কখনও শত শত কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গ্রামের দিকে ফিরতে শুরু করলেন। সেই পথে কেউ মারা গেলেন ক্লান্তিতে, কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ অনাহারে। এই মৃত্যুর সংখ্যা কোনও সরকারি তালিকায় ঠাঁই পায়নি। অথচ এই রাস্তাঘাটে ঝরে পড়া প্রাণগুলিও তো কোভিড ব্যবস্থাপনারই শিকার।

সরকার জানিয়েছিল, গরিবদের জন্য রেশন ও নগদ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। বাস্তবে দেখা গেল, বহু মানুষ সেই সহায়তা পাননি আধার নম্বর বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অনুপস্থিতির কারণে, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে, অথবা শুধুমাত্র তথ্য না পৌঁছনোর কারণে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলোর কাছে একবেলা খাবার হয়ে দাঁড়াল প্রশ্নবোধক চিহ্ন, আর হাসপাতাল তো দূরের কথা, পাড়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পৌঁছনো গেল না। এই অবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিচ্ছবি আমরা দেখেছি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। একদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলির সীমাহীন লুঠ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য লক্ষ টাকা, আইসিইউ-র বেডের জন্য ঘুষ, অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলির চরম বেহাল দশা। বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে কোনও জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছিল না, ছিল না চিকিৎসক, ছিল না যথাযথ ব্যবস্থাপনা। দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মত শহরে মানুষ অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় হাসপাতালের গেটেই মারা যাচ্ছেন - এই দৃশ্য সেদিন আমরা সকলেই দেখেছি।

অথচ সরকারি হিসাবে সেই মৃত্যু নেই। কারণ মৃত্যু সরকারি তালিকায় উঠতে গেলে 'মেডিক্যাল সার্টিফিকেশন অফ কজ অফ ডেথ' (MCCD) চাই। সেটাও দেশে ২০২১ সালে হয়েছিল মাত্র ২৩.৪% মৃত্যুর ক্ষেত্রে। তার মানে, ৭৬.৬% মৃত্যুর কারণ সরকার জানেই না! এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, কত বড় পরিসরে মৃত্যুকে চেপে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এই অসমতা ও গোপনীয়তা ছিল রাজ্যভিত্তিক। গুজরাটে সরকারি কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা ৫,৮০৯, অথচ অতিরিক্ত মৃত্যু ১.৯৫ লক্ষ অর্থাৎ ৩৩ গুণ বেশি। মধ্যপ্রদেশে সরকার বলছে ৬,৯২৭ জন মারা গেছেন, অথচ অতিরিক্ত মৃত্যু ১.২৬ লক্ষ যা ১৮ গুণ বেশি। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হিসেব ১১,০৫২, অতিরিক্ত মৃত্যু ১.৬ লক্ষ বা ১৫ গুণ। এইসব রাজ্যেই দেখা গিয়েছে প্রশাসনিক অব্যবস্থা, তথ্য গোপন এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার মর্মান্তিক মিলনবিন্দু। বিপরীতে কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি ইত্যাদি রাজ্য যারা তুলনামূলক স্বচ্ছ ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যনীতি অনুসরণ করেছে সেখানে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবের কাছাকাছি। কেরলে ৪৪,৬৫৫ অতিরিক্ত মৃত্যু, সরকারি হিসেব ৪৩,৯৮৭ যা মাত্র ১.০২ গুণ। এটিই দেখায়, স্বচ্ছতা সম্ভব, যদি সদিচ্ছা থাকে।

তাহলে প্রশ্ন উঠে আসে এই ১৯.৭ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এটি কি কেবল ভাইরাসের তাণ্ডব? না কি তার থেকেও বড়, রাষ্ট্রের অযোগ্যতা? আন্তর্জাতিক গবেষক ও পরিসংখ্যানবিদেরা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ভারতে কোভিড মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসেবের অনেক বেশি। কিন্তু কেন্দ্র সরকার সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে, WHO-এর সঙ্গে প্রকাশ্য বিতর্কে যায়। আজ নিজেদের দেশের সরকারি রিপোর্টই সেই দাবিকে সত্য প্রমাণ করেছে। এই মৃত্যু শুধুই কোভিড-আক্রান্তদের নয়, এই মৃত্যু রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির অভাবের, স্বাস্থ্য নীতির অন্তঃসারশূন্যতার এবং সবচেয়ে বড় কারণ হল দারিদ্র্য ও অসমতার জন্য মৃত্যু। যে দেশে হাসপাতাল নেই, রেশন পৌঁছায় না, তথ্য লুকোনো হয়, সেখানে ভাইরাস নয়, নীতি-ব্যর্থতাই সবচেয়ে বড় ঘাতক।

এই পরিসংখ্যান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অতিমারির সময় শুধুই ভাইরাস নয়, সরকারও মানুষের জীবনের নিয়ামক হয়ে ওঠে। ভুল সিদ্ধান্ত, অনুপযুক্ত প্রস্তুতি এবং সত্য চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা ইতিহাস কখনও ক্ষমা করে না। কোভিড অতিমারির সময় যে ১৯.৭ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে, তার প্রতিটিই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দলিল, যা কোনওভাবেই ভাইরাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ২০২১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল কোভিডে মৃতদের পরিবারপিছু ৫০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই নির্দেশ একদিকে মানবিক ছিল, আবার অন্যদিকে সরকারকে বাধ্য করেছিল মৃত্যুর যথাযথ হিসেব রাখতে। কিন্তু যদি স্বীকার করা হতো যে প্রকৃত কোভিড-মৃত্যু ৩.৩ লক্ষ নয়, বরং ২০ লক্ষের কাছাকাছি তাহলে এতে সরকারের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় দাঁড়াত প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা। সেই দায় এড়াতে মৃত্যু কমিয়ে দেখানো কার্যত এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়।

একই সময়ে, ২০১৯ সালে ঘোষণা করা হয় কর্পোরেট করহারে বড় রকম ছাড়। কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০% থেকে কমিয়ে ২২% করে দেয়, এবং নতুন উৎপাদন শিল্পের জন্য তা আরও কমিয়ে ১৫% করা হয়। এতে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে প্রায় ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় পেয়েছে দেশের বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি। অথচ এই সময় দেশের বহু দরিদ্র পরিবার সরকারি রেশন পাননি, ভাতা পাননি, অথবা তাঁদের আবেদন প্রক্রিয়া তথ্যগত জটিলতায় আটকে ছিল। একদিকে দরিদ্র নাগরিকেরা সরকারি ক্ষতিপূরণ পেতে মরিয়া, অন্যদিকে সেই অর্থ বরাদ্দের দায় এড়াতে মৃত্যু চেপে যাওয়া - এ এক নির্মম অথচ কৌশলগত বাস্তবতা, যার ব্যাখ্যা শুধুই প্রশাসনিক ব্যর্থতা দিয়ে সম্ভব নয়; এর মধ্যে রয়েছে এক প্রকার অদূরদর্শী এবং জনবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন।

অন্যদিকে, এই তথ্য গোপনের আরও একটি বড় কারণ ছিল সরকারের স্বচ্ছতার অভাব এবং পরিকল্পনার দুর্বলতা আড়াল করা। রাষ্ট্র যদি স্বীকার করে নিত যে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা ৬ গুণ বা ১৫ গুণ বেশি, তাহলে প্রশ্ন উঠত কেন অক্সিজেন প্ল্যান্টের জন্য প্রাক-নির্বাচনী বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হয়নি? কেন হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থেকেছে? কেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে দুর্বল অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল? এইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার বদলে সরকার তথ্যকেই আড়াল করল। অথচ একই সময়ে 'PM Cares Fund' নামে একটি বিতর্কিত তহবিল গঠিত হল, যা প্রধানমন্ত্রীর নামে তৈরি হলেও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির অধীনে নয়, সংসদীয় নজরদারির আওতায়ও নয়। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই তহবিলে জমা পড়ে প্রায় ১০,৯৯০ কোটি টাকা যার মধ্যে বহু অর্থ আসে সরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতন কাটছাঁট করে, সরকারি পরিষেবা সংস্থাগুলোর সামাজিক দায়ভিত্তিক অনুদান থেকে এবং সাধারণ নাগরিকদের স্বেচ্ছা ও কখনও কখনও চাপাচাপির অনুদানে।

এই বিপুল অর্থ তাহলে কোথায় গেল? স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোন খাতে তা ব্যবহৃত হল? কত অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি হল, কত বেড বাড়ানো হল, বা কোন রাজ্য কত বরাদ্দ পেল এসবের কোনও প্রকাশ্য উত্তর নেই। বেশিরভাগ আরটিআই-এর জবাবেই বলা হয়েছে, 'PM Cares' কোনো পাবলিক অথরিটি নয়, তাই তথ্য জানানো সম্ভব নয়। এ যেন এক প্রতীকি 'নির্ভরতাহীনতা', যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের টাকায় গড়া তহবিলের ব্যবহার নাগরিককেই জানাতে বাধ্য নয়। অথচ সেই সময়ে হাজার হাজার মানুষ অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষায় থাকাকালীন মারা যাচ্ছেন, পাড়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ - সেই বেদনার মধ্যেও তহবিল থেকে কী প্রকৃত উপকার হল, তা এক রহস্য। এই ১৯.৭ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যুর প্রতিটিই এক একটি প্রশ্নচিহ্ন। কে দায়ী? কেন তারা বাঁচতে পারল না? কেন রাষ্ট্র তাদের খোঁজ রাখেনি? এই প্রশ্ন শুধু তথ্যের নয়, নীতির, নৈতিকতার ও ন্যায়বিচারের। রাষ্ট্র হয়তো সাময়িকভাবে সংখ্যা ঢেকে দিতে পারে, দায় এড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তা লেখে না। ইতিহাস নির্মাণ করে নির্লিপ্ততা, অব্যবস্থা আর মিথ্যাচারের বিরুদ্ধ দলিল হিসেবে। একদিন, এই রাষ্ট্রকেই সেই প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, নইলে অতিমারির চেয়েও বড় ব্যাধি হয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্রীয় দায়হীনতা ও গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার মৃত্যু।