আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৫ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
সমসাময়িক
মিথ্যা মিডিয়া
ভারতের সংবাদমাধ্যম, বিশেষত টিভি মিডিয়া নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে আজ এক দশকের বেশি সময় ধরে। লাগাতার দেশের শাসকদলের গুণকীর্তন করা, বিরোধীদের অযাচিতভাবে তীব্র আক্রমণ, সংঘ পরিবারের নির্দেশ মেনে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার করা, সরকার বিরোধী যে-কোনো স্বরকে 'আর্বান নকশাল' ইত্যাদি নামে কলঙ্কিত করে তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা, বর্তমান ভারতীয় মিডিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সরকারের তাঁবেদার এহেন মিডিয়া গোটা বিশ্বে বর্তমানে বিরল। তবুও ভারত ও পাকিস্তানের ভিতর বিগত কয়েকদিনের সামরিক উত্তেজনার সময় টিভি মিডিয়ার সম্প্রচার মিথ্যা, যুদ্ধজিগির এবং নির্লজ্জতা অতীতের সমস্ত সীমাকেও অতিক্রম করেছে।
পহেলগামের নৃশংস অমানবিক উগ্রপন্থী হত্যাকাণ্ডের পরে টিভি মিডিয়াতে লাগাতার পাকিস্তানপন্থী উগ্রপন্থীদের সমালোচনা ও আক্রমণ করার নামে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা যায় একাধিক চ্যানেলকে। সরাসরিভাবে দেশের সংখ্যালঘু অংশের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার শুরু করা হয়, বারংবার উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলতে শোনা যায় তথাকথিত টিভি সঞ্চালকদের। যেখানে দেশের সরকারের বক্তব্য ছিল এই যে পহেলগামে উগ্রপন্থী কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের ভিতরে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করা, সেখানে উগ্রপন্থীদের সেই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা না করে দেশের মিডিয়ার একটি বড় অংশ সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে আদতে উগ্রপন্থীদের সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যকেই প্রশ্রয় দেয়।
এই প্রচার চলাকালীন দেশের সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ভিতর অবস্থিত ৯টি জঙ্গি ডেরার উপর আকাশপথে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। এর পরে সরকারের তরফে সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারের বিদেশ সচিব স্পষ্ট করে বলেন যে ভারতের সামরিক অভিযান 'সিন্দুর'-এর লক্ষ্য পাকিস্তানের সেনা অথবা নাগরিকরা ছিল না। এই সামরিক অভিযান চালানো হয় পাকিস্তান মদতপুষ্ট উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে। বিদেশ সচিব একথাও বলেন যে ভারতের অভিযান ছিল পরিমিত এবং উত্তেজনা বাড়ানো ভারতের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনা যদি ভারতের উপরে আক্রমণ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী ব্যবস্থা নেবে। কোনো সরকারী আধিকারিক এমন দাবি করেননি যে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে বা পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে এই অভিযান চালিত হয়েছে।
কিন্তু ভারতের মিডিয়া এই সামরিক অভিযানকে যুদ্ধ আখ্যা দিয়ে লাগাতার দেশের মধ্যে যুদ্ধজিগির তুলতে থাকে। টিভি স্টুডিওকে রণক্ষেত্রের মতন সাজিয়ে, প্রায় সামরিক পোশাক পরে বিভিন্ন সঞ্চালক যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা করে। লাগাতার ভুয়ো খবর পরিবেশিত হতে থাকে বিভিন্ন তথাকথিত সূত্রকে উদ্ধৃত করে। যেখানে দেশের সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে অপেরশন 'সিন্দুর'-এর প্রধান লক্ষ্য পাক সেনা বা সাধারণ মানুষ নয়, তখন কেন দেশের মিডিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গতিবিধিকে যুদ্ধ আখ্যা দিয়ে দেশের সেনা ও সাধারণ মানুষের বিনিময়ে নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর খেলায় নামে? কারণ দেশের মানুষ বা দেশের সম্মান নয়, এই মিডিয়ার প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন করা যা করতে হলে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর খবর পরিবেশনা করার থেকে তারা পিছিয়ে আসে না।
ভারতের উগ্রপন্থী ঘাঁটি ধ্বংস করার জবাব দিতে পাক বায়ু সেনা তিনদিন টানা দেশের বিভিন্ন শহরে বায়ুপথে আক্রমণ নামিয়ে আনে। একই সাথে সীমান্তবর্তী নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর প্রবল অস্ত্র ভারতের দিকে চালায়। এর ফলে কিছু নিরপরাধ সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। যদিও পাকিস্তানের বায়ুপথে আক্রমণকে দেশের বায়ুসেনা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাক সেনার এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের সেনা জবাবী সামরিক আক্রমণ করে মূলত বায়ুপথে। পাকিস্তানের বেশ কিছু গুরুত্বপূ্র্ণ সামরিক পরিকাঠামোর উপরে ভারতীয় বায়ুসেনা আক্রমণ করে।
আবারও মিডিয়া সত্যের তোয়াক্কা না করে একের পর এক ভুয়ো খবর প্রচার করতে থাকে। বলা হয় যে ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানের লাহোর, ইসলামাবাদ, কোয়েট্টা সহ বহু শহরে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছে। টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে খবর যে ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে। বলা হয় যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাঙ্কারে গিয়ে লুকিয়েছেন এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রধানকে অপসারিত করা হয়েছে। খ্যাতনামা সাংবাদিকদের টিভির পর্দায় উল্লাস করতে দেখা যায় যে ভারত প্রায় পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিয়েছে অথবা পাকিস্তানের মানচিত্র পালটিয়ে দেশটিকে চার টুকরে ভেঙে দিয়েছে। এই সমস্ত খবর সামাজিক মাধ্যমের 'ফেক নিউজ' হলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু এই সমস্ত খবর দেশের খ্যাতনামা প্রায় প্রতিটি চ্যানেলের পর্দায় দেখা গিয়েছে। মানুষ এই খবর দেখে বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু পরের দিন সকালবেলাতেই বোঝা গেছে যে এই সমস্ত খবর ভুয়ো।
এর ফলে দেশের টিভি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে ঠেকেছে তা নিয়ে আমাদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। এই মিডিয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আগেও ছিল না। তাদের পক্ষপাতদুষ্ট তথাকথিত সাংবাদিকতার ভণ্ডামি মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। পাকিস্তান কাণ্ডে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্বিধাহীন এবং লজ্জাহীনভাবে ভুয়ো খবর বেচে মানুষকে চূড়ান্ত বিভ্রান্ত করার নীতি। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন মিডিয়ার দিকে নয়। আমাদের প্রশ্ন থাকবে মূলত সরকারের কাছে।
ভারত পাকিস্তান সামরিক সংকটের সময় দেশের বিদেশসচিব এবং সেনাবাহিনীর তরফে লাগাতার মানুষকে জানানো হয়েছে যে কী ঘটছে। বারংবার বলা হয়েছে যে দেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সামরিক বা বেসামরিক পরিকাঠামোকে ধ্বংস করতে চায় না। শুধুমাত্র পাকিস্তানের আক্রমণের প্রত্যুত্তরে সামরিকভাবে পাকিস্তানের উপর আক্রমণ চালানো হয়েছে যাতে পাকিস্তানের ক্ষতিসাধন হয়েছে। কোথায় কোথায় কী কী আক্রমণ করা হয়েছে, তাতে কী কী ক্ষতি হয়েছে, তাও বিদেশসচিব তথা সেনা মুখপাত্ররা বিষদে ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলে তারপরেও কেন এরকম কদর্যভাবে ভুয়ো খবর মানুষকে দেওয়া হল?
এই সংকট চলাকালীন, দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক একটি নির্দেশিকা জারি করে যে সূত্রের ভিত্তিতে নয়, সরকারীভাবে যা বলা হচ্ছে তাই যেন সংবাদমাধ্যম মানুষকে জানায় এবং সামরিক গতিবিধির লাইভ কভারেজ যেন না করা হয়। অতীতের উদাহরণ তুলে ধরে এই কথাও বলা হয় যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়ার দায়িত্ববোধহীন সম্প্রচারের ফলে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে সামরিক কার্যকলাপ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সরকারীভাবে এহেন নির্দেশিকা থাকার পরেও, মিডিয়া যেই অপরিণামদর্শিতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকার এখনও অবধি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি যেই সব চ্যানেল ভুয়ো খবরের বেসাতি খুলে বসিয়েছে তাদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেনি। আমরা জানতে চাই, সরকার কেন একটি বারের জন্যেও এই ধরণের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুলছে না?
অন্যদিকে, খবরে প্রকাশ যে 'ওয়ার'-এর ওয়েবসাইট দেশে আর খোলা যাচ্ছে না কারণ সরকারী বিধিনিষেধ। দেশ যখন সামরিক কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে তখন 'ওয়ার'-এর মতন সংবাদমাধ্যম, যারা সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কিছু প্রশ্ন সরকারের সামনে তুলে ধরেছে, তাদের ওয়েবসাইট আটকে দেওয়া হল। কিন্তু যেইসব চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যম লাগাতার সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক কাজকর্মের ভুয়ো রিপোর্ট মানুষকে পরিবেশন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে একটি শব্দও খরচ করতে দেখা গেল না!
আসলে যেসকল সংবাদমাধ্যম এই ধরনের ভুয়ো খবর প্রকাশ করেছে, তারা সবাই মোদী তথা সরকারের ভৃত্য। বিগত ১০ বছরে এমন কোনো ইস্যু নেই, যেখানে এই সংবাদমাধ্যমগুলি মোদী সরকারের বিরোধিতা করেছে। বরং মিথ্যা এবং অর্ধসত্য জনগণের সামনে হাজির করে তারা লাগাতার সরকারের গুণগান করে গেছেন, কারণ এটাই তাদের কাজ। অতএব সরকারও এদের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। তাই টিভির পর্দায় যা খুশি দেখালেও তাদের কোনো ভয় নেই।
এই মিথ্যাচারের সমর্থনে যুক্তিও সাজানো হয়ে চলেছে সামাজিক মাধ্যমে। মোদী ভক্তদের একাংশ বলছেন যে এই মিথ্যা পরিবেশন আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অঙ্গ। মিথ্যা কথা বলে পাকিস্তানের জনগণ তথা সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। যারা এই সব কথাগুলি বলছেন তারাও মানুষকে বোকা বানানোর খেলায় নেমেছেন। পাকিস্তানে বসে পাকিস্তানের মানুষ তথা সেনা ভারতের ভুয়ো মিথ্যার উপর ভিত্তি করে হতাশ হয়ে পড়বেন এইসব কথা মানতে হলে যেই উর্বর মস্তিষ্কের দরকার, তা আছে একমাত্র তাদের যারা গো-মূত্রে সোনা আছে বলে মনে করেন। ভারতের এই মিডিয়া সার্কাস নিয়ে পাকিস্তান সেনা সাংবাদিক সম্মেলনে গোটা বিশ্বের সামনে বলেছে ভারত তথা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম একের পর এক মিথ্যা কথা জনগণকে বলে চলেছে। এর ফলে ভারতীয় মিডিয়ার আন্তর্জাতিক স্তরে বিশ্বাসযোগ্যতা কমেছে।
ভারতের টিভি মিডিয়া মোদী তথা বিজেপির জন্য সম্মতি নির্মাণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই মিডিয়ার মালিকরাই আবার মোদীর মূল অর্থদাতা তথা পৃষ্ঠপোষক। অতএব, মিডিয়ার 'ন্যারেটিভ' সরকার তথা মোদীর পক্ষেই থাকবে। প্রয়োজনে নির্ভেজাল মিথ্যা বলতেও এরা পিছপা হবে না। এই মিডিয়া দেশের মানুষের কোনো ভালো করতে পারে না। বিজেপি-র বাণী আরও উগ্রভাবে দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আশাই এদের একমাত্র কাজ। একদিন দেশের মানুষ এই মিথ্যার কারবারিদের সত্য উপলব্ধি করবেন। সেদিন যদি আসে তাহলে ভারত পাকিস্তান সাম্প্রতিক সামরিক সমস্যার সময় এদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে মানুষের বিবমিষা হবে।