আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

পুনঃপাঠ

অবরুদ্ধ কিউবা

গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্


যে-রাতে অবরুদ্ধ হল কিউবা, তখন সেখানে ছিল ৪৮২,৫৬০টি গাড়ি, ৩৪৩,৩০০টি রেফ্রিজারেটর, ৫৪৯,৭০০টি রেডিয়ো, ৩০৩,৫০০টি টেলিভিশন সেট, ৩৫২,৯০০টি ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, ২৮৬,৪০০টি ফ্যান, ৪১৮,০০টি ওয়াশিং মেশিন, ৩৫১,০০০০টি হাতঘড়ি, ৬৩টি রেলইঞ্জিন আর ১২টি সদাগরি জাহাজ। সবই মেড ইন ইউএসএ, কেবল হাতঘড়িগুলি ছিল সুইস কোম্পানির।

মনে হয় কিউবার মানুষের এটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল যে এই সংখ্যাগুলো তাদের জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ। উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তারা দ্রুত বুঝতে পারে কিউবা আলাদা একটা দেশ নয়, বরং আমেরিকারই বাণিজ্য-উপকূল। আখ আর তামাকের ব্যাবসা সবটাই নির্ভর করত মার্কিনি লগ্নির ওপর। এই দ্বীপের মানুষের ব্যবহারের সব জিনিসই বানানো হত আমেরিকাতে, তা সে আমেরিকার রাজনৈতিক সীমাতেই হোক বা কিউবার মূল ভূখণ্ডে। হাভানা বা অন্য দু-একটা শহরে খুশির প্রাচুর্য উপচে পড়ছে বলে মনে হলেও, টুথব্রাশ থেকে শুরু করে মালেকন এলাকার কাচে মোড়া কুড়িতলা হোটেল — সবই বিদেশিদের বানানো। কিউবা দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রায় তিরিশ হাজার জিনিস আমেরিকা থেকে আমদানি করত। বিপুল ক্রয়ক্ষমতা-সম্পন্ন কিছু ক্রেতাও তাকিয়ে থাকত এখানকার মায়াবী বাজারের দিকে। যেমন সেইসব পর্যটকেরা, যারা ফেরি নৌকা চড়ে আসত ওয়েস্ট পাম সৈকত থেকে কিংবা সমুদ্রের বুক চেরা রেলপথে নিউ অরলিয়েন্স থেকে, তারাও এইসব আমদানি করা মালপত্তর কিনত। এখানে কোনো শুল্ক লাগত না যে! এমনকী,  ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর প্রথমবারের যাত্রায় যে পেঁপে আবিষ্কার করেছিলেন তাও এখানকার বাতানুকূল দোকানে বিক্রি হত উৎপাদক দেশ বাহামার হলুদ রঙের স্টিকার সেঁটে। কিউবার গৃহবধূরা যে পোলট্রির ডিমকে ওষুধের গন্ধওলা জঘন্য কুসুমের জন্য জঞ্জাল জ্ঞান করতেন, তার খোলাতেও নর্থ ক্যারোলিনার একটি কারখানার মার্কা মারা থাকত। ধুরন্ধর কিছু মুদিখানার মালিক আবার এই ডিমগুলোকে কোনো দ্রবণে ডুবিয়ে ওইসব মার্কা তুলে ফেলে খানিকটা মুরগির গু মাখিয়ে দিত, যাতে দিশি ডিম বলে বেশি দামে বেচা যায়।

এমন কোনো উপভোক্তা-ক্ষেত্র ছিল না যা আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল নয়। কয়েকটা কারখানায় সস্তায় শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে সামান্য মালপত্র তৈরি করা হত যত সব আদ্যিকালের হাতফেরতা কলকব্জা দিয়ে। ওসব যন্ত্র যেদেশে তৈরি সেসব দেশে অনেকদিন আগেই বাতিল হয়ে গেছে। অধিকাংশ যন্ত্রকুশলীই আমেরিকান। আর কিউবার লোকেদের মধ্যে যারা যন্ত্রপাতিতে পারদর্শী হয়ে উঠত তাদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আকর্ষণীয় বেতনের লোভ দেখিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যেত। এমনকী কিউবায় নানান যন্ত্রের স্পেয়ার পার্টসের একটা গোডাউন পর্যন্ত ছিল না। থাকবেই বা কেন, কিউবার অলীক বাণিজ্যের সবটাই যে নিয়ন্ত্রিত হত নব্বুই মাইল দূর থেকে, একবার ফোন করে দিলেই পরের উড়ানে সূক্ষ্মতম যন্ত্রাংশও চলে আসত কোনো শুল্ক ছাড়াই।

এমন সর্বাত্মক নির্ভরতা সত্ত্বেও নাগরিকেরা পাশবিক অবরোধের মুখে দাঁড়িয়েও দেদার খরচ করে চলেছিল। যারা বিপ্লবের জন্য প্রাণ বিপন্ন করতে পিছপা নয়, এমনকী যারা পরে মৃত্যুবরণও করেছে, তারাও ছেলেমানুষের মতো মালপত্র খরিদ করে খুশি মিটিয়েছে। শুধু তাই নয় : বিপ্লবীরা ওদেশে প্রথমেই যেটা করেছে তা হল গরীবগুর্বো মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। আর সেসময়ে গরীব মানুষেরাও এন্তার জিনিসপত্র কিনে গেছে। হঠাৎ যেন মানুষের হুঁশ হয়েছে যে অনেক শখই অন্তত অর্ধেকজীবনের মতো মুলতুবি রাখতে হবে, হয়তো এ জীবনে মেটানোও যাবে না। তাই বাজারে যেসমস্ত জিনিস বিক্রি হয় রাতারাতি সেগুলোর বদলি জোগার করতে না পারায় একমাস আগেও যেসব ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চোখধাঁধানো সম্ভার ছিল, দ্রুতই সেগুলো হাড্ডিসার হয়ে গেছে।

বিপ্লবের শুরুর দিনগুলোতে কিউবা ছিল তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন ও নৈরাজ্যের রাজধানী।  জনসাধারণের বিবেকে যদিও নবতর মূল্যবোধের জন্ম হতে অনেক দেরি - ক্যারিবীয় পৌরুষ কিন্তু সেই জরুরি অবস্থার সময়ে জাগরূক ছিল। নতুনের ঝোড়ো হাওয়া ও স্বায়ত্বশাসনের স্বাদ পেতে জাতীয় আবেগ তখন এতটাই উন্মুখ ছিল এবং আসন্ন অমঙ্গলের লক্ষণগুলো এতটাই বাস্তব ও স্পষ্ট ছিল যে মানুষ একটা জিনিসের সঙ্গে হামেশাই অন্য জিনিসকে গুলিয়ে ফেলত। যেমন কেউ কেউ ভাবত দুধের অপ্রতুলতার মতো সমস্যাও বন্দুকের নল দিয়ে সমাধান করে ফেলবে। সেসময়ে বিদেশিদের আলোড়িত করা পাচাঙ্গা ডান্সপার্টিগুলোরও আত্মা ছিল কিউবান এবং শিকড় ছিল বাস্তবেরই মাটিতে। বিপর্যয়ের কান ঘেঁষে যাওয়া নিতান্তই নিরীহ ভাবাবেশ বলা যায়। ১৯৬১-এর শুরুতে আমি যখন প্রেনসা ল্যাটিনার সাংবাদিক হিসেবে চারদিকের আঁখো-দেখা-হাল জোগাড় করতে দ্বিতীয়বার হাভানা গেলাম, তখন খেয়াল করেছিলাম সেদেশের চাক্ষুষ বাস্তবতার খুব সামান্যই বদল হয়েছে। কিন্তু চাপা সামাজিক উৎকণ্ঠা হয়ে উঠেছে অসহনীয়। মার্চ মাসের এক চমৎকার বিকেলে আমি সান্তিয়াগো (ডে কিউবা) থেকে উড়ে গিয়েছিলাম হাভানা। বিমানের জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে গেলাম নদী-বঞ্চিত সেই দেশের অলৌকিক সব মাঠ, পাংশু গ্রামগুলি, নিরালা খাড়ি। সেই দীর্ঘ যাত্রায় আমি যুদ্ধের চিহ্ন অনুভব করছিলাম। বোমারুবিমান হানার আতঙ্কে হাসপাতালগুলোর ছাতে সাদা বৃত্তের মধ্যিখানে বিশাল বিশাল রেড ক্রশ আঁকা। ইশকুল, গির্জা, বৃদ্ধাবাসগুলোর ছাতেও একই চিহ্ন আঁকা। সান্তিয়াগো আর ক্যামাগুয়ের অসামরিক বিমানবন্দরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জড়ো করা শত্রু-বিমান ধ্বংসকারী যত গোলা-বন্দুক ট্রাকের ক্যানভাসের আড়ালে লুকোনো ছিল, উপকূলে আগে যেসব স্পিড বোট বিনোদনের কাজে ব্যবহার করা হত সেগুলো তখন শত্রু সৈন্যের অবতরণ ঠেকাতে তৎপর। সাম্প্রতিক নাশকতার কারণে সর্বত্র প্রবল প্রতিশোধের হাওয়া : মিয়ামি থেকে পাঠানো যুদ্ধবিমান আখের খেতগুলোকে আগ্নেয় বোমায় জ্বালিয়ে খাক করে দিয়েছে, অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের ডিনামাইটে ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানা। দুরূহ জায়গায় তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়েছিল মিলিটারি ক্যাম্প - যেখান থেকে বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আর রসদ নিয়ে কাজ চালাত। হাভানা বিমানবন্দরে ওরা অবশ্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছিল যুদ্ধের যাবতীয় আয়োজন লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে। কেবল বিমানবন্দরের মূল ভবনের এক কার্নিস থেকে অন্য কার্নিসের ধার পর্যন্ত ঝোলানো এক বিশালাকার ঘোষণা : ‘কিউবা, একটি স্বাধীন দেশ।’ গতবারের সেই সব দাড়িমুখো সৈনিকদের বদলে, এবার জলপাই-সবুজ পোশাক পরা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলাচ্ছে, যদিও তাদের হাতে সেই বাতিস্তার স্বৈরতান্ত্রিক আমলের অস্ত্রশস্ত্র। কোথাও অন্য কিছু দেখলাম না। বিপ্লবীরা আধুনিক অস্ত্র জোগাড় করতে পেরেছিল যখন আগের বছর মার্চের ৪ তারিখ আমেরিকার হাজারো প্রতিরোধ সত্ত্বেও ফরাসি জাহাজ লা কুব্রে-তে করে বেলজিয়াম অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল। যদিও অন্তর্ঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাভানা ডকে সাতশো টন অস্ত্রশত্র সহ সে-জাহাজ ধ্বংস করা হয়। সেই ধ্বংসলীলায় পঁচাত্তর জন মানুষ মারা যায়, আহত হয় দুশো জন। আজ পর্যন্ত কেউ সে-অন্তর্ঘাতের দায় স্বীকার না করলেও, কিউবার সরকার একে সিআইএ-র কাজ বলেই মনে করে। এই ঘটনায় মৃতদের অন্ত্যেষ্টিতে এসেই প্রথম বার ফিদেল কাস্ত্রো উচ্চারণ করেন সেই অমোঘ মন্ত্র : স্বদেশ অথবা মৃত্যু । কথাগুলো আমি প্রথম দেখেছিলাম সান্তিয়াগোর রাস্তায়, ক্যামাগুয়ে বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার ধুলো ওড়ানো খোয়াখোবড়া হাইওয়ের ধারে অতিকায় বিলবোর্ডে, যেখানে আগে উত্তর আমেরিকার উড়ান কোম্পানিগুলোর বা দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপন ছিল, সেখানে মোটা তুলির টানে আঁকা। একই জিনিস দেখলাম হাভানা বিমানবন্দরে টুরিস্টদের জন্য দোকানগুলোর জানলায় কার্ডবোর্ড কেটে তার ওপরে লেখা। ওয়েটিং রুমে, কাউন্টারেও একই ছবি। চুল কাটার সেলুনের আয়নায় সিসের রং দিয়ে লেখা, ট্যাক্সির উইন্ডস্ক্রিনে লিপস্টিক দিয়ে লেখা। এটা এমন সামাজিক সম্পৃক্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এমন কোনো জায়গা ছিল না, এমন কোনো মুহূর্তে ছিল না যেখানে বিপ্লবের এই প্রমত্ত বাণী লেখা ছিল না। চিনি কলের ড্রামগুলোতে, সরকারি নথির তলায়, খবরের কাগজে, রেডিয়োতে টেলিভিশনে মাসের পর মাস সমস্ত দিন ধরে ক্রমাগত প্রচার করা হয়েছে যাতে তা কিউবার মানুষের মর্মমূলে গেঁথে যায়।

হাভানাতে আসর একেবারে জমে গিয়েছিল। কিন্নরীরা ঝুল-বারান্দা থেকে গান গাইছে, সমুদ্রে উজ্জ্বল পাখিদের আনাগোনা, চারিদিকে সুর থৈ থৈ করছে। কিন্তু এই জীবনোল্লাসের তলায় আপনি অনুভব করবেন  সৃজনের দ্বন্দ্ব। এক রকমের জীবনধারা ততদিনে বাতিল হয়েছে, নতুন জীবনবোধের সামনে সে টিকতে পারছে না। নতুন জীবন তখনও অগ্নিময়, কিন্তু অনুপ্রাণিত এবং একই সঙ্গে বিধ্বংসী। সে শহর তখনও উপভোগের শেষ ঠিকানা। এমনকী ওষুধের দোকানেও স্লট মেশিন, উপনিবেশের গলিঘুঁজির পক্ষে বিপুলায়তন সব অ্যালুমিনিয়ামের গাড়ি, কিন্তু মানুষের হাবভাব পরিবর্তিত হচ্ছিল অবিশ্বাস্য ভাবে। সমাজের তলা থেকে পলি উঠে আসছিল আলোয়। এবং সেইসঙ্গে মানব-লাভার উদ্গীরণ - ঘন, ধোঁয়া-ওঠা, সদ্যমুক্ত শহরের যাবতীয় মোচড় ও বাঁকবদল সামলাতে গিয়ে হুল্লোড়ে এক ঘূর্ণিতে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া। ভীষণ ভাবে চোখে পড়ছিল গরিব মানুষগুলো কীভাবে প্রকাশ্যেই বড়োলোকেদের জায়গায় বসছিল। বিলাসবহুল হোটেলের লবিতে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ছে কিংবা বেদাদোর কফিখানাগুলোর চাতালে বসে দিব্যি আঙুল চেটে খাবার-দাবার সাঁটাচ্ছে। অথবা এককালের অভিজাত ক্লাব সিবোনি-র সুমিং পুলের উজ্জ্বল রংদার জলের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছে। হোটেল হাভানা হিলটনের (লোকমুখে ইদানীং হাবানা লিব্রে) সোনালি চুলের দারোয়ানটাকে হঠিয়ে দিয়ে এখন তার জায়গা নিয়েছে মুক্তিবাহিনীর উৎসাহী বাচ্চাগুলো। ওদের সারাদিনের কাজ হল যত চাষাভুষো লোককে বোঝানো যে তারা নির্ভয়ে হোটেলের ভেতরে ঢুকতে পারে এবং তাদের ঢোকা আর বেরুনোর দরজা দেখানো। সেই সঙ্গে এটাও বোঝানো যে, ঘর্মাক্ত কলেবরেও যদি কেউ হোটেলের বাতানুকুল লবিতে ঢোকে তবু তার যক্ষ্মা হবার বিন্দুমাত্র ভয়ও নেই। লুইয়ানোর এক দাপুটে ছোকরা, ছিপছিপে কালো চেহারা, শার্টের বুকে প্রজাপতি আঁকা, পায়ে আন্দালুসিয়ার নাচিয়েদের মতো হিল তোলা চকচকে চামড়ার জুতো, পেছন ফিরে হোটেল রিভিয়েরার কাচের রিভলভিং দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। মজার ব্যপার হল ঠিক সেই সময় এক ইউরোপীয় কূটনীতিকের স্ত্রী দরজাতে পাক দিয়ে বেরুবার চেষ্টা করলেন। ক্ষণিকের আতঙ্কে মহিলার বরটি ভেতর থেকে দরজাটা ঠেলে দিলেন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুক্তিসেনা একই সময়ে তাড়াহুড়ো করে উলটো দিকে জোরসে লাগালো এক ঠেলা। ফলে যতক্ষণ না দরজাটা আবারও ঘুরতে শুরু করে, ওই শ্বেতাঙ্গিনী আর কৃষ্ণাঙ্গ যুবক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য একজনের দাঁড়াবার জায়গায় দু-জনে স্ফটিকের পাল্লার ফাঁদে চেপ্টে গেল। শেষে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা হতভম্ব মেয়েটি বরের জন্য অপেক্ষা না করেই প্রায় লাফাতে লাফাতে অপেক্ষারত লিমুজিনে চেপে বসে এবং হুস করে বেরিয়ে যায়। হতবুদ্ধি কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি, কী হল ঠিক বুঝতে  না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল⎯ ‘একীরে বাবা! মেয়েটার গায়ে ফুলের মতো গন্ধ রে!’

উলটপুরাণও ঘটছে কোথাও কোথাও। বোঝাই যাচ্ছিল যে গ্রামে-শহরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা গত এক বছরে অনেকটাই বেড়েছে। বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গণ পরিবহন ও সাধারণ জনপরিষেবা পেতে মানুষের ব্যয় কমিয়ে একটা মানবিক চেহারা দেওয়া হয়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম গণ পরিবহনের মতোই দুম করে অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে এবং শহর থেকে গ্রামে প্রায়ই বিনামূল্যে প্রমোদভ্রমণ আয়োজন করা হচ্ছে। তাছাড়া বেকারত্ব কমছে দ্রুততার সঙ্গে, মজুরি বাড়ছে, নাগরিক বিধি সংস্কারের ফলে প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার উদ্বেগ কমছে, শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। ষাট মাইল দীর্ঘ ভারাদেরো সৈকত, যা আগে শুধু ধনকুবেরদের মনোরঞ্জনের জন্য বরাদ্দ ছিল, এখন শর্তহীন ভাবে আম আদমিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বড়োলোকেরাও সেখানে যেতে পারে। সাধারণ ক্যারিবীয় ধারণা অনুযায়ী কিউবানরা বিশ্বাস করত পয়সা রোজগার করা হয় খরচ করার জন্যই, কিন্তু কিউবার ইতিহাসে এই প্রথমবার তারা সেটা বাস্তবে করে দেখাতে পারছে।

আমরা খুব কমই জানতাম কীরকম নিঃশব্দচরণে আমাদের জীবনে ক্রমেই ঘাটতি প্রবেশ করছে। বে অফ পিগসে প্রতিক্রিয়ার শক্তির অবতরণের পরও ক্যাসিনোগুলো খোলা ছিল, খদ্দেরহীন ছোটো ছোটো বেশ্যারা রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছে যদি রুলেট খেলে জেতা কোনো কাপ্তেন ছেলে তার রাতটুকু উতরে দেয়। এটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না যে ওই ছোট্ট পাখিরা ক্রমেই বিষণ্ণতর আর সস্তা হয়েছে। তবে যাই হোক, হাভানা আর গুয়ানতানামোর নৈশজীবন দীর্ঘ আর নিদ্রাহীনই ছিল। পয়সা দিয়ে যেসব রাতের পার্টিগুলোয় মানুষ যেত সেখানে বাজনা বেজে গেছে সূর্য ওঠা অব্দি। এই সব পূর্বতন জনজীবনের অবশেষই সেখানে স্বাভাবিকত্বের বিভ্রম তৈরি করে রেখেছিল। এই নিশাচর খ্যাপাটে জীবন কিংবা আগ্রাসনের জঘন্য গুজব অথবা আসন্ন যুদ্ধের বাস্তবতা - সবই প্রশমিত ছিল, যদিও এসব অনেক আগে থেকেই সত্যি ছিল।

কখনো মাঝরাতের রেস্তোরাঁয় গরুর মাংস পাওয়া যেত না, কিন্তু আমরা তোয়াক্কা করতাম না, মুরগি তো পাওয়া যেতে পারে। কখনো কলা থাকত না, কিন্তু আমরা তোয়াক্কা করিনি, আরে রাঙা আলু তো পাব। আশেপাশের ক্লাবগুলোর বাজনদারেরা এবং অকুতোভয় আড়কাঠিরা রাতের উপার্জনের আশায় এক গ্লাস বিয়র নিয়ে অপেক্ষা করে যায়। তাদের দেখে মনে হয় আমাদের মতোই জীবনের এই প্রাত্যহিক ক্ষয়ে তারাও বিহ্বল হয়ে আছে।

দোকানগুলোর সামনে লাইন পড়তেই দেখা গেল কারখানায় তৈরি জিনিসপত্রের প্রাথমিক কিন্তু সক্রিয় কালোবাজারি শুরু হয়ে গেছে। তখনও কেউ ভাবেনি যে এসব শুরু হচ্ছে কেননা ক্রমশ জিনিসপত্রের জোগান কমছে। বরং উলটোটাই ভেবেছিল, ওদের ধারণা ছিল এসব হচ্ছে মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ এসে যাওয়ায়। এই সময় কারুর হয়তো একটা অ্যাসপিরিন দরকার, হয়তো আমরা তারপর একটা সিনেমা দেখতে যাব, কিন্তু পরপর তিনটে ওষুধের দোকানে পাওয়া গেল না। চতুর্থ দোকানটাতে পেলাম। সেখানে দোকানদার হালকা চালে জানাল গত তিন মাস ধরেই না কি অ্যাসপিরিন খুব কম আসছে। ঘটনা হল শুধু অ্যাসপিরিনই নয়, বহু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের জোগানই কিছুদিন ধরে কমছিল। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি শিগগিরই জিনিসপত্র আর পাওয়াই যাবে না। কিউবার সঙ্গে সব রকমের বাণিজ্যে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা জারি করার এক বছর পরেও সেখানকার জনজীবনে বিশেষ কোনো হেলদোল ছিল না, মানুষের অন্তরাত্মার বদলের কোনো ছাপ বাস্তব জীবনে আদৌ দেখিনি।

জীবনের নানান খুঁটিনাটি বিষয় বুঝতে বুঝতে এই অবরোধের কথা আমি খানিকটা ভয়ংকর অথচ আবেগতপ্ত ভাবেই জেনেছিলাম। প্রেনসা ল্যাটিনার অফিসে একদিন নাইট শিফটের কাজ সেরে মন্থর ভাবে হাঁটছিলাম যদি কিছু খাবারদাবার পাই। তখন সবে ভোর হচ্ছে। তখনও সমুদ্র রাতের আলস্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি, বিস্তৃত হলুদ সৈকত তাকে দিগন্তরেখার আকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আমি ফাঁকা রাস্তার মাঝখান দিয়ে অসংলগ্ন ভাবে হাঁটছিলাম, মালেকনের দিক থেকে নোনা হাওয়া এসে ঝাপটা মারছিল আমার চোখে-মুখে, পুরোনো শহরটার জল চোয়ানো ক্ষয়া পাথরের তৈরি দোকানগুলোর মধ্যে একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজে কিছু খাবার কথা ভাবছিলাম। শেষ পর্যন্ত একটা ছোট্ট রেস্তরাঁ খুঁজে পেলাম যার শাটারটা নামানো আছে কিন্তু তালা দেওয়া নেই। ভেতরে আলো জ্বেলে একটা লোক কাউন্টারের কাচ মুছে ঝকঝকে করছিল দেখে আমি নামানো শাটারটা তুলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম। সবে শাটারটা তোলার চেষ্টা করেছি এমন সময় নির্ভুল শুনলাম আমার পিছন থেকে কেউ রাইফেল তাক করছে। একটা সুরেলা কিন্তু দৃঢ় গলা ভেসে এল।

‘সামলে কমরেড’, মেয়েটি বলল, ‘হ্যান্ডস আপ’।

ভোরের কুয়াশায় যেন অলৌকিক আবির্ভাব। মিষ্টি মুখের মেয়েটির চুলগুলো পনিটেল করে ঘাড়ের দিকে টেনে বাঁধা। তার জলপাই রঙের শার্টে তখন খেলা করছে সমুদ্রের দামাল হাওয়া। মেয়েটা নিঃসন্দেহে একটু চমকেই গেছিল কিন্তু নিজের পা দুটো যেন ততক্ষণে মাটিতে পুঁতে রাইফেল হাতে পাক্কা সৈনিকের মতো দাঁড়িয়েছিল।

‘বেজায় খিদে পেয়েছে’, আমি বললাম।

আমার বলায় হয়তো এমন প্রত্যয় ছিল যে মেয়েটির অবিশ্বাস করুণায় বদলে গেল। ‘অনেক দেরি করে এসে পৌঁছেছেন’, সে বলল।

‘ঠিক উলটো’, প্রত্যুত্তরে বলি আমি। ‘সমস্যাটা হল আমি বড্ডোই তাড়াতাড়ি এসে গেছি। কিন্তু আমি প্রাতরাশ চাই’।

তারপর আমি হাতের ইশারায় কাচের ওপারে থাকা লোকটাকে বোঝালাম আমাকে কিছু খাবার দেওয়ার জন্য, যদিও তার দোকান খুলতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। আমি হামলে পড়ে অর্ডার করলাম ডিম, হ্যাম, দুধ দেওয়া কফি, মাখন-রুটি, টাটকা ফলের রস - যা মাথায় এল সব। দোকানদার কেমন যেন সন্দেহজনক ভাবে সামান্য কয়েকটা কথায় আমাকে জানিয়ে দিল, দোকানে গত সাতদিন ধরে ডিম বা হ্যাম কিছুই নেই, দুধ আসছে না গত তিন দিন। তাই আমাকে কেবল কালো কফি আর মাখন ছাড়া রুটি খাওয়াতে পারে, অবশ্য গতরাতের বেঁচে যাওয়া ম্যাকারনি খানিকটা গরম করে দিতে পারে। আমি একটু অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম খাবারদাবারের হলটা কী। আমার অবাক হওয়া দেখে লোকটাই কেমন জানি অবাক হয়ে গেল।

‘কিছুই হয়নি’, লোকটা বলল। ‘কেবল আমাদের দেশটা উচ্ছন্নে গেছে’।

আমি প্রথমে দোকানদারটিকে বিপ্লবের শত্রু ভাবলেও, সে কিন্তু আদৌ তা ছিল না। বরং তার একেবারে উলটোই বলা উচিত। তার পরিবারের এগারোজন সদস্য মিয়ামি চলে গেলেও সে যায়নি। সে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সারাজীবন থেকেই গিয়েছিল। তার ব্যাবসার কারণেই সে আমার মতো রাতজাগা সাংবাদিকের চাইতে অনেক সহজেই অনাগত জীবনের পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিল। ও ভাবছিল আর মাস তিনেকেই খাবারের অভাবে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। তবে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আগেই ঠিক করে রেখেছিল তাই খুব বেশি হেলদোল ছিল না।

অনুমান একেবারে অভ্রান্ত ছিল।  ১২ মার্চ ১৯৬২, অবরোধের তিনশো বাইশতম দিনে খাদ্যদ্রব্যের ওপর কড়া র‍্যাশনিং শুরু হল। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য মাসে বরাদ্দ হল গরুর মাংস তিন পাউন্ড, এক পাউন্ড মাছ, এক পাউন্ড মুরগি, ছ-পাউন্ড চাল, শুয়োরের চর্বি দু-পাউন্ড, দেড় পাউন্ড বিন, চার আউন্স মাখন এবং পাঁচটা ডিম। র‍্যাশনের হিসেবটা এমন ভাবে করা হয়েছিল যাতে কিউবার সব মানুষের দৈনিক ক্যালোরির চাহিদাটুকু মেটে। বাচ্চাদের জন্য বয়স অনুযায়ী অন্য হিসেব ছিল, চোদ্দো বছর পর্যন্ত সব বাচ্চার জন্য দৈনিক এক লিটার দুধ বরাদ্দ ছিল। পরে অমিল হল পেরেক, কাপড় কাচার সাবান, ইলেকট্রিক বাল্ব, গেরস্থালির অন্যান্য জরুরি জিনিসও। কর্তৃপক্ষের সংকট তখন আর শুধু নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ রইল না, ওগুলো জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। শত্রুপক্ষের এই চাপিয়ে দেওয়া ঘাটতি বিস্ময়কর ভাবে সমাজের নৈতিকতাকে আরও আঁটোসাঁটো করেছিল। র‍্যাশনিং শুরুর ওই বছরেই ঘটল ‘অক্টোবর সংকট’, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হিউ থমাস যাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবথেকে মারাত্মক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন, কিউবার বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝাড়া একমাস ত্রস্ত হয়ে রইল, নিজেদের প্রতিরোধের জায়গায় অটল থাকল যতক্ষণ না বিপদ দূরে গেছে বলে মনে হয়। ওরা ছররা বন্দুক নিয়ে পরমাণু বোমার সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিউবাকে অবরুদ্ধ করতে যে সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছিল তা যেকোনো সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতিকেও উপড়ে ফেলতে পারত। কিন্তু সেই সময়েও শিল্পোৎপাদন পৌঁছেছিল সর্বোচ্চ সীমায়, কারখানায় কামাই বন্ধ হয়ে গেল। এমনকী অন্যান্য বাধা, যা তুলনায় কম নাটকীয় সময়ে মারাত্মক ক্ষতিকর হয়, সহজেই কাটিয়ে দেওয়া গেল। নিউ ইয়র্কের এক টেলিফোন অপারেটর একবার কিউবায় তার এক সহকর্মীকে বলেছিল তারা ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল কী ঘটে এই আশঙ্কায়।

‘আমরা কিন্তু এদিকে দিব্য ছিলাম’, কিউবার অপারেটরটি জানিয়েছিল। ‘যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পরমাণু বোমার ঘায়ে তো মরতে হয়নি’।

দেশে তখন পর্যাপ্ত জুতো তৈরি হত যাতে কিউবার সবাই বছরে একজোড়া নতুন জুতো কিনতে পারে। তাই কাজের জায়গায় এবং স্কুলগুলোতেও জুতো পাওয়া যেতে লাগল। একেবারে ১৯৬৩-র আগস্টে যখন আর দোকানগুলোয় বিক্রির জন্য কিছুই অবশিষ্ট রইল না, তখনই প্রথম জামা কাপড়বিক্রিও নিয়ন্ত্রিত হল। তারা ন-টি জিনিসের র‍্যাশনিং আরম্ভ করল। তার মধ্যে ছিল ছেলেদের প্যান্ট, নারী-পুরুষ উভয়েরই অন্তর্বাস আর কিছু কাপড়ের জিনিস। তবে এক বছরের মধ্যেই নয় সংখ্যাটি বাড়িয়ে পনেরো করতে হয়।

বিপ্লবোত্তর কিউবায় ইতিহাসে প্রথমবার বড়োদিন পালন করা হল কচি শুয়োরের মাংস আর তুরোন ছাড়াই এবং এই প্রথমবার খেলনা বিক্রিতেও র‍্যাশনিং চালু হল। আবার একই সঙ্গে এটাই ছিল কিউবার ইতিহাসের প্রথম বড়োদিন যখন সব বাচ্চা অন্তত একটা হলেও খেলনা পেয়েছিল। এক্ষেত্রে যে শিশুদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হয়নি তার জন্য খেলনার র‍্যাশনিংকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐকান্তিক সহায়তা, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাহায্য, তখনকার দিনে কিউবার কাছে বিরাট ভরসার জায়গা ছিল। তাছাড়া বহু সমাজতন্ত্রী, লাতিন আমেরিকার বিশেষজ্ঞের সাহায্যও ছিল। তবু এই অবরোধ ছিল অনিবার্য বাস্তবতা, দৈনন্দিন জীবনের দুর্বোধ্য ক্ষতগুলোকে প্রতিনিয়ত সংক্রমিত করে যা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল কিউবার ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের দিকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পৃথিবীর অন্য দেশগুলির সঙ্গে কিউবার প্রায় কোনো যোগাযোগই ছিল না। মিয়ামি যাবার প্রাত্যহিক পাঁচটি বিমান, কিংবা নিউ ইয়র্ক যাবার জন্য কিউবানা দে অ্যাভিয়েশনের সপ্তাহে দু-বারের বিমান ওই অক্টোবর সংকটের কারণে বন্ধ ছিল। কিছু লাতিন আমেরিকান সংস্থার বিমান কিউবা যেত কিন্তু ক্রমশ তাদের দেশগুলি কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত রাখায় ধীরে ধীরে সেসব সংস্থার বিমান বাতিল হতে থাকল। শেষমেশ মেক্সিকো থেকে একটি সাপ্তাহিক বিমান অনেক বছর পর্যন্ত এই মহাদেশের সঙ্গে কিউবার নাড়ির যোগটা টিকিয়ে রেখেছিল। অবিশ্যি এটি একই সঙ্গে মার্কিন গুপ্তচর ও ভৈরব বাহিনীর অনুপ্রবেশেরও মাধ্যম ছিল। কিউবানা দে অ্যাভিয়েশনের হাতে শুধু মহাকাব্যিক ব্রিস্টল ব্রিটানিয়া বিমানই অবশিষ্ট ছিল। সেসব বিমান আবার বিশেষ চুক্তিসাপেক্ষে ইংরেজ নির্মাতা সংস্থাই রক্ষণাবেক্ষণ করত। কিউবানা দে অ্যাভিয়েশনের ওই বিমানগুলি উত্তর মেরুর পথে প্রায় ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো কসরৎ দেখিয়ে প্রাহা পৌঁছত। কারাকাস কিউবার সৈকত থেকে এক হাজার মাইল দূরেও নয়, তবু সেখান থেকে একটা চিঠি পাঠালে সেটা অর্ধেক দুনিয়ার ঘুরে এসে পৌঁছত হাভানায়। পৃথিবীর অন্য দেশের সঙ্গে কিউবার টেলি যোগাযোগ ছিল মিয়ামি বা নিউ ইয়র্কের মাধ্যমে, সমুদ্রের তলা দিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক তারে জোড়া। সেই যোগাযোগটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কিউবার এক জাহাজের নোঙরের ঘায়ে। হাভানা বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই নোঙরটার ওজন হিসেব করতে ভুলে গিয়েছিল। শক্তির একমাত্র উৎস ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টন পেট্রোলিয়াম, সোভিয়েত ট্যাংকারে বছরের পর বছর আট হাজার মাইল দূরের বাল্টিক বন্দরগুলি থেকে আসত। প্রতি তিপ্পান্ন ঘণ্টায় একটা করে সোভিয়েত ট্যাংকার কিউবায় এসে উপস্থিত হত। গুপ্তচরবৃত্তির অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত সিআইএ-র জাহাজ ‘অক্সফোর্ড’ বহু বছর ধরে কিউবার ভূখণ্ড লাগোয়া জলভাগে চৌকি দিয়ে গেছে যাতে হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্র বাদ দিলে আর কোনো পুঁজিবাদী দেশের সাহস না হয় মার্কিনি সিদ্ধান্ত অমান্য করার। সবার চোখেই এটা ছিল মাপা উত্তেজনা। হাভানার মালেকন থেকে পড়শি দেশের খানিক উঁচু শহর সান্তিয়াগো, মানুষ সমুদ্রের জলে সেই নোঙর করা উত্তেজক জাহাজটির উজ্জ্বল ছায়ারেখা দেখত।

কিউবার খুব বেশি লোকের মনে থাকার কথা নয়, তিনশো বছর আগে ক্যারিবীয় সাগরের ওপারে কার্তাহেনা দে ইন্দিয়াসের বাসিন্দাদের একই রকম নাটকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অ্যাডমিরাল ভেরননের নেতৃত্বে একশো কুড়িটা সেরা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে তিরিশ হাজার বাছাই করা সৈন্য নিয়ে ওই ভূখণ্ডকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশ নিযুক্ত হয়েছিল আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো থেকে, আজ যেগুলির উত্তরাধিকার বর্তেছে মার্কিন দেশের ওপর। ওই খুনে বাহিনীর একজন সর্দার ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের এক ভাই, যে পরে উপনিবেশ মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কার্তাহেনা দে ইন্দিয়াসের খ্যাতি ছিল যুদ্ধের সময় চমকপ্রদ আত্মরক্ষার কৌশল নির্মাণে আর ওদের নর্দমাগুলোতে বিপুল পরিমাণে থাকা ভয়ঙ্কর ইঁদুরের পালের জন্য। তারা এই আক্রমণ সামলেছিল দুর্ভেদ্য রণকৌশলে, যদিও সেদেশের মানুষকে খেতে হচ্ছিল যাবতীয় অখাদ্য-কুখাদ্য, যা হাতের কাছে মেলে, গাছের বাকল থেকে শুরু করে চেয়ারের গদি পর্যন্ত। কয়েক মাস পরে, আক্রান্তদের বীরত্বে এবং হলদে জ্বর, আমাশা আর উত্তাপে বিধ্বস্ত হয়ে ব্রিটিশ বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ওই শহরের নাগরিকেরা কিন্তু সুস্থ সতেজ ছিল। কেবল তারা সব খেয়ে ফেলেছিল, এমনকী শেষ ইঁদুরটাও।

কিউবার অনেকেই নিশ্চয় এই গল্পটা জানত। কিন্তু তাদের ইতিহাসচেতনা এতই দুর্বল যে তারা ভাবেইনি এমনটা আবারও ঘটতেই পারে। ১৯৬৪-র নিউ ইয়র্কে বসেও কেউ ভাবেনি আরও টেনে ফাঁস দেওয়া নির্দয় অবরোধ হতে পারে। তারা ভাবতেই পারেনি ওই ভূখণ্ডে পরিস্থিতি এমন হবে যে অসংখ্য বাড়িতে এবং প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এক ফোঁটাও খাবার জল থাকবে না।


তরজমাঃ শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

______________________________
(গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত এবং জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁর নিজের প্রথম পছন্দের পেশা ছিল সাংবাদিকতা। গত কয়েক মাসের অবরুদ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতায় পড়ে নেওয়া যাক অন্য রকমের এক অবরোধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন। বোগোতা থেকে প্রকাশিত অলতারনেটিভা পত্রিকার নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭৮ সংখ্যায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।)