আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

'ডরাই সাধা কাফনের সপনে' - জঙ্গিপুরের জার্নাল

অনিতা অগ্নিহোত্রী


কীরকম ধুলো-ময়লা মাখা ট্রেনটা। বগিগুলো যেন লোহা লক্কড়ের গাদা থেকে উঠে এসেছে। যে মানুষগুলো পোঁটলা ব্যাকপ্যাক মাথার বোঝা নিয়ে একটু বসার জায়গার জন্য দৌড়চ্ছে, যে মেয়েরা গায়ের চাদর ওড়না সামলে অথচ হাঁটুর কাছে কাপড় তুলে ছুটছে তাদের চেনে বলেই ট্রেনটা এই রকম। ময়লা, স্নান না করা, বেপরোয়া। একমাত্র এসি কোচটাই যা একটু পদের। একটাই যেহেতু, তাই মাসখানেক আগে টিকিট না কাটলে পাওয়া যায়না। তার যাত্রী চাকুরে, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, নানা রঙের মধ্যবিত্ত যারা এসি গাড়ির বাজেটে কুলোতে না পেরে গরম আর ধুলো না লাগিয়ে যেতে চায়। হাওড়া থেকে জঙ্গিপুর আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তায়, কামরায় নানা স্টেশন থেকে ওঠে অন্তত সাতশো হকার। জলসেচ এ সবুজ বর্ধমানের কালনা-কাটোয়া পেরোলে যাত্রীদের চেহারা, জিনিসপত্র কিছু মলিন ও ধূলিধূসর দেখায়। বোঝা যায়, মুর্শিদাবাদ জেলায় গাড়ি ঢুকেছে। ফেরার সময় যে রিটায়ার্ড কলেজ কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জঙ্গিপুর স্টেশনে, তিনি বলেছিলেন, এইসব বগি মেন লাইনে চলবে না, যেখানে গড় গতিবেগ ৬০-৭০ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা। তাদের বাতিল না করে এই লাইনে পাঠিয়ে দেওয়া।

জঙ্গিপুর রোড স্টেশন। মহকুমার সদর শহর - জঙ্গিপুর। যার হাতে পত্তন, সেই জাহাঙ্গিরের সময় শহরের নাম ছিল জাহাঙ্গিরপুর। ভাগীরথী অনেকটাই গ্রাস করে নিয়েছে পুরোনো শহরের। ব্রিটিশ আমলের আরম্ভের গোড়াতেও জঙ্গিপুর বিখ্যাত ছিল রেশম আর নীল চাষের জন্য। পূব পাড়ে জঙ্গিপুর। নদীর গ্রাস থেকে বাঁচাতে সরকারি দফতরগুলি নিয়ে যাওয়া হয়েছে নদীর ওপারে রঘুনাথগঞ্জে।

জঙ্গিপুরে পুরোনো জনপদ। বাজার, মসজিদ, দোকানপাট। ক্রমশ বড়ো আর গা ঘেঁষাঘেষি হয়ে উঠছে, যেমন ছোট শহরের বিধি। তার সঙ্গে গাড়ির জ্যাম। রঘুনাথগঞ্জ যেতে গেলে নদী পেরোতে, তার শান্ত গেরুয়া জলে ভেসে আছে নৌকা। গলি, পুরোনো বাড়ি, মন্দির। নদীর ধারে ১৯৫০-এ তৈরি কলেজটিও। এখন তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৮,০০০। জঙ্গিপুর কলেজের শিক্ষক নুরুল মোর্তজা, শুভঙ্কর দাস আর হাইস্কুল শিক্ষক জাহির আব্বাসের সঙ্গে এসেছি। জঙ্গিপুর দেখব।

এমন এক মহকুমা জঙ্গিপুর যাকে মাতিয়ে রেখেছে দুই বড়ো নদী। পদ্মা আর গঙ্গা বা ভাগীরথী। রঘুনাথগঞ্জ থেকে বার হয়ে ভাগীরথী সেতু পার হয়ে জঙ্গিপুরের মধ্যে দিয়ে জয়রামপুর হয়ে অ্যাফ্লাক্স (Afflux) বাঁধ পেরোলাম। দীর্ঘ বাঁধ। এখন দেখতে মাটি ঢাকা পাকা সড়কের মতো। নুরুল মোর্তজার কাছে শুনলাম, ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির সময়েই তৈরি হয়েছিল এই বাঁধ। ফারাক্কা থেকে ময়া গ্রাম (লালগোলার কাছে) পর্যন্ত বিস্তৃত এই পদ্মার জলে জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ যেন প্লাবিত না হয়, তার জন্য তৈরি হয়েছিল।

মিঠিপুর পঞ্চায়েত। এখানে সীমান্ত রেখা বেয়ে বয়েছে পদ্মা। নদীর পারে কিছুটা পশ্চিমবঙ্গ। তারপর বাংলাদেশের রাজশাহী। ফারাক্কা থেকে বেরিয়েছে দুই ধারা, ভাগীরথী আর পদ্মা। পদ্মা এই সীমান্ত অঞ্চল, জঙ্গিপুর, লালগোলা হয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের ভিতর। ভাগীরথী একদা জলহীন হয়ে পড়ছিল। কারণ জলের ঢাল পদ্মার দিকে। পদ্মার খাতের চেয়ে ভাগীরথীর খাতের উচ্চতা বেশি। কাজেই বর্ষাকাল ছাড়া গঙ্গা বা পদ্মার জল ভাগীরথী দিয়ে বইত না। ফারাক্কা ব্যারেজ হওয়ার পর ফীডার চ্যানেলের জল পেয়েছে ভাগীরথী। এখন সম্বৎসর তার জল একরকম। না হলে কলকাতা বন্দরেরও নাব্যতা কমে যাচ্ছিল।

মিঠিপুর গ্রাম। নদীর তীর শান্ত। বিকেল নামছে। বিরাট বট গাছটা ডালপালা মেলে ঝুরি নামিয়ে বসেছে। দেখে মনে হয় বহু পুরাতন। সেকেন্দ্রা হাইস্কুলের শিক্ষক আর কবি, জাহির আব্বাস বললেন, বেশি নয়, মাত্র দশ বারো বছর। পাশে পুরোনো গাছটা ছিল, মূল গাছটা, সেটা এখন নেই। নদীতে জল কম। বালির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত জল বর্ষায় এই গাছতলা পর্যন্ত চলে আসে। নদীর পর দুটো মাঠ। তারপর বাংলাদেশ, রাজশাহী জেলা। ওদিকের পাড়ে অজস্র গর্ত। জঙ্গিপুর কলেজের শিক্ষক নুরুল মোর্তজা বললেন, ওখানে ছোটো ছোটো পাখির বাসা। রঙীন পাখি। গাঙ্ শালিক? জীবনানন্দের পর গাঙ শালিকের কথা আর কে লিখেছে? বর্ষার জল এলে পাখিরা কোথায় যায়? খালি গা ভুঁড়ির নীচে লুঙ্গি যে লোকটা ভাঙা দাঁতে হাসছিল, সে বলল, গাছে উঠে বসে থাকে। ফিরে এসে পাখির তত্ত্ব তালাশ করলাম। এরা হল, নীল সবুজ পাখি। বাঁশপাতি। ব্লু টেইলড বী ইটার। Merops Philippinus. আসলে রামধনু রঙা। ব্লু টেইলড বললে পুরো বোঝা যায় না। জেলার এক দুর্লভ প্রাণী বৈচিত্র, চুপচাপ মিশে আছে ধূসর নদীর উঁচু পাড়ে।

মুর্শিদাবাদ জেলায় কোনো স্বাভাবিক অরণ্যভূমি নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের এই অভাব চোখে লাগে। কিন্তু আছে নদী, আছে জলাভূমি। ১০০ হেক্টরের বেশি আয়তনের বাংলার যে বড়ো জলাভূমিগুলি, তার ২৩টির মধ্যে ১৩টিই মুর্শিদাবাদে। এখানে গড়ে উঠেছে পাখি ধরা ও পাচারের এক আন্তঃজেলা চক্র। মানুষের লোভ কিছুই বাকি রাখছে না। পরিযায়ী পাখিরা আসে জলাভূমিগুলিতে। আছে স্থানীয় পাখিরাও। কিছুদিন যাবৎ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে আগ্রাসন চলছে পাখিদের উপর। মুর্শিদাবাদের পাটনবিল জলাভূমি থেকে তিনটি নাইলনের ব্যাগে বাঁধা অজস্র পরিযায়ী পাখি নিয়ে ধরা পড়েছে একজন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এমন কত ঘটনা নজরেও পড়ছে না। পাখিদের জীববৈচিত্র জেলার জন্য জরুরী, কবে বুঝবে মানুষ? জঙ্গল বিভাগ আর পাখিপ্রেমীদের নজরদারী সত্ত্বেও ৪৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফাঁদ পাওয়া গেছে মুর্শিদাবাদে। ৯০০-র বেশি ৩০টি প্রজাতির পাখিকে ফাঁদ থেকে মুক্তি দেওয়া গেছে। এ হল খুব সাম্প্রতিক কথা। গতবছরের।

নদীর অবস্থাও ভালো নয়। তীরে ময়লার স্তূপ। প্লাষ্টিকের অনশ্বর পাউচ। কেউ পরিষ্কার করে না? পঞ্চায়েত? কে করবে? লোকে বরং বাইকে করে ময়লা এনে এখানে ফেলে দিয়ে যায়। পঞ্চায়েত জানে না? সবই জানে। ময়লা পড়ে থাকবে এই রকম। বর্ষায় জল উঠলে নদীতে চলে যাবে। কি ভয়াবহ! তাই রঘুনাথগঞ্জের বাসিন্দা দাস মশাই বলছিলেন এখন ভাগীরথীর নীচের বালি দেখা যায়, জল পরিষ্কার। বর্ষায় স্নান করা যায়না, গা চুলকায়। পদ্মা নদীও সুন্দর। জলের আঁকাবাঁকা স্রোত বালির মধ্যে দিয়ে গেছে অনেক দূর। বর্ষায় আবর্জনার ভারে নিশ্চয়ই আবিল হয়ে উঠবে।

নদীর ধারে সরকারী জমিতে বাঁশের বেড়া দেওয়া অস্থায়ী রাম মন্দির। ২২শে জানুয়ারী অযোধ্যায় প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে। সরকারি জমি, কু-লোকে বলে মন্দিরের নির্মাণও সরকারি খরচে। গেরুয়া কাপড়ে ঢাকা, বাঁশে টাঙানো গেরুয়া পতাকা। বট গাছও রেহাই পায়নি। তার ডালে গেরুয়া ঝাণ্ডা। ‘জয় শ্রীরাম’ বলে বিকট চীৎকার করে গেল কেউ একজন সাইকেলে। হালদার পাড়ার বিড়ি বাঁধা মেয়েরা চোখ তুলেও চাইল না। কেনই বা তুলবে! কাজ থেকে হাত আর চোখ তুললেই তো সময় নষ্ট। এই হল জাতিধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের জীবিকা এই অঞ্চলে। মজুরির রেট একেবারে গলায় পা দিয়ে ঠেসে রাখা। হাজার বিড়ির জন্য ১৭০ টাকা। জানা গেল এলাকায় আরো কম রেট আছে। বড়ো সাইজের কেন্দু পাতাকে বিড়ির সঠিক আকারে চৌকণ করে কেটে নিতে হয়। এমনভাবে যাতে পুরো পাতার সবচেয়ে কম অংশ বাতিল হয়। তারপর বিড়ির তামাক ভরা, রোল করা ও বাঁধা। হালদার পাড়ার পথের ধারে, ঘরের সামনে, দাওয়ায় বসে যে মেয়েরা কাজ করছেন, তাঁরা ভাস্কর সম্প্রদায়ের হিন্দু। ভাস্কররা হলেন কাঠ মিস্ত্রী। ওড়িশায় যেমন মহারাণা সম্প্রদায়। দুয়ারের বাইরে শাশুড়ি ননদ, ভিতরে দাওয়ার উপর পুত্রবধূ। গা ঘেঁষে শিশু সন্তান। তামাক ঠাসার সময় ছাইয়ের বাটিতে হাত ডুবিয়ে নেওয়া। তামাকের সংস্পর্শে জীবন হানিকর রোগের সম্ভাবনা। শিশুদেরও বিপুল আশঙ্কা। কিন্তু কেউ বিকল্প জীবিকার কথা ভাবার অবস্থায় নেই। পুত্রবধূ বলছিলেন, কাছেই থাকেন মুন্সী যাঁকে গিয়ে তৈরি বিড়ি জমা করতে হয়। তাঁর হাজার বায়না। একটু দোষ পেলেই বাণ্ডিল কে বাণ্ডিল বাতিল। বাতিলের জন্য কোনও দাম নেই। সারা দেশে নথিভুক্ত ২৩ লক্ষ তামাক শ্রমিক। তাদের ১২.৪ লক্ষ বাংলায়। তার মধ্যে ৫.৪ লক্ষ কেবল মুর্শিদাবাদ জেলায়। মেয়েরা বয়ে চলেন কম মজুরি জনিত শোষণ ও বৈষম্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যহানির ভয়। তাঁদের অন্য কোনও দক্ষতা নেই, এমন নিরুপায় অবস্থা। ধুলিয়ানের বিড়ি শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় হাসপাতালটি টাকা ও ডাক্তার, যন্ত্রপাতির অভাবে ধুঁকছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন।

পুরুষরা বিড়ি কম বাঁধে। তাদের কাজ বাইরে। ধুলিয়ান এলাকায় বহু বছর ধরে আছে দক্ষ রাজমিস্ত্রীরা। সারা দেশে রাজমিস্ত্রী যায় এখান থেকে। একশো বছর আগে বিভূতিভূষণের লেখাতে আছে, 'মুকসুদাবাদ' থেকে ঘর ছাইতে আসা লোকেদের কথা।

মিঠি গ্রাম থেকে গিরিয়া হয়ে নবকান্তপুরের মধ্যে দিয়ে আবার অ্যাফ্লাক্স বাঁধ। গিরিয়ার চা দোকানে অসামান্য চা আর মিল থেকে নিয়ে আসা গরম মুড়ি আর তেলেভাজা। জাহিরের উদ্যোগ। আর কী আনন্দ। চায়ের আড্ডায় লালগোলা থেকে এসে গেছে নীহারুল ইসলাম। বলতেই হয় পদ্মা সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের জীবন বাংলা সাহিত্যে অমর হয়েছে নীহারুলের মরমী কলমে। আর এক গল্পকার নদীয়ার আনসারউদ্দিন, বিড়ি বাঁধা মেয়ের জীবনের হৃদয় মোচড়ানো ছবি এঁকেছেন 'ফুলমতির বিবাহ আসর' গল্পে। বিড়ি বাঁধার হাতটি বড় মিঠে ফুলমতির। কিন্তু পণ দিতে অপারগ বাপ, পাত্রপক্ষের সামনে তার মেয়ের হাতের বিড়ির গন্ধ পায় না ধোঁওয়ায়, পায় পোড়া মাংসের ঘ্রাণ।

সামনে ঘন বাঁশঝাড়ে ঢাকা জমিতে বিকেল ঘনায়। কিন্তু দোকানের সামনের নীচু জমি উপচে পড়ছে বহু মাসের জমে থাকা আবর্জনায়। গিরিয়াতে দুটি যুদ্ধ হয়েছিল। আলিবর্দী খান আর সরফরাজ খানের যুদ্ধ ১৭৪০-এ। ব্রিটিশের পক্ষে মেজর অ্যাডামস্ আর মীর কাশিমের সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৬৩-তে। সেসব যুদ্ধের কোনও দাগ, চিহ্ন নেই মানুষের দৈনন্দিন যাপনে। তবু, ইতিহাসের নামাবলী গায়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদ তার পিঠের দারিদ্রের অস্ত্রলেখা চাপা দিতে চায়।

বেলা পার করে পৌঁছলাম আহিরাণ। বার্ষিক যে নৌকো রেস হয় তা নদীর এইখান থেকে শুরু হয়। ভাগীরথীর উপর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। কিন্তু জ্যোৎস্না যেন এখনও লিপ্ত হয়নি বন পৃথিবীর অঙ্গে। লিকার চা আসবে দোকান থেকে। অপেক্ষা করছি। জলের ওপারে টিউব লাইট জ্বলছে। ওখানে কি হচ্ছে, যাত্রাপালা? না কি কথকতা? একজনের গলা শোনা যাচ্ছে সঙ্গে যন্ত্রসংগীত, আর বুঝি একজন দোহারও আছেন। বিষয়, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রেম। বাবা-মা সন্তানের জন্য যা করে, কেউ তা করতে পারে না। আপনারা কীর্তন শোনেন কেন, যদি বাপ-মাকে তাড়িয়ে দেন, জানবেন, কীর্তন শুনে কোনও লাভ নাই। সূর্য ডোবার একটু আগে আকাশ লাল ছিল। তখন আম ও লিচুর মঞ্জরীতে আলো পড়েছিল। আরও আগে এলে আরও ভাল দেখা যেত। আকাশ ঘন লাল থেকে অন্ধকার। তারপর অন্ধকারে উঠে এল পূর্ণিমার চাঁদ। কথক বলে চলেছেন। পরম প্রিয় ভাই লক্ষ্মণের প্রতি রামের অবিশ্বাস। অযোধ্যায় সিংহাসনে বসবেন রাম, অকস্মাৎ মূর্ছা গেলেন লক্ষ্মণ। রামের মনে জাগল অবিশ্বাস। তবে কি ভাই খুশি নন? তিনিও কি রাজা হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করছিলেন মনে মনে? না, লক্ষ্মণ দাদাকে বললেন, বনবাসের চোদ্দো বছর কিছুই খাননি তিনি। তাই তাঁর দেহ ক্লান্ত, উপবাসী। বটে! রাম জানতে চাইলেন, কিছুই খাওনি! তবে আমি যে রোজ ফল এনে দিতাম, তার কি করতে? সেসব কিছুই আমি খাইনি, দাদা। জমিয়ে রাখতাম। একেবারেই খাইনি, তাতো নয়, বললেন লক্ষ্মণ। সাত দিন আমি ফল খেয়েছি। সুখে-দুঃখে-শোকে, উপবাস ভেঙেছি, তারও বিশদ বর্ণনা দিয়ে দাদাকে হিসেব দিতে লাগলেন লক্ষ্মণ। এ কাহিনী আগে শুনিনি। তবে নদীর ওপারের হ্যাজাক জ্বালা শামিয়ানা থেকে ভেসে আসা রাম লক্ষ্মণের এই কথোপকথনে, রামকে মনে হচ্ছিল, ঈর্ষাপরায়ণ, অসংবেদী, নির্মম। রামের প্রতি টান বাঙালির মজ্জায় তেমন কোনদিনই ছিল না, যদি না সীতা পাশে থেকে কিঞ্চিত তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলতেন। এখন তো একক রাম, তাঁর নামে জয়ধ্বনি রণহুংকারে পর্যবসিত। হনুমান, লক্ষ্মণ সবারই এক উগ্ররূপ গাড়ির স্টিকারে পরিণত হয়েছে।

কি দিবে তোমারে ধর্ম? ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতায়। এ ধর্ম আর আজকের ধর্ম উন্মাদনা এক নয়। তবু ‘দুঃখ নব নব’ রূপে এসে জুটেছে মানুষের অদৃষ্টে। তারা সাধারণ দরিদ্র মানুষ। জঙ্গিপুর দিয়ে পুরো মুর্শিদাবাদকে মাপার চেষ্টা ঠিক নাও হতে পারে। তবে দেশের পিছিয়ে পড়া ২৩টি জেলার একটিতে আর বাংলার অন্যতম দরিদ্র জেলায় প্রবেশ করার অনুভূতিটা মনে লেগে থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলার জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ মুসলমান। আজ থেকে এক দশকের বেশি আগে ‘সাচার কমিটি’ অনুসন্ধানে বার করেছে, দারিদ্রের হিসেবে জনজাতি ও তফশিলি জাতির ঠিক উপরেই মুসলিম সম্প্রদায়। সরকারি চাকরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব গৌণ। মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলিতে স্বাস্থ্য পরিষেবার অবস্থা দীন। শিক্ষা ও সব পরিকাঠামোই কার্যত অনুপস্থিত। জ্বলজ্বলে রিপোর্ট সত্ত্বেও মাথায় হিজাব/ রুমাল চাপিয়ে ইফতারে শামিল হওয়া রাজনীতিক তাদের জন্য নতুন কোনও ভাবনা খুঁজে পাননা। বিড়ি ছাড়া অন্য শিল্প? লঘু উদ্যোগ? কারিগরি প্রশিক্ষণ?

ধর্ম ছাড়া হারাবার কিছু নেই তাই সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুকন্যাটির মাথায় হিজাব চড়ে, আর কলেজের শিক্ষক ক্লাসে বসা সারি সারি তরুণ মুখের দুই চোখ ছাড়া কিছুই দেখতে পান না। কিন্তু পরীক্ষার সময় অ্যাডমিট কার্ড দেখতে চাওয়াও বারুদের ঢিপিতে আগুন দেওয়ার সমার্থক হয়ে উঠতে পারে। সবাইকে সামলে চলতে হয়, কারণ জীবিকাবিহীন দারিদ্রের পরিসরে ধর্মই সবচেয়ে লোভনীয় ব্যবসা। এক জন প্রিন্সিপাল ও তাঁর সহকর্মী শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ানোর পরিসরটি যথাসম্ভব নির্মল ও পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করে চলেছেন বহুবিধ প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে। তাঁদের সদিচ্ছা ও পরিশ্রমকে কুর্নিস জানাতে হয়।

অন্যদিকে প্রিমিটিভ অ্যাকিউমুলেশনের তত্ত্বে বিশ্বাসী নেতৃবর্গ শাসনের ভার নামিয়েছেন ঠিকেদার ও তাদের পোষা গুণ্ডাদের উপর। জঙ্গিপুর থেকে ফারাক্কা রেললাইন তৈরির কাজে ঠিকাদাররা কাজে নামিয়েছেন মাটি মাফিয়াদের। তারা ক্ষেতের উপরিতলের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ভয় দেখিয়ে, অনুমতি না নিয়ে। চাষি বাধ্য হচ্ছেন জমি বেচে দিতে। কারণ চারপাশের জমির তল নেমে গেলে মাঝের জমিতে চাষ হবে কি করে?

শেরশাবাদিয়া ভাষা আমি আগে শুনিনি। জাহির আব্বাস ওই ভাষাতেই কবিতা লেখেন। মুর্শিদাবাদের অনেক জেলায় এই ভাষার চল। আমরা যখন পদ্মার তীরে মিঠিপুরে ঘুরছিলাম, তখনও সিএএ আইন কার্যকর হয়নি। কারণ, অধিনিয়ম জারি হয়নি। আইন প্রণয়নের চার বছর পর অধিনিয়ম জারি হল ১১ মার্চ, ২০২৪-এ। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের দাপটজনিত আশঙ্কা গত চার পাঁচ বছর ধরে ছেয়ে আছে সীমান্ত অঞ্চলে। যার নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই সে কোথায় যাবে? ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি কিভাবে চলে? সেখানে একবার ঢুকলে মানুষ বেরোতে পারে কি?

জাহির আব্বাস নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন,
‘বাপ দাদোর মুখে শুন্যাছি লোদ্দী ভাঙার কথা।
ধানের অ্যাইল, কাল্যাইয়ের ভুঁই
দিন ফুরাইলে খাসতলায় ক্যাহিল মানুষের
একটুকুন ঠিকানা ব্যালতলা আর বটতলা
সবই গেছে পদ্দার প্যাটে।‘

পদ্মা গ্রাস করে নিয়েছে এ অঞ্চলের বহু চেনা জায়গা। খ্যাড়ের ভুঁই, কালু হাজীর বাইশ বিঘার দাগ, খ্যাপা পীরের মাজার। তবু মানুষ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ওপারে যায়নি। বাপ দাদার ভিটে আঁকড়ে পড়ে থেকেছে। ব্রিটিশের লাথি খেয়েও মুখ খোলেনি।

‘আর অ্যাজ এনআরসি না ফেনআরসির
কথা শুনে কপালে ভাঁজ উঠে।
তাই ডরাই সাধা কাফনের সপনে।’

অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী শিবির কথাগুলি মনে জাগায় সাধা (সাদা) কাফনের অর্থাৎ মৃত্যুর ভয়। এই ভয় জাগিয়ে রাখা আর সাম্প্রদায়িকতার বিষে এলাকাকে জারিয়ে রেখে আখের গোছায় বিভেদপন্থী রাজনীতি। কিন্তু রাজ্য যারা শাসন করে তারা মাটি-কাটা মাফিয়া আর দারিদ্র জিইয়ে রাখা বিড়ি শিল্পের বাইরে কিছু ভাবতে চায় না।