আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
বাবা রামদেবের শীর্ষাসন পর্ব
রঞ্জন রায়
গৌরচন্দ্রিকা
“Entire country taken for a ride, you shut eyes for 2 years!’
‘গোটা দেশকে বোকা বানানো হচ্ছে আর আপনারা গত দু’বছর ধরে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন’!
পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠেছেন সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে; প্রসঙ্গ বাবা রামদেবের 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ'-এর বিজ্ঞাপন, তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।
এবম্বিধ ক্রোধের কারণ?
সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিমা কোহলি এবং এহসানউদ্দিন আমানুল্লা 'ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন'-এর দায়ের করা মামলার শুনানি করছিলেন। আবেদনকারীদের বক্তব্য ছিল - পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ যেভাবে বিজ্ঞাপন করে ক্যান্সার থেকে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের দাবি করছে এবং সরকার স্বীকৃত আধুনিক এলোপ্যাথি পদ্ধতির বিরুদ্ধে দুষ্প্রচার করছে তাতে জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে এবং সেগুলো স্পষ্টতঃ দেশের Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954-এর উল্লংঘন।
ঠিক আছে, কিন্তু নিরপেক্ষ ন্যায়ের সিংহাসনে বসে এত উষ্মা!
কারণ, কোর্টের মর্যাদাহানি। ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের চার বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
কোভিড মহামারী ও বাবা রামদেবের ব্যবসা
সালটা ২০২০। মার্চের শেষ থেকে কোভিড মহামারীর আতঙ্ক গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের আদেশ দিলেন, থালা ও শাঁখ বাজাতে এবং দীপ জ্বালাতে বললেন। জনতাকে বললেন - কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ ১৮ দিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল, দেখ আঠারো দিনে কী করি! জনতা ভরসা পেল কিন্তু অচিরাৎ বুঝল যে এই শত্রু অজানা, একে পরাস্ত করতে কোনো রামবাণ এখনও মানুষের হাতে আসেনি, রিসার্চ চলছে; এবং ততদিন ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন এবং আরও কয়েকটি ওষূধ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে।
মার্চ ২০২০ থেকে দেশে করোনার ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গে শুরু হল গোমূত্র সেবন বা নাকে সরষের অথবা আয়ুর্বেদিক তেল লাগিয়ে করোনা ঠেকানোর বিপত্তারণ মন্ত্র। এমন সময়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ভারত সরকারের আয়ুষ মন্ত্রক থেকে গেজেটে ১ এপ্রিল নির্দেশ প্রকাশিত হল যে কেউ যদি আয়ুর্বেদ বা ইউনানি বা সিদ্ধ পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের দাবি প্রিন্ট, টিভি বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত করে তবে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেই সময়ে ২৮ মে, ২০২০ তারিখে 'ইকনমিক টাইমস'-এ একটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল যে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর জেলার কালেক্টর চুপচাপ বাবা রামদেবের 'পতঞ্জলি রিসার্চ ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট'-এর তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোভিড-১৯-এর রোগীদের উপর পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু খবরটা চাউর হওয়ায় এবং এ' নিয়ে কিছু এনজিও এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিং দেশের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেলের অনুমতি ছাড়া এবং নতুন কোনো ওষুধ মানুষের উপর পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত আইনি প্রোটোকলের পালন ছাড়া এমন অনুমতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলায় (২২ মে) সে অনুমতি বাতিল করা হয়।
এ' নিয়ে পতঞ্জলি ট্রাস্টের ৯৬% শেয়ারের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণ বলেন - "ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমরা আয়ুর্বেদ নিয়ে কোন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছি না। যে ওষুধগুলো বহু লোক নিয়মিত ব্যবহার করছে তা করোনা রোগীদের দিলে কতটুকু লাভ হয় দেখতে চাইছি।"
ম্যাজিক শো
২৩ জুন, ২০২০ সন্ধ্যেবেলা। করোনা প্যানডেমিকে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা তখন প্রায় ৫ লক্ষ ছুঁতে চলেছে। গোটা দেশ উৎফুল্ল। কারণ বিদেশি ভ্যাকসিন বের হয়নি তো কী? ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদের রিসার্চে নাকি দেশি ওষূধ বেরিয়েছে; ভ্যাকসিন নয় একেবারে সারিয়ে তোলার ওষুধ।
সমস্ত চ্যানেলে দেখাচ্ছে বাবা রামদেব আচার্য বালকৃষ্ণকে পাশে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করছেন। এছাড়া তাঁদের দু’পাশে হাসিমুখে বসে আছেন দু’জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী - স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডক্টর হর্ষবর্ধন এবং সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি।
ব্যস, দর্শকেরা আশা-ভরসায় উদ্বেল!
সামনের টেবিলে রয়েছে করোনিল, শ্বাসারি এবং অনুতৈল নামে নাকে দেওয়ার জন্যে একটি তেল। বাবা রামদেব জানালেন যে উনি রাজস্থানের জয়পুরের 'ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট' নামের একটি হাসপাতালে ১০০ জন রোগীর উপর রান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালের নিয়ম মেনে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাতে ৩ দিনে ৬৬% এবং ৭ দিনে ১০০% রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। অতএব - মা ভৈঃ!
সন্ধ্যেয় 'ইন্ডিয়া' নামের হিন্দি চ্যানেলকে দেওয়া একটি ইন্টারভিউয়ে উনি জানালেন যে কোভিদের চিকিৎসার জন্যে কোনো এলোপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। প্রায় ৫৪৫ টাকার এই তিনটে ওষুধের কম্বিনেশনই যথেষ্ট। সাতদিনে একশ’ পার্সেন্ট সাকসেস! দুনিয়ায় কোনো দেশ এখন অব্দি যা পারেনি - অক্সফোর্ড হোক বা আমেরিকা বা চীন বা জার্মানি - তা প্রাচীন আয়ুর্বেদ পারল।
সমস্ত টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে বাবাজির যোগ প্রজ্ঞা এবং রিসার্চের জয়জয়কার। যারা এ নিয়ে প্রশ্ন করার গুস্তাখি করেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা দেশদ্রোহী এবং বিলিতি সাহেবদের পা-চাটা অভিধা পেল।
কেউ কেউ প্রশ্ন করল ওষুধটি বাজারে ছাড়ার বা বিজ্ঞাপিত করার আগে উনি আই.সি.এম.আর. (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ) থেকে অনুমতি নিয়েছেন তো? বাবা হেসে জবাব দিলেন - কোনো বে-আইনি কাজ করিনি। দরকারি অনুমতি এবং কাগজপত্র সবই আছে।
অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স
কিন্তু সেদিনই রাত্রে আয়ুষ মন্ত্রক পতঞ্জলি আয়ুর্বেদকে নোটিস ধরিয়ে জানাল যে এই দপ্তর সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত যেন করোনিলের বিক্রি এবং প্রচার বন্ধ রাখা হয়। কেন?
কারণ ২১ ডিসেম্বর ২০১৮-তে ভারত সরকারের গেজেটে ড্রাগস এন্ড কসমেটিক্স অ্যাক্টের কিঞ্চিৎ সংশোধন করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে কোনো আয়ুর্বেদিক, সিদ্ধ, ইউনানি বা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নামে কোনো রোগ নিরাময়ের বা চিকিৎসার জন্যে বিজ্ঞাপন দেওয়া বা প্রচার করা নিষিদ্ধ।
এদিকে দেখা যাচ্ছে হরিদ্বারে এই ওষুধ উৎপাদনের জন্যে লাইসেন্সের আবেদনে কোথাও করোনার চিকিৎসার নামগন্ধ নেই। অনুমতি নেওয়া হয়েছিল ‘ইমিউনিটি’ বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে।
রিসার্চের নামে যা দেখা গেলঃ 'ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস রেজিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া'র রেকর্ডেও এই প্রয়োগে পতঞ্জলির নাম আছে কিন্তু করোনিল বা শ্বসারির নাম নেই। রিসার্চের স্থান এবং ফলফলের জায়গা খালি।
৯৫ জনকে নিয়ে তথাকথিত ট্রায়াল হয়। ৪৫ জনকে (ট্রিটমেন্ট গ্রুপ) ওষুধ দেওয়া হয় এবং বাকি পঞ্চাশ জন ‘প্লেসিবো’ গ্রুপ, অর্থাৎ যাদের ওই ওষুধ দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এতে শুধু ২০ থেকে ৪০ বছরের লোককে নেওয়া হয়েছিল। অনেকেই উপসর্গবিহীন, বা সামান্য কিছু উপসর্গ। পুরো রিসার্চ ঠিকমতো করলে অর্থাৎ চিকিৎসার পর ফলো-আপ পিরিয়ডের উপসর্গ, সাইড এফেক্ট এসব দেখতে গেলে দু’মাস লাগে। অথচ এঁরা একমাস পুরো হতে না হতেই ওষুধ বানিয়ে ফেললেন।
এরা কোনো মেডিক্যাল জার্নালে রিসার্চের ফল এবং রিপোর্ট প্রকাশ করা দরকার মনে করেননি। Peer Reviewও নয়। রোগীদের ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট যেমন কো-মরবিডিটি আছে কিনা, চিকিৎসার সময় এবং ডোজ, নারী-পুরুষ - এসব কোনো রেকর্ড নেই।
ফলে মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই রাজ্যে আয়ুষ মন্ত্রকের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত করোনিলের বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিলেন। মুজফরপুর এবং জয়পুরে বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর. হল। রাজস্থানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হুংকার দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অপরাধে কড়া ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন।
ফের ম্যাজিকঃ শীর্ষাসন
সাতদিন গেল না। এবার ৩০ জুন তারিখে রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণ আবার প্রেস কনফারেন্স করলেন। বললেন - উনি আয়ুর্বেদকে বদনাম করার ষড়যন্ত্রের শিকার। উনি নাকি কখনই দাবি করেননি যে পতঞ্জলির নতুন 'ক্লিনিক্যালি ট্রায়ালড' বটিকা 'করোনিল' করোনা সারাতে পারে বা এই ওষুধ খেয়ে করোনার রোগী সেরে গেছে।
ওনার ঘোষণা অনুসারে আয়ুষ মন্ত্রক ওদের তিনটি ওষুধের প্যাকেজ - দিব্য করোনিল, দিব্য শ্বাসারি বটি এবং দিব্য অনুতৈলকে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ বৃদ্ধির ওষুধ হিসেবে বিক্রি করার লাইসেন্স দিয়েছে।
কিন্তু অ্যাডভোকেট তুষার আনন্দ দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করে প্রার্থনা করেছেন যে উচ্চ আদালত মিথ্যা দাবি করে লোকের প্রাণ নিয়ে খেলা করার অপরাধে বাবা রামদেবের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর. করার নির্দেশ দিক।
২০২০ সালের জুন মাসে দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর - স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডক্টর হর্ষবর্ধন এবং সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি - পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত মেইনস্ট্রিম চ্যানেলে করোনিলের সাতদিনে করোনা সারিয়ে তোলার দাবির পর বাবা রামদেবের ঐ তিনটি ওষুধের প্যাক প্রায় সাতশো টাকা দামে বিক্রি হওয়া শুরু হয়। দ্রুত বিক্রির হিসেব কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যায়।
তবে এরপর কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে সহজলভ্য হওয়ায় বাবার বিক্রি অনেকটা কমে যায়। তখন বিরক্ত বাবা রামদেব অ্যালোপ্যাথিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বলতে থাকেন যে অনেক ডাক্তার তো ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও মারা গেছে।
বাবার করোনিল খেয়ে কেউ তো মারা যায়নি। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তাররা জনতাকে বোকা বানাচ্ছে, ধোঁকা দিচ্ছে।
আর টিভি ক্যামেরার সামনে শুয়ে উনি পা নাচাতে নাচাতে বলতে থাকেন - 'ডক্টর-টর-টর!' আরও বলেন যে অ্যালোপ্যাথিক সিস্টেম ‘স্টুপিড সায়েন্স’!
সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে 'ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন' থেকে ওঁর বিরুদ্ধে ১,০০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদীজিকে চিঠি লিখে বলা হয় রামদেব বাবাকে সিডিশনের আইনে বিচার করতে।
দশ মাস কেটে গেল। বাবার ব্যবসা বেড়ে চলেছে। এদিকে কোভিড মহামারী তার দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন মিউটেশন করে আরও ভয়ানক রূপ ধরেছে। লোক মারা যাচ্ছে, অক্সিজেন সিলিণ্ডার এবং হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে 'ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন' চিঠি লিখে বলে - হয় অ্যালোপ্যাথিকে ‘স্টুপিড সায়েন্স’ বলার জন্যে বাবা রামদেবকে শাস্তি দিন, নয় আধুনিক মেডিক্যাল ফেসিলিটি বন্ধ করে দিন।
বাবা একটি ভিডিওতে হাসিমুখে বলেন আমাকে কে জেলে পুরবে? কার বাপের এত হিম্মত? তাঁর বিজনেস সাম্রাজ্যের ৯৪% অংশের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণ বলেন - আই. এম. এ. হিন্দুদের ক্রিশ্চান বানাতে চায়, তাই পতঞ্জলির ওষুধের বিরুদ্ধে মামলা করছে। ডক্টর জয়লাল, আই. এম. এ.-র সচিব বলেন - "আমাদের চিন্তা হল এর ফলে বাবা রামদেবের বিরাট ভক্তের দল ভ্যাকসিন নিতে চাইবে না, যার ফল অত্যন্ত চিন্তাজনক হতে পারে।"
সরকারের থেকে সাড়া না পেয়ে মরিয়া আই. এম. এ. সুপ্রীম কোর্টের দরজায় গেল। মামলা শুরু হল।
সুপ্রীম কোর্ট মামলা গ্রহণ করে বাবা রামদেবকে তিরস্কার করে বলল - ডাক্তারদের এবং অন্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে সমালোচনা করার বাবার কোন অধিকার নেই।
বাবাও - আমি ঠিক এরকম বলতে চাইনি বলে সাফাই দিলেন।
মামলা কিছুদিন হিমঘরে রইল। ব্যবসা চলতে লাগল। কিন্তু আই. এম. এ. লেগে রইল।
গত বছর নিয়মিত শুনানি শুরু হলে জাস্টিস আমানুল্লা এবং জাস্টিস প্রশান্ত মিশ্রের বেঞ্চ 'পতঞ্জলি' কোম্পানিকে বলে - সব ফলস ক্লেইমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে।
সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চের সামনে 'পতঞ্জলি'র অ্যাডভোকেট ২১ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে শপথ নিয়ে যা বললেন তার ভাবার্থঃ আগে যা হয়েছে তা হয়েছে, এখন থেকে কোম্পানি তার উৎপাদিত ওষুধের বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিংয়ে কোনো আইন ভাঙবে না। বিশেষ করে নিজেদের ওষূধের আরোগ্য করার ক্ষমতা নিয়ে কোনো দাবি বা অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় বা বিজ্ঞাপনে দেবে না। এবং এটা পালন করতে 'পতঞ্জলি' কোম্পানি বদ্ধপরিকর।
পরের দিন 'পতঞ্জলি' কোম্পানি এক সাংবাদিক সম্মেলন করে। সেখানে বাবা রামদেব বলেনঃ পতঞ্জলি হাজার হাজার লোককে বিপি, সুগার, থাইরয়েড, অ্যাজমা, আর্থরাইটিস, ওবেসিটি, লিভার, কিডনি ফেলিওর এবং ক্যান্সার থেকে নিরাময় করেছে। সুপ্রীম কোর্ট তদন্ত করে যদি দোষী পান তো শাস্তি দিন; কোটি টাকা ফাইন করুন, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিন-মাথা পেতে মেনে নেব।
পরবর্তী শুনানি ছিল ফেব্রুয়ারি ৬।
কিন্তু শুনানি চলাকালীন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে আই. এম. এ.-র পক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট পি. এস. পটওয়ালিয়া শীর্ষ আদালতকে বললেন - 'পতঞ্জলি' কথা রাখেনি। সমানে একই রকম বিজ্ঞাপন ও দুষ্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে আদালতে শপথ জমা করার পরের দিনই 'পতঞ্জলি' একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ফের আদালতের আদেশের কড়া সমালোচনা করে।
সিনিয়র কাউন্সিল আদালতের সামনে 'পতঞ্জলি'র একটি লম্বা-চওড়া বিজ্ঞাপনের নমুনা পেশ করেন যাতে এই দাবিগুলি করা হয়েছেঃ
• আমাদের বিরাট ডেটাবেস - এক কোটির বেশি লোক সম্পূর্ণ সেরে গেছে। লাখ লাখ লোক নিজে থেকে এগিয়ে এসে প্রমাণ দিয়েছে। আমাদের কাছে বাস্তব এবং ক্লিনিক্যাল এভিডেন্স আছে।
• অ্যালোপ্যাথি পদ্ধতিতে রিসার্চ হয়না। তাই ওরা রক্তচাপ, ডায়বেটিস, থাইরয়েড, বাত, হাঁপানি এসব সারাতে পারে না; শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অথচ আমাদের যোগ, আয়ুর্বেদ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসার সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ লোক এই অসুখগুলো থেকে মুক্তি পেয়েছে।
অ্যাডভোকেটের মতে এইধরণের বিজ্ঞাপন সম্বন্ধিত আইনের ধারা ৩-এর সরাসরি উল্লংঘন।
জাস্টিস আমানুল্লার প্রশ্ন - কোম্পানি এইরকম দাবি করে কোন সাহসে? সরকারের আয়ূষ মন্ত্রালয় করছেটা কী? এই পিটিশন তো দু’বছর আগে জমা পড়েছিল।
জাস্টিস হিমা কোহলি বলেন - আমাদের বিচার্য বিষয় সুপ্রীম কোর্টের গত নভেম্বরের আদেশের কী হল? তার কতটুকু পালন করা হয়েছে?
সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল কে. এম. নটরাজ বলেন - যদি Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954-এর উল্লংঘন প্রমাণিত হয় তখন সে ব্যাপারে উপযুক্ত অ্যাকশন নেবার এক্তিয়ার যে রাজ্যে ঘটনা ঘটেছে সেখানকার রাজ্য সরকারের।
তাহলে আয়ুষ কী করছে?
“আমরা নোডাল এজেন্সি। আমরা ডেটা সংগ্রহ করছি এবং বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে কনসাল্টেসন করছি।
যেমন, আইন ভাঙা নিয়ে কোন কমপ্লেন হয়েছে কি? হলে সম্বন্ধিত রাজ্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? আমরা আইন ভাঙলে কোম্পানিকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।"
জাস্টিস কোহলি জানতে চান কারা সেই এজেন্সি এবং কিসের কনসালটেশন?
জবাবে নটরাজন জানান - চারটে স্টেজ আছে - উৎপাদনের অনুমতি, মার্কেটিং, আইন ভাঙা এবং উৎপাদিত ওষুধের গুণমান নির্ধারিত মাপদণ্ড অনুযায়ী কিনা এইসব খুঁটিয়ে দেখা। কাজেই চারটে স্টেজের জন্য চারটে আলাদা এজেন্সির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। উত্তর দেওয়ার জন্য আরও একটু সময় চাই।
তখন জাস্টিস আমানুল্লা বললেন - আমরা দুই ব্যক্তির নামে (বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণ) সুপ্রীম কোর্টের আদেশের অবমাননার (কন্টেম্পট) নোটিস দেব।
তবে শেষ পর্যন্ত আদালত শুধু 'পতঞ্জলি' কোম্পানি এবং আচার্য বালকৃষ্ণের নামে নোটিশ জারি করল এবং 'পতঞ্জলি'কে আগামী নির্দেশ পর্যন্ত তাদের সবরকম ওষুধ ও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে দিল।
জব সাঁইয়া ভয়ে কোতোয়াল
সুপ্রীম কোর্টের আদেশের পর সাতটা দিন কাটেনি নিচের খবরটি আমাদের চোখে পড়লঃ
কেন্দ্রীয় সরকার হরিদ্বারের 'পতঞ্জলি অর্গানিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট'কে একটি প্রোজেক্টের জন্য 'নমামি গঙ্গে' প্রোগ্রামের অন্তর্গত 'ন্যাশনাল গঙ্গা প্ল্যান'-এর ফান্ড থেকে ৫০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে। প্রোজেক্টটি হল রিসার্চের মাধ্যমে Sewage Treatment Plants (এস.টি.পি.)-এর থেকে নির্গত sludge বা বর্জ্যকে biosolids-এ রূপান্তরিত করে প্রাকৃতিক কৃষির জন্যে সার হিসেবে প্রয়োগ করার একটি মানক পদ্ধতি (Standard Operating Procedure) তৈরি করা। এই 'National Mission for Clean Ganga' কিন্তু জলশক্তি মিশন মন্ত্রকের অধীন।
এইবার প্রশ্ন ওঠেঃ বাবা রামদেবের গত কয়েক দশকের আয়ুর্বেদ বা জৈব কৃষির ব্যাপারে রিসার্চের রিপোর্ট কার্ড কেমন? কেমনই বা তার কোম্পানির তৈরি ভেষজের গুণবত্তা বা কোয়ালিটি?
বাবা রামদেবের রিপোর্ট কার্ড
বাবা রামদেবের ওষুধ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। এর আগে উনি ক্যান্সার, এইডস (এইচ. আই. ভি.), এমনকি সমকাম(!) সারানোর দিব্য আরোগ্যের দাবি করে হইচই ফেলেছিলেন। এঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের ৯৪% শতাংশের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণও বিতর্কিত চরিত্র।
ওর হাইস্কুল এবং 'সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি' থেকে পাশ করার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলেও বলা হয়। সিবিআই ওর বিরুদ্ধে নকল ডিগ্রির ভিত্তিতে পাসপোর্ট নেওয়ার অভিযোগে কেস করে। পাসপোর্ট ২০১১ সালে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। সাত বছর পরে হাইকোর্ট শর্ত সহ পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার আদেশ দেয়।
যোগগুরু থেকে ব্যবসায়ী?
২৩ জুন, ২০২০ তারিখে সন্ধ্যেয় 'ইন্ডিয়া টুডে' টিভির সাক্ষাৎকারে বাবা রামদেব বলেন যে উনি ব্যবসা করেন না, জনতার সেবা করেন। অ্যাঙ্কর রাজদীপ সরদেশাই হেসে বলেন - ব্যবসা করছেন তো! এখন তেল, টুথপেস্ট, ঘি, চাল, ম্যাগি, কোল্ড ড্রিংক এবং জিন্স - সবই তো বিক্রি করছেন।
আদালতের চোখে বাবা রামদেবের ব্যবসার সুনীতি
'ন্যাশনাল অ্যান্টি-প্রফিটিয়ারিং অথরিটি' (এন. এ. এ.) গত মার্চ, ২০১২ তারিখে এক রায়ে বাবা রামদেবের 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেড'কে ৭৫.০৮ কোটি টাকা পেনাল্টি জমা করতে বলে। ওর অপরাধ?
জিএসটি (পণ্য এবং সেবা কর) দর কম হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ওঁর কোম্পানির ওয়াশিং পাউডার বিক্রির সময় দাম কমানো উচিত ছিল। উনি তা না করে প্রোডাক্টের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা কেব্দ্রীয় জিএসটি আইনের উল্লংঘন।
এই পণ্যটির উপর জিএসটি আগে ২৮% ছিল। পরে কমে প্রথমে ১৮% তারপরে ১২% হয়ে যায়। তাহলে পতঞ্জলির উচিত ছিল সেই হিসেবে দাম কমিয়ে দেওয়া যাতে করহ্রাসের সুফল গ্রাহক পায়।
রায়ে বলা হয়েছে, ওই রাশি এবং ১৮% জিএসটি যোগ করে আগামী তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গ্রাহক কল্যাণ ফান্ডে জমা করতে হবে। ডাইরেক্টর জেনারেল অ্যান্টি-প্রফিটিয়ারিংকে (ডি.জি.এপি.) আগামী চার মাসের মধ্যে অনুপালন/কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে 'ডাইরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স' বাবা রামদেবের চীনে রপ্তানি করার সময় ৫০ টন (৫০,০০০ কিলোগ্রাম) রক্তচন্দনের কাঠ বাজেয়াপ্ত করে। এর বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে বাবা দিল্লি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে বলেন - ওঁর কাছে 'ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড'-এর বৈধ অনুমতি আছে। আর এই কাঠ অন্ধ্রপ্রদেশের বনবিভাগের থেকে নীলামের মাধ্যমে কেনা।
বাবার পারমিট ছিল সি-গ্রেড রক্তচন্দনের কাঠ রপ্তানি করার। রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স ওনার কনসাইনমেন্ট এই সন্দেহে জব্দ করে যে এতে গ্রেড-এ এবং গ্রেড-বি’র কাঠ রয়েছে। ঐ দুটো গ্রেড রপ্তানি করা নিষিদ্ধ।
'ইকনমিক টাইমস'-এর রিপোর্ট অনুসারে ২০১৪-তে বিশ্ববাজারে এ-গ্রেড রক্তচন্দনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম প্রতি টন ৩০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২ কোটিতে পৌঁছে যায়। হাইকোর্ট আগামী শুনানির তারিখ ১৮ এপ্রিল ঠিক করেছিলেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ও. ডি. আর. আই.-এর জবাবও চেয়ে পাঠিয়েছিলেন।
ব্যাপারটা তক্ষুনি মেটেনি। 'ডাইরেক্টর অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স' (ডি. আর. আই.) ১ আগস্ট, ২০১৮ তারিখে 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ' এবং তার চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার সমেত আরও আটজনকে শোকজ নোটিস জারি করে বলে কাঠের গুঁড়িগুলোর সঙ্গে কাগজে বলা কোড মিলছে না - অর্থাৎ স্মাগলিংয়ের ইঙ্গিত।
হরিদ্বার কোর্ট বাবা রামদেবের কোম্পানি 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেড'কে ‘মিসব্র্যান্ডিং’ এবং মিসলিডিং অ্যাড’-এর জন্য ১১ লক্ষ টাকা ফাইন করেছিল। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মতে ‘অন্য কোম্পানির তৈরি মাল নিজেদের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা' ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড (প্যাকেজিং অ্যান্ড এবং লেবেলিং রেগুলেশন্স ২০১১) আইনের ধারা ৫২ (মিসব্র্যান্ডিং) এবং ধারা ৫৩ (মিসলিডিং অ্যাড)-এর সরাসরি উল্লঙ্ঘন।
এছাড়া পতঞ্জলির মধু, নুন, সরষের তেল, জ্যাম এবং বেসনের মান নিয়েও অভিযোগ ছিল। তার ভিত্তিতে ১৬ আগস্ট, ২০১২ তারিখে কিছু স্যাম্পল জব্দ করে পরীক্ষা করা হয়, যা নির্ধারিত মানের চেয়ে কম পাওয়া যায়। পরীক্ষাটি উত্তরাখন্ডের একমাত্র অনুমোদিত রুদ্রপুর ল্যাবে করা হয়। আলাদা আলাদা করে ফাইন করলে মোট ১৮ লাখ টাকা ফাইন হতো। ম্যাজিস্ট্রেট একসাথে ১১ লাখ টাকা ফাইন করে একমাসের মধ্যে জমা দিতে আদেশ দিয়েছেন। বলেছেন আবার যদি কোয়ালিটিতে খামতি পাওয়া যায় তাহলে আরও কড়া শাস্তি হবে।
সন ২০১৭-তে একটি আর. টি. আই. পিটিশনের উত্তরে জানা যায় যে 'পতঞ্জলি'র দিব্য আমলা জুস এবং শিবলিঙ্গি বীজ সরকারি ল্যাব পরীক্ষায় ফেল করেছে। শিবলিঙ্গি বীজে ৩১.৬৮% ‘ফরেন ম্যাটার’ (অন্য পদার্থ) পাওয়া গেছে। আর আমলার জুসের পি. এইচ. ভ্যালু নির্ধারিত মান ৭-এর চেয়ে কম পাওয়া গেছে। এর ফলে অ্যাসিডিটি হতে পারে।
এর একমাস আগে পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় 'পতঞ্জলি'র আমলা জুস গুণমানের বিচারে পাস না করায় সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন স্টোর্স ডিপার্টমেন্ট (সি. এস. ডি.) এক ব্যাচ আমলা জুস ওখানে বিক্রি স্থগিত করে।
প্রায় দুই দশক আগে সিপিআই(এম) নেত্রী এবং রাজ্যসভার সাংসদ বৃন্দা কারাত ৩ জানুয়ারি, ২০০৬ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী শিব বসন্তের একটি চিঠি নিয়ে দাবি করেন যে বাবা রামদেবের 'হার্বাল আয়ুর্বেদিক দিব্য ফার্মেসি'তে তৈরি ওষুধে জড়িবুটি ভেষজ ছাড়া মানুষের হাড়ের গুঁড়ো এবং পশুর শরীরের অংশও মেশানো রয়েছে।
কারাতের ইউনিয়নের সদস্য শ্রমিকেরা মে মাসে হরিদ্বারে দিব্য ফার্মেসির প্রেসক্রিপশন এবং ওদের কাউন্টার থেকে কেনা ওষুধের রসিদ সহ স্যাম্পল নিয়ে সরকারি পরীক্ষার জন্যে জমা করে। ওরা জানায় যে একটি মৃগী সারানোর ওষুধে মানুষের খুলির হাড়ের গুঁড়ো এবং যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধে (দিব্য যৌবনামৃতবটি) ভোঁদড়ের অন্ডকোষের পাউডার মেশানো হয়।
তখন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা - শরদ পাওয়ার, লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং, প্রকাশ জাবড়েকর, রাম মাধব এবং সুভাষ চক্রবর্তী - বাবার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান; বৃন্দা কারাতকে 'মাল্টিন্যাশনালের পয়সা খাওয়া দালাল' বলে আক্রমণ করা হয়। ওঁর ইউনিয়ন অফিসে হামলা হয়।
এদিকে বাবা বৃন্দার দেওয়া স্যম্পলের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন কেননা ওই স্যাম্পল কোনো সরকারি কর্মচারি বাজেয়াপ্ত করেনি। উনি নিজে কিছু স্যাম্পল দেন তাতে ভেষজ ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায়নি।
তখন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অম্বুমনি রামদাস সংসদে জানান যে হায়দ্রাবাদের সরকারি ল্যাবে মানব ডি.এন.এ. পাওয়া গেছে, অন্যগুলিতে পাওয়া যায়নি। আরও অনুসন্ধান দরকার। একমাস বাদে উত্তরাঞ্চল সরকার বাবাকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
উইকিপিডিয়া বলছে - 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেড' একটি ভোগ্যপণ্য উৎপাদক এবং বিতরক সংস্থা। এর ২০১৬-১৭ সালে ঘোষিত টার্নওভার (বছরের ব্যবসা) ১০,২১৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালের হিসেবে এর সম্পদের মূল্য ৩,০০০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন রয়ে গেলঃ ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক কার পাশে দাঁড়িয়ে?
জয় বাবা সুপ্রীম কোর্ট!
গত ২ এপ্রিল তারিখে সুপ্রীম কোর্টে লোকজন এবং মিডিয়ার ভীড়। কারণ, বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণের সলিসিটরের দেওয়া ক্ষমা প্রার্থনা সুপ্রীম কোর্ট অগ্রাহ্য করে ওদের দু’জনকে সেইদিনই আদালতে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছে। মুকুল রোহাতগীর মতো নামী অ্যাডভোকেট 'পতঞ্জলি'র পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে হ্যাঁ, আইন ভাঙা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আদালতের অবমাননা করা হয়নি।
কিন্তু বিচারপতি আহসানুদ্দৌল্লা এবং জাস্টিস হিমা কোহলির বেঞ্চ মনে করিয়ে দিলেন - গত নভেম্বর, ২০২৩-এ কোর্টে এফিডেভিট করে কথা দেওয়া হল যে পতঞ্জলি আর হাল্কাভাবে নিজেদের প্রোডাক্ট নিয়ে বড় বড় অসুখ সারিয়ে তোলার দাবি করবে না এবং অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধেও প্রচার করবে না।
অথচ তার পরের দিনই, ২২ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে একটি প্রেস কনফারেন্স করে ঠিক উলটো কথা বলা হল। তারপর ডিসেম্বরের ৪ তারিখে যে ভ্রমপূর্ণ বিজ্ঞাপন দেওয়া হল - এগুলো সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশের অবমাননা নয় তো কি?
আজ যে এফিডেভিট দেওয়া হয়েছে তাতেও বলা হচ্ছে - ড্রাগস্ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডি’স (অব্জেকশনেবল্ অ্যাডস্) আইন যখন পাশ হয়েছিল তখন আয়ুর্বেদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ তেমন ছিল না। এখন পরিবর্তিত অবস্থায় এই আইনটি প্রাসঙ্গিক নয়।
জাস্টিস হিমা কোহলি মানলেন না। ওঁর মতে এই বক্তব্যটি দেখাচ্ছে যে এঁদের ক্ষমা চাওয়া 'নিঃশর্ত' নয়। কোন আইন যখন বলবৎ আছে তাকে মানতে হবে, হেলাফেলা করা চলবে না।
অগত্যা 'পতঞ্জলি' আয়ুর্বেদের মুখ বাবা রামদেব এবং লিমিটেড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আচার্য বালকৃষ্ণ আদালতে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন।
কিন্তু আদালত সেই ক্ষমাপ্রার্থনা স্বীকার করল না। বলল - মামলা চলবে দুটো অপরাধের জন্যে - আদালতের অবমাননা এবং আদালতে মিথ্যা ডকুমেন্ট দেওয়া (পরে তৈরি দস্তাবেজ এফিডেভিটের সঙ্গে সংলগ্ন করা হয়েছিল) যা আইনের পরিভাষায় perjury.
আর এটা একেবারে বাজে অজুহাত যে গত ২১ নভেম্বরে আদালতের আদেশের কথা 'পতঞ্জলি'র মিডিয়া বিভাগ জানত না, কাজেই ওদের ভুলের দায়িত্ব বাবা রামদেব এবং কোম্পানির নয়!
আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল উক্ত বিচারকদের মতে যেভাবে কোভিডের সময় সারিয়ে তোলার ১০০% মিথ্যা গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ বিক্রি করে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে সেটা খুব বড় অপরাধ এবং এ’ব্যাপারে সম্বন্ধিত রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ মন্ত্রক দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ওদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
উপসংহার
কেরালা রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ কোঝিকোড জেলা আদালতে উত্তরাখন্ডের 'দিব্য ফার্মেসি'র বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে, অভিযোগ - মালয়ালম এবং ইংরেজি ভাষায় বাবা রামদেবের 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ প্রোডাক্ট'-এর ভ্রামক বিজ্ঞাপন দেওয়া।
আমরা অ্যাডভোকেট তুষার আনন্দের দিল্লি হাইকোর্টের আবেদনের সঙ্গে সহমত - উচ্চ আদালত মিথ্যা দাবি করে লোকের প্রাণ নিয়ে খেলা করার অপরাধে বাবা রামদেবের বিরুদ্ধে এফ. আই. আর. করার নির্দেশ দিক।
এদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গে এসে নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করেছেন - দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনের স্থান জেলের ভেতর। তাহলে বাবা রামদেবের স্থান কোথায় হওয়া উচিত?
তথ্যসূত্রঃ
● Live Law; 27 February, 2024.
● ভারত সরকারের গেজেট ক্রমাংক জেড ২৫০২৩/০৯/২০১৮-২০২০-ডিসিসি (আয়ুষ) ১ এপ্রিল, ২০২০।
● ইকনমিক টাইমস এবং পিটিআই; ২৮ মে, ২০২০।
● দ্য ওয়্যার; ২৪ জুন, ২০২০।
● গেজেট অফ ইন্ডিয়াঃ এক্সট্রাওর্ডিনারি, ভাগ-২, খন্ড-৩; ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০।
● দি হিন্দু এবং ফ্রন্টলাইন; ২৪ জুন, ২০২০।
● এনডিটিভি; ২৪ জুন, ২০২০।
● ইকনমিক টাইমস; ২ জুলাই, ২০২০।
● ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; ২ জুলাই, ২০২০।
● দ্য ওয়্যার; ২৬ মে, ২০২১।
● পিটিআই; ২৩ মে, ২০২১।
● হিন্দুস্থান টাইমস্; ২৯ মে, ২০২১।
● পিটি আই; ২২ নভেম্বর, ২০২৩।
● ইকনমিক টাইমস; ৬ জানুয়ারি, ২০২৪।
● ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।
● ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।
● ইডিয়ান এক্সপ্রেস; ৪ মার্চ, ২০২৪।
● দ্য কুইন্ট; ৩০ জুন, ২০২০।
● প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড; ১৮ জুলাই, ২০১৮।
● ইকনমিক টাইমস; ১৭ই মার্চ, ২০২০।
● বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস; ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।
● ইকনমিক টাইমস; ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।
●সিএনবিসি টিভি ১৮-এর নিউজলেটার; ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮।
● টাইমস অফ ইন্ডিয়া; ২০১৬।
● হিন্দুস্থান টাইমস; ৩০ মে, ২০১৭।
● ফ্রন্টলাইন; ২১ এপ্রিল, ২০০৬।
● উইকিপিডিয়া এবং ফিনানসিয়াল এক্সপ্রেস; ৬ জানুয়ারি, ২০০৬।
● পিটিআই এবং রিডিফ ডটকম; ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬।
● উইকিপিডিয়া।
● দি হিন্দু; ৩ এপ্রিল, ২০২৪।
● ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; ২ জুলাই, ২০২০।