আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১

সমসাময়িক

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন - হাটে পথে ঘাটে ভাড়াটে জল্লাদ


২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে কাকদ্বীপে সিপিআই(এম) দম্পতি দেবু দাস এবং ঊষারানি দাসকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা মনে আছে? ২০১৮ সালের ১৩ মে মাঝরাতে ওই ঘটনা ঘটেছিল। ক্যাটারিং-এর কাজ সেরে কাকদ্বীপের বুদাখালি গ্রামে ফিরছিলেন বছর কুড়ির দীপঙ্কর। বাড়ির কিছুটা আগে থেকেই পোড়া পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখেন, ঘরটা পুড়ে গেছে। আরও কিছুটা এগিয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে দেখেন দুটো মাংসপিণ্ড দলা পাকিয়ে পড়ে রয়েছে।

যে রাতে এই ঘটনা ঘটেছিল পরের দিন সকালে ছিল পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন।

দীপঙ্কর সে সময়ে থানায় অভিযোগ করেছিলেন, বাবা-মাকে হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। একই অভিযোগ ছিল প্রতিবেশীদেরও। খুনের অভিযোগে তৃণমূলকে দায়ী করেন দীপঙ্কর। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে পরে জানায়, শর্টসার্কিট থেকে দুর্ঘটনা। গ্রামের লোকজন অবশ্য সে সময়ে জানিয়েছিলেন, অগ্নিকাণ্ড যখন ঘটে, সে সময়ে এলাকায় লোডশেডিং চলছিল।

এমনটা নয় যে, ২০১১-র আগে পশ্চিমবঙ্গ ছিল একেবারে শান্তি-উদ্যান। তা নয়, তবে বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচনে বিরোধীদের শক্তিশালী অঞ্চলে পুলিশের মদতে তাদের খুন করে, পুলিশকে পঙ্গু করে, ভোটদাতাকে ভোট দিতে না দিয়ে যে অরাজক অবস্থা চলছে তা আর কিছুতে না হোক, সারা দেশের মধ্যে নির্বাচনী দুর্বৃত্তায়নে পশ্চিমবঙ্গকে এক নম্বরে উঠিয়ে এনেছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি, রাজনীতি ও ভোটের দুর্বৃত্তায়ন সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে।

সংবাদমাধ্যমে দেখবেন নির্বাচনের সময়ে বিশাল বাইকবাহিনী আর হাতে বোমা ও বন্দুক নিয়ে ঘোরাঘুরি করা মাসলম্যানদের। এই বাইকবাহিনী, এই মাসলম্যান এদের পুষতে অর্থ লাগে। তা আসছে কোথা থেকে?

ইলেকটোরাল বন্ডের কথা ভুলে গেলে চলবে? প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট ৬,০৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা মোট নির্বাচনী বন্ডের অর্থের প্রায় ৪৮ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস যাদের ঝুলিতে এসেছে ১,৬০৯ কোটি টাকা (প্রায় ১৩ শতাংশ)।

পিছনের দরজা দিয়ে অর্থ আদায়ের এখানেই শুরু নয়, এবং নিশ্চিত থাকুন শেষও নয়।

ভুলে গেলে চলবে না বিগত দশকের চিট ফান্ড ও পনজ়ি স্কীমে স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া বিপুল অর্থ। সত্যি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? নাকি ব্যবহৃত হলো সমাজবিরোধীদের জগতে - নির্বাচনে।

স্ন্যাপশট - পশ্চিমবঙ্গের ভোটের এক দশকের ভোট

বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নির্বাচনে খুনোখুনির কিছু প্রকাশিত তথ্য নিচে দেওয়া হলো।

পশ্চিমবঙ্গে ভোট নিহত আহত মন্তব্য
২০১৩ পঞ্চায়েত ভোট ৩১ তথ্য পাওয়া যায়নি খাতায়-কলমে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৩।
২০১৪ লোকসভা ভোট ১২৯৮ • সারা দেশে মোট মারা যায় ১৪ জন, অর্থাৎ তার অর্ধেক মৃত্যু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
• সারা দেশে নির্বাচনে আহতের সংখ্যা ছিল ২০০৮, অর্থাৎ মোট আহতের প্রায় ৬৫ শতাংশ আঘাতপ্রাপ্ত বাংলায়।
২০১৮ পঞ্চায়েত ভোট অসমর্থিত সূত্রে ৭৫ তথ্য পাওয়া যায়নি খাতায়-কলমে সেই সংখ্যা ছিল ১৪।
২০১৯ লোকসভা ভোট ১১ ১৫০৮ • রাজনৈতিক হিংসা - ৬৯৩।
• স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ওই বছর জুনের ১ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাংলায় ভোট পরবর্তী ৮৫৩টি হিংসার ঘটনা ঘটে, ৬১ জন নিহত হন।
• এনসিআরবি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে রাজনৈতিক খুনের তালিকায় বাংলা শীর্ষে ছিল।
২০২১ সালে বিধানসভা ভোট ২৫ তথ্য পাওয়া যায়নি ১৫ হাজার রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা, ৭ হাজার মহিলার শ্লীলতাহানি ঘটে - এই তথ্য দিয়েছে সিকিম হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) প্রমোদ কোহলির নেতৃত্বাধীন কল ফর জাস্টিস।
২০২৩ পঞ্চায়েত ভোট ৫৫ তথ্য পাওয়া যায়নি ৮ জুন থেকে ১৬ জুলাই ২০২৩-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসার কারণে মোট ৫৫ জন মারা গেছে।


শুধু ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক। ৮ জুন থেকে ১৬ জুলাই, ২০২৩-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসার কারণে মোট ৫৫ জন মারা গেছে। ৮ জুলাই ২০২৩ তারিখে, নির্বাচনের দিন হিংসাত্মক ঘটনায় ১২ জন মারা যান। ৯ জুলাই ২০২৩-এ, আরও ৬টি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, সেদিন এক পুলিশ অফিসারের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। নির্বাচনের দিনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ১৮ হয়েছে। এমনকী গণনার দিনেও বন্দুকের গুলি ও বোমায় বরানগরে ৩ জন মারা যান। ওই নির্বাচনে ভোটের দিন সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ৬৬.৩০ শতাংশ, আর রাজ্য নির্বাচন কমিশন দিনের শেষে ঘোষণা করে সব মিলিয়ে ৮০.৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে, অর্থাৎ ১৪ শতাংশ ভোট পড়ে সন্ধ্যা পাঁচটার পরে।

প্রতিটি ভোটের আগে ঘটে দফায় দফায় রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা। তাতে লাশ পড়ে কিছু - সবই গ্রাম ও মফস্বলের মানুষের। তাদের অনেকে দরিদ্র, দলীয় কর্মী। আর কিছু হল মাংসে-মদে-বাইকে পালিত হাড় হিম করা রাতভর দাপিয়ে বেড়ানো বাইকবাহিনী। ভোটের দিন বুথ ক্যাপচার, জাল ভোট, নকুলদানা, জল-বাতাসা - এই পেশাদার 'মাসলম্যান বাহিনী'র কাজ। অবশ্য তৃণমূল নেতৃবৃন্দের কথায় এ হলো বিরোধী প্রচার।

"যদি কেউ মারা যায়, সে আমাদেরই লোক। আসলে তৃণমূলনেত্রীর উন্নয়ন দেখে বিরোধীদের হিংসে হচ্ছে।"

এতেও অবশ্য শেষ হয় না। ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটে চলে জেলায় জেলায়। যতদিন না...। যতদিন না সব ভেড়ি লুট হয়, সব পঞ্চায়েত দখল হয়, সব কারখানা তোলাবাজের হাতে বন্ধ হয়।

এই রাজ্যে গণতন্ত্র আজ মুক্ত। তাই শেষবার কবি বিবেকের ভূমিকায় বলেছিলেন,
"সবাই শুধু মিথ্যে রটায়।
পথগুলি সব দেদার খোলা...
দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন
রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।"

এই লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথে বুথে থাকুক, তাকে সাহায্য করুক স্থানীয় পুলিশ। সাধারণ মানুষের দাবি, নিজের ভোট নিজে দেব - এ আমাদের অধিকার।

নির্বাচন শেষে আর কোনও সন্তান যেন পিতৃমাতৃহীন না হয়, আর কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয় ক্ষমতা দখলের এই বীভৎস পালায়।