আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১
সম্পাদকীয়
বিভাজন প্রক্রিয়া অব্যাহত
দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর। ২০২৩-এর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে মণিপুর হাইকোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই রাজ্যের অন্যান্য জনজাতি সংগঠনগুলি তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই ঘটনা থেকেই ৩রা মে থেকে মণিপুরের সংঘাতের সূচনা। মণিপুরের আদি বাসিন্দা মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকি-জো-সহ কয়েকটি তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত দু’শো জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ঘরছাড়ার সংখ্যা ৬০ হাজার পেরিয়ে গেছে। পরে মণিপুর হাইকোর্ট সেই বিতর্কিত নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিলেও মণিপুর স্বাভাবিক হয়নি এখনও।
ইতিমধ্যে সংবেদনশীল অনেক ঘটনা সারা বিশ্বে তো বটেই দেশজুড়ে ঘটে গেছে। প্রায় সব ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যেমন, আগামী পাঁচ বছর দেশবাসীর জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের ঘোষণা করে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে পাঁচ বছর পরেই ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এ এক জটিল ধাঁধা। অর্থনীতিবিদরা এখনও পর্যন্ত এর সমাধান করতে পারেননি। আমরা তো কোন ছাড়!
আমাদের চোখে পড়েছে যে এই সময়সীমায় তিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্যবার পাড়ি দিলেও মণিপুরে আসার সময় পাননি। এমনকী মণিপুরের ঘটনাবলী সম্পর্কে পারতপক্ষে কোনো শব্দও উচ্চারণ করেননি। নেহাত না বললে নয় বলে সংসদের আলোচনা প্রসঙ্গে কয়েক মুহূর্তের জন্য মণিপুরের নাম নিয়েছিলেন। ঠিক আট মাস আগে লোকসভায় তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি বক্তৃতায় দাঙ্গাবিধ্বস্ত মণিপুরের পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি (৮ এপ্রিল, ২০২৪) আবার সেই দাবি শোনা গেল তাঁর মুখে। 'আসাম ট্রিবিউন' পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন - "ভারত সরকারের সময়োচিত হস্তক্ষেপ এবং মণিপুর সরকারের প্রচেষ্টার কারণে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।" যদিও গত বছরের জুলাই থেকে মণিপুরে গোষ্ঠীহিংসা শুরু হলেও কেন প্রধানমন্ত্রী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি - বিরোধীদের তোলা এই প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। বরং গত বছর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দু’দিনের সফরে মণিপুরে গিয়ে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্রিয় হয়েছিলেন, সে কথা তুলে ধরেছেন তিনি। স্বল্প সময়ের জন্য মণিপুরের রাজধানীতে অবস্থানের পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে খুব শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এবং বাস্তবে তা হয়নি।
প্রসঙ্গত নির্বাচনী প্রচারে ১৫ এপ্রিল, ২০২৪ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মণিপুরে যাবেন বলে সংবাদে প্রকাশ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যায় যে মণিপুরের ২টি লোকসভা আসনের একটিতে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী অনুপস্থিত। কাজেই মণিপুরে আগ্রাসী নির্বাচনী প্রচারের প্রয়োজন নেই।
হিংসাদীর্ণ মণিপুরে নির্বাচনী প্রচার নেই বললেই চলে। মেইতেই অধ্যুষিত রাজধানী ইম্ফল কেন্দ্রিক ইনার মণিপুর কেন্দ্রে প্রার্থীরা লুকিয়ে-চুরিয়ে রাতের আঁধারে কারো বাড়ির আঙ্গিনায় সভার আয়োজন করছেন। আউটার মণিপুরে কী হবে তা কেউ জানে না। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সকলেই নীরব।
এর মধ্যেই নজর কাড়ে একটি আবেদনপত্র। একে অবশ্য আবেদনপত্র না বলে বলা যায় ‘করুণ আবেদন’! রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আবেদনপত্র সাঁটা একটি করে বাক্স রাখা হয়েছে। জনসাধারণের কাছে প্রশাসনের করুণ আবেদন, - আপনাদের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র এই বাক্সে জমা করুন। এ এক অন্যরকম ‘ড্রপ বক্স’। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের প্রধান দপ্তরের সামনে নাকি একটা ড্রপ বক্স রাখা ছিল যাতে সকলের অগোচরে লোকেরা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে কেনা ইলেকটোরাল বন্ড ফেলে দিয়ে যেত। মণিপুরের বাক্সে কেমন সাড়া মিলেছে সে পরিসংখ্যান এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে বাস্তবে গত ১১ মাসে একাধিক বার বিভিন্ন থানা এবং সেনার অস্ত্রাগারে জঙ্গিরা হানা দিয়ে যে বিপুল অস্ত্র লুট করেছে, তার বেশির ভাগই এখনও পাওয়া যায়নি। বরং তা কাজে লাগিয়েই মেইতেই বনাম কুকিদের যুদ্ধ চলছে বহু জায়গায়। লুট হওয়া অস্ত্রের সন্ধানে গত এগারো মাস ধরে সেনা-পুলিশের বিস্তর অভিযানে অল্পই অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র যে মেইতেই বা কুকি-জো জনগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে রয়েছে, তা হিসেবে যেমন স্পষ্ট, তেমনই পারস্পরিক অভিযোগেও ধরা পড়ে। এ দিকে, সেনার বিহার রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন মণিপুরের জো-কুকি জনগোষ্ঠীর মানুষ। চব্বিশ ঘণ্টার বন্ধে একাধিক মিছিল, সভা-সমিতিতে মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংহের বিরোধিতার পাশাপাশি বিহার রেজিমেন্টের নাম করে স্লোগান দিয়ে চলেছে বিক্ষোভকারী জনতা। অভিযোগ, সেনা জওয়ানেরাই মেইতেই জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়ে কুকি এলাকায় অভিযান চালায়। এরাই মর্টার ছুড়ে দুই জো-কুকি গ্রামরক্ষীকে হত্যা করে। সোমবার ১৫ এপ্রিল মণিপুরে নির্বাচনী প্রচারে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে ইম্ফলেই তাঁর সফর সীমিত থাকছে। ইনার মণিপুর আসনের বিজেপি প্রার্থীর জন্য তিনি ভোট চাইবেন। তবু সবাই তাকিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মণিপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে নতুন কী ব্যাখ্যা দেন, তা শোনার জন্য।
গত বছরের ৩ মে জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর কর্মসূচি ঘিরে মণিপুরে অশান্তির সূচনার পর থেকে এর ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন বলে অভিযোগ। ঘরছাড়া ৫,০০০ ভোটারের জন্য সেই রাজ্যে ২৯টি বিশেষ নির্বাচন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। মণিপুরের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি ঘরছাড়াদের বড়ো অংশ, বিশেষত কুকি-জো জনগোষ্ঠীর নাগরিকেরা পড়শি রাজ্য মিজ়োরামের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিজ়োরামে আশ্রয় নেওয়া মণিপুরের ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে কোনও বিশেষ বন্দোবস্তের কথা নির্বাচন কমিশন জানায়নি।
এই পরিস্থিতিতে মণিপুরের পরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আর এক রাজ্যে হিংসা ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ছড়িয়েছে। মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পূর্ব নাগাল্যান্ডের ছ’টি জেলা - মন, তুয়েনসাং, কিফিরে, নোকলক, লংলেং এবং শামাতোরকে নিয়ে নতুন রাজ্য গড়ার দাবিতে কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ওই এলাকায় বসবাসকারী সাতটি জনজাতি গোষ্ঠীর যুক্তমঞ্চ 'ইস্ট নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন', সংক্ষেপে ই.এন.পি.ও.। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে তারা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য ভাগের দাবিতে বিধানসভা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ইএনপিও নেতৃত্ব।
তাঁদের ওই পদক্ষেপের কারণ ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। সে সময় নাগাল্যান্ডে ভোট প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এনডিপিপি-বিজেপি জোট ক্ষমতায় ফিরলে সমস্যার ‘ইতিবাচক সমাধান’ হবে। কিন্তু গত এক বছরে কোনও উদ্যোগ না দেখে নতুন করে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে পূর্ব নাগাল্যান্ডে। আন্দোলন পরিচালনা করছেন মায়ানমার ও পূর্ব নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী কন্যাখ নাগা জনগোষ্ঠীর নেতারা। অন্য দিকে, রাজধানী কোহিমা-সহ পশ্চিম ও মধ্য নাগাল্যান্ডের মূল বাসিন্দা টাংখুল নাগারা পৃথক রাজ্যের বিরোধী।
এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল যে নাগাল্যান্ডের জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। সেই সমঝোতা চুক্তি এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। বিরোধীদের দাবি, নব্বইয়ের দশকে উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে জেলাভিত্তিক দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও গত দু’দশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধু কোহিমা-ডিমাপুর অঞ্চলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর সেই বঞ্চনা থেকেই উঠে এসেছে পৃথক রাজ্যের দাবি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসাম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি মিললেও বিজেপি জোটের সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদেরও। দাবি না মেটানো হলে ইএনপিও ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সবমিলিয়ে সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ না করার ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে। এবং শুরু হয়েছে আগ্রাসী আধিপত্যবাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের এক ধারাবাহিক বিবাদ। এবং এই বিবাদের ফলে প্রশ্রয় পাচ্ছে বিভাজন প্রক্রিয়া। জাতীয় স্তরে এই বিষয়ে কোনও আলোচনা হয় না বললেই চলে। এমনকী স্থানীয় সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমও এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে মানুষের নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এক অদ্ভুত নৈর্ব্যক্তিক আচরণে অভ্যস্ত। এই উদাসীনতা কিন্তু সমাজ-সভ্যতা তথা রাজ্য ও দেশের জন্য মোটেও ভালো নয়। এমনটাই চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এক কঠিন-জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, যা দেশের জন্য মোটেও মঙ্গলময় হবে না।