আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন নয়, মেরুকরণ


বিগত দশ বছর ধরে একটি দল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন। তৃতীয়বার সরকার বানানোর লক্ষ্যে তারা এই নির্বাচন লড়ছেন। তাই তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে কী বলা হল তা আলোচনার দাবি রাখে। একদিকে যেমন সেখানে বিগত দশ বছরের সাফল্যের হিসেব থাকবে, অন্যদিকে সেখানে থাকবে আগামীদিনের জন্য কর্মসূচী। বিজেপি দিনকয়েক আগে যেই ইস্তেহার প্রকাশ করেছে তার দিশা থেকেই স্পষ্ট যে দেশের মানুষের মৌলিক সমস্যা সমাধানের কোনো কর্মসূচী তাতে নেই। বরং তাতে রয়েছে ধর্মীয় বিভেদের রশদ, যার ভিত্তিতে বিজেপি নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছে।

২০১৪ সালে মোদী যখন প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার জন্য লড়ছিলেন তখন বিজেপি বলেছিল যে তারা বিকাশ বা উন্নয়নের স্বার্থে লড়ছে। ইউপিএ সরকারের তথাকথিত জনবিরোধী এবং উন্নয়ন বিরোধী দুর্নীতির মডেলের বিরুদ্ধে তারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। কিন্তু দশ বছর পর যখন দেখা যাচ্ছে যে যুবদের মধ্যে বেকারত্ব পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, অথবা দেখা যাচ্ছে যে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার আগের তুলনায় কমেনি, তখন বিজেপি-র ইস্তেহারে এই নিয়ে কোনো কথা দেখা যাচ্ছে না। গোটা ইস্তেহারে বেকারত্ব কথাটির কোনো উল্লেখ নেই। কর্মসংস্থান কথাটির উল্লেখ আছে ২৮ বার। এর মধ্যে একবারও বিগত দশ বছরে কত কর্মসংস্থান তৈরি করা হল তার কোনো হিসেব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি বিজেপি। বরং বারংবার এই দাবি করা হয়েছে যে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করা হয়েছে এবং আগামীদিনে আরো হবে। কিন্তু সত্যিই যদি এত কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে থাকে তাহলে তার সংখ্যাটা তারা বলছে না কেন? উত্তর সহজ। দেশে কর্মসংস্থান আসলে কমেছে। তাই সেই নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান বিজেপি-র ইস্তেহারে জায়গা পায়নি।

দ্বিতীয়ত, মানুষের জীবনে মূল্যবৃদ্ধি প্রতিনিয়ত তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে কমাচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সরকার মূল্যবৃদ্ধি কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম ২০১৪ সালের তুলনায় অনেকটা কমে গেলেও দেশের মানুষকে অনেক বেশি টাকা দিয়ে পেট্রোল ও ডিজেল কিনতে হচ্ছে। বিজেপি-র ইস্তেহারে মূল্যবৃদ্ধি শব্দটি একবার ব্যবহৃত হয়েছে যেখানে তারা দাবি জানিয়েছে যে মূল্যবৃদ্ধির হার নাকি তারা কমাতে সক্ষম হয়েছে। দেশের মানুষের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অবশ্য এক অন্য সত্যের বার্তা দিচ্ছে যার কোনো ছাপ বিজেপি-র ইস্তেহারে নেই। কৃষকদের এমএসপি সংক্রান্ত দাবি নিয়েও ইস্তেহার নিশ্চুপ।

তাহলে বিগত দশ বছরে কী সাফল্য রইল? বিজেপি ইস্তেহার বলছে ৮০ কোটি-র বেশি মানুষকে তারা বিনা পয়সায় রেশন দিয়েছেন। যদি সত্যিই দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এত মানুষকে বিনা পয়সায় রেশন দিতে হল কেন? জন ধন একাউন্টে ৫০ কোটি মানুষ ব্যাঙ্কে খাতা খুলেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই একাউন্টগুলিতে তারা কত টাকা জমা করেছেন তার কোনো তথ্য ইস্তেহারে দেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছে যে ২৫ কোটি ভারতীয় নাকি দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ঘটনা হল ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল যে দারিদ্র আসলে বেড়েছে। সরকার সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। ২০২২-২৩ সালের সমীক্ষা রিপোর্টের মূল ফলাফল প্রকাশিত হলেও তার বুনিয়াদি তথ্য এখনও জনগণের সামনে আনা হয়নি। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে দারিদ্র কমেছে। কিন্তু কতটা কমেছে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।

অতএব ১০ বছর কেন্দ্র সরকার চালানোর পরে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপুল উন্নয়নের বাণী বিজেপি তার নির্বাচনী ইস্তেহারে লিখতে পারেনি। কারণ ইউপিএ জমানার ১০০ দিনের কাজ, বা তথ্যের অধিকার, বা শিক্ষার অধিকারের মতন কোনো যুগান্তকারী উন্নয়নের দিশানির্দেশ করতে মোদী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বরং নোটবন্দী, অপরিকল্পিতভাবে জিএসটি প্রবর্তন এবং ভ্রান্ত লকডাউন নীতির ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই বিগত দশ বছরের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বিজেপি-র পক্ষে ভোট পাওয়া মুশকিল হবে।

অবশ্য বিজেপি-র মূল রাজনৈতিক বক্তব্য অথবা স্লোগান কখনওই উন্নয়ন ছিল না। আসলে সাম্প্রদায়িকতা এবং হিন্দুত্ব বাদ দিয়ে বিজেপি দলটির কোনো অস্তিত্ব থাকে না। তাই ইস্তেহারে ফলাও করে রাম মন্দির তৈরি করার কৃতিত্ব তাদের চাইতে হয়। একটি মসজিদকে ভেঙে সেই স্থানে মন্দির তৈরি করার মধ্যে যারা কৃতিত্ব দাবি করে ভোট চায়, তারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিরুদ্ধেই তাদের রাজনীতি করছে। সরাসরি ধর্ম এবং রাজনীতিকে এইভাবে মিশিয়ে ভোট চাওয়া এর আগে কখনও ঘটেনি। অন্যদিকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করাকেও তারা তাদের অন্যতম সাফল্য হিসেবে দাবি করছে। এই ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের বোঝা উচিত যে তাদের মামলার রায়গুলিকে কীভাবে বিজেপি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। রাম মন্দিরের রায় হোক অথবা ৩৭০ ধারার রায়, সেগুলিকে বিজেপি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ডের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায় যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে, তাই স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে বলেছেন যে তারা কোনও ভুল করেননি, বরং যারা নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা করেছে তারাই নাকি তাদের ভুল বুঝতে পারবে। হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেটদের থেকে আদায় করেছে সিবিআই-ইডি-আয়কর দপ্তরের ভয় দেখিয়ে। কিন্তু সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করতে তারা পিছপা নয়।

উন্নয়নে চিড়ে ভিজছে না। অতএব আগামীদিনে আবারও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বিজেপি ২০২৪ সালের নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে চাইছে। একদিকে 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' তারা লাগু করবে বলে ইস্তেহারে ঘোষণা করেছে। যদিও পূর্বে একটি আইন কমিশন এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন আদিবাসী, দলিত ও অন্যান্য সংগঠন এই নীতির বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছে। তবু বিজেপি আবার নির্বাচিত হলে এই নীতিই তারা গ্রহণ করবে বলে ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে বিজেপি-র এজেন্ডায় রয়েছে 'এক দেশ এক ভোট' নীতি। দেশে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মূলে আঘাত করবে এই নীতি, যার বিরুদ্ধে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। তবুও বিজেপি এই নীতিকে তাদের একটি প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চাইছে।

সর্বোপরি দেশের প্রধানমন্ত্রী যেই রাজনৈতিক আখ্যান এই নির্বাচনে এখন অবধি রেখেছেন, তার থেকে শুধুমাত্র ধর্মীয় মেরুকরণের গন্ধ আসছে। কখনও তিনি বিরোধীদেরকে পাকিস্তানের মুসলিম লীগের সাথে তুলনা করছেন, কখনও তিনি কে কোন মাসে মাংস খেয়েছে তা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন, কখনও তিনি বিরোধীদের সনাতন ধর্মের বিরোধী বলে গাল পাড়ছেন। অন্যদিকে, লাগাতার রাম-এর নামে ভোট চেয়ে চলেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই উন্নয়ন করে থাকেন তাহলে কেন ধর্মীয় মেরুকরণের কথা বলছেন। আসলে, উন্নয়ন নয়, সাম্প্রদায়িকতাই বিজেপি-র প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা।

দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উচিত এই সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার বিরুদ্ধে একজোট হওয়া। ধর্ম নয়, উন্নয়নের প্রশ্নে নির্বাচন হোক। দেশের উন্নয়ন কখনও ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে হতে পারে না। তাই যারা সাম্প্রদায়িক তারা আসলে দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।