আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

পুনঃপাঠ

আগ্রাসী রাম, সেবক হনুমান


তিথিটা পরিকল্পিতভাবেই বেছে নেওয়া। যাঁরা বাংলায় হিন্দি-বলয়ের 'উৎসব' রাম-নবমীর তথাকথিত প্রচলন নিয়ে বিচলিত, এবং এর বিপরীতে বাংলায় উৎসবের 'অন্য ধারার' গৌরব প্রচারে মনোযোগী, তাঁদের তথ্য বা আবেগ দুটোতেই কোনো ভুল নেই। রামনবমী-র ঠিক আগে পরে বাংলায় যে উৎসবগুলো পালিত হয়, সেগুলোতে যতটা না ধর্মের ছোঁয়া তার চেয়ে অনেক বেশি লোকসংস্কৃতির ব্যাপকতা। কিন্তু যে ব্যাপারটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়, সেটা হল রামননবমীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ইতিহাস। না, রামনবমীকে কেবলমাত্র একটা উৎসব হিসেবে দেখা চলেনা, আর পাঁচটা উত্তর-ভারতীয় উৎসবের চেয়ে তার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। বস্তুত, রামনবমী আজকের যে ভয়ানক চেহারায় হাজির হয়েছে, তার উৎসস্থল সে অর্থে উত্তর ভারত নয়, সে জায়গাটা আমদের প্রতিবেশী জামশেদপুর, যেখানে বহু বাঙালিরও বাস। ১৯৬৪-তে স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত আক্রমণের 'সুফল' হিসেবে এই অঞ্চলে জনসঙ্ঘ ও আরএসএস-এর বিস্তারের সূচনা। সেই ইতিহাসের ধারায় ১৯৭৮-এ তারা রামনবমী উদযাপনের উদ্যোগ নেয় এবং ঘোষণা করে যে, রামনবমীর মিছিল সাবিরনগর নামে একটি মুসলমান বসতের উপর দিয়ে যাবে। প্রশাসন সেটা আটকায় বটে, কিন্তু আক্রমণের প্রস্তুতি চলতে থাকে, এবং ১৯৭৯-র রামনবমীতে এক বীভৎস রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে তা পূর্ণতা পায়। উল্লেখ করা যায়, সেই আক্রমণের শিরোভাগে ছিল জনসংঘী বিধায়ক দীননাথ পান্ডে, ১৯৬৪-র মুসলমান-বিরোধী আক্রমণ থেকে জনসংঘ-আরএসএস ভিত্তি-র প্রসারের মধ্য দিয়ে যার বিধানসভায় প্রবেশ। এর পর, রাজনৈতিক সাফল্যের সহজ পথ ধরে রামনবমীর ত্রাস ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা আমাদের জানান, কীভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকড়গুলো আর্থনীতিক সম্পর্কের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে - জামশেদপুর, এবং ঝাড়খন্ডের ভিন্নত্র, বিশেষত শিল্পাঞ্চলগুলিতে মুসলমানদের রুজি কেড়ে নেওয়ার একটা হাতিয়ার হিসেবে দাঙ্গার ব্যবহার; একই ইতিহাস ভাগলপুর-গুজরাট-মহারাষ্ট্র-উত্তরপ্রদেশে। দাঙ্গা মানে তো স্ব-পক্ষীয়র উপর আক্রমণ, একশ্রেণির রাজনীতিকদের দ্বারা দরিদ্র মানুষের বঞ্চনাবোধকে ধর্মীয় খাতে বইয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফসল নিজেদের গোলায় তোলা।

এই বিশেষ দিনটি আগমনের আগে আগেই ঝাড়খন্ডে এবং হিন্দি বলয়ের বিভিন্ন জায়গায়, মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায় - যাকে দাঙ্গা বলা হয়। আসলে তো তা একতরফা আক্রমণ, তাতে শুধু রক্তক্ষয়-প্রাণনাশ-ই হয়না, মুসলমান জনসাধারণের জীবিকাচ্ছাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নিতান্তই যারা বাস্তব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকতে চায়, নিজের সুবিধে মতো করে একটা বিশ্বাস গড়ে নেয়, তাদের বাদ দিলে বাকি আপামর লোকের কাছে এটা অজানিত নয় যে, মুসলমানরা প্রধানত খেটে খাওয়া লোক, তাদের দৈনিক কাজে না বেরোতে পারলে হাঁড়ি চড়েনা। রামনবমী মুসলমানদের উপর দু-ভাবে আক্রমণের ইতিহাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

একটা প্রতীকের বিরুদ্ধে কি তার প্রতিচ্ছবি দিয়ে প্রতিহত করা যায়? রাজ্য সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্ত্রী সেটাই বিশ্বাস করছেন বলে মনে হয়। তাঁর ভাইরা রামনবমীর প্রত্যুত্তরে হনুমান-পূজন শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু, সুস্থ বুদ্ধি যদি এই ব্যাপারটার মধ্যে একটা প্রতীকের আদল দেখতে পায়, সেটা নিশ্চইয় তার দৃষ্টি-র সমস্যার কারণে নয়ঃ রামনবমীর রাম উগ্রতা ও আক্রমণের প্রতিমূর্তি।

এবার, হনুমান, বালকেও জানে, রামের একান্ত সেবক, যে বুক চিরে রাম-সীতার প্রতিকৃতি দেখিয়ে দেয়। ভাই-রা কি উগ্রমূর্তি, খোলা তলোয়ার নিয়ে হুংকারে উন্মাদ কিছু মুসলমান-সংহারী রামের-ই সেবার প্রতীক হয়ে উঠছেন না? পুরাকাহিনির ধারায় শত্রুভাবে ভগবানকে পাওয়ার যে ব্যাপার এটা কি সেরকম কিছু? এই প্রতীকায়ন কি অবচেতনে? রাজ্য সরকারের ভাব-ভঙ্গী দেখে কিন্তু তা মনে হয়না। রামনবমীর খোলা তলোয়ার নেত্রীর হাতে এক দ্বি-ধারী তলোয়ার এনে দিয়েছেঃ একদিকে, এই নগ্ন, উল্লসিত, বে-আইনী এবং সর্বোপরি মানব-সভ্যতা-বিরোধী ভীতি-প্রদর্শনকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না করা, যাতে মুসলমানরা আরো সন্ত্রস্ত হয়ে উত্তরোত্তর তাঁর শরণে, বা বলা ভালো তাঁর বশবর্তী থাকেন। আর অন্যদিকে ইতিমধ্যে, মুসলমানদের বিষয়ে গৃহীত তাঁরই অপরিণামদর্শী নীতির কারণে উগ্র হিন্দুত্বের প্রভাবাধীন হয়ে পড়া লোকেদের কাছে বার্তা দেওয়া, আমি তোমাদের-ই লোক!

পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, নেত্রী ভোট-সংগ্রহে যত পারদর্শী-ই হোন না কেন, তিনি শিক্ষা নিতে জানেন না। হিন্দুদের একাংশের মন পেতে অখিলেশ যাদব মুজঃফরনগরে মুসলমান জনসাধারণকে হন্তারকদের সামনে অসহায়ভাবে পড়ে থাকতে দেখেও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রইলেন। তাঁর ভাবটা ছিল, মুসলমানরা আর আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? ওদের ভোট তো পাবই, বিজেপি-র মুসলমান নিধনের এই সুযোগে হিন্দুদের কিছু ভোট যদি বাগিয়ে নেওয়া যায়, মন্দ কী! তাঁর এই রাজনৈতিক অসততা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব-হীনতার পরিণতি দেখেও বঙ্গ-সম্রাজ্ঞী এক-ই পথ ধরেছেন।

মুস্কিল হল, পরিণতির মূল্য তো রাজনীতিকদের চোকাতে হয়না, সেটা দিতে হয় সাধারণ মানুষকে, যে মানুষ, দিনের একটা বিশেষ অবস্থায় হিন্দু বা মুসলমান, কিন্তু বাকি দিনজুড়ে খেটে খাওয়া, ঘর্মস্রাবী জনতা। অনৈতিক রাজনীতির যে ছিদ্রপথটাকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাদখলের রাজপথ বানিয়ে ফেলল, কোনো রাখঢাক নেই, সেই একই পদ্ধতি-প্রকরণের ভেতর দিয়ে তারা বাংলার মানুষ এবং রাজনীতিকে পর্যুদস্ত করতে চায়। ধর্মীয় উন্মাদনার সাহায্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আরোহনের ইতিহাস তাদের পক্ষে। এ খেলায়, এবং এই খেলাতেই, তারা ওস্তাদ। কলকাতার রাজপথে রামনবমীর খোলা তলোয়ার নিয়ে তারা সেই ইতিহাসের-ই পুনরাবৃত্তি করতে চায়। ক্ষমতার নেশায় চুর মুখ্যমন্ত্রী-র মস্তিষ্কে এই সহজ কথাটি সহজে প্রবেশ করবে, এটা দুরাশা। কিন্তু, তা বলে, অসভ্যতার নিদর্শন-প্রদর্শনগুলোকে বিনা বাধায় রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতে দেওয়া চলেনা। এ মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে যাঁদের কাছ থেকে সব থেকে বেশি, সব থেকে প্রতিবদ্ধ সংগ্রামটা প্রত্যাশিত ছিল, সেই বামপন্থীরা স্ব-খাত সলিলে।

হয়তো সে কারণেই, আজকের পশ্চিমবাংলায় সমাজ, রাজনীতি ও মানুষকে হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ-এর বিষবাষ্প থেকে সুরক্ষিত রাখার দায়টা সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে। উগ্র রামনবমীর প্রত্যুত্তরে যে সমাহিত, মানবিকতা ও বুদ্ধির সংমিশ্রণে উজ্জ্বল বাংলা নববর্ষ পালিত হল, হয়তো সেটাই হয়ে উঠবে একটা মহত্তর সংগ্রামের শুরুয়াত।

পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজে আধিপত্যকারী গোষ্ঠীটি লোক-উৎসবগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি - এগুলোর পরিসর প্রধানত বিপুল খেটে খাওয়া জনতার অঙ্গনে। বাংলাদেশে 'পয়লা বৈশাখ' জাতীয় উৎসব হয়ে উঠলেও 'বাংলা নববর্ষ' এ বঙ্গে তৈজস-বিপণির বাইরে বড় একটা বিস্তার লাভ করেনি। আশা রাখতে হয়, আগ্রাসী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে, হিংসা ও নরহত্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞায় নতুন বাংলা সাল নতুন পথ দেখাবে। ধর্মীয় প্রতীকের বিপরীতে অন্য একটি ধর্মীয় প্রতীক নয়, মানবীয় সম্মিলনের মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশের প্রতীক তুলে ধরাটাই সে সংগ্রামের আয়ূধ।

______________________________
'আরেক রকম' পত্রিকার ১ মে, ২০১৭ সংখ্যার 'সমসাময়িক' বিভাগে এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। বিষয়টি আজও প্রাসঙ্গিক।