আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

পুনঃপাঠ

আরেক রকম

শঙ্খ ঘোষ


আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, একই রকম একই রকম দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সে-ক্লান্তি থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য কখনো কখনো ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। না যদি পায় তেমন কোনো অব্যাহতি, যদি কেবলই মনে হয় ‘আশা নেই, জীবনের ভাষা নেই’, গোটা পৃথিবীটারই ওপর সে রাগ করে বসে। জীবনটাকে তখন মনে হতে থাকে ভারাতুর, দুর্বহ, গ্লানিময়।

একাকারের এই প্লানি থেকে মুক্ত হবার জন্য আরেক রকমের খোঁজ পেতে চায় মন। কিন্তু কোথায় মিলবে তাকে? আছে হয়তো নানা পথ নানা দিকে ছড়ানো। ভেবে দেখতে গেলে, যাকে আমরা একই রকম একই রকম ভেবে চলেছি সব সময়ে, কখনো কখনো তারই মধ্যে কি লুকোনো থাকে না কোনো আরেক রকম? থাকতে পারে না কি? আমাদের দেখার সীমাতেই ভাবছি প্রতিদিন একই সকাল একই দুপুর একই রাত্রি, কিন্তু তবু হয়তো সেই প্রতিদিনেরই মধ্যে একজন কবি পেয়ে যেতেন ‘সোনালি-পাড়-দেওয়া’ নতুন নতুন চিঠি, মনে হতো যেন খামটি খুলে ফেললেই ‘অপূর্ব’ কোনো খবর পাওয়া যাবে তার থেকে। সেই অপূর্বতাকে দেখবার সম্ভাবনা কিন্তু রয়ে গেছেআমাদেরই মনের মধ্যে, আমাদের সজীব সচল উৎসুক মনে। কতই তো এমন ঘটে যে আমাদের দেখার বিশিষ্টতায় পালটে যায় কত মুখশ্রী। দূর থেকে যাকে এক রকম জেনেছি, কাছে গিয়ে দেখি তাকে আরেক রকম। এক পাশ থেকে যাকে ভাবছি এক রকম, দিক বদল করে আরেক পাশ থেকে তাকেই দেখি আরেক রকম। কোনো একটা সময়ে যাকে দেখেছি এক রকম, ভিন্ন সময়ে সে-ই হয়তো হয়ে ওঠে আরেক রকম। সময় আর স্থান পালটে নিলে এইভাবে কখনো-বা একই রকমের মধ্যে আরেক রকমের উদ্ঘাটন ঘটে যেতে পারে। আর তখন, একাকারের ভিতর থেকে উদ্ঘাটিত সেই বিচিত্রতায়, জীবনকে তত দুর্বহ বলে বোধ হয় না আর। আমাদের চাই তবে সেই উদ্ঘাটনের মন।

আবার অনেক সময়ে, একই রকমের মধ্যে নয়, একই রকমের পাশে পাশে থেকে যেতে পারে আরেক রকম, আমাদের কিছুটা অলক্ষ্যে। গলায় একরাশ হতাশা নিয়ে আমরা বলিঃ জাতিচরিত্র উচ্ছন্নে গিয়েছে। একেবারে মিথ্যে নয় সে বলা। প্রতিদিন ভোরের কাগজ সে-উচ্ছন্নতার নিত্যনব বিবরণ নিয়ে আসে। সে বিবরণ জানতে জানতে, দুর্নৈতিকতার ভয়াবহ প্রসার বুঝে বিকল হয়ে আসে মন। কিন্তু আমাদের সমাজচিত্রে সেই সার্বিক দুর্নৈতিকতাই কি একমাত্র সত্য? তারই পাশে পাশে দেশের এ-কোণে ও-কোণে ছড়িয়ে নেই কি উজ্জীবক অনেক ঘটমানতাও? যখন বলি দেশের যুবশক্তি একেবারে অসাড় হয়ে এল, আত্মকেন্দ্রিকতায় আর ভোগসর্বস্বতায় বিকল হয়ে এল সব, তখনই কিন্তু এ-শহরের নাম প্রান্তে ঘটে চলেছে আত্মকেন্দ্রিকতায় আর ভোগসর্বস্বতায় বিকল হয়ে এল সব, তখনই কিন্তু এ-শহরের নানা প্রান্তে ঘটে চলেছে আত্মত্যাগময় কর্মণ্যতার অনেক মুহূর্ত, অনেক ‘আরেক রকম’-এর প্রাণবান উদাহরণ। এই শহরেরই উত্তরপুবে রাজারহাটে এক চিলতে এক বাড়িতে গরিবঘরের কয়েকজন প্রতিবন্ধী শিশুকিশোরকে নাচে-গানে-আঁকায়-পড়ায় তালিম দিয়ে চলছিল অল্প কয়েকজন যুবকযুবতীর এক সংগঠন - ‘তিতীর্ষা’ তার নাম - অনেকদিন ধরে। এর-ওর দুয়োরে ঘুরে ঘুরে কিছু অর্থসংগ্রহ করে এই-যে একটা কাজে তারা ব্রতী হয়েছিল, সে তো আরেক রকম একটা আদর্শেরই টান, একটা ব্রতযাপন। ব্রতী সেই যুবকযুবতীদের কারো সামান্য জীবিকা ছিল, কারো-বা ছিল না। কিন্তু তবুও কয়েকটি অবহেলিতকে সম্পূর্ণ বিকশিত করে তুলবার স্বপ্ন তাদের টেনে নিয়েছিল অনেক দূর। আমাদের এই ভাঙা আদর্শহীন সমাজের পাশে সেও তো একটা সমাজ, আরেক রকম অগোচর সমাজ। ছোটো একটা সংগঠন মাত্র না বলে সমাজই বলবার ইচ্ছে হয় তাকে, কেননা এ-উদাহরণ কোনো একক উদাহরণ নয়। উত্তরপশ্চিমে বালি-অঞ্চলে গড়ে উঠছে একটি যুবা-সংগঠন ‘নিকৃণ’, প্রতিটি শীতে যে-সংগঠন নানা স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে জুটিয়ে কয়েকদিনের এক মেলার আয়োজন করে। এক-এক বছরে সে-মেলার এক-একটি বিষয় নির্ধারিত হয়- ধরা যাক ‘বংলার সঙ’কিংবা ‘মাতৃতান্ত্রিক সমাজ’কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন’কিংবা একরকমই আরো অনেক কিছু। সংগঠকেরা বছর জুড়ে বিষয়টি নিয়ে সব রকমের তথ্য সংগ্রহের কাজে ঘুরে বেড়ান বইপত্রের কাছে, মানুষজনের কাছে। মেলা-সূচনার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সেসব তথ্য নিয়ে পৌঁছে যান তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে, বুঝিয়ে দেন কোন স্টলে বিষয়টির কোন্ দিক নিয়ে কথা বলতে হবে তাদের, বানিয়ে তুলতে হবে চার্ট কিংবা ছবি বা মূর্তি। সে-ছেলেমেয়েরাও মেতে যায় আনন্দময় সেই শিক্ষায় আর তার প্রয়োগে, কয়েকটা দিনের জন্য ভিন্ন এক মুখচ্ছবি দেখা যায় তাদের। এ-সংগঠনের নেতৃত্ব যার, বছরজোড়া এই স্বপ্ন ছাড়া আর যেন কোনো কাজ নেই তার, নেই যেন কোনো পরিবারবন্ধন, কেননা সবাইকে নিয়েই সে বানিয়ে তুলতে চায় তার পরিবার। এবং ছেলেটির অসুস্থতারও কোনো শেষ নেই। অশক্ত শরীরে ডাক্তারের নির্দেশ উপেক্ষা করেও এই-যে কাজটা সে (বা তারা) করে চলেছে বছরের পর বছর, সে কিসের টানে? কিসের টানেই-বা দক্ষিণপ্রান্তের মহেশতলা-গার্ডেনরিচ অঞ্চল থেকে বারো বছরের ওপর মাসে মাসে বেরিয়ে চলেছে ‘মন্থন’-এর মতো টুকরো একটা উঁচু মানের পত্রিকা, বার করে চলেছে অক্লান্ত কজন মানুষ? আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক কিংবা বিশ্বনৈতিক সমস্তরকম সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে কিছু-না-কিছু ভাবনা বা বিতর্ক চলছে সেখানে, মাঝে মাঝে আয়োজন চলছে কোনো আলোচনা-বৈঠকেরও। বিজ্ঞাপনহীন কৃশ সে-পত্রিকাটির এ-মলাটের শুরু থেকে শেষ মলাটের শেষ পর্যন্ত ভরে থাকে সজীব অক্ষরে অক্ষরে, সমাজচিন্তার প্রকাশে। এইসবেরই মধ্যে, এইসব ‘তিতীর্ষা’বা ‘নিকৃণ’, ‘মন্থন’-এরই মতো আরো আরো অনেক এমন কর্মক্রিয়ার মধ্যে, ক্লান্তিকর হতাশাজনক একাকার এক রকমের পাশে, আমরা হয়দতো খুঁজে নিতে পারি আরেক রকমকে। আমাদের চাই সেই সন্ধান।

সেই সন্ধানের দিকে এগিয়ে গেলে কখনো-বা নিজেরাও আমরা চাইতে পারি আরেক রকম হয়ে উঠতে। ‘কিছু-না’-এর হতাশায় ডুবতে ডুবতে, ‘চৈতন্যে মড়ক’-এর ভয়াবহতা ভাবতে ভাবতে, এসব ছোটোখাটো চিহৃগুলি যখন চোখে পড়ে, মনে একটা উজ্জীবন আসতে পারে তখন। তখন তো সবাই মিলেই ভাবতে পারিঃ আমরাই-বা কেন হয়ে উঠতে পারব না ওই আরেক রকম? ঠিকই, সেটা হয়ে উঠতে গেলে আমাদের বেরিয়ে আসতে হয় আমাদের প্রতিদিনের খোলশ ছেড়ে। আজ আমি যতটুকু, তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে কাল তো হয়েও উঠতে পারি আরেক রকম, সে-সম্ভাবনা তো আমারও মধ্যে আছে তবে। আছে তো নিত্যসচলতার এক সম্ভাবনা। রবীন্দ্রনাথ একবার এই সচলতার কথা বলেছিলেন এক ভিন্ন ভাষায়। আমাদের ‘যেমন-হয়ে-থাকে’ অস্তিত্বটুকু কেবলই এগিয়ে চলতে থাকে ‘যেমন-হওয়া-ভালো’ অস্তিত্বের দিকে, অন্তত সেইভাবেই চলবার কথা ছিল মানুষের। সন্দেহ নেই যে এই ভাবনার মধ্যে আছে একটা নৈতিকতার বোধ। সেই নৈতিকতাকে সামনে রেখে আমরা যদি প্রতিদিনই - এমনকী প্রতি মুহূর্তই - সজাগ রাখি নিজেকে, তবে কেবলই সেই আরেক রকমের দিকে উন্মীলিত হতে পারি আমরা। চাই সেই প্রাত্যহিক উন্মীলন।

আবার, এই ‘আরেক রকম’কে যদি একটা তত্ত্বভাবনা হিসেবে নিই, তবে সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন তাৎপর্য হতে পারে তার। আমি যদি বলি তুমি আরেক রকম, আমার মতো নও, তবে সেই ‘তুমি’টিও বলতে পারে আমি আরেক রকম, তার মতো নই। দুই আরেক রকম মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন। তখন সেই আরেক রকমের দিকে আমাদের পারস্পরিক দৃষ্টি হবে কেমন? তাকে কি আমি বা আমাকে কি সে সর্বগ্রাসে নিজেরই মতো করে নিতে চাইবে, বা চাইব? না কি, আরেক রকম বলেই মর্যাদা দিয়ে তাকে ছেড়ে রাখতে পারব তার আত্মতার মধ্যে? আমাদের একটা প্রবণতাই আছে সবকিছুকে নিজের বৃত্তে টেনে নেওয়ার, নিজের মতো করে নেওয়ার, আর তা নইলে পূর্ণ বিরূপতায় তাকে বর্জন করার। এই গ্রহণ-বর্জনের যেন কোনো বিকল্প তৃতীয় স্তর আর নেই। একই রকম একই রকম একই রকম করে একটা সর্বাঙ্গীণ ছাঁচের মধ্যে আনতে পারলে কোনো কোনো মন তৃপ্তি পায়, কোনো কোনো জীবনদর্শন বা রাষ্ট্রদর্শন পৌঁছে যেতে চায় সেই সামূহিক একীকরণের দিকে, পূর্ণাঙ্গ এক বৃত্তবদ্ধতার দিকে। তার থেকে যদি স্বতন্ত্র স্বরের ঘোষণা করে কেউ, তবে সেই আরেক রকমের দিকে সন্দেহের চোখে বিরূপতার তোখে এমনকী শত্রুতার চোখে তাকাতে চায় সেই দর্শন, তাকে সহ্য করতে পারে না সেই মন। আর এরই থেকে তৈরি হয়ে ওঠে একরকমের মৌলবাদ, আরেক রকমকে সহ্য করতে না পারবার মতো মৌলবাদ, জীবনের যে-কোনো স্তরে। এই মৌলবাদের বাইরে থেকে আরেক রকমকে বুঝতে চাওয়া, সেও একটা বড়ো কাজ। তখন হয়তো এমনও ঘটতে পারে যে আরেক রকমের সঙ্গে আরেক রকমের সংযোগে-সংঘর্ষে গড়ে উঠতে পারে তৃতীয় এক আরেক রকম। আর এইভাবেই নিরন্তর এক প্রবহমান ‘আরেক রকম’-এর দিকে মুক্তি পেতে থাকে আমাদের জীবন।

নিত্যনূতন উদ্ঘাটনে, নিত্যনূতন সন্ধানে, নিত্যনূতন উন্মীলনে, নিত্যনূতন মুক্তিতে নিয়ে যেতে পারে যে আরেক রকমের বোধ, সে-বোধে পৌঁছলে সকলেই বলতে পারিঃ আমরা কিন্তু থেমে থাকিনি, আমাদের সাধ্যমতো চলতে চেয়েছিলাম আমরা।

সেই চলাটাই হোক ‘আরেক রকম’।

______________________________
আমরা গর্বিত যে কবি শঙ্খ ঘোষ আমাদের পত্রিকার প্রথম সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তিনি ‘আরেক রকম’ পত্রিকার শুরু থেকেই অভিভাবকসম ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের পথচলায় বারে বারে তাঁর সাহচর্য, উপদেশ ও চিন্তার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। আরেক রকম, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যার (১ জানুয়ারি ২০১৩) প্রথম প্রবন্ধ ছিল শঙ্খ ঘোষ রচিত এই প্রবন্ধ। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই নিবন্ধ পুনর্মুদ্রিত করলাম।