আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

পুনঃপাঠ

আমার বাবা

সুকুমারী ভট্টাচার্য


(প্রথম পর্ব)

বেশ খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে শুরু করতে হবে। যে মাহেশের রথ পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত সেই মাহেশের জমিদারের অষ্টবিংশ শতকের শেষদিকে কী একটা চিত্ত-পরিবর্তন হয়, তিনি সহসা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং জীবনযাত্রা থেকে হিন্দু চাল-চলন সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা আমার ঠাকুরমা প্রিয়বালার পরনের বেশবাস বিলিতি হয়ে গেল। তাঁর দিদি লীলাবতী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। দীর্ঘদেহিনী, শ্বেতচন্দনের মতো গাত্রবর্ণ। ঠাকুরদা সে তুলনায় অনেক সাদাসিধে দেখতে ছিলেন, পড়তেন নবম কিংবা দশম শ্রেণিতে। পিতার নির্দেশে এঁরা শাড়ি পরতে পেতেন না, যদিও ঠাকুরমা বিবাহের দিন থেকেই আমরণ শাড়িই পরতেন। তিনি ছিলেন, বুদ্ধিমতী, স্বল্পভাষিণী এবং শান্তস্বভাবের।

বড়ো ঠাকুরমা লীলাবতীর বিয়ে হয়েছিল সোনাটিকরি গ্রামের জমিদার এবং পাশ-করা ডাক্তারের সঙ্গে। ইনি মারা যান শেষ যৌবনেই, তারপর লীলাবতী সম্পত্তির কিছু অংশ নিয়ে ছোট বোনের সঙ্গে বাস করতে এলেন মহানদ গ্রামে। সেইখানেই আমরা তাঁকে দেখেছি। পুরো সাহেবি ইংরেজি বলতেন ইংরেজি কেতায়। মুখ ফিরিয়ে থাকলে একেবারেই বোঝা যেত না এ ইংরেজি কোনো বাঙালিনি বলছেন। ওদিকে ঠাকুমাও এরকম ভালো ইংরেজি বললেও তাঁর বাংলাটি ছিল মধুর। বেয়ারা-বাবুর্চি-খানসামার সংসারে মানুষ হয়েও এঁরা গোপনে অনেকটা বাঙালিয়ানা বজায় রেখেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। ঠাকুরমার মা-র একটি খাতা দেখেছিলাম মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে। তাতে উনি আশপাশের সমাজের বহু জীবনরীতি, বিশ্বাস ও চালচলনের বর্ণনা ও সমালোচনা করেছিলেন। আমার প্রবল আত্মগ্লানি রয়ে গেল খাতাটি তখন নিয়ে নিইনি বলে।

প্রিয়বালার চার ছেলেমেয়ের বিদুষিপ্রভা, সরসীকুমার, চারুপ্রভা ও নলিনীকুমার। জ্যেষ্ঠপুত্র সরসীকুমার আমার বাবা। তাঁর জ্যেষ্ঠাভগিনী বিদুষিপ্রভা এক অসামান্যা নারী ছিলেন। বাবার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৩০ আগস্ট, মৃত্যুদিন ২৩ অক্টোবর, ১৯৪৫। বড়ো পিসিমা জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ২ জুলাই।

মাহেশের জমিদার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে মেয়েদের বিয়ের জন্য প্রথম প্রজন্মের খ্রিস্টান ছেলে খুঁজছিলেন যশোরে মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি কপোতাক্ষ নদীতীরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে। সেখানে ঠাকুরদার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গিনী ছিলেন এক বিধবা কিশোরী। ঠাকুরদা তখন কলকাতার কলেজে পড়েন, গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে গেছেন। প্রচন্ড গরমের দিনে তিনি পাশের বাড়ির বন্ধুটির খুব কান্নার শব্দ পেয়ে মেয়েটির মাকে জিজ্ঞাসা করেন ‘ও কাঁদে কেন?’ মা-র উত্তর, ‘আজ একাদশী, ওর তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু বিধবার তো আজ নিরম্বু উপবাস।’ অনেক অনুনয় বিনয় করেও বন্ধুর জন্য এতটুকু জলের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। সেই সন্ধ্যায় মেয়েটি মারা গেল। ঠাকুরদা সোজা কলকাতায় এসে বিশপস কলেজের সাহেবকে বললেন, ‘আমি এখনই খ্রিস্টান হব। ধর্মের তত্ত্বকথা পড়েশুনে শিখব। কিছু তর্কাতর্কির পর সাহেব তাঁকে খ্রিস্টধর্ম দিয়েছিলেন। দেশে ফিরে সেকথা জানাতে তাঁর পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বড়ো সম্পত্তি থেকে জমিদারীতে তাঁর অংশ থেকে বিপিনবিহারী দত্ত বঞ্চিত হলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই ছাত্র কলকাতার এক ধনী ছাত্রকে পড়ানোর বিনিময়ে অন্ন ও আশ্রয় পেলেন। যাই হোক, তাঁর ছাত্র টেনেটুনে পাশ করলেও ঠাকুরদা নিজে আশানুরূপ ফল করতে পারেননি। বাড়ির বাজার সরকার ও সহপাঠীর গৃহশিক্ষকতা করে তিনি mixed course-এ সংস্কৃত দর্শন ও কেমিস্ট্রি নিয়ে পাশ করলেন - তখন এটা চালু ছিল। তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে কয়েকটি বিষয়ে এম.এ পড়ানো হত।

আমার বাবাও স্কটিশ কলেজেই এম.এ পড়তেন। পাশ করার পর প্রথমে হিমালয়ের সাধুদের সঙ্গে কিছুকাল ধর্মচর্চা করেন। এঁদের জীবনযাত্রা খুব কঠিন ছিল। অনিয়মিত সামান্য খাওয়া, তাও প্রধানত শিলাজতু পাথর কেটে কোথাও কোথাও গাঢ় গোলাপী চটচটে মধুর মতো ঘন রস বেরিয়ে জমা হত। খেতে মিষ্টি এবং বেশ কয়েক ঘন্টা শরীরকে পুষ্টি ও উষ্ণতা দিত। ঝরনার জল এবং দৈবাৎ দু-একটা ফলও মিলত।

তখন দেশে ধর্মজিজ্ঞাসা খুব একটা চলতি ব্যাপার ছিল। কোন নামে রূপে ভগবান সত্য - এই নিয়ে খুব চর্চা অনুসন্ধান চলত। এই আবহাওয়ার মধ্যে বাবাও আক্রান্ত হন এবং তাঁর বিশ্বাস জন্মায় প্রাচীন শাস্ত্রের ঋষিরা যখন হিমালয়েই বেশি ভক্তিমান, কীর্তিমান, সেজন্য ওখানে গিয়ে সন্ধান করা দরকার। গেলেনও তাই। নানা দেশের নানা ভাষাভাষীর নানান দার্শনিক ঋষিদের সঙ্গে একে একে আলাপ করলেন। যা শুনলেন তাতে ওঁর জিজ্ঞাসা মিটল না। ফিরে এলেন। এলেন কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে দক্ষিণেশ্বরে। পরে একে একে রাজস্থানের ও পাঞ্জাবের কয়েকটি স্কুলের হেডমাস্টারের কাজ করলেন। গরিবের ছেলেরও দেশভ্রমণের শখ থাকতে পারে। তখন এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। রাজস্থানের পশুবধ নিষিদ্ধ ছিল বলে রাস্তায হাঁটলে হরিণ ও ময়ূরের দল নির্ভয়ে পাশাপাশি হাঁটত, পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে গা-ঝাড়া দিয়ে পরম নির্ভয়ে আগের মতো হাঁটত। পাঞ্জাবে অমৃতসর, আম্বালা, বাটালা ও আরো দু-তিন জায়গায় কয়েক মাস স্কুলে পড়ানোর সুবাদেই ঘরে ছিলেন। তাঁর স্বভাব ছিল, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সবকিছু লক্ষ্য করা। তাই তাঁর কাছে এসব জায়গার গার্হস্থ্য ও সমাজ জীবনের বহু অনুপুঙ্খ শুনতে পেয়েছিলাম।

ধর্মানুসন্ধিৎসা তাঁকে নানাদিকে নিয়ে যেত। তাই রাজস্থান ও পাঞ্জাবে যাওয়া। পরে তিনি ছোট ভাইকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে গেলেন দীক্ষা নেবার আশায়। স্বামীজিরা বিশেষ উৎসাহ দেননি। ভোজনশালায় আশ্রমিকরা খেতে বসতেন; বাবা ও কাকাকে খাবার দেওয়া হত দরজার বাইরে মাটিতে। আশ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাথাপিছু দুখানি ধুতি, পরিধেয় ও উত্তরীয় হিসেবে। বাবা ও কাকাকে একখানি করে ধুতি দিয়ে বলা হল আধখানা ধুতি পরতে ও অপরার্ধ উত্তরীয় হিসেবে ব্যবহার করতে। সর্বধর্মসমন্বয়ের পীঠস্থানে ওই জাতি-ভেদটা বাবাকে বড় ধাক্কা দেয়। যেমন দেয় আশ্রমে কেবল কালীপুজোর অনুষ্ঠান; অন্য কোনো ধর্মের কোনো অনুষ্ঠান হত না। নিজেদের আদর্শ থেকেই ওঁরা এমন বহু ছোটবড়ো বিষয়ে সরে থাকতেন।

একবার পূর্ববঙ্গে বিধ্বংসী বন্যা হয়। ত্রাণকার্যে নিযুক্ত কিছু শিষ্যের সঙ্গে বাবাকেও যেতে হযেছিল। প্রকান্ড বটগাছের উপর বিশাল পাটা পেতে গাছের ওপর খিচুড়ি রান্না করে মোটা গরুবাঁধা দড়িতে প্রকান্ড ডেকচি বেঁধে দড়ি করে অতি সাবধানে নামাতে হত। এ কাজ বাবাকেই দেওয়া হয়েছিল। নৌকায় করে বারে বারে বন্যাপ্লুত গ্রামে প্রয়োজনমতো খিচুড়ি বিতরণ করতেন। কাজটা খুবই বিপজ্জনক। অতএব খ্রিস্টানের ছেলের প্রাণের ওপর দিয়ে বিপদটা যাক।

ওখান থেকে ফেরার বেশ কিছুদিন পরে কাশীতে প্লেগের মহামারি শুরু হয়। সেখানেও বাবার সঙ্গে আর একজন শিষ্যকে পাঠানো হল। সে কাশীতে গিয়েই উধাও হল। বাবা একা কিছুদিন রোগীদের যথারীতি শুশ্রূষা করে নিজে পেটের অসুখে পড়লেন। সেটা প্লেগ না হলেও যথেষ্ট কষ্টদায়ক ছিল। শরীর যখন যন্ত্রণায় নিরতিশয় কাতর তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িতে শুয়ে পড়লেন। দু-দিন পরে এক অচেনা ভদ্রলোক এসে রুগ্ন বাবাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে প্রথম কদিন ডাক্তার দেখিয়ে বাবাকে সুস্থ্য করলেন - ইনি স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজ্যপাল হরেন মুখোপাধ্যায়ের সহোদর ভাই তারক মুখোপাধ্যায়। বাবা তখন খুবই দুর্বল ও শয্যাগত। সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের আলোচনায় ব্যাপৃত রইলেন। মূল সূত্র নিয়ে এই দুই ধর্মাম্বেষী আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এলেন যে খ্রিস্টধর্ম প্রাচ্যেরই সৃষ্টি। কিন্তু সর্বত্রই একে সাহেবি পোশাকে, ভাষায়, নামে ও আচার-আচরণে বিদেশি আবরণে প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। আর এ দেশের লোকেরা এটাকে সাহেবি ধর্ম বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছে এবং নিজেদের ধর্মজীবন থেকে দূরে রেখেছে। এই মোহ-আবরণ সরিয়ে দিয়ে একে একান্তভাবে প্রাচ্যের ধর্ম বলে প্রকাশ করলে দেশের লোকের দ্বিধা হবে না খ্রিস্টান বলে পরিচিত হতে। ভারতীয় থেকেও পুরো খ্রিস্টান হয়ে থাকা সহজ হবে। এর জন্য আমার মামা ও কাকাকে সঙ্গে নিলেন। এর কিছু পরে একে রূপদান করে একটা অতি বাস্তব কর্মকান্ড সৃষ্টি করে এক অভিযানে সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ নিলেন। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে চিঠি লেখেন। এই সিদ্ধান্ত কাজে পরিণত করবার আগে অনেক দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল।

পিসিমা শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দিতে আসার পর বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। রবীন্দ্রনাথ দর্শনের কিছু কিছু বিষয়ের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার জন্য বাবার সঙ্গে বেশ কিছুকাল আলাপ করেন। অল্প কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ বিলেত গেলেন, বাবা কলকাতায় ফিরলেন।

ততদিনে বাবা ও পিসেমশায়দের প্রস্তাবিত ব্যাপারটি অনেকটাই বাস্তবায়িত হওয়ার দিকে এগিয়েছে। টাকার জোগাড় হল। পিসেমশায়ের অনেক নিজস্ব টাকা দান, ঠাকুরমার দিদি লীলাবতী দেবীর কাছ থেকে বেশ কিছু ধার - লীলাবতী জমিদার বাড়ির বিধবা। দিদিমা ও ঠাকুরমার কিছু টাকা নিয়ে একটি বড় মূলধনে প্রাথমিক কাজগুলো করা, জমি কেনা, বালেশ্বরের কাছে গিডনি গ্রামে ধানজমি, পুষ্টিকর খাদ্যে পালিত শুয়োর যার প্রচুর চাহিদা ছিল কলকাতার সাহেবদের কাছে। ব্যবসায়িক দিক থেকে প্রভূত লাভজনক। সুবিস্তৃত ধানজমিতে তখনকার সবচেয়ে আধুনিক ধানচাষ পদ্ধতিতে ধানচাষ হত এবং সেটা খুবই লাভজনক হতে লাগল। ক্রমেই সাঁওতালদের বৃহৎ এক দরিদ্রদল সাগ্রহে এবং সানন্দে এগিয়ে এসেছিলেন। কারণ এঁদের ব্যবহারটা ছিল মানবিক ও সমান সমান আচরণে গঠিত।

গিডনিতে মা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমি ওই তিন বছর বয়সেই অত্যন্ত দুরন্ত ছিলাম আর আমার বোন দেড় বছর বয়সে অত্যন্ত শান্ত ছিল। মা দু-জনের জন্য দুটি সাঁওতাল মেয়ে নিযুক্ত করেন দেখাশোনা করবার জন্য। আমারটির নাম রাইমণি, বোনেরটির নাম সুখী। একদিন জেদ করে ওদের বাড়ি গেলাম এবং অত্যন্ত জেদ করে ওদের যে হাঁড়িয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল তার থকে অল্প একটু খেলাম। এর পরে বাড়ি নিয়ে যেতে মা তাঁর তিন বছরের রক্তচক্ষু কন্যাকে দেখেই রাইমণিকে ছাড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। রাইমণির কাপড় জোর করেই ধরে থেকে সে যাত্রা রক্ষা হল। সুখী ও রাইমণি আমাদের শালবনে নিয়ে যেত। আমরা সেখানে রজন সংগ্রহ করতাম, মা-বাবা দুজনেই বেহালা বাজাতেন, ওঁদের কাজে লাগত। বনজঙ্গলে ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোই প্রধান কাজ ছিল এবং অত্যন্ত আনন্দ পেতাম ছোটখাটো ঝরনার ধারে নানা জাতীয় জীব, গাছ, লতা দেখে বেড়াতে। এই স্বপ্নস্পর্শ থেকে উৎখাত হওয়াটা ভীষণ কষ্টকর ছিল।

বেশ চলল বছর তিনেক, লাভ ভালোই হচ্ছিল। চতুর্থ বছরে মারাত্মক খরা, খালবিল শুকিয়ে উঠল, চাষ একেবারে বন্ধ। শুয়োরদের স্নান ও পানের জলে এত টান পড়ল যে সেগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া হল। এক রাত্রির কথা মনে পড়ে। আমরা ছোটরা পাশের ঘরে শুয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম খুব জোর আলোচনা হচ্ছে। বাবা সকালে, কাকা, মামা ও পিসেমশায়কে সামনে রেখে সাঁওতালদের বললেন, ‘ভুখা মজুরদের পাতের ভাত ও শখের শুয়োরমাংস বেচতে পারবেন না তাঁরা।’ সব চাবি ওঁদের হাতে তুলে দিলেন, সাঁওতালরা সবাই মিলে সরবে কাঁদতে লাগলেন। অত্যন্ত ভারী মন নিয়ে আমরা সবাই কলকাতায় ফিরালম দু-দিন পরে। খ্রিস্টধর্মকে ভারতীয় রূপ দেওয়ার এই পর্ব ওখানেই শেষ হল। যতদূর জানি, এ চেষ্টা তেমনভাবে পরে কেউ করেনি। কলকাতায় বাবা, মামা ও কাকা ফিরলেন ওঁদের অংশের বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে। সকলেরই আয় কম, ফলে দীর্ঘকাল ধরে অতি কষ্টে ঋণ শোধ করা হল।

মাহেশের জমিদারের কন্যাদায় জটিল হয়ে উঠল এই কারণে যে, তিনি কন্যাদের জন্য প্রথম প্রজন্মের খ্রিস্টান পাত্র খুঁজছিলেন এবং সেটা ছিল বেশ বিরল। এদিকে বিপিনবিহারী দত্তেরও ওই সমস্যা। যাই হোক লোকপরম্পরায় উভয়ে উভয়ের সন্ধান করে শেষ পর্যন্ত দুই পরিবারের যোগ হল। মাহেশের জমিদারের প্রথমা কন্যা লীলাবতী দেবীর বিয়ে হল হুগলির সোনাটিকরি গ্রামের জমিদার ও পাশ-করা ডাক্তারের সঙ্গে। দ্বিতীয়া কন্যা প্রিয়বালার বিয়ে হল বিপিনবিহারী দত্ত - আমার ঠাকুরদার সঙ্গে। মাহেশের জমিদারের শখ ছিল হুগলির মহানদ (লোকে বলে মহানাদ) গ্রামে মেয়েজামাইয়ের বাস্তুবাড়ি তৈরি করে দেবেন। সঙ্গে বড় একটা বাগান; মাতাদিঘি নামে সুবিস্তত এক দিঘি। বাড়ির উঠোন ছাড়িয়েই বেশ বড় একটি বাগান। সেখানে মজবুত ও সুদৃশ্য এক দোলনা, আর মার্বেল পাথরের দুটি সুদৃশ্য আসন। সারাদিনের স্কুলের হেডমাস্টারি, গির্জার পাদরির কাজ সেরে ওই শ্বেতপাথরের আসনে বসে ঠাকুমার সঙ্গে বিদেশি সাহিত্য পাঠ, তার ভাষ্য ইত্যাদি দিয়ে ঠাকুমার জ্ঞান ও সাহিত্যের রসগ্রহণের বাড়ানো। সাহিত্যিক, ধর্মীয়. সামাজিক, দার্শনিক আলোচনা ছাড়াও প্রেমালাপ ও হাস্যরসেরও কিছু যোগ মিলত।

বেশ চলছিল। এক সমযে ওঁদের প্রথম সন্তান কী এক রোগে ভুগে মারা গেল অতি শৈশবেই। স্নেহপ্রবণ মাহেশের শ্বশুরমশায় প্রায় তখনই জামাইকে ডাক্তারি পড়তে পাঠালেন। তিনি ফিরলে আশপাশের পাঁচখানি গ্রামের একমাত্র ডাক্তার হলেন। পরিশ্রম বাড়ল, দায়িত্ব ও কর্মভারও বাড়ল। বাড়ল শরীরের ওপর ধকল। যখন তাঁর তেতাল্লিশ বছর বয়স, তখন এক ভিনগ্রামের মানুষ ছই-ছাড়া এক গরুর গাড়িতে করে রোগী দেখতে নিয়ে গেল। রোগী দেখে এসেই জ্বর। শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে শয্যা। রোগটা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। তখন এ রোগের নির্ণয় হত না। ছ-দিন ভুগে সাতদিনের দিন ঠাকুর্দার মৃত্যু হয়।

ছত্রিশ বছরের ঠাকুমার হাতে কোনো সঞ্চয় ছিল না। চারটি ছেলেমেয়ে। এমন সময়ে প্রেসবিটিয়ান মিশন ওঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বুদ্ধিমতী ছাত্রী বিদুষিপ্রভাকে লুধিয়ানায় ডাক্তারি পড়তে পাঠালেন। সেখানে প্রত্যেকটি পত্রেই অত্যুচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হলেন। এম.বি.বি.এস ডিগ্রি পেলেন না। কারণ পিতার মৃত্যুর পরেই লুধিয়ানা চলে আসতে হয় এবং অর্থাভাবেই আই.এস.সি পড়া হয়নি। বড়ো পিসিমার কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ যেন ওঁকে এম.বি.বি.এসের পুরো কোর্সটা পড়তে দেওয়া হয়। ডিগ্রির জন্য লালায়িতও ছিলেন না, ছিলেন জ্ঞানের জন্য। পুরো কোর্সটা উনি একাগ্র নিষ্ঠায় শেষ করেন। পরবর্তী জীবনে গয়ায় কর্মকালে উনি প্রচুর যশ অর্জন করেন।

ওখানে পরীক্ষার প্রত্যেক পত্রে নব্বই-এর ঘরে নম্বর পেয়েছিলেন, তার প্রতিলিপি আমি দেখেছি। পাশ করে উনি আমন্ত্রিত হন দিল্লির লেডি আরউইন কলেজে। কিছু কাজ করার পর পর রবীন্দ্রনাথ লুধিয়ানা কর্তৃপক্ষকে লেখেন একজন নির্ভরযোগ্য লেডি ডাক্তার পাঠাতে। তাঁরা উত্তরে জানান, যাকে পাঠাচ্ছি (পিসিমা) তেমন ছাত্রী আগে কখনো পাইনি, পরেও কখনো পাব বলে মনে হয় না। নিয়োগপত্ৰ পেয়েই বড় পিসিমা সাহেবি মানের বেতন, কোয়ার্টার্স ও দুটি অনুচরের (সরকারি নিয়োগের) পাওনা ছেড়ে পরের ট্রেনেই চলে এলেন খড়ের ছাউনি মাটির ঘরে। মহা খুসি কবির কাছে থাকতে পারবেন বলে।

এরপর ছোটভাইকে স্কুলে দিয়ে পরপর বিশপস কলেজে আই. এস. সি পাশ করে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি. এস. সি মিকস্ড কোর্স অর্থাৎ দর্শন ইতিহাসের সঙ্গে কেমিষ্ট্রি নিয়ে বি.এ পাশ করেন। বাবা অসুস্থ মাকে দেখতে পরীক্ষার আগের সপ্তাহে কদিনের জন্য দেশে গেলে এম এ ক্লাসে মিশনারি সাহেব ক্যামেরন হস্টেলে বাবার ঘরটা আর একজনকে দিয়ে দিলেন। ফলে মফস্বলের আশ্রয়হীন ছেলে এম.এ পড়বার সময়ে ক্লাসের সময়ে ক্লাসের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়েও পরীক্ষা দিতে পারলেন না। দেশে ফিরে গেলেন।

বাবার পরিচ্ছদ ছিল অতি সাধারণ। সেটা স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগ, দেশের বহুসংখ্যক লোকই গান্ধীবাদী, বাবাও তাই। পরনে সাদা খদ্দরের থান। খদ্দর ভারী বলে বাবা নিজের কাপড় সর্বদা নিজেই কাচতেন ও ঠিকে মেয়েটির উপর বাড়তি ওজন চাপাতেন না। খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পায়ে বিদ্যাসাগরি চপ্পল। আমাদের এক অতি ধনী জ্ঞাতির বিয়েতে বাবা কন্যাসম্প্রদান করেন; কন্যার পিতা মারাত্মক অসুস্থ। ওদের বাড়ি থেকে অনুরোধ এল বাবা যেন সম্প্রদান করেন। অবস্থা বুঝে বাবা রাজি হলেন। পরদিন সকালে সাজসরঞ্জাম নিয়ে দর্জি হাজির। বাবা বাড়ির গৃহিণীকে বললেন, আপনি তো জানেন আমি খদ্দর পরি, এসব কেন? তিনি বললেন, তুমি তো রায়সাহেবের কন্যাকে সম্প্রদান করবে। এতটুকু না হলে কি চলে? বাবা বললেন, তা হলে কাপড়ই সম্প্রদান করুক, আমাকে বাদ দিন। কিছু বাগবিতন্ডার পরে ওঁরা রাজি হলেন। খদ্দর পরেই বাবা সম্প্রদান করলেন।

এর পরে ঘটনার আনুপূর্বিকতায় হয়তো খানিকটা গোলমাল থাকবে। তবে যতদূর মনে পড়ে এর পরে বাবা হিমালয়ে যান, গুহায় গুহায় নানা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। ওই সময়কার শিক্ষিত বাঙালি যুবকের একাংশে ধর্ম সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন ছিল। ধর্মের সত্য স্বরূপ কী এই নিয়ে নানা সংশয় ছিল আগেই বলেছি। বাবা বাংলা, ইংরেজি ও চলনসই হিন্দি ও ওড়িয়া বলতে পারতেন। ওদিকে খাদ্যাভাব অর্থাভাব খুব ছিল - পাহাড়ি গরুমোষের যৎসামান্য দুধের অংশ এবং শিলাজতু। নিজের সব প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর না পেয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই চলে আসেন।

এরপর কাকাকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে আশ্রমবাসী হিসেবে থাকতে চান বাবা। কর্তৃপক্ষ একবছর পরে দীক্ষা দেবেন বলেছিলেন দেননি। তা ছাড়া, তাঁদের সঙ্গে যা যা ঘটে তা আগেই বলেছি। এরপর খ্রিস্টধর্মকে প্রাচ্যধর্ম প্রমাণ করা ও দেশে সে ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে গিডনিতে উদ্যোগের কথা আগেই লিখেছি।

এরপর শুরু হল ঋণশোধের পর্ব। পিসেমশায়ের শিয়ালদায় ওমদা রাজা লেনে সুবৃহৎ তিনতলা বাড়ি ছিল। তার বিক্রয়মূল্য ছিল প্রকাণ্ড। উনি মামাকে নিজের কাছে রেখে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন। মুশকিল হল বাবার, কাকাকে ম্যাট্রিশ পাশ করাবার দায়িত্ব। তাই বালেশ্বরে স্কুলে হেডমাস্টারের পদ নিলেন। কাকার শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিয়ে সেই সঙ্গে মাসে মাসে ঋণশোধ করতে লাগলেন। এরই মধ্যে এক মহাজন একটা বড় অঙ্কের পরিশোধ দাবি করলেন - এক মাসের মধ্যেই। আমার তখন বছর ছয়েক বয়স, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম ভীষণ একটা অর্থকৃচ্ছ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন বাবা, তবু সদাপ্রসন্ন হাসিখুশি, রসিক গল্প দিয়ে পরিস্থিতিকে জয় করেছিলেন তিনি।

বালেশ্বরের পরে আরো দু-চারটি স্কুলে হেডমাস্টারের পদে কাজ করেন বাবা। আশ্চর্য ভালো শিক্ষক ছিলেন তিনি। যাঁরা পড়েছেন তাঁর কাছে তাঁরা এই সেদিনও এমন গল্প করেছেন যে হঠাৎ শুনলে অত্যুক্তি মনে হতে পারে। এ খবরটা আমরা বাবার জীবৎকালে জানতে পারিনি। জেনেছি অল্প কিছুদিন আগে। এবং এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়, স্কুল বাবাকে দিয়ে কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিত প্রায় বিনামূল্যেই। একটু বড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমি দরাদরি করলে ওরা কাজটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিতেন। তিনি টাকাটা বেশি পেতেন কিন্তু কাজটার গুরুত্ব বুঝে সেটা করতে পারতেন না। বাবা বাংলা সাহিত্য এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়েছিলেন যে সাহিত্যিক ভাষায় কিছু লেখা তাঁর পক্ষে অতি সহজ ছিল। সেই ভাষা তাঁর সহকর্মীদের কারো আয়ত্তে ছিল না।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাবার অনেক কথা হয়। কবি দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করতেন; উপনিষৎ ও গীতার বিভিন্ন যোগ যোগশাস্ত্রের সমবায় সূত্রগুলি আলোচনা হত। নতুন করে রাজযোগ সম্বন্ধে কবির আগ্রহ ছিল এবং এ নিয়ে আলোচনাও হত বেশি। কবির পাশের ঘরে বাবার অবস্থান। ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাবার পর রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দেন, তাতে দেশবাসীকে অনুযোগ করেন। শান্তিনিকেতনের সেই সভায় বাবা উপস্থিত ছিলেন। বাবা বলতেন রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় যে ক্ষোভ, দুঃখ ও অভিমান সেটা ছিল সম্পূর্ণতই যথাযথ। কবি যথার্থই বলেন, যে, তিনি যদিও দীর্ঘকাল ধরে কবিতা লিখেছেন - প্রায় চল্লিশ বছর, সে কবিতার উৎকর্ষ দেশের লোক বোঝেনি। যখন বিদেশি পাঠক, বোদ্ধা প্রশংসা করল তখন দেশের লোকের চেতনা হল যে আমি কবিতা লিখে থাকি এবং সে কবিতা বিদ্বজনের কাছে আদরণীয়। বিদেশি রসজ্ঞদের প্রশংসা পর দেশের লোকের স্বীকৃতি কবিকে আহত করে। এটা এতটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যে, বাবা একে অস্বাভাবিক বলে মনে করেননি। তাঁর কবিতা নিয়ে বেশ কিছু কবি-অকবি নানা ব্যঙ্গপরিহাস করেছিল। কবি তার উত্তর দিয়েছেন ছড়া বা সরল উক্তিতে। এর কিছুদিন পরে কবি আমন্ত্রিত হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। বাবা কলকাতায় কাজে ফিরে আসেন। বাবা যথাসম্ভব লেখা পড়া ও পাঠনে মনোযোগী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ৬ দিন কাটাবার পরে সপ্তম দিনের সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিছু কথা শেষে বলেছিলেন, তার মধ্যে ‘মাকে দেখিস’ এটুকু ছাড়া অন্য কথাগুলি আবছা শুনেছিলাম, বুঝতে পারা যায়নি।

এ তো গেল বাবার কর্মজীবনের ছোটো আলেখ্য। বাবার চিত্ত সর্বদাই নতুন ভাবে, চিন্তায় উদ্বেলিত থাকত। বাবা কেমিস্ট্রির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সোনা বানালেন। স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি, নাইট্রিক অ্যাসিডে না-গলা এবং রং না-হারানো - এই তিনটি পরীক্ষায় পাশ করলে আঠারো ক্যারাট পর্যন্ত সোনাতেই অনেক লাভ। বাবার মন ছিল খুবই বিজ্ঞাননিষ্ঠ। বি এস সি-তে কেমিস্ট্রি তাঁর পাঠ্য ছিল এবং অনেক বই পড়েছিলেন অনেক ল্যাবরেটারির পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছিলেন। লাভের মধ্যে মায়ের গলার মটরমালার একটা করে মটর যেত। অবশেষে খাঁটি সোনার চেয়ে কম মানের সোনা হল, যা নাইট্রিক অ্যাসিডে গলে না, রং পাল্টায় না। খামতি শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম ওজনের সোনা পাওয়া গেল। ইংরেজিতে যাকে বলে specific gravity, তা ঠিক পাওয়া গেল না। মেদিনীপুরের সবচেয়ে বড়ো স্বর্ণকার আমাদের পারিবারিক বন্ধু হেমন্ত ফোটোগ্রাফার শম্ভু সাহার জ্যাঠতুতো ভাই, সোনা কেনবার জন্য বাবাকে বহু অনুরোধ করলেন। কিন্তু ততক্ষণে সোনার টুকরো এবং রাসায়নিক দ্রব্য সব রাস্তায়। বাবা ছিলেন প্রকৃত আদর্শবাদী। অতএব, এত মাস ধরে যা করলেন তা যখন খাঁটি সোনায় উত্তীর্ণ হল না তখন তিনি তার পরিশ্রমকে ব্যর্থ জ্ঞান করে ওর থেকে সরে এলেন। এবং একদিনও পিছনে ফিরে চাইলেন না। আঘাত নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন কিন্তু বাবার অনুশোচনায় কোনো প্রকাশই ছিল না। দরিদ্র শিক্ষক এতদিন ধরে সাধনায় ব্যর্থ হলেন এ জন্য কোনো আর্থিক ক্ষোভ তাঁর একটুও ছিল না।

এর মধ্যে স্কুলের পরীক্ষার প্রচুর টাকার কালি স্কুল থেকে কেনা হয় দেখে ভাবলেন স্বদেশী রসায়নে প্রস্তুত কালি থাকলে দেশের অনেক টাকা বাঁচে। কাজেই এর পরই শুরু হল দীর্ঘ দিন ধরে কালির পর্ব। নিশাদল এবং আরো চার-পাঁচটি উপাদানকে তাপে ও মিশ্রণের নানা প্রক্রিয়ায় কালিতে পরিণত করার বিচিত্র প্রচেষ্টা। সাত-আটটি বোতলে নানা গুণের সিদ্ধিযুক্ত কালি দেখা যেত। এরই শেষদিকে সাত দিন ভুগে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে চলে গেলেন। কয়েকদিন পর আমার ভাই ও আমি বোতলগুলো থেকে কালি ঢেলে দেখলাম। তলায় তলানি জমে না এবং দিলে নাইট্রিক অ্যাসিডে গলে না। শুকিয়ে গেলে জলে দলে রং একেবারে পাকা থাকে। তখন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় অনভিজ্ঞ আমরা ভাইবোনেরা সম্পূর্ণ বিমূঢ় অবস্থায় বসে রইলাম। রাসায়নিক পদার্থ সবই হাতের কাছে, কিন্তু কোনটা কতখানি কখন দিতে হবে, কতক্ষণ জ্বাল দিতে হবে তাও আমরা জানি না। বহু বছর বোতলগুলি ফেলতে পারিনি। ওই কালি ব্যবহার করেছি অনেকদিন, কিন্তু ওর রহস্য মোচন করতে পারিনি, কারণ রসায়ন সম্বন্ধে অতটা জ্ঞান ছিল না। ওই একনিষ্ঠ সাধনাও ছিল না।

বাবা যে কাজে হাত দিতেন সেটা নিখুঁত ভাবে না করে উঠতে চাইতেন না। তাঁর এ গুণটা আমাদের কারোরই ছিল না। এসব রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই স্কুলের হেডমাস্টার ও অন্য এক ধনী লোক দুটি বৃহৎ গ্রন্থ ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে দেন। দুটি কাজই খুব কঠিন। শুধু ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ মাত্র নয়। বাবার আদর্শ ছিল অনুবাদটি যেন যথার্থ বাংলা বাগধারাকে মেনে চলে। বহু পরিশ্রম করে বই দুটি অনুবাদ করার পরে মোটামুটি ‘ভালো হয়েছে, বেশ হয়েছে’ বলা হল এবং প্ৰতিশ্রুত অর্থের অর্ধেকের কম দিয়ে বিদায় দেওয়া হল। অনুবাদ দুটির খুব প্রশংসা হওয়ার পরে বাবা আরো অনুবাদ করার জন্য আমন্ত্রিত হন, কিন্তু পরিশ্রমের মর্যাদা ও অর্থমূল্য না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর কোনো অনুবাদ করেননি। অথচ বাবা সংস্কৃত ভালো জানতেন বলে তাঁর বাংলা অনুবাদগুলি সহজ সুখপাঠ্য এবং যথাযথ হত।

বাংলা পড়াতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের পন্ডিত দুর্গামোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বাবার হৃদ্যতা ছিল, সেটা ছিল অবশ্য বাবার সংস্কৃত জ্ঞানের ওপরে প্রোথিত। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি সম্বন্ধে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের মন্তব্য মনে পড়ে। ইংরেজির অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য প্রথম দর্শনেই আমাকে বলেছিলেন, বৌদি, তুমি দাদার স্ত্রী হিসেবে আমার কাছে যতটা আপন ও সম্মানের, তার চেয়েও বেশি দামি হয়েছো সরসীবাবুর মেয়ে হিসেবে। আমি দেশেবিদেশে নানা শিক্ষকের কাছে পড়েছি, কিন্তু সরসীবাবুর মেধা এবং স্বয়মুদ্ভাবিত শিক্ষাপ্রণালীর কোনো তুলনা কোথাও পাইনি। প্রখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকার আমার বিশেষ কনিষ্ঠ প্রিয়ছাত্র ছিল। এই সেদিন চলে গেল। সেও এই কথাই বলেছিল।


______________________________
সুকুমারী ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষে আমরা ইতিপূর্বে ‘আরেক রকম’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিবন্ধটি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুনর্মুদ্রিত করলাম। এই নিবন্ধের শেষ অংশ প্রকাশিত হবে আগামী সংখ্যায়। - সম্পাদক