আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩০
সমসাময়িক
লাদাখে কী হচ্ছে?
সোনম ওয়াংচুক তেমন কোনো বিখ্যাত মানুষ নন। তবে তাঁর জীবনযাপন-ক্রিয়াকর্মাদি সম্পর্কে অনেকেই খোঁজখবর নেন। এমনকী তাঁকে অনুকরণ করে নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা। পর্দার চরিত্রের সুবাদে বাস্তবের সোনম ওয়াংচুক এখন দেশে-বিদেশে যথেষ্ট পরিচিত।
সোনম ওয়াংচুক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার তবে সার্বিকভাবে একজন শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী। খাতায়-কলমে সোনম ওয়াংচুক লাদাখের একটি ইস্কুলের মাস্টারমশাই এবং পরিবেশকর্মী। পরিবেশ-বান্ধব বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করার উপযোগী বিভিন্ন পদ্ধতি তিনি উদ্ভাবন করেছেন এবং লাদাখের বিভিন্ন প্রত্যন্ত প্রান্তে তা প্রয়োগ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও হিমবাহের গলে যাওয়ার জন্য কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে তা নিয়ে তাঁর অবিরাম প্রচার লাদাখের মানুষকে সচেতন করতে সাহায্য করছে এবং দেশের পরিবেশ আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
প্রকৃতি-পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, সুস্থায়ী উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে তিনি নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। লাদাখের প্রকৃতি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে যদি ভবিষ্যতে কর্পোরেট সংস্কৃতি শুরু হয়, তা হলে তো মুশকিল। পাহাড়ের হিমবাহ গলা জল পাঞ্জাবের উপর দিয়ে যায় বলে পাঞ্জাবের কৃষি উৎপাদন এত সুসংহত। লাদাখের নদীই যদি শুকিয়ে যায়, তা হলে আগামীদিনে কোম্পানির প্যাকেটবন্দি চাল কিনে কৃষকদের দিন চলবে কি না, সেটা রীতিমতো চিন্তার বিষয়।
গত ৬ই মার্চ থেকে তিনি কতকগুলি নির্দিষ্ট দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য খোলা আকাশের নিচে অনশন আন্দোলন শুরু করেন। লাদাখের প্ৰশাসনিক সদর শহর লেহ্-র স্বাভাবিক তাপমাত্রা তখন সর্বনিম্ন মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনশন আন্দোলন পর্বে তিনি লবণ মেশানো জল ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করেননি। তাঁর দাবি - লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এবং স্থানীয় জনজাতির সংস্কৃতি সুরক্ষিত করতে হবে। গত ৬ই মার্চ থেকে অনশন শুরু করেছিলেন সোনম। চার দফা দাবি সামনে রেখে তিনি জানিয়েছিলেন, যত দিন না তাঁর দাবি কেন্দ্র মানছে, তাঁর অনশন চলবে। কী এই চার দফা দাবি? সোনমের চার দফা দাবির প্রথমটি হল লাদাখকে রাজ্যের সম্মান দিতে হবে। এ ছাড়া লেহ্ এবং কার্গিল জেলার জন্য আলাদা আলাদা লোকসভা আসন, লাদাখের জন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং তাতে চাকরি দেওয়ার আলাদা প্রক্রিয়া, খনি ব্যবসায়ী এবং শিল্পগোষ্ঠীগুলির হাত থেকে লাদাখের প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং সর্বোপরি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল নিশ্চয়তার নিরাপত্তা বলবৎ করার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। সংবিধানের এই নিয়ম বলবৎ হলে দেশের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এই এলাকাভুক্ত জমিগুলির জন্যও থাকে বাড়তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। কিন্তু ২৬ মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রের তরফে সোনমের দাবি নিয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি।
সোনম ওয়াংচুক গত তিন সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ছিলেন। তাঁর অনশন শয্যার পাশে এসে দাঁড়ান শুধু লেহ্ নয় লাদাখের শত শত মানুষ। অনশন শয্যা থেকেই তিনি জনগণকে “জাতির স্বার্থে এবার খুব সাবধানে তাঁদের ব্যালট শক্তি ব্যবহার করার” আহ্বান জানান।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য থেকে ২০১৯-এর ৫ই আগস্ট আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে গঠন করার পর থেকে লাদাখ গত সাড়ে চার বছরে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভের সাক্ষী হয়েছে। ২০২৩-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে লাদাখবাসীদের দাবিদাওয়া ও উদ্বেগগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য লেহ্ এবং কার্গিল উভয় অঞ্চলের সদস্যদের নিয়ে একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সমগ্র লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। গত ৪ঠা মার্চ এই দুটি মূল বিষয়ের উপর আলোচনা ঐক্যমতে না পৌঁছনোয় সোনম ওয়াংচুক ৬ই মার্চ তাঁর অনশন শুরু করেছিলেন। সোনম ওয়াংচুকের অনশনকে কার্গিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ)-সহ লাদাখের বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্থা সমর্থন করে। কেডিএর সদস্যরাও কার্গিলে অনশন শুরু করেছেন এবং ২৬শে মার্চ মঙ্গলবার তাঁদের ধর্মঘট তৃতীয় দিনে প্রবেশ করেছে।
দীর্ঘ অনশন পর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রীকে লাদাখে গিয়ে সোনমের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায়নি। তাঁদের সময় কোথায়? তাঁরা এখন স্বপ্নিল প্রতিশ্রুতি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ভোট ভিক্ষার কাজে ব্যস্ত। আমলাদের অন্তত পাঠানো যেত? তাই বা কী করে হয়! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন যে এখন আমলাদের সাময়িক বিশ্রাম। নতুন সরকার গঠনের পর আবার তেড়েফুঁড়ে কাজ শুরু করতে হবে।
আগের একটি ভিডিওতে, ওয়াংচুক বলেছিলেন যে তাঁর অনশন ভারত সরকারকে তাঁদের প্রতিশ্রুতি “হিমালয়ের ভঙ্গুর ভূমি রক্ষা ও সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার” কথা মনে করিয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ। তিনি বলেন, এটি লাদাখের যাযাবর উপজাতিদের ভারত-চিন সীমান্তে চারণভূমি হারানোর প্রেক্ষাপটে ছিল। “একদিকে, তাঁরা ভারতীয় শিল্পপতিদের কাছে নিজেদের জমি হারাচ্ছেন (প্রায় ১,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার প্রধান চারণভূমি)। এবং অন্যদিকে, তাঁরা চারণভূমি হারাচ্ছেন চিনের কাছে, যেটি উত্তর থেকে আগ্রাসন করা হয়েছে। চিনের সৈন্যরা গত পাঁচ বছরে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিশাল অংশ দখল করেছে।”
অনশনের চতুর্দশ দিনে সোনম ওয়াংচুক বলেছিলেন যে ২৭ মার্চ এই দখলদারির প্রকৃত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সীমান্ত পর্যন্ত একটি পদযাত্রা করা যেতে পারে। “১০ হাজার লাদাখি মানুষ সীমান্তে মার্চ করবে,” বলে সোনম ওয়াংচুক ঘোষণা করেন যে যাযাবর নেতারা, যাঁদের সঙ্গে তিনি মিছিল করবেন, “আমাদের দেখাবেন তাঁরা আগে কতদূর চরাতে যেতেন এবং এখন কোথায় থামতে হচ্ছে”।
তবে, তাদের ভারত-চিন সীমান্তে মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। মিছিলের অন্য সম্ভাব্য তারিখ ৭ এপ্রিল।
এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে সোনম ওয়াংচুক অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। কোন আশ্বাসের ভরসায় তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন তা জানা যায়নি। কার্গিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আন্দোলন স্থগিত বা প্রত্যাহার করেছে কিনা তা-ও স্পষ্ট নয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনো বার্তা এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
লাদাখ মানে নিছক পর্যটন কেন্দ্র নয়। লাদাখের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূগর্ভস্থ বৈচিত্র্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখের জমির তলায় কোন কোন খনিজ পদার্থ রয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। আশঙ্কা হয়, বিষয়টিকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে গোপনে কোনো লেনাদেনা-বেচাকেনার ছক কাটা হচ্ছে না তো!