আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

বিরোধী রাজনীতি বনাম ইডি তদন্ত


গত ২১শে মার্চ, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করেছে আবগারি বরাত পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতি মামলায়। ইতিমধ্যেই এই তদন্তে জেলে গিয়েছেন কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির অন্যতম নেতা ও দিল্লীর প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ শিষোদিয়া সহ আপের জনসংযোগ আধিকারিক বিজয় নায়ার ও আরও দুজন নেতা। একই দুর্নীতি মামলায় ইডি তেলেঙ্গানার বিআরএস পার্টির নেত্রী কবিতা রেড্ডিকেও গ্রেফতার করেছে। ফলত এই তদন্ত হঠাৎ করে শুরু হয়নি। বস্তুত ২০২১ সাল থেকে দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আদেশে এই তদন্ত শুরু হয়। ফলে নির্বাচনের আগে এই তদন্ত শুরু হয়েছে এমন অভিযোগ ধোপে টেঁকে না। যদিও এই তদন্ত আবার নতুন করে সংবাদমাধ্যমে ফিরে এসেছে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের পর। ইতিমধ্যে কেজরিওয়াল বহুবার ইডির সমন এড়িয়েছেন। কিন্তু দিল্লী হাইকোর্টে তার গ্রেফতারি এড়ানোর আর্জি খারিজ হতেই ২১ তারিখ তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। দিল্লী হাইকোর্ট তাকে ১লা এপ্রিল অবধি ইডি হেফাজতে থাকার আদেশ দিয়েছে এবং ঐদিনের শুনানিতে কেজরিওয়ালের ভবিষ্যৎ স্থির হবে। এর মধ্যেই দেশের লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হয়েছে এবং এই ঘটনা যথারীতি সেই আবহে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একদিকে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী নিজের দুর্নীতি বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরে ভারত ভ্রমণ করছেন আর বিরোধী জোট তথা ইন্ডিয়ার কারিগরেরা যেমন কেজরিওয়াল একজন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা তার প্রচার হচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধী জোট দাবি করেছে এই গ্রেফতারি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত এবং ইন্ডিয়া জোটকে ভাঙার চেষ্টা। এই আবহে দুটি মতেরই যুক্তিনিষ্ঠ পর্যালোচনা দরকার।

দিল্লীর আপ সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে মূল অভিযোগটি এখনও অবধি জনসমক্ষে আনা হয়েছে তা হল দিল্লীতে মদের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে আবগারি দপ্তর এমন একটি ব্যবস্থা তৈরী করে যা থেকে সরকারি আমলা ও মন্ত্রীদের ঘুষ পাওয়ার রাস্তা তৈরী হয়। অভিযোগ এইভাবে মোট ২৫০ কোটি টাকার বেশী ঘুষ আম আদমী পার্টি পেয়েছে যার ভেতর ১০০ কোটি টাকা তারা পাঞ্জাব ও গোয়ায় নির্বাচন লড়তে কাজে লাগিয়েছে। যদিও আপ নেতারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি জমা করেছেন কিনা তা এখনও ইডি বলেনি। সুতরাং ধরা যায় দুর্নীতির পুরো টাকাটাই দলীয় তহবিলকে স্ফীত করেছে যা তারা রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং বিনা অভিযোগে কেজরিওয়াল গ্রেফতার হয়েছেন এমনটা নয়। অন্যদিকে গত ২৮ তারিখ দিল্লী হাইকোর্টে নিজেই সওয়াল করে কেজরিওয়াল দাবি করেছেন যে অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন তাদের তৃতীয় জবানবন্দিতে কেজরিওয়ালের নাম জড়ায় যা কোর্টে ইডি বলছে না। তাদের মধ্যে একজন যে আগে অভিযুক্ত, পরে রাজসাক্ষী হয়েছে মূলত তার বয়ানের ভিত্তিতেই কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও তার আগের কোনো বয়ানেই দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর নাম ছিল না। সুতরাং পুরোটাই এক সাজানো ষড়যন্ত্র এমনটা কেজরিওয়ালের দাবি। অন্যদিকে কোর্টে ইডি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় চেয়েছে। যারা অভিযোগ এনেছেন তারা অভিযোগ প্রমাণ করতে সময় চাইছেন কোর্টে। উপরন্তু যাদের বয়ানের ভিত্তিতে কেজরিওয়াল গ্রেফতার হয়েছেন তাদের জামিন হয়ে যাওয়া, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই ইডির এত তৎপর হয়ে ওঠা এগুলো যে একধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ সেই অভিযোগকেও অস্বীকার করা যায়না।

গোটা ঘটনার বিশ্লেষণে কে দোষী তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে না নিয়েও কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথমত মোদী সরকারের আমলে একটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত হয়েছে যা আগে দেশে ঘটত না। দেখা যাচ্ছে বহুক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলো কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে ধৃতকে হেফাজতে চাইছে। ক্ষেত্রবিশেষে তা দস্তুর হলেও গ্রেফতারের আগে কিছু পোক্ত তথ্যপ্রমাণ নিয়ে এগোনো হতো যা এখন অন্তর্হিত। ইউএপিএ হোক বা দুর্নীতি সবক্ষেত্রেই অভিযুক্তের দায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। এই প্রবণতা বাড়ছে ক্রমাগত। ফলে আশঙ্কা আসে এই গ্রেফতারি আদৌ দুর্নীতি দমনে নাকি সম্ভাব্য বিরোধীদের কণ্ঠরোধে। দ্বিতীয় প্রশ্ন আসে দুর্নীতি দমনে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি কেবল বিশেষ ক্ষেত্রেই তৎপর ও কর্মক্ষম কেন? দিল্লী কাণ্ডে হয়ত দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু সেই একই তদন্তে দুজন মূল অভিযুক্ত রাজসাক্ষী হয়ে যায় কীভাবে? শুধু তাই নয়, তারাই আবার কর্ণাটকে বিজেপির প্রচারের মুখ হয়ে ওঠে কীভাবে? একই সাথে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যিনি কিনা নারদ ঘুষ কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত এখন বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নারদ তদন্ত আজ ঠান্ডাঘরে। মহারাষ্ট্রে প্রফুল্ল প্যাটেল বিজেপিতে যোগদানের পরেই তার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এমন একাধিক অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের আগে সিপিআই(এম), সিপিআই ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও আয়কর দপ্তর বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে কর ফাঁকির অভিযোগ এনে বিপুল টাকা জরিমানা দাবি করেছে। নির্বাচনের আগে এ সমস্ত উদ্যোগ যে এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অঙ্গ তা বলে দিতে হয়না।

এই ঘটনাপ্রবাহ দেশের এক ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপদকেই ইঙ্গিত করে। একদিকে আমরা দেখছি কেন্দ্রের সরকার অবসৃত। গোটা দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে গেছে। সুতরাং কেন্দ্রের সরকারে এখন কোনো দলের রাজনৈতিক চাপ নেই। কিন্তু তারপরেও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলোর এই তৎপরতা এবং মূলত বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকে নতুন বা পুরোনো অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যাতিব্যস্ত করে রাখা প্রমাণ করে যে নির্বাচন কমিশনের বকলমে বিজেপিই এখনও সরকারি যন্ত্রের চালিকাশক্তি রয়ে গিয়েছে। যা দেশের সংবিধানের গুরুতর অমর্যাদা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার পরিচালনায় যে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক কর্মীদের বসিয়ে দিতে পেরেছে বিগত ১০ বছরে তা প্রমাণিত এই ঘটনায়। সরকার না থাকলেও তার কর্মীরা সেই সরকারকে রেখে দিতে মরিয়া। এ কেবল রাজ অনুগ্রহের লোভে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যেরই প্রমাণ। আর গোটা ঘটনাপ্রবাহে নির্বাচন কমিশনের নীরবতা প্রমাণ করে যে তারা আদতে বিজেপির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক ময়দানে এক অদ্ভুত হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা আজ প্রশ্নাতীত নয়। ফলে সাধারণ মানুষ এদের কথায় আজ বিশ্বাস করতে পারেননা। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল মানুষ দুটি দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন এই দোলাচলে আটকে যান। একদিকে যারা তদন্তকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রক তারাও দুর্নীতিকে নিজেদের দলভারী করার একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখে। অন্যদিকে যারা বিরোধী তারাও এই অনৈতিকতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের দুর্নীতিকে আড়াল করার সুযোগ পেয়ে যায়। যেমন এই ঘটনায় এ রাজ্যের তৃণমূল আহ্লাদিত। তারা ভাবছে এই সুযোগে নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, আবাস দুর্নীতি সবকিছুকেই ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ এবং সঠিক ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে যদি বিরোধীদের ভয় দেখানোর অস্ত্রে পর্যবসিত করা হয়, তাহলে সত্যিকারের দুর্নীতিগ্রস্ত যারা তারাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তাই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা বজায় রাখা অতি গুরুত্বপূ্র্ণ, যদিও তা বিজেপির হাতে ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে।

এমতাবস্থায় একটি সাধারণ নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন হতে চলেছে। কিন্তু দুর্নীতির অছিলায় যেভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে বিরোধী দলগুলিকে হেনস্থা করা হচ্ছে, তাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, দলের টাকা আয়করের জরিমানা হিসেবে কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার থেকে এই কথা স্পষ্ট যে দেশে ভোট হলেও গণতন্ত্র আজ বিপদের সম্মুখীন। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সমতা নেই। বিজেপি সমস্ত ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে বিরোধীদের বিরুদ্ধে লাগাতার ইডি-সিবিআই-আয়কর দপ্তরের মাধ্যমে হেনস্থা করে চলেছে। কিন্তু বিরোধীদের কাছে যেহেতু কেন্দ্রীয় সংস্থাদের রাশ নেই, তারা আপাতত নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হতে বাধ্য। নির্বাচনের মধ্যেই যদি বিরোধীদের সম্পদ, নেতৃত্ব সমস্ত কিছুকেই বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আর নির্বাচন তারা লড়বেন কী করে! গণতন্ত্রের এই সার্বিক অবনমনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ যদি এখনই মুখ না খোলেন, তাহলে ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর উপরে আরও বড় কুঠারাঘাত নেমে আসবে। সমস্বরে মানুষকে এই কথা বোঝানোই বিরোধীদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা হওয়া উচিত।