আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

যুবসমাজ, বেকারত্ব ও রাজনীতি


"আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত"।

রবীন্দ্রনাথ আজকের দিনে এই গান লিখলে হয়ত, আরেকটি লাইন জুড়তেন যে, "আমরা বেকার, আমরা অদ্ভুত"। কারণ দেশে বর্তমানে যুবদের বেকারত্বের হার অতীতের প্রায় সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সদ্য প্রকাশিত আইএলও-র একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০২২ সালে দেশে যত মানুষ কর্মহীন ছিলেন তার মধ্যে ৮৩ শতাংশ যুব (১৫-২৯ বয়সী)। এই কর্মহীন মানুষদের মধ্যে প্রায় ৬৬ শতাংশ শিক্ষিত যুব। অর্থাৎ দেশে বেকারত্বের সমস্যা মূলত যুবদের এবং শিক্ষিত যুবদের সমস্যা। যেমন দেখা যাচ্ছে যে যেই যুবরা নিজেদের নাম সই করতে জানে না, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু যারা স্নাতক বা তার বেশি পড়াশোনা করেছে তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৯.১ শতাংশ। অর্থাৎ আপনি যদি যুব স্নাতক হন তাহলে আপনার কর্মহীন থাকার সম্ভাবনা অশিক্ষিত হওয়ার তুলনায় নয় গুণ বেশি। এমতাবস্থায় দেশের ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল নয়, সেই কথা বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না।

এই নতুন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এমন একটি সময়ে যখন দেশে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছে। দেশের শাসকদল বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেদেরকে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে যুব সম্প্রদায়ের বন্ধু বলে প্রচার করেছেন। এই কথাও সত্য যে যুবদের একটি বৃহদাংশের ভোট মোদী তথা বিজেপি-র ঝুলিতে গেছে। কিন্তু আখেরে দেখা যাচ্ছে যে যেই যুবদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশে ঢক্কানিনাদ করেছেন, তাদের অবস্থা আগের থেকে খারাপ হয়েছে। তারা মূলত বেকারত্বের জ্বালায় মরছেন, শিক্ষান্তে চাকরি পাওয়া দূরস্থান তাদের বেকার থাকার সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। এরপরেও কি তারা মোদীকেই ভোট দেবেন? এই নির্বাচনেও কি যুবদের সিংহভাগ ভোট বিজেপি-র ঝুলিতেই যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে রয়েছে। তবু কিছু কথা বলা দরকার।

দিল্লির সিএসডিএস সংস্থা যারা বহু বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে চলেছেন, তারা মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লির কলেজ ছাত্রদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায় বেকারত্ব ও অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে। এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে প্রায় ৮০ শতাংশ যুবরা বলছেন যে বিগত দুই বছরে চাকরি পাওয়া খুব মুশকিল (২৫ শতাংশ) অথবা মুশকিল (৫৫ শতাংশ) হয়ে গেছে। কিন্তু যখন তাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে যে বাড়তে থাকা বেকারত্বের জন্য কে বা কী দায়ী, তখন ৩০ শতাংশ বলছেন মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, ১৪ শতাংশ বলছেন কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩৫ শতাংশ যুবরা বলছেন যে বেকারত্বের জন্য দায়ী জনগণই। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে যদি বেকারত্বের জন্য কোনো সরকার বা নীতিকে দায়ী করতে হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে যুবদের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। বরং নিজেদেরকেই দায়ী করার একটি প্রবণতা প্রবলভাবে বিরাজ করছে। আবার দেখা যাচ্ছে যে ৪১ শতাংশ যুবরা মনে করছেন যে তাদের ভোটকে প্রভাবিত করার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বেকারত্ব, যার পরেই রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি (২৩ শতাংশ)। ১৬ শতাংশ যুবরা মনে করছেন যে মোদী সরকার কর্মসংস্থান তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, আবার ৫৫ শতাংশ মনে করছেন যে মোদী সরকার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি কর্মসংস্থানের নিরিখে।

যেহেতু উপরোক্ত সমীক্ষাটি দিল্লি শহরের কলেজ ছাত্রদের মধ্যে করা হয়েছে, তাই এর ভিত্তিতে গোটা দেশের যুবদের মনোভাব নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। তবু এই সমীক্ষা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে যুবদের মধ্যে বেকারত্বের কারণ এবং কে দায়ী এই নিয়ে বেশ কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে। এটিই যদি গোটা দেশের যুব সমাজের মতের প্রতিফলন হয়, তাহলে শুধুমাত্র বেকারত্বের জন্য মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যুবরা ভোট দেবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠা আবশ্যিক। অনেক সময় বিভিন্ন বামপন্থী পরিমণ্ডলে একটি কথা বারবার ফিরে আসে যে সংকটের সময় হল বামপন্থীদের জন্য ভালো সময়। কারণ মানুষ সংকটের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারবেন যে এই ব্যবস্থায় তার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তখন তারা বামপন্থীদের বা প্রগতিশীলদের দিকে ঝুঁকবেন। এরই রেশ টেনে বলা যায় যে দেশে যখন যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এত বেকারত্ব তখন নিশ্চই তারা প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবেন এবং বিজেপি সরকারকে একটি উচিত শিক্ষা দেবেন। এই কথাটা কি সঠিক? সত্যিই কি বেকারত্ব বা আর্থিক সংকট বাড়লে বাম তথা প্রগতিশীলদের রাজনৈতিক শক্তি বাড়ে?

উত্তরে জোরের সঙ্গে না বলতেই হয়। উপরোক্ত ধারণাটির মধ্যে একটি নির্ণয়বাদ লুকিয়ে আছে। দেশে আর্থিক সংকট বাড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, মানুষ নিজে থেকেই বুঝবেন যে তাদের সমস্যা বাড়ছে এবং তারা প্রগতিশীল তথা বাম শক্তিদের নিজেদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে চিনে নিয়ে তাদের সমর্থন করবেন। এই ধারণাটি অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট। নিজেদের জীবনযুদ্ধে লড়তে থাকা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষের মনে কোনো হঠাৎ বোধোদয় হয় না, তাদের কাছে সঠিক রাজনীতি নিয়ে যেতে হয়, তাদের সংগঠিত করতে হয় বাম প্রগতিশীল পতাকার তলায়। তারা নিজেদের থেকে সংগঠিত হন না।

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এই সত্য বুঝতে পারব। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৭-৩৮ অবধি গোটা পৃথিবীতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপ প্রবল মন্দার সম্মুখীন হয়। বেকারত্বের হার বিভিন্ন দেশে ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই মহামন্দা, পুঁজিবাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো সংকটের পরে কিন্তু বামপন্থী শক্তি বাড়েনি। বরং গোটা ইউরোপ তথা পৃথিবী নিমজ্জিত হয়েছিল ফ্যাসিবাদের আক্রমণে। কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যু, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি পেরিয়ে সেই ফ্যাসিবাদকে হারানো সম্ভব হয়েছিল।

ভারতের পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই তৎকালীন ইউরোপের থেকে আলাদা। কিন্তু মোদ্দা কথাটি এখানেও খাটে যে আর্থিক সংকট প্রগতিশীল রাজনীতিকে শক্তিশালী করে না। ভারতের নিরিখেই যদি দেখা যায় তাহলে দেখব যে বিগত বেশ কিছু নির্বাচনে বিজেপির একটি প্রধান শক্তি যুবরা। আবার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত বা হাঙ্গামার সময় সঙ্ঘ পরিবারের হয়ে সর্বাধিক মারমুখী অংশও বয়েসে নবীন। তারাই গো-রক্ষা বাহিনী, বজরঙ দল, রোমিও স্কোয়াডের মূল চালিকাশক্তি। কাজেই বেকারত্বের জন্য যুব সমাজ বিজেপি-র থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বা নেবে এমন আশা করা মূর্খামি হবে।

আসলে ফ্যাসিবাদের জনভিত্তি তৈরি হয় সংকটের সময়। যেকোনো পুঁজিবাদী সংকট তৎকালীন উদারবাদের সংকট ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বামপন্থীরা সেই সংকটের কালে নিজেদের দুর্বলতার দরুন ভারতে কোনো বিকল্প খাড়া করতে পারেনি। সেই অবস্থায় বেড়েছে বিজেপি-আরএসএস-এর প্রভাব। মন্দির এবং বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সামাজিক প্রভাব ক্রমশ বাড়িয়ে গেছে। মোদীর উপর ভর করে তারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো হয়ে গিয়েছে যুবসমাজের মধ্যে। তাদের বোঝানো হয়েছে যে তোমাদের সংকটের জন্য আসলে দায়ী মুসলমান-রা, বহিরাগত বাংলাদেশীরা ইত্যাদি। তোমার চাকরি নেই ঠিকই, কিন্তু তোমার ইজ্জত আছে। সেই ইজ্জতের শিখর রাম মন্দির। দেখো আমরা মসজিদ ভেঙে তৈরি করেছি রাম মন্দির। তুমি সেই গর্বে গৌরবান্বিত বোধ করো।

এই সাম্প্রদায়িকতা তথা বিদ্বেষের রাজনীতি আপাতত তুঙ্গে। বামপন্থীরা যখন বলেন ‘জাতের নয় ভাতের লড়াই’ করতে হবে। কথাটা তারা ভুল বলেন না। কিন্তু জনমানসের একটি বৃহদাংশে সেই কথার কোনো প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় না, কারণ ধর্ম বা জাতের নামে যুবসমাজকে বিভাজিত রাখতে ক্ষমতাবানরা সক্ষম হয়েছে।

অন্যদিকে, বর্তমানের যুবসমাজ আর আজ থেকে কয়েক দশক আগের যুবসমাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখনকার যুবসমাজ বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বাস করে। তাদের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা সবই নতুন। তাদের মধ্যে উন্নয়নের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এবং তারা দেখছে যে কেউ কেউ পুঁজিবাদ তথা নব-উদারবাদের সিঁড়ি বেয়ে বেশ তরতর করে উপরের দিকে উঠেছে। তারা ভাবছে তারাও একদিন তাদের সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে। সেই সোপানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কাছে কোনো বিকল্প উন্নয়নের পথ কোনো বিরোধী দল দেখাতে পারেনি এখন অবধি। কিন্তু মোদী তথা বিজেপি লাগাতার যুবসমাজের সঙ্গে বার্তালাপে রয়েছে। স্কিল ইন্ডিয়া, স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া ইত্যাদি নামধারী স্কিমগুলিকে যুবসমাজের সামনে বারবার তুলে ধরা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ফেসবুক, টুইটার, ইত্যাদিতে প্রবল প্রচার চালানো হচ্ছে। এতে যে যুবসমাজের কোনো লাভ হচ্ছে তা নয়। কিন্তু এই সব উদ্যোগের মাধ্যমে যুবসমাজের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে ভাষা দিচ্ছে মোদী সরকার।

তাহলে কি যুবদের বেকারত্ব কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না? অবশ্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। কিন্তু তাকে বাস্তবের মাটিতে ইস্যু বানাতে হলে বিরোধীদের লাগাতার যুবসমাজের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। বোঝাতে হবে তাদের বেকারত্বের জন্য আসলে কীভাবে মোদী সরকার দায়ী। তাদের মনে করাতে হবে যে মোদী সরকার বছরে ২ কোটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে জিতেছিল। কিন্তু এখন সেই প্রতিশ্রুতির পরিনাম আমরা সবাই দেখছি। সর্বোপরি, একটি বিশ্বাসযোগ্য অর্থনৈতিক কর্মসূচী হাজির করতে হবে জনগণের সামনে যা মোদী সরকারের নীতির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের একটি বিকল্প পথের কথা বলে। যুবদের উপযোগী কর্মসূচী ও রাজনীতি তাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে বিরোধীদের। একমাত্র তাহলেই বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত যুবসমাজ বিরোধী রাজনীতির উপরে ভরসা রাখতে পারবে। আর দুই মাস পরে জানা যাবে বিরোধীরা কতটা সফল হল বেকারত্বের ইস্যুকে ২০২৪-এর নির্বাচনে নির্ণায়ক ইস্যুতে রূপান্তরিত করতে।