আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

পুরুষের তন্ত্র

শ্রীদীপ


অনেক রেস্তোঁরার বাইরে দেখবেন লেখা থাকেঃ প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ। এ বহিষ্কারক-বার্তা ঘোষিত এবং উচ্চারিত। এ ছাড়াও আরেক ধরণের বহিষ্কারক-বার্তা আছে আমাদের সমাজে, যা অঘোষিত, কিন্তু আরো কড়াকড়িভাবে তা প্রযোজ্য। সেই অঘোষিত মূল্যবোধ অনুযায়ী - বিচরণের অধিকার কেবল পুরুষের। যে কোনো স্থানে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পোশাকে, যে কোনো ভাবে, যে কোনো ভঙ্গিমায় - যেখানে-সেখানে ও যখন-তখন পুরুষ ঘুরে বেড়াতে পারে। নারী তা করতে গেলেই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রশ্ন করে নারীর বিচরণের স্বাধীনতাকে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রশ্ন করা হয়ঃ নারী এখানে, এতো রাতে, কেন, কি উদ্দেশ্যে? কেনই বা খোলামেলা তার পোশাক? কেন তার বুকের খাঁজ বা পা একটু বেশি উন্মোচিত? কেন তার হাঁটাচলা ও চাহনি উদ্ধত?

কোনো ভদ্র ঘরের মহিলাকে, ভদ্রতার মান বজায় রাখতে, তাই ভদ্র সময়ে, ভদ্র স্থানে, ভদ্রভাবে নিজেকে পেশ করতে হয়। পানের দোকান হোক বা পাড়ার চায়ের দোকান; মদের ঠেক হোক বা ক্লাবের ক্যারাম; গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নিচে দাবার আসর হোক বা মাঝরাতের গঙ্গার ঘাট - ভেবে দেখুন এই স্থানকালগুলিতে আপনি পুরুষকে দেখেন না নারীকে? কে দৃষ্টিগোচর আর কে দৃষ্টির অগোচরে? কার উপস্থিতি এ সব জায়গায় অধিক বাঞ্চনীয়, কাম্য বা শ্রেয়? ভদ্রলোকেরা এ সকল জায়গায় থাকতেই পারে রাতে বা দিনে। কিন্তু ভদ্রমহিলারা নন। এ সকল স্থানে, নারীর আগমনে প্রশ্ন ওঠে তৎক্ষণাৎ, প্রশ্ন ওঠে তার শালীনতা নিয়ে। নেমে আসে বিধিনিষেধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাণী।

পুরুষতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, নিজের আধিপত্য জাহির করতে গিয়ে, এটা ধরেই নেয় যে ভদ্রমহিলার ন্যায্য স্থান গৃহস্তের গন্ডির ভেতরে। সত্যজিতের 'মহানগর'-এ এই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের একটি স্পষ্ট উদাহরণ আছেঃ 'দি প্লেস ফর এ ওম্যান ইজ এ্যাট হোম'। ছয় দশক পরেও সেই মনোভাবের বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। এটা ঠিক, যে বহু মহিলা রোজগার করেন। অনেক বেশি সংখ্যক মহিলা আজ স্বাবলম্বী। কর্মের খাতিরে, মহিলাদের বাইরে পদার্পন করার সামাজিক স্বীকৃতি বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেলেও, অকাজে এবং অসময়ে, নারীর ঘরের বাইরে যাওয়াকে, এখনো পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারে কি? ঘর ও বাহিরের এই লিঙ্গভিত্তিক পুরুষতান্ত্রিক বিভাজন, আধুনিকতার গোড়া থেকেই - যবে থেকে কর্মক্ষেত্র ও গৃহকার্য পৃথক হয়েছে।

স্কুল, কলেজ, অফিস, বাজার বা ব্যাংকে মহিলাদের যাতায়াত থাকলেও, তা পুরুষতন্ত্রের আরোপিত প্রত্যাশা মাফিক। লোকস্থানে নারী কতক্ষণ থাকতে পারে, কী পোশাকে থাকতে পারে, কী ভাবে থাকতে পারে, তা নির্ধারণ করে - লিঙ্গ-নির্ভর ক্ষমতার প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ। সমাজ নারীকে শরীর ঢাকিয়ে; সময় মতো বাড়ি পাঠিয়ে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এখনও ঘোমটা-সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র পরিয়ে; বাপ-স্বামী-ভাইয়ের সাথে তর্ক করা থেকে বিরত রেখে; পরিবারের স্বার্থে, নিজের কামনা-বাসনা-আকাঙ্ক্ষাকে উৎসর্গ করতে শিখিয়ে - সভ্যতা ও ভদ্রতার পাঠ পড়ায়। সেটা মূলত দমন প্রক্রিয়া। কে সুশীল আর কে সস্তা সেই অযথা বিভাজন করে রাখে পুরুষ, নিজের ক্ষমতার খাতিরে।

পুরুষতন্ত্রের অন্যতম মূল শর্তই হল নারীকে সামাজিক প্রথা, পরম্পরা ও সম্ভ্রমের ধারক ও বাহক বানিয়ে, তার ওপর শাসন অব্যাহত রাখা। পুরুষতন্ত্র নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে, নারীকে বারংবার বুঝিয়ে এসেছে যে নারীর ইজ্জত রক্ষার মধ্য দিয়েই, নারীর সঙ্গে জড়িত পুরুষদের মান-ইজ্জত বজায় থাকবে। তাই পুরুষ ছলে-বলে-কৌশলে নির্ধারণ করবে কোন জায়গায়, কতক্ষণ, কতটা ও কীভাবে নারীর উপস্থিতি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। নৈতিকতার জালে জড়িয়ে, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষ। করে অনুগত। নারী-সুরক্ষার নামে চালায় পুরুষের নিয়ন্ত্রণ। নারী-শালীনতার মুখোশের আড়ালে, অনবরত উঁকি মারে নারীর স্বাধীনতা হরণ ও পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারজ্ঞাপন। ক্ষমতার খেলায় জিততে, পুরুষ হয়ে ওঠে নারীর অভিভাবক, রক্ষক, প্রতিপালক।

নারীর শিক্ষা, তার স্বাস্থ্য, তার শরীর, তার প্রণয়, তার যৌনতা, তার কামনা, তার শখ, তার আকাঙ্ক্ষা, তার নিজস্ব ইচ্ছা-চাহিদা ইত্যাদির কতটা নারীর নিজের নিয়ন্ত্রণে, আর কতটা পুরুষের অধীনে? বহু ক্ষেত্রেই, নারীর শিক্ষা কোথা থেকে প্রাপ্ত হবে এবং কদ্দুর পর্যন্ত, সেটা নির্ধারণ করে দেয় তার পিতার অনুদান। অনেক ক্ষেত্রেই, নারীর কর্মজীবনে যোগ দেওয়া না-দেওয়া, বা চাকরি ছাড়ার পিছনে কাজ করে পারিবারিক অনুমোদন ও প্রয়োজন। সন্তানের দেখাশোনা ও পড়াশোনার স্বার্থে নারীকে তার কর্মজীবন বিসর্জন দেওয়ানোর আখ্যান আমাদের ঘরে ঘরে। স্বামীর কর্মজীবন অব্যাহত রাখার জন্য, নারীকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না কি? স্বামীর বদলিতে, নারীকেই নিজের ইচ্ছের গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে, পুরুষকে অনুসরণ করার প্রত্যাশা মেনে নিতে হয় না কি? অফিস সামলে, সাংসারিক কাজের সিংহভাগ কে সামলায় - নারী না পুরুষ? প্রজনন কটা ক্ষেত্রে নারীর প্রয়োজন মেটাতে? বেশিরভাগ বাড়িতে, রান্না করবে নারী কিন্তু রান্না হবে পুরুষের ইচ্ছেমতো। গৃহসজ্জা থেকে গোছগাছের দায়ভার সামলাবে নারী - কিন্তু আর্থিক ও বৈষয়িক সিদ্ধান্ত নেবে ক্ষমতাশালী গৃহকর্তা। নারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতেও পুরুষ পিছু পা হয় না। নারীর শরীরও তার নিজস্ব সম্পত্তি নয়, পুরুষতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী। অতীতে ও বর্তমানে বারংবার এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার জন্য তাই নারীর শরীরে অযাযিত হানা দিয়েছে।

সবই পুরুষের ইচ্ছে ও পুরুষের প্রাপ্তি। কেবল কর্তার ইচ্ছে অনুসারে মুখ বুজে, কোনো পুরস্কার প্রত্যাশা না করে, মুখ ঝামটা ও অপমান সহ্য করে, পুরুষের পরিচর্যা করে যাবে নারী - তবেই না তিনি করুণাময়ী দয়াময়ী মহিলা! নিজে ক্ষুধার্ত থেকে পরিবারের পুরুষকে খাওয়াবেন, তবেই না সে নারী আদর্শ আত্মত্যাগী প্রতিমা হয়ে উঠবেন! নারী কেবলই নারীসুলভ ভূমিকা পালন করে যাবেন বাধ্য ও আনুগত্যের সাথে। জোর জুলুম করার অধিকার একমাত্র পুরুষের। এর পরেও, সন্তুষ্ট পুরুষ বহুগামী হলে, সেটা পুরুষের প্রণয়-প্রতিভা বা পৌরুষের গরিমা, আর অসন্তুষ্ট নারী বহুগামী হলে - সে নাকি চরিত্রহীনা ও অপবাদের শিকার। পুরুষের পদোন্নতি তার মেধা ও কর্মদক্ষতার ফল, আর নারীর পদোন্নতি - পুরুষকে প্রলোভিত করতে পারার পরিণাম মাত্র। সমাজ সত্যিই কি উদার, নারীর প্রতি। অসাম্যের নিদর্শন দিয়ে যায় সে সকল সাংসারিক ও অতিসাংসারিক ক্ষেত্রে।

বাবা-দাদা-বর-ছেলে মিলে ঠিক করে দেবে কোনটা মা-বোন-বৌ-মেয়েদের জন্য সম্মানজনক আর কোনটা সম্মানহানির কারণ; কোনটা উপযুক্ত আর কোনটা অপ্রীতিকর। কতটা রাতে ফিরলে, ভদ্রতার সীমা উলঙ্ঘন করা হয়। পুরুষই ধার্য করবে অন্ধকারে একা বেরোলে নারী কেন লভ্য বস্তু। আবার সেই পুরুষই, পরে অভিমত দেবে যে এত রাতে ওই পোশাকে ওভাবে হাঁটলে তো পর পুরুষকে দায়ী করা চলে না ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সে নারীর ওপর পুরুষের কুনজর পড়লে, সেটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। যে নারী অন্য পুরুষের ব্যাক্তিসম্পত্তি নয়, সে ভোগের বলে গণ্য হবে। কুখ্যাতির সমস্ত হাতছানিকে সেই নারী আহ্বান জানাতেই যেন পথে নামে। যে নারী একা বা কোনো নির্দিষ্ট পুরুষের নয়, সে নারী বহু পুরুষের লালসার ভোগ্য-পণ্য বা মর্যাদা বর্জিত - কলুষিত। সে সম্মানের অযোগ্য। আবার প্রয়োজনে নারীকে অযৌন করে তুলতেও পুরুষ প্রবৃত্ত হয় নিজের স্বার্থে।

যে নারী দায়ে-পড়ে বা স্বেচ্ছায় কোনো গৃহস্থের অন্তর্গত নয়, যে নারী যথেষ্ট অনুগত নয়, সেই নারীই আসলে ভীতির উৎস। কারণ তার শরীর ও যৌনতা কোনো এক পুরুষের অধীনে আটক নয়। সেই নারী, ভদ্র সমাজকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে - এমন দোষারোপ দিয়ে, হয় তাকে বাগে আনতে হবে, নয় তো তাকে ঠেলে দিতে হবে উৎপীড়নের পথে ভোগ্য-পণ্য হিসেবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারীর চূড়ান্ত অবমাননা কী কী - তার তালিকা সুদীর্ঘ। কেউ বলবেন বিজ্ঞাপনে, আইটেম-নাম্বারে ও পর্নোগ্রাফিতে নারী শরীরের পণ্যিকরণ। কেউ বলবেন, পুরুষতন্ত্র চালনার স্বার্থে বহু নারীকে পুরুষের সহযোগী বানিয়ে ফেলা। বা দৈনন্দিন জীবনে নারীর অবদানকে প্রতিনিয়ত অধঃখনন করা বা পর্যাপ্ত স্বীকৃতি না দেওয়া। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের সবচাইতে অন্তর্ভেদী শোষণ: নারীকে বাধ্য করা এই লিঙ্গ অসমতা অহরহ মেনে নিতে। এই মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সম্ভব নির্যাতন ও অন্যায়ের স্বাভাবিকরণ। নির্যাতন আত্মস্থ করে ফেললে, তখন মনে হয় পুরুষের বলপ্রয়োগ নিতান্তই নিয়তি। তখন আর প্রয়োজন হয় না প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার। সতী থেকে সতীসাবিত্রী; পুরুষের সাথে আজীবন মানিয়ে নেওয়া থেকে তোষামোদ; বৈবাহিক ধর্ষণের নির্মমতা থেকে যৌনকর্মীর প্রতি রূঢ় আচরণ; বেগার খাটনি থেকে বিরাট লাঞ্ছনা; অবহেলা থেকে অপবিত্রতা - সবটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়, পীড়ন মেনে নিলে। খর্ব করা যায় বিরোধিতা; প্রয়োজন হয় না সংশোধনী প্রয়াসের। লাঘব হয় সংঘর্ষের স্বভাবনাও।