আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সাংবাদিকের দিনযাপন বা মিডিয়ার সত্যমিথ্যা

গৌতম হোড়


আন্তর্জালে অনুসন্ধান করতে গিয়েই চোখ কপালে উঠে গেল। সারা দেশে ৯৮০টির মতো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা শিক্ষা দেওয়া হয়। তার মধ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। সরকারিও নেহাত কম নয়। দিল্লির কথাই ধরুন। এখানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি কলেজে সাংবাদিকতা কোর্স আছে। তাছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স আছে। দিল্লির অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। শুধু সাংবাদিকতা ও মাস্ কমিউনিকেশন পড়ানোর জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস্ কমিউনিকেশন আছে। রাজধানীতে ৯৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা পড়ানো হচ্ছে। দিল্লি ও রাষ্ট্রীয় রাজধানী ক্ষেত্র, যার মধ্যে গুরুগ্রাম, নয়ডা, মেরঠ, ফরিদাবাদ, গাজিয়াবাদের মতো দিল্লির লাগোয়া শহরগুলি আছে, সেখানে ১৯১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়।

পশ্চিমবঙ্গও যে খুব পিছিয়ে আছে এমন নয়। এখানে ৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়। মহারাষ্ট্রে ১৬১, কর্ণাটকে ১৬৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়ুয়ারা সাংবাদিকতা ও মাস্ কমিউনিকেশন পড়তে পারেন।

বেসরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম কোর্সের জন্য ভালোরকম পয়সা খরচ করতে হয়। সেটা বছরে এক থেকে সাত লাখ পর্যন্ত হতে পারে। যদি ধরে নেওয়া যায়, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গড়ে ৪০ জন পড়ুয়া সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের শিক্ষা নিচ্ছে, তাহলে ভারতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী রীতিমতো সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের শিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে নামছে। যারা এত লাখ টাকা খরচ করে সাংবাদিকতা ও মাস্ কমিউনিকেশনের শিক্ষা নিচ্ছে, তারা কি এরপর তুলনায় অনেক কম বেতন নিয়ে সাংবাদিকতা করতে রাজি হবে?

সম্প্রতি খ্যাতনামা সাংবাদিক বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একটা পোস্ট শেয়ার করেছেন। সেই পোস্টটি কল্পনা শর্মার। বৈজয়ন্ত লিখেছেন, তিনি মাসকয়েক আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া বিভাগের পরীক্ষক হয়ে গেছিলেন। সেখানে পড়ুয়ারা বুদ্ধিমান, ওয়াকিবহাল, খাটাখাটনি করেন। কিন্তু তারা প্রায় কেউই ভবিষ্যতে সাংবাদিকতায় আসবেন না।

কল্পনা শর্মাও মুম্বইয়ের একটি কলেজে মিডিয়া স্টাডিজের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়াদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কতজন সাংবাদিক হবেন? ৩৫ জনের মধ্যে একজন জবাব দিয়েছিলেন, তিনি সাংবাদিক হতে চান। বাকিরা সেই ধরনের কোনো ইচ্ছার কথা জানাননি। অথচ, প্রথম বর্ষে অনেকেই সাংবাদিক হতে চাইতেন। কিন্তু দুই বছরের অভিজ্ঞতায় তারা বুঝতে পেরেছেন, সাংবাদিকতায় কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই তারা এখন আর সাংবাদিক হতে চান না। এরপর কল্পনা মুম্বইয়ে একজন সাংবাদিকের মৃত্যুর প্রসঙ্গ এনেছেন। যিনি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় কভার করতে গিয়ে মারা যাননি, বরং অনিশ্চয়তা ও চিন্তাভাবনা-জনিত চাপের কারণে মারা গেছেন। এরপর কল্পনা নিজের মতো করে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন।

শুরুতে যে এতগুলো তথ্য দিয়ে এই নিবন্ধটিকে সংখ্যাতত্ত্ববহুল করলাম, তার কারণ হল, এর ফলে পরিস্থিতিটা বুঝতে সুবিধা হবে। পড়ুয়াদের মানসিকতা ও সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা বুঝতে সুবিধা হবে। তার জন্য প্রয়োজনে আরও কিছু তথ্য জানানো দরকার। 'স্ট্যাটিসটিকা' জানাচ্ছে, ভারতে ২০২২ সালে প্রিন্ট মিডিয়ায় ৯৩ হাজার জন কাজ করতেন। তবে প্রিন্ট মিডিয়ায় যারা কাজ করেন, তারা সকলেই হয়ত সাংবাদিক নন। তবে তর্কের খাতিরে এখানে ধরে নিলাম, ৯৩ হাজারই সাংবাদিক এবং ২০২২-এর ওই সংখ্যাটা এখনও আছে, কমেনি। তার সঙ্গে টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া যুক্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে লাখ পাঁচেক সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক আছেন। এবার দেখুন, প্রতিবছর চল্লিশ হাজার পড়ুয়া সাংবাদিকতা নিয়ে পাস করে বেরোচ্ছে। তারা কি চাকরি পাবে? প্রতিবছর সাংবাদিকতায় কি অত চাকরি তৈরি হয়? এককথায় জবাব হলো, হয় না। করোনার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি।

এবার আসি সাংবাদিকতায় বেতনের প্রসঙ্গে। অল্প কিছু জায়গা, মিডিয়া সংস্থা আছে, যেখানে ভদ্রস্থ বেতন পাওয়া যায়। টিভি হলে তাও কয়েক বছর চাকরি করার পর রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারলে মাসে ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ২৫ হাজারের মধ্যে বেতন ঘোরাফেরা করে। প্রিন্টের ক্ষেত্রে বেতন আরও কম। ডিজিটালে তো লাভের মুখ দেখাটাই বড় ব্যাপার। ফলে সেখানে সিনিয়ার না হলে বেতন এক লাখের বেশি হওয়া মুশকিল। ইংরেজি সাংবাদিকতায় বেতন তুলনায় একটু বেশি। অন্য ভাষায় একটু কম। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রিন্টে ছোট প্রতিষ্ঠান হলে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে শুরু করতে হয়। টিভি হলে একটু বেশি। এই সামান্য অর্থ নিয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা কেন সাংবাদিকতা করতে আসবে? ফলে বেতনের অমোঘ আকর্ষণ নেই, যা দেখে তরুণ প্রজন্ম সাংবাদিকতার দিকে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসবে। বরং উল্টোটাই সত্যি। প্রচুর ঝুঁকি আছে, চাপ আছে, রিপোর্টার হলে সোর্স তৈরি করতে সময় লাগে। খবর তো আর কারখানায় তৈরি প্রোডাক্ট নয়, প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় উৎপাদন হবে। বরং খবরেরও উত্থান-পতন আছে। কখনও একদিনে একাধিক ভালো খবর পেয়ে যাবেন, কখনও হয়ত এক সপ্তাহে একটাও পাবেন না।

কিন্তু এখন কর্পোরেট কালচারের সময়ে সেসব যুক্তি কেউ শুনতে চায় না। কোনও একটা চ্যানেল বা কাগজে কোনও খবর প্রকাশিত হলে সব জায়গায় ম্যানেজমেন্টের রক্তচাপ বেড়ে যায়। সেই খবর প্রয়োজন না প্রয়োজনীয় নয়, সে খবরের গুরুত্ব কতটা, তার দর্শকদের বা পাঠকের সেই খবরে উৎসাহ আছে কিনা, তা দেখার দরকার পর্যন্ত নেই, প্রথম কাজই হল, রিপোর্টারকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা, কেন এটা মিস হল? খবরের বাজারে ছোট-বড় সব মিডিয়া গোষ্ঠীর সাংবাদিকরা সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে কেউ একদিন এক্সক্লুসিভ খবর করবে, কেউ অন্যদিন। সেটাই তো স্বাভাবিক। তার জন্য বেচারা সাংবাদিকের উপর সমানে চোটপাট করা, তাকে চাপ দেওয়ার কি সবসময় দরকার আছে? দরকার না থাকলেও এটাই হয়। ফলে চাপ বাড়ে। তবে এটাও তো সব চাকরিরই অঙ্গ। ভুল হলে বা সময়ে কাজ করতে না পারলে বা প্রত্যাশাপূরণ না করতে পারলে তো চাপ আসবেই।

একসময় সাংবাদিকতায় নিরাপত্তা ছিল। একবার ঢুকলে সেখান থেকে অবসর নেওয়ার রীতি ছিল। এখন তা আর নেই। হামেশাই ছাঁটাই হয়। চুক্তির নবীকরণ হয় না। পশ্চিমবঙ্গের একটি মিডিয়া সংস্থা প্রসঙ্গে বলা হতো, সেখানে চাকরি হচ্ছে, সরকারি চাকরির থেকেও পাকা। সেখান থেকেও দেদার ছাঁটাই হয়েছে। তার উপর যে সাংবাদিকরা রিপোর্টিং করেন, তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেতে হয়। অনেক সময় তাতে বিপদের ঝুঁকি থাকে। গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাকেও দিল্লি দাঙ্গা ও মণিপুরে খবর করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। জীবনসংশয় ছিল। এটা হতেই পারে। রিপোর্টার হতে গেলে এই ঝুঁকি নিতেই হয়।

কোনো সন্দেহ নেই, এইসব কারণের জন্য আকর্ষণ কমতেই পারে। কমছেও। তবে এটাই সব নয়। কিন্তু এই যে কর্মীদের উপর চাপ দেওয়া, এই যে চাকরির অনিশ্চয়তা, এটা যে শুধু সাংবাদিকতার পেশায় আছে, অন্যত্র নেই এমন তো নয়। কর্পোরেটে কর্মীদের টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়। বছরের শেষে সেই টার্গেট পূরণ করতে হয়। সেই টার্গেট মানে সহজ কোনও লক্ষ্য নয়, রীতিমতো কঠিন। ফলে কর্মীরা প্রবল চাপে থাকেন। ছোট-বড় যে কোনও সংস্থা, মায় অত্যন্ত নামী বহুজাতিক সংস্থাতেও এখন রাতারাতি ছাঁটাই হয়। তারপরেও তো সেখানে চাকরির ক্রেজ কমেনি। শুধু সাংবাদিকতায় কেন কমে যাবে?

সাংবাদিকতা এমন একটা পেশা, যার কিছু বিশেষত্ব আছে। খবরের পেশায় চ্যালেঞ্জ যতটা বেশি, তেমনই বেশি উত্তেজনা, নতুনত্ব। যদি খবরের গন্ধ পেয়ে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ না হয় তো কারও সাংবাদিকতার জগতে আসাই উচিত নয়। সংবাদ এমন একটা জিনিস, যা কখনওই একঘেয়ে নয়। তাই কোনও খবর পেলে তা রিপোর্টার হিসাবেই হোক বা ডেস্কে এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে হোক, সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাই তার কাজের জীবনে একঘেয়েমি কম থাকে। তারা সবসময় কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়। অন্য কোনও চাকরিতে এই সুযোগ নেই। আমার নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত একটা উদাহরণ দিই। কলকাতায় আমি দুটি প্রধান খবরের কাগজে কাজ করেছি। তার মধ্যে একটি কাগজের জন্মলগ্ন থেকে। সেখানে গত শতকের আশির দশকের প্রায় মাঝামাঝি থেকে তিন বছর ধরে আমরা একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা বেতনে চাকরি করে গেছি। সম্পাদক বলেছিলেন, যেদিন সম্ভব হবে, তিনি স্কেলে বেতন দেবেন। দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সম্ভব হলেই পারফরমেন্স বোনাস চালু করবেন। করেছিলেন। দু-চারজন ছাড়া সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরনো মেধাবী ছাত্রছাত্রীর দল কেউই প্রথমদিকে পেশা ছাড়েননি। সেই কাগজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাতদিন কাজ করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে সম্পাদক তো বটেই, সব কর্মীর অবদান ছিল প্রচুর। এমনও হয়েছে, দু'দিন, তিনদিন টানা অফিসে থেকে যেতে হয়েছে। অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু ওই যে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের কারণে অনেকেই আর সাংবাদিকতার জগত থেকে বেরোতে পারেননি। পরে কয়েকজন অধ্যাপনাকে পেশা করেছেন, অন্যরা রেডিও বা টিভি অথবা পাবলিক রিলেশনের জগতে চলে গেছেন, কিন্তু ৭৫ ভাগ সাংবাদিকতায় থেকে গেছেন।

এখন হলে কি সম্পাদকের ওই কথায় এত জন সাংবাদিক কাজ করতেন? সহজ উত্তর, করতেন না। কারণ, সময় বদলে গেছে। সেই সঙ্গে চাহিদা বেড়েছে, চাকরির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। ভালো বেতনের প্রচুর ক্ষেত্র সামনে এসেছে। ফলে কে আর শুধু অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের জন্য আধপেটা খেয়ে সাংবাদিকতা করে যাবেন? আসলে পড়ুয়াদের মনোভাবই তো বদলে গেছে। তাদের কাছে কেরিয়ারই সর্বোপরি। তাদের কাছে ভালো বেতনের চাকরি খুবই জরুরি। এর জন্য তাদের বিন্দুমাত্র দোষ দিচ্ছি না। সময়ের সঙ্গে না চললে পিছিয়ে পড়তে হয়। বুনো রামনাথরা কি এখন আছেন? থাকা সম্ভব নয়।

পাবলিক রিলেশনে বা অন্য ক্ষেত্রে তারা ভালো বেতন পেয়ে যাবে। সাংবাদিকতা পাস করেও অন্য ক্ষেত্রে তারা চলে যেতে পারে। কনটেন্ট রাইটার হতে পারে, বইয়ের এডিটর হতে পারে, লেখার হাত ভালো হলে ফ্রিল্যান্সিং করা যেতে পারে। ফলে তারা কেন ৪০-৫০ হাজারের চাকরির জন্য লালায়িত হবে? বিশেষ করে যেখানে চাকরির নিশ্চয়তা পর্যন্ত নেই। মেধাবী ছেলেমেয়েদের লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিয়ে নেওয়ার পর এবং ১৫-২০ বছর চাকরি হয়ে যাওয়ার পর একদিন তাদের হাতে ছাঁটাইয়ের নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাদের সামনে হতাশা ছাড়া আর কী বিকল্প আছে?

তবে এটা তো শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হচ্ছে না। সব ক্ষেত্রে হচ্ছে। বিশ্বের তাবড় কোম্পানি রাতারাতি কর্মীদের ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরিয়ে দিচ্ছে। তা সে তথ্যপ্রযুক্তির বড় কোম্পানি হোক বা অন্য কোনও ক্ষেত্র। আর্থিক সংকট এলে তো প্রথম কোপটা কর্মীদের উপরই পড়ে। তারপরেও সেখানে চাকরির ক্রেজ বাড়ছে। কারণ, তারা যতদিন কর্মীদের রাখে, ততদিন খুবই ভালো বেতন দিয়ে রাখে। প্রচুর সুযোগসুবিধাও দেয়। ভারতের একটি অন্যতম প্রধান মিডিয়া সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সেখানে সাংবাদিকরা বছরে সাতদিন বিলাসবহুল কোনো রিসর্টে সপরিবারে বিনা পয়সায় থাকতে পারে। আর সাংবাদিকরা এলটিএ-ও পান। তারপরেও অনেক সাংবাদিককে সেই সুবিধা নিতে দেখিনি। সেখানে অফিসে জিম ছিল, টেবিল টেনিস বোর্ড ছিল। তাতেও খুব একটা ভিড় থাকত না।

কিন্তু সাংবাদিকতার আরেকটা সংকট এখন প্রবল হয়েছে। মিডিয়াকে বেঁচে থাকতে হয় মূলত বিজ্ঞাপনের আয় থেকে। তার মধ্যে একটা বড় অংশ আসে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে। সেই বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ টাকা নয়, সারা বছরের হিসাব ধরলে অনেক অনেক বেশি। দুই সরকারের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন আসে। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার। জাতীয় স্তরে ইংরেজি কাগজগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি একাধিক রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন পায়। এছাড়া বেসরকারি সংস্থা বিজ্ঞাপন দেয়। শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, বিয়ে, চাকরি, নোটিশ ইত্যাদি। বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপন নীতি খুব স্পষ্ট। ধরুন ‘ক’ কোম্পানি একটি কাগজ বা টিভি চ্যানেলকে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়। সেখানে অলিখিত শর্ত থাকে, সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে লেখা যাবে না। লিখলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। ঘরের লক্ষ্মীকে কে হাতছাড়া করতে চায়! এখন রাজ্যে ও কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারাও ওই বেসরকারি সংস্থার নীতি অনুসরণ করছে। বিরুদ্ধে লিখলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞাপন বন্ধ হলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি। এই ক্ষতি সহ্য করে কাগজ বা চ্যানেল কি চলতে পারে? পারে না। আর এখানেই সাংবাদিকতার আরেকটি সংকট দেখা দিয়েছে। অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হলেও কিছু করার নেই। নীতি মেনে চলতে হবে। এর ফলে অনেকের মোহভঙ্গ হতে পারে, সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য ক্ষেত্রে চলে যেতে পারে অথবা সাংবাদিকের চাকরি না-ও করতে পারে। টিভিতে খবরের চ্যানেল জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে মিডিয়ার চাকরির চাহিদা বাড়তে থাকে। কারণ, মুখ দেখাবার, যশ পাওয়ার ইচ্ছে তো মানুষের চিরটাকাল ধরেই আছে। প্রথমদিকে টিভিতে বেতনও বেশি ছিল। খুব দ্রুত কিছু সাংবাদিক টিভি-র কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েন। সেখান থেকে মিডিয়ার চাকরির, টিভি-র অ্যাংকার, সাংবাদিক হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়।

এখন তা কমে গেলে হাহুতাশ করে কোনও লাভ নেই। বাস্তবের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কোনও লাভ নেই। এতকিছুর পর কি মনে হচ্ছে, কোথাও কোনও আশা নেই? না পরিস্থিতি অতটা নিরাশাজনকও নয়। তার দুটো কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হলো, ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর মিডিয়ার ছবিটাই বদলে গেছে। এখন সকলের হাতে ক্যামেরা সহ সেলফোন, অধিকাংশের কাছে ইন্টারনেটের সুবিধা। ফলে ইউটিউব চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। চ্যানেল যদি নাও থাকে, কোনও ঘটনা ঘটলে তার ভিডিও পোস্ট করার সুয়োগ থাকছে। তাই কোনও ঘটনা চেপে যাওয়া সম্ভব নয়। কারও না কারও মোবাইল-বাহিত হয়ে তা ঠিক সামনে এসে যাবে।

তাছাড়া গ্রামে-গঞ্জে, ছোট-বড় শহরে প্রচুর অজানা-অচেনা সাংবাদিক কাজ করছেন। মাটি কামড়ে থেকে কাজ করছেন। জেলার প্রচুর সাংবাদিক ভালো কাজ করছেন। হয়ত ছোট আকারে। হয়ত তারা বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সাংবাদিকতা পড়েননি। তাতে কী এসে যায়। এই সাংবাদিকদের প্রভাবও কম নয়। এই সাংবাদিকদের বিজ্ঞাপন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বলে দায়ও কম। ফলে তারা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন।

আর দ্বিতীয় কারণটা হলো, জনমতের বিপক্ষে গেলে, প্রতিবাদী চরিত্র বিসর্জন দিলে কাগজের ক্ষেত্রে পাঠক ও চ্যানেলের ক্ষেত্রে দর্শক হারাতে হয়। তখন কাগজ বা চ্যানেল আবার নীতি বদল করে। বা বলা ভালো, বদল করতে হয়। কে আর চায় যে, প্রতিদ্বন্দ্বী ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলবে, তাদের টপকে যাবে! তখন নীতিবদল হয়। তার মূল্যও দিতে হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেশখালির ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সাংবাদিকতার বড় শিক্ষা, খবরের সঙ্গে থাকতে হয়, মানুষের পাশে থাকতে হয়। মানুষের চাহিদাকে মিডিয়া অগ্রাহ্য করতে পারে না। একটা সময় ছিল, যখন খবরের কাগজে খবর ছিল মূলত কলকাতা বা তার আশপাশের এলাকাভিত্তিক। খুব বড় না হলে গ্রামগঞ্জ বা জেলার খবর তেমন প্রাধান্য পেত না। সেসব খবরের জায়গাও থাকত না। বরুণ সেনগুপ্ত 'বর্তমান' প্রকাশ করার পর জেলা ও গ্রামের জন্য আলাদা পাতা চালু করলেন। জেলার তো বটেই, কলকাতার রিপোর্টারদেরও গ্রামে পাঠাতে শুরু করলেন। বরুণবাবু দুটি কারণে এটা করেছিলেন। প্রথমত, তাঁর বিশ্বাস ছিল, গ্রামে যাওয়া উচিত। 'বর্তমান'-এর সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণে এসে তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করতেন, কে শেষ কবে গ্রামে গেছ, জেলায় গেছ? কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, জেলার, গ্রামের খবর দেওয়াটা খবরের কাগজের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয়ত, তিনি বুঝেছিলেন, কলকাতা বা তার আশপাশের এলাকা থেকে খবরের কাগজকে বেরোতে হবে। ছড়াতে হবে। তাকে নতুন বাজার ধরতে হবে। নতুন পাঠক পেতে হবে। ফলে জেলা ও গ্রামের খবর দেওয়াটা খুব জরুরি। ফলে জেলার ও গ্রামের খবরের পাতা 'বর্তমান'-এ এত জনপ্রিয় হল যে, বাকি সবকটি খবরের কাগজ এই পাতা চালু করতে বাধ্য হল।

মিডিয়ার যেহেতু জনমত প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকে, তাই তার উপর চাপ থাকবেই। আগেও ছিল, এখনও আছে। তার উপর আরেকটা সংকটও এসেছে। এখন ডিজিটাল মাধ্যমের কল্যাণে মানুষের ধৈর্য অনেক কমে গেছে। 'শর্টস্' যবে থেকে জনপ্রিয় হয়েছে, তবে থেকে ধৈর্যের সীমা হয়ে গেছে ১৫ সেকেন্ড। মানুষ তার বেশি কিছু দেখতে চাইছে না। পড়তে চাইছে না। এর প্রভাব নিশ্চিতভাবে মিডিয়ার উপর পড়ছে এবং আগামীদিনে আরও বেশি করে পড়বে। মানুষের কাগজ পড়ার অভ্যাসও কমে যাচ্ছে। লন্ডনে দেখেছি, বিনা পয়সায় কাগজ মেট্রো স্টেশনের বাইরে রাখা আছে। তাও দিনশেষে দেখা যাচ্ছে, মাত্র অর্ধেক কাগজ শেষ হয়েছে। বাকি অর্ধেক হয়নি। কারণ, মানুষ বিনা পয়সার কাগজ নিতেও উৎসাহী নন। তারা একবার মোবাইলে হেডলাইন দেখে নেন। আমাদের দেশে পরিস্থিতি অতটা খারাপ হয়নি, তবে আগামী দিনে যে হবে না এমন নয়।

ফলে সংকট আছে ও থাকবে। এমন সংকট মিডিয়ায় অনেকবার এসেছে, অনেকবার আসবেও। তাই বলে সবকিছু শেষ হয়ে গেল বলে হতাশায় ডুবে থাকারও কোনো অর্থ নেই। কারণ, সংকট থেকে বেরিয়ে আসাটাই মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। নিশ্চয়ই মিডিয়ার ক্ষেত্রেও সেই বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যাবে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলায়। ফলে মিডিয়াও বদলাবে। নতুন পথে চলবে।