আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

শাহজাহানের পশ্চিমবঙ্গ

অশোক সরকার


শেখ শাহজাহান গ্রেপ্তার হয়েছে, সন্দেশখালিতে আনন্দে শাঁখ বাজাচ্ছেন মহিলারা, ছেলেরা পটকা ফাটাচ্ছে, মহিলা পুরুষ সবাই আবীর খেলছেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা। মিডিয়া ক্রমশ অন্য খবর খুঁজবে। আসুন এই অবসরে একটু অন্য প্রশ্ন করা যাক। শাহজাহান-রা রাজত্ব করতে পারে কেন? সবাই বলবেন এর উত্তর খুব সোজা - চারটি 'প'-এর সমাহার - পার্টি, পুলিশ, পঞ্চায়েত আর প্রশাসন যখন মিলে মিশে যায় তখন কোথাও শাহজাহান কোথাও অনুব্রত তৈরি হয়। কথাটা ঠিক, কিন্তু সেটা কেন-র উত্তর নয়, 'কীভাবে'-র উত্তর। চলুন আরেকটু তলিয়ে আসল উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। কে বলতে পারে, নতুন কিছু পেলেও পেতে পারি।

শেখ শাহজাহানকে বুঝতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি আর দলীয় রাজনীতির সম্পর্কটিকে বুঝতে হবে। এই অর্থনীতির সিংহভাগই হল যাকে আমরা পোশাকি ভাষায় 'অসংগঠিত ক্ষেত্র' বলে থাকি। পশ্চিমবঙ্গে তার মধ্যে ইটভাটা, মাছের ভেড়ি, পাথর খাদান, পানের বরজ, গরু পাচার, বালি তোলা, জমি-বাড়ির দালালি, সিমেন্ট-বালির সাপ্লাই, ধানের মহাজন, চালকল - সবই পড়ে। তার সঙ্গে আছে অসংখ্য ছোট দোকান, মানে কেনাবেচার ব্যবসা। আর আছে হকার, টোটো, অটো, মোটরভ্যান (ভ্যানো), বাস, ছোট হাতি, মিনি ট্রাক ইত্যাদি বহু ধরনের পরিষেবা কেন্দ্রিক ব্যবসা। এই সব রকমের ব্যবসাকে এক কথায় বলা হয়, ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গে এর সংখ্যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অসংগঠিত ক্ষেত্র বা লঘু ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ দুটিই অর্থনীতির পরিশীলিত ভাষা। এই অর্থনীতি কয়েকটা বিশেষ নিয়মে চলে। তার মধ্যে যেমন চাহিদা-জোগান, গুনমান-দাম, প্রচার-বিক্রি, একচেটিয়াত্ব, কার্টেল ইত্যাদি অর্থনীতির মুল নিয়মগুলি বিদ্যমান তেমনি পাশাপাশি এই উদ্যোগগুলি চলার অন্য আরও নিয়ম আছে। সেগুলি 'রাজনৈতিক আশ্রয়'-এর নিয়ম। অসংগঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক আশ্রয়ের গঠনতন্ত্রটাই পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব।

সাধারণভাবে দেখা যায়, যেসব উদ্যোগে উন্নত কারিগরি এবং দক্ষ ও অতি দক্ষ শ্রমিক লাগে, যেসব কেনাবেচার ব্যবসা উন্নত কারিগরি নির্ভর বস্তুকে নিয়ে, এবং যাদের ব্যবসা মূলত সংগঠিত শিল্পের সঙ্গে, সেই উদ্যোগগুলি ক্ষুদ্র বা লঘু উদ্যোগ হলেও তারা নানা কারণেই যতটা সম্ভব অর্থনীতি ও প্রশাসনিক নিয়ম মেনেই চলে, নিতান্ত দায়ে পড়েই তারা কখনো-সখনো সামান্য কিছু ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ নিতে বাধ্য হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক শিল্প এবং কিছু পরিষেবা শিল্পও এই তালিকায় পড়ে।

এর বাইরে একটা বিশাল সংখ্যক অসংগঠিত ক্ষেত্রের উদ্যোগ আছে যেগুলি মূলত অদক্ষ শ্রমিকের কায়িক শ্রম ভিত্তিক, এবং যে সব উদ্যোগের ব্যবসার জগতটাও বৃহত্তর অসংগঠিত ক্ষেত্রেরই অঙ্গ। মাছের ভেড়ি থেকে শুরু করে উপরে লেখা অনেকগুলি উদ্যোগই এই পর্যায়ে পড়ে। এই উদ্যোগগুলি আগাপাশতলা 'রাজনৈতিক আশ্রয়' নির্ভর। পুলিশের আশ্রয়, নেতার আশ্রয় আর প্রশাসনের নিচু তলার কর্মীদের (কখনও কখনও উপর তলার কর্মীদেরও) আশ্রয়। আশ্রয় মানে শুধু টাকা দিয়ে তাদের পেট ভরানো নয়। সেটা আশ্রয়ের ন্যূনতম অঙ্গ। সাধারণভাবে এইসব উদ্যোগের অভিজ্ঞতা যার আছে, সে জানে, অনেক ছোট উদ্যোগ চালাতে গেলে তিন ধরনের মানুষকে খুশি করতে হয়, পুলিশ, এলাকার নেতা এবং প্রশাসনের প্রান্তিক কিছু কর্মীকে। কেন? কারণ এই উদ্যোগগুলি মূলত সব রকম নিয়ম মেনে চলে না, অনেক ক্ষেত্রেই সব নিয়ম মেনে চললে তারা টিকতেই পারবে না। সহজভাবে দেখলে - ন্যূনতম মজুরি, জমির বাজার স্বীকৃত ভাড়া, বিদ্যুতের যথাযথ মিটার, সব রকমের ছাড়পত্র নেওয়া ও তা সময়মতো পুনর্নবীকরণ করা, কেনা-বেচার প্রশাসনিক নিয়ম ইত্যাদি সব কিছু মানলে অনেক উদ্যোগই টিকবে না। তাই ন্যূনতম স্তরে নিয়মের হাড়িকাঠ থেকে বাঁচতে কিছু টাকা দিয়ে এই 'রাজনৈতিক আশ্রয়' কেনা হয়।

'রাজনৈতিক আশ্রয়'-এর একটা আরও সংগঠিত স্তর আছে। এমন অনেক উদ্যোগ আছে যা নানাভাবে মানুষের এবং প্রশাসনের যে ক্ষতি করতে থাকে, সেই ক্ষতি আড়াল করা, মানুষের ক্ষোভ সামলানো, যে কোনও রকম তদন্তের সম্ভাবনাকে রোখা, তার সঙ্গে পার্টিকে ভোট এনে দেওয়া, মিছিলে ভিড় এনে দেওয়া, ব্রিগেড ভরানো, নিজস্ব ভাড়াটে বাহিনী, চর বাহিনী এবং অন্যান্য অঙ্গগুলিকে সক্রিয় রাখা - এসব সংগঠিত 'রাজনৈতিক আশ্রয়' ছাড়া সম্ভব নয়। অসংগঠিত ক্ষেত্র আর রাজনৈতিক আশ্রয়ের এই আলগা ছবিটা আঁকার সূত্রে আমাদের আলোচনার প্রধান প্রশ্নটা দেখা দেয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সম্পর্কটা নিবিড় কেন? এটা কি শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিশেষত্ব?

সংগঠিত শিল্পেও যে রাজনৈতিক আশ্রয় নেই তা নয়, তাকেই 'crony capitalism' বলা হয়। সংগঠিত শিল্পজগতে এমন কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। একাধিক কারণে তা জরুরি হয় পড়ে - জাতীয় সুরক্ষা, জনকল্যাণ, মৌলিক পরিষেবা, পরিবেশ, বিশেষ কোনও সামাজিক বর্গের সুরক্ষা ও অন্যান্য। এইসব ক্ষেত্রে শিল্প করতে গেলে সরকারের গুড বুকে, সরকারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে থাকতে হয়। সরকার বলতে সরকারি আমলা ও নেতা-মন্ত্রী। সাধারণভাবে শিল্পগোষ্ঠীগুলি সরকার থেকে নানা সুবিধা চাইতে থাকে, সরকারের আমলা-মন্ত্রীরাও সরকারের ও দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে যতটা সম্ভব সুবিধা দিতে থাকে।

এই সমীকরণ পালটে যায় যখন, নেতা-মন্ত্রী ও দলের সঙ্গে শিল্পগোষ্ঠীর সম্পর্কটাই বদলে যায়। এই সম্পর্কটা বদলে যায় যখন দল-নেতা-মন্ত্রী, সরকার ও দেশের স্বার্থের উপরে দল ও নেতার স্বার্থকে স্থান দেয়, তার জন্য শিল্পগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আর শিল্পগোষ্ঠীও সেই স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের শিল্পস্বার্থের একটা বিনিময় সম্পর্ক তৈরি করে। এই বিনিময় সম্পর্কটায় এক পক্ষ অন্য পক্ষকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে থাকে আর তার বদলে অন্য পক্ষ দল ও নেতার রাজনৈতিক স্বার্থকে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। মোদী, বিজেপি আর আদানিদের সম্পর্কের সূত্রে এই ব্যবস্থাটা আমাদের দেশে এখন কিছুটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

এই বিনিময় সম্পর্কটা মূলত কয়েকজন নেতা, বিশেষ কয়েকটি আমলা, এবং কিছু টেকনোক্রাট-দের সঙ্গে শিল্পগোষ্ঠীর কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখন অবশ্য তার সঙ্গে কিছু আইনজীবী এমনকী, শোনা যায় বিচারপতিকেও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই সম্পর্কটা যথেষ্টই গোপন থাকে।

অসংগঠিত ক্ষেত্রে উদ্যোগের সঙ্গে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সম্পর্কের চেহারা এবং কারণ দুটোই আলাদা। এখানে একটা অন্য বিষয় সামনে চলে আসে, যার নাম জীবিকা বা কর্মসংস্থান। সংগঠিত শিল্প ও তার শাখা-প্রশাখা শিল্প পশ্চিমবঙ্গ থেকে যত সরে গেছে ততই জীবিকার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। ৫০ থেকে ৭০-র দশক পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি ক্ষেত্রে শহরে ও গ্রামে নিচু তলায় বেশ কিছু চাকরি হতো। সেই পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় আর সংগঠিত শিল্পের প্রসার না হওয়ায় জীবিকার সংকট প্রকট হতে বাধ্য। এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে দলীয় রাজনীতির একটা নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে।

একটা উদাহরণ দিই। একটা মফস্বল শহরে ধরা যাক ১৫০ থেকে ২০০-টা টোটো চলতে পারে। কিন্তু টোটো নিতে আগ্রহী ১,০০০ জন। এই পরিস্থিতিতে তিনভাবে তা সমাধান হতে পারে। ১,০০০ জনই টোটো কিনে রাস্তায় নামবে তারপর অত যেহেতু চাহিদা নেই, তাই ক্রমশ অনেকে গুটিয়ে যাবে, পড়ে থাকবে ২০০ জন। মিউনিসিপালিটি ১,০০০ জনকেই পারমিট দেবে, কিন্তু কার কী হল দেখবে না। অথবা মিউনিসিপালিটি ১,০০০ জনের আবেদন নিয়ে একটা লটারি করবে, সেই লটারিতে যে ২০০ জনের নাম উঠবে তাদের পারমিট দেবে।

কিন্তু আরেকটা উপায়ও সম্ভব। যেহেতু টোটোকে মিউনিসিপালিটি থেকে অনুমতি নিতে হয়, তাই সেখানকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা ঠিক করল বেছে বেছে তাদের টোটোর অনুমতি দেওয়া হবে, যারা দলের অনুগামী, দলকে চাঁদা দেবে, দলের মিছিলে যাবে, দল টাউন বা রাজ্য বন্ধের ডাক দিলে বাড়ি বসে থাকবে। জনসভায় লোক দরকার হলে টোটো ভরতি করে লোক নিয়ে যাবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক আশ্রয় থেকেই কর্মসংস্থান বা জীবিকা তৈরি হল। শুধু তৈরি হওয়া নয়, রাজনৈতিক আশ্রয়েই সেই জীবিকা টিকে রইল। পশ্চিমবঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রে অজস্র দোকান, টোটো, অটো, মোটর-ভ্যান, রাস্তার ধারের গুমটি, খেয়ানৌকা, বাস, মিনিবাস, এইভাবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে তৈরি হয়েছে, এবং সেই আশ্রয়েই বেঁচে আছে। এই আশ্রয়ে থাকলে সামান্য কিছু আইন বিরুদ্ধ কারবার কেউ চেয়েও দেখবে না, তার একটু বেশি বাড়াবাড়ি হলে দলের নেতারা সামলে দেবে। অবশ্য খুব বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেললে, দল সাথে নাও থাকতে পারে।

কর্মসংস্থানের নাম করে এই ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে ৯০-এর দশকে অল্পবিস্তর চালু হলেও তার বিস্তার ও সমৃদ্ধি ঘটেছে এই শতকের দ্বিতীয় দশকে। এতে বেশ কিছু উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছিল। একটা নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল, অনেক পরিবারের রোজগারের ব্যবস্থা তো হয়েইছিল, সঙ্গে স্থানীয় নেতা-কর্মীদেরও জীবিকার কিছুটা সুরাহা হয়েছিল। আর দলের স্থানীয় ইউনিটগুলোর দলীয় কাজকর্মের জন্য অর্থেরও কিছুটা সুরাহা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা ছিল বিকেন্দ্রিকৃত, এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। রাজনৈতিক দল এখানে মধ্যস্থতাকারী নয়, এখানে তারাই কর্মসংস্থান ও পরিষেবার বাজারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।

কর্মসংস্থান ছাড়াও অসংগঠিত ক্ষেত্রে বিভিন্ন যে উদ্যোগগুলি ছিল সেগুলির কী হল? সেগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সম্পর্কটা এত নিবিড় কেন। এইখানে উদ্যোগ বলতে আমি কিছু বিশেষ উদ্যোগ বোঝাচ্ছি যেগুলি স্থানীয় হলেও একটা দোকান, একটা অটো, একটা বাস জাতীয় ছোট উদ্যোগ নয়, তার চেয়ে বড়ো। যেমন মাছের ভেড়ি, পাথর খাদান বা গরুর সাপ্লাই। এইসব উদ্যোগগুলি মূলত শ্রমনির্ভর - বিশেষত অদক্ষ শ্রমিক নির্ভর এবং এদের বাজার একাধিক জেলা, এমনকি একাধিক রাজ্যজুড়ে। অর্থাৎ এইসব উদ্যোগের মালিকেরা রোজগারপ্রার্থী পরিবার নন, এরা উদ্যোগপতি। এই উদ্যোগপতিরা অবশ্য সাধারণ উদ্যোগপতি নন। এরা একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা এবং উদ্যোগপতি, এবং এদের দুটো পরিচয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই নেতা-উদ্যোগপতি সংমিশ্রণের একটা বিশেষত্ব আছে। এদের উদ্যোগের অনেকটাই বেআইনি। শ্রমিকদের বেগার খাটানো, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্রের অভাব, ভেজাল মেশানো, কালো টাকার বিনিময়, ট্যাক্স ফাঁকি ইত্যাদি। এই উদ্যোগগুলি কিছুটা সরকারের নজর এড়িয়ে আর কিছুটা স্থানীয় সরকারি কর্মীদের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে এরা পার্টির প্রচ্ছন্ন আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে। এটা crony capitalism-এর মতো বিনিময়ের সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্কটা তার চেয়ে অনেক গভীর ও ব্যাপক। এই উদ্যোগপতিরা একদিকে স্থানীয় এলাকায় দলীয় কাজকর্ম সামলায়, অন্যদিকে নিজেদের ব্যবসা সামলায়। পার্টির মিছিল, মিটিং, পার্টিরকর্মীদের হাত খরচা, পার্টির স্থানীয় ঝামেলা মেটানো, এলাকায় বিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য যা করণীয় সবই এদের হাত দিয়ে হয়ে থাকে। প্রশাসনের কিছু কাজকর্মেও এরা সহায়তা দেয়। আর অন্যদিকে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে যা করতে হয়, তার কিছুটা নিজস্ব কর্মী ও কিছুটা ওই পার্টিরকর্মীদের মাধ্যমেই করে থাকে। এদের 'পার্টি-ব্যবসায়ী' বলা যেতে পারে। এই পার্টি ব্যবসার দৌলতে বেশ কিছু স্থানীয় ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়, এলাকায় সামান্য কিছু উন্নয়নের কাজও হয়ে থাকে। অর্থাৎ এলাকার অর্থনীতি ও এলাকার রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। সরকারি প্রকল্পের উপকার কে পাবে, সেটাও ক্রমশ এইসব পার্টি-ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন চলতে থাকলে সম্পর্কটার মধ্যেই একটা সংশ্লেষ হয়ে যায়, পার্টির স্থানীয় ইউনিট, কাজকর্ম, প্রভাব প্রতিপত্তি সবটাই এই পার্টি-ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়।

পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের পার্টি ব্যবসায়ীর উত্থান বামেদের হাত ধরে, কিন্তু বামেদের দলীয় শক্তি কখনওই সম্পূর্ণভাবে এই পার্টি-ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়নি। সেটা ঘটেছে তৃণমূল দলের ক্ষেত্রে। শাহজাহানরা এইভাবেই তৈরি হয়েছে। পার্টি-নির্ভর কর্মসংস্থান ও পার্টি-ব্যবসা - দুটি ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ চরিত্র আছে। দুটি ক্ষেত্রেই অসংগঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে পার্টি ব্যবস্থার একটা সম্পৃক্ত চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। এটাই পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব। এই ব্যবস্থায় যে দোকানদার সে-ই পার্টির কর্মী, যে অটোচালক সে-ই পার্টির প্রচারক, যে পার্টি ব্যবসায়ী সে-ই পার্টির স্থানীয় সংগঠক, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়ক এবং এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের নির্ধারক।

সংগঠিত শিল্পের ব্যাপক ও গভীর প্রসার ঘটলে কর্মসংস্থান, বাজার ও সাধারণভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাশটি মূলত বাজারের নিজস্ব নিয়ম এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমূলক নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীও তৈরি হয়, তারাও এই ব্যবস্থার মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। পশ্চিমবঙ্গে সেই ধরনের শিল্প-বাজার ব্যবস্থা অনেক দশক ধরেই আর উপস্থিত নেই। এই অবশিল্পায়নের ইতিহাসের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির গভীর যোগ আছে। এখানে তা আলোচনার সুযোগ নেই, কিন্তু এই অবশিল্পায়নের ফলে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান ও উদ্যোগের যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে, সেই শূন্যতায় জায়গা নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দল। এমনকি সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণী দুর্বল হয়ে যাওয়ায় শ্রমের বাজারে যে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, তারও সুযোগ নিয়েছে রাজনৈতিক দল। এই দুইয়ের সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির উপর রাজনৈতিক দলের থাবা ক্রমশ সুদৃঢ় হয়েছে। বাম আমলে সেটা হয়েছে গরিবের কর্মসংস্থানের নামে, তৃণমূল আমলেও তা চালু থেকেছে, আর সঙ্গে যোগ হয়েছে পার্টি-ব্যবসায়ীদের দাপট।

এ এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। একদিকে রাজনৈতিক দলের আর্থিক ও সমর্থন বলয়, অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান ও উদ্যোগ এই দুইয়ের সংমিশ্রণের মধ্যে সরকারের প্রশাসনতন্ত্র সংকুচিত হয়ে দুইদিকেরই লেজুড় হয়ে গেছে, সরকারটা হয়ে গেছে পার্টি ও পার্টি ব্যবসায়ীদের লেজুড়। সরকারের নিয়মতন্ত্র, নৈতিকতা, নীতি, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা চুলোয় গেছে। আর বাজারের নিজস্ব নিয়মতন্ত্রের মধ্যে যতটুকু ন্যায্যতা থাকে সেটা গেছে ঘুচে। পশ্চিমবঙ্গের অবশিল্পায়নের সবচেয়ে বড়ো স্বত্বভোগী হল রাজনৈতিক দল। আর সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হল সাধারণ মানুষ।