আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

২০১৯-এর আইন ও ২০২৪-এর বিধিঃ যতটা মুসলিম বিরোধী ততটাই উদ্বাস্তু বিরোধী

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


বঙ্গে উল্লাস ও আসামে আতঙ্ক

নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে দু’কোটি হিন্দু শরণার্থীরা, বলছেন অমিত শাহ। অতিরিক্ত একজনও যদি নাগরিকত্ব পায় আমি পদত্যাগ করব, বলছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। অর্থ বোঝা গেল? আসলে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো গল্পই নেই। সবটাই ভাঁওতাবাজী। অকারণে আনন্দে উদ্বেল হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়ারা। পশ্চিমবঙ্গের কোনো উদ্বাস্তুই এই আইনে নাগরিকত্ব পাবে না। বিজেপির নেতাদের মিথ্যে প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অনলাইন পোর্টালে নাগরিকত্বের আবেদন করে বসলে আসামের ১৯ লক্ষ এনআরসি-ছুটদের মতো অসহায় অবস্থায় পড়বেন না তারা এর নিশ্চয়তা কি সরকার দেবে? মানুষ ভাবছে এত বছর ধরে আছি, চাকরি করি, ভোট দিই, ঘর-বাড়ি আছে, রাজনীতিও করি কেউ কেউ - আমাদের কী হবে, কিচ্ছু না! আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষিত ১৯ লক্ষ মানুষও দীর্ঘদিন এই দেশের বাসিন্দা হয়ে ভোট দিয়েছে, চাকরি করেছে, ব্যবসা করেছে, ঘর-বাড়ি করেছে, তারপর একদিন কলমের এক খোঁচায় রাষ্ট্রপরিচয়হীন হয়ে গেছে। আসামের ১৯ লক্ষ এনআরসি-ছুটদের বেশিরভাগের জন্ম এদেশেই। বাংলাদেশ তারা চোখেও দেখেনি। তবু আজ তারা সব অধিকার হারিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে।

আসামের অসমীয়া জনগনের আতঙ্কটাও একেবারেই অমূলক। অসমীয়া সাধারণ মানুষের ধারণা, সিএএ-র সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে হিন্দু শরণার্থীরা এসে রাজ্যকে ভরিয়ে দেবে। কিছু নেতা এমন কথাও বলছেন যে বাংলাদেশের ১.৯ কোটি হিন্দু জনসংখ্যার পুরোটাই এরপর চলে আসবে আসামে। বাংলা ও আসামের শিক্ষিত বাঙালি ও অসমীয়াদের একটা বড় অংশও বিশ্বাস করেন যে সিএএ হয়ে যাওয়ায় এখন পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা যখন খুশি এদেশে চলে আসতে পারবে। আইনটা যে এখন যারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ বা আফগানিস্থানে রয়েছে তাদের জন্যে নয়, শুধুমাত্র ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যারা ভারতে চলে এসে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বসবাস করছে তাদের জন্যেই, সেটা তাদের জানার পরিধির মধ্যেই নেই। আইনটাকে না জেনেই বাংলায় একদল মাতছে উল্লাসে, আর আসামে অন্যরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। একদলের উল্লাস অন্যদলের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে। অথচ গোটাটাই একটা ভাঁওতাবাজী। যে আইন পাঁচ বছর আগে পাশ হল, তার বিধি প্রণয়ন করতে হল বুঝি নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসেই। এর সময় নির্বাচনটাই বলে দিচ্ছে এর সাথে নাগরিকত্বের সম্পর্ক নেই, আছে ভোটের সম্পর্ক।

যতটা মুসলিম বিরোধী, ততটাই উদ্বাস্তু বিরোধী

অনেকের ধারণা সিএএ আইনটি সম্প্রদায় হিসেবে শুধুমাত্র মুসলিমদের ক্ষতি করবে, আর কারো নয়। যারা মুসলিম বিদ্বেষী তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন যে, এতদিনে ‘ওদেরকে’ টাইট দেওয়া যাবে। ‘ওদের’ নাগরিকত্ব কেড়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। এই আইনকে শুধুমাত্র মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী মনে করাটাও শুধুমাত্র মুসলিম বিদ্বেষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। অনেক প্রগতিশীল মানুষও মনে করেন যে এই আইনটির একমাত্র অন্যায়ের দিকটি হল এর মুসলিম বিরোধী বৈশিষ্ট্য। ফলে এদের প্রতিবাদও শুধুমাত্র মুসলিম সংখ্যালঘুদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে চালিত। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। এমন ধারণা পোষণ করার একটি ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। একে শুধুমাত্র মুসলিমকেন্দ্রিক বলে ধরে নিলে পরোক্ষে ইসলামাতঙ্কের রাজনীতি উৎসাহিত হয়ে যাওয়ার ভয়ও থেকে যায়।

এই আইনের প্রথম আঘাত আসবে হিন্দু উদ্বাস্তুদের উপরই যারা এর সাহায্যে তাদের নাগরিকত্বের অনিশ্চয়তার ঘটবে ভাবছে। এর প্রধান সমস্যা হচ্ছে, আবেদন জানালেই যে নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত হয়ে যাবে, এটা এই আইন বা বিধির কোথাও লেখা নেই। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, আবেদন প্রত্যাখাত হলে আবেদনকারীর পরিচয় কী দাঁড়াবে সেটা সম্পর্কেও আইন বা বিধি সম্পূর্ণ নীরব। ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন ও ১৯৪৬-এর বিদেশি নাগরিক আইনে ২০১৫ সালে সংশোধনী এনে আফগানিস্থান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কারাবাস ও শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়ার যে ব্যবস্থা হয়েছে, সেটা আবেদন প্রত্যাখাত হওয়ার পরও বহাল থাকবে কিনা এ সম্পর্কেও আইন বা বিধি নীরব। তারপর, প্রথমত, আবেদন করার সময় আবেদনকারীকে এই হলফনামা দিতে হবে যে সে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং দ্বিতীয়ত, তাকে তিনটি নথি সঙ্গে জমা দিতে হবে। সর্বশেষে, তার এই আবেদন জেলা ও কেন্দ্রীয় এই দু’টি পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত হবে নাগরিকত্ব সম্পর্কে। আইনে বা বিধিতে সরাসরি নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। ফলে কোনো নথির যথার্থতা যদি অস্বীকৃত হয়ে আবেদন প্রত্যাখাত হয়, তখন সেই আবেদনকারীর ভয় থাকছে বন্দী শিবিরে আটক হওয়ার বা সমস্ত ধরনের নাগরিক অধিকার হারানোর।

মুসলিমদের উপর মূল আঘাত আসবে সম্ভবত জাতীয় জনপঞ্জী (এনপিআর)-এর ভিত্তিতে ভারতীয় নাগরিকদের জাতীয় পঞ্জী (এনআরআইসি) তৈরির পর্বে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চাইবে এই সুযোগে মুসলিমদের নাগরিকত্ব হরণ করার সব ধরনের সুযোগ গ্রহণের। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দ্বারা চালিত হয়ে যে কোনো ভাষাগোষ্ঠী বা ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষকেই এনআরআইসি থেকে বের করে দিয়ে নাগরিক অধিকার হরণের সুযোগ থাকছে এই আইনে। ফলে শুধুমাত্র অ-মুসলিম উদ্বাস্তু বা মুসলিম জনগোষ্ঠী নয়, এই আইনের অপপ্রয়োগে বিপদ নেমে আসতে পারে যে কোনো বৈধ ভারতীয় নাগরিকের উপরও। কীভাবে সেটা হতে পারে তা সবিস্তারে পরে আলোচিত হচ্ছে।

সিএএ ও পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু

পশ্চিমবঙ্গে কারা এই আইনের সুযোগ নিতে চাইছে?

পশ্চিমবঙ্গে এই আইনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই সমস্ত উদ্বাস্তুরা যারা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর সীমান্তের ওপার থেকে ভারতে এসেছে এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ধারা অনুযায়ী সরকারিভাবে নাগরিকত্ব অর্জন করেনি। যারা ১৯৪৮-এর ১৯ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই জন্মেছে তারা জন্মসূত্রেই ভারতীয় নাগরিক। ১৯৮৭ সালের পর যারা জন্মেছে তারা জন্মসূত্রে সরাসরি নাগরিকত্বের অধিকারী নয়। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২ ডিসেম্বর, ২০০৪ অবধি একটা আইন এবং ৩ ডিসেম্বর, ২০০৪ থেকে অন্য আইন। যারা দ্বিতীয় পর্বে জন্ম নিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব জন্মসূত্রে পেতে হলে পিতামাতার একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। তৃতীয় পর্বে ২০০৪ সালের পর যাদের জন্ম তাদের পিতামাতার একজনকে শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিক হলেই চলবে না, অপরজন যেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হয় সেটাও সুনিশ্চিত করতে হবে। নাগরিকত্ব আইনের এই পরিবর্তন একটি গুরুতর চারিত্রিক পরিবর্তন যার অভিঘাত ইতিমধ্যেই সুদূরপ্রসারী হয়ে গেছে।

নাগরিকত্ব আইনের এই জটিলতার জন্ম বাজপেয়ী সরকারের সময়ে ২০০৪ সালে আনা নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর পর। নাগরিকত্ব আইনে সেবারই প্রথম যুক্ত করা হয় 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'র বিষয়টি।

অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয় দুই ধরনের বহিরাগতদের। এক, যে সমস্ত মানুষ বর্হিরাষ্ট্র থেকে পাসপোর্ট ছাড়া এসে এ দেশে বসবাস করছে এবং দুই, যারা বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ফিরে যায়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হিসেবে আসা জনগনের যে অংশটি যুদ্ধশেষে ফিরে যায়নি বা যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে তাদের সকলেই বাজপেয়ী সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ফলে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করে এরা লেখাপড়া করছে, চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে, কেউ কেউ ভোটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক সাংসদও হচ্ছে, তবুও ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী এরা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় সেই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিকত্বের বিষয়টি এমন অনিশ্চিত পরিণতির দিকে এগোচ্ছে তাতে তিনি শুধু নীরব ছিলেন তাই নয়, যখন আসামের সংসদ সদস্যরা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে হৈচৈ বাধায় সংসদে তখন তিনিও তাতে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে। তবে এ কথা যোগ না করলে সত্যের অপলাপ হবে, যখন বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব আইনের এই মারাত্মক সংশোধনীটি সংসদে আনে তখন সংসদে সেটি সর্বসম্মতিক্রমেই পাশ হয়েছিল। এর বিপজ্জনক দিকটি কোনো রাজনৈতিক দলই সেদিন অনুধাবন করতে পারেনি। যদিও ওই সংশোধনী আনার পেছনে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সক্রিয় ছিল।

পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু রাজনীতিতে এর আগের পর্বে নাগরিকত্বের বিষয়টির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কলোনির পাট্টা ও পুনর্বাসনের বিষয়। ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন উদ্বাস্তু রাজনীতিরও গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। সমগ্র রাজনীতির সূচিমুখ হয়ে যায় নাগরিকত্বের প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মতুয়াদের এই বিক্ষোভ নিরসনের জন্যেই বাজপেয়ী সরকারের দেওয়া আঘাতের উপর মলম হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে 'নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল' আনে বিজেপি। এই প্রথম নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে ধর্মকে যুক্ত করা হল। আফগানিস্থান বা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের হিন্দুদের ঢালাও নাগরিকত্ব প্রদান হবে, এমন প্রচারের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিজেপি তাদের সমর্থনভিত্তি প্রসারিত করার উদ্যোগ নেয়। ওই একই সময়ে আসামেও ক্ষমতায় আসে বিজেপি যেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতা রয়েছে। ফলে দুটো দিকে ভারসাম্য রাখতে গিয়েই ২০১৯ থেকে ২০২৪ অবধি আইনের বিধি প্রণয়ন নিয়ে টানাপোড়েন চলে। এখন আইন বাস্তবায়নের বিধি আনা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা আসনের দিকে পাখির চোখ রেখে। কিন্তু পদ্ধতিটি এতটাই দুরূহ ও অসম্ভব করা হয়েছে যাতে প্রকৃত সুযোগ কেউই নিতে না পারে এবং আসামের অসমীয়াদের অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা এই আইন থেকে কোনো সুরাহা পাবে না। প্রথমত, তাদেরকে হলফনামা নিয়ে বলতে হবে যে তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। দ্বিতীয়ত তাদের বা তাদের পিতামাতার বাংলাদেশের সরকারি নথি দিয়ে প্রমাণ দিতে হবে তাদের বাংলাদেশে বসবাসের। তৃতীয়ত, হলফনামা দিয়ে বলতে হবে যে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হওয়া সত্ত্বেও পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি নাগরিক আইনের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার যোগ্য অর্থাৎ তিনি ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছেন। এই নথি ও হলফনামার একটিও অসত্য প্রমাণিত হলে তিনি শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবেন, এটাও বলতে হবে। এই গোটা প্রক্রিয়াটির ফলাফল নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের বিবেচনার উপর। যদি আবেদন প্রত্যাখাত হয় তখন আবেদনকারীর অবস্থান কী হবে? আইন বা বিধিতে এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই বলে কিছু হবে না এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

আসামে যারা এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাদের বর্তমান অবস্থা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আসামের এনআরসি চূড়ান্ত কিনা সেটা এখনও সরকারের তরফে জানানো হয়নি। যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা পুনর্বিবেচনার জন্যে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। কিন্তু তারা যে প্রত্যাখাত হয়েছে সেটা এখনও সরকারিভাবে জানানো হয়নি। এমনকী কী পদ্ধতিতে তারা পুনর্বিবেচনার জন্যে আবেদন করবে সে সম্পর্কিত বিধিও এখনও নির্ধারিত হয়নি। অথচ এনআরসিতে বাদ পড়তেই তাদের আধার কার্ড বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকী উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্যে। এমন মানুষের সংখ্যা ১৯ লক্ষ। এছাড়াও ৬ লক্ষ মানুষ রয়েছে যাদের নাম ভোটার তালিকায় প্রথমে ওঠেনি, পরে এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই অংশের জনগনেরও আধার কার্ড জব্দ করে রাখা হয়েছে। আসামের এই ২৬ লক্ষ মানুষ বিদেশি হিসেবে চূড়ান্তভাবে ঘোষিত না হলেও তাদের সব অধিকার হরণ করা হয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে নিজেদেরকে অ-ভারতীয় বলে হলফনামা দিয়ে যারা আবেদন করবে তাদের দশাও এমন যে হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার চেয়েও বড় কথা সমস্ত প্রয়োজনীয় নথি জোগাড় করাই তাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এই মুহূর্তে যে পোর্টাল খোলা হয়েছে সেখানে কোনো নথি জমা দেওয়ার কথা বলা নেই। কিন্তু বিধিতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে নথিপত্র জমা দেওয়ার কথা, যা পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় চেয়ে নেওয়া হবে। বিজেপি নেতারা মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে যে কাউকে কোনো নথি জমা দিতে হবে না।

আসামের এনআরসি-ছুট ও সিএএ

সিএএ আইন প্রণয়নের পেছনে যদি থাকে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া রাজনীতির চাপ, তবে এনআরসি-র পেছনে আছে আসামের অসমীয়া রাজনীতি। উনবিংশ শতক থেকেই আসামের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে অসমীয়া বাঙালি সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করা বা আসামে শিক্ষায় বা প্রশাসনে বাংলা ভাষা চালু করা কিংবা আসামে চাষবাসের উন্নতির জন্যে বঙ্গদেশ থেকে বাঙালি কৃষকদের নিয়ে এসে বসতি প্রদান করা, এ সমস্ত কিছুর বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আধুনিক আসামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে সারা দেশে একমাত্র আসামে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি হয়েছিল অসমীয়া জনগোষ্ঠীর 'বাঙালি আতঙ্কের' প্রশ্নকে মোকাবিলা করার জন্যেই। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি দশকে ভাষাকে কেন্দ্র করে আসামে যে বাঙালি বিরোধিতার রাজনীতি নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেটাই ১৯৭৯ সালে অবৈধ অনুপ্রবেশকে ঘিরে উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা নেয়। কেন্দ্রে তখন ক্ষমতায় জনতা পার্টির সরকার। সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তখন আরএসএস সারাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় রয়েছে। এই সক্রিয়তার অংশ হিসেবেই আসামের অসমীয়া বাঙালি সংঘাতের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে আরএসএস-এর। এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে তারা সুচতুরভাবে গোপনে অসমীয়া রাজনীতির বাঙালি বিদ্বেষের বৈশিষ্ট্যকে মুসলিম বিরোধিতা ও বিদ্বেষের দিকে ঘোরাতে শুরু করে। ক্রমে বাঙালি বিরোধিতার প্রশ্ন থেকে বিদেশি বিতাড়ন হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশী বিতাড়ন বা মিয়া বিতাড়ন হয়ে ওঠে আসামের জাতীয়তাবাদী অসমীয়া রাজনীতির মূল বিষয়।

অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা, ভোটার তালিকা থেকে নাম বর্জন করা এবং আসাম থেকে বহিষ্কার করা - এই তিন মূল দাবিকে কেন্দ্র করেই ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সারা আসাম উত্তাল হয়েছে আন্দোলনে বিক্ষোভে। অহিংস অসহযোগের পাশাপাশি হিংসার ঘটনাও ঘটেছে তখন। নানা স্থানে গণহত্যার ঘটনাও ঘটে। আসামে যে এনআরসি তৈরি হয়েছে তা ১৯৫১ সালের এনআরসি-র নবীকরণ বা হালনাগাদ। আসামের অসমীয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কাছে নিজেদেরকে গ্রহণযোগ্য করতে বিজেপি এনআরসি তৈরি করা নিয়ে বিরাট শোরগোল করেছিল। অন্যদিকে, উদ্বাস্তু নাগরিকদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্যে তারা প্রতিশ্রুতি প্রদান করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের। তারা উচ্চকন্ঠে প্রচার করতে থাকে যে এনআরসি থেকে যে সমস্ত মানুষ বাদ যাবে, তাদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করার জন্যে সরকার সিএএ আইন প্রণয়ন করবে। কিন্তু সিএএ আইন যে একটা ফানুস এবং সেটা যে আসামের এনআরসি-ছুট মানুষের কোনো সুরাহাই আনবে না সেটা প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজেই। তিনি খোলাখুলিই বলেছেন, যে মানুষেরা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্তির আবেদনে নিজেদেরকে ভারতীয় বলে দাবি করেছে, তারা কি এখন নিজেদেরকে বাংলাদেশী বলে হলফনামা দিয়ে আবেদন জানাবে? ফলে আসামে খুব বেশি মানুষ আবেদন করবে না। বরাক উপত্যকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক নেতাও সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, যে নথিগুলি জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা আবেদনকারীদের পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব। তাছাড়া, উদ্বাস্তু জনগণ তো পূর্ব ভারতে শুধু আসামের সমতল অঞ্চল আর পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করে না। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে সমস্ত রাজ্য ও অঞ্চলকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে সেখানেও বিপুল সংখ্যায় উদ্বাস্তুরা বাস করে। এই উদ্বাস্তুদের ভবিষ্যৎ একই অনিশ্চয়তায় রয়ে গেল সিএএ আসার পরও।

এখন বরং বিপদ আরো বাড়বে। যেহেতু ওই অঞ্চলগুলি সিএএ-এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে, ফলে ওখানে নতুন করে উদ্বাস্তু বিরোধী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়ে অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে। দাবি উঠতে পারে ওই অঞ্চলগুলি থেকে সমস্ত উদ্বাস্তু জনগণের উচ্ছেদ ও অপসারণের। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ থেকে আসা কোনো উদ্বাস্তুকেই নাগরিকত্ব দেবে না এই আইন। মুখে যতই বড় বড় কথা বলুন বিজেপির নেতারা, এই আইনে প্রথম সর্বনাশটি নেমে আসবে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ওপরই। এই সহজ সত্যটি এই আইনের সমর্থক বিজেপির অনুগামীরা বুঝছে না, কারণ তারা নিজেদের দলের বিষয়ে অন্ধ। তাদের ধারণা গরিব ধনী নির্বিশেষ সব হিন্দুর ত্রাণকর্তা বিজেপিই। তারা শুধু বিশ্বাসে নয়, দৃষ্টিশক্তিতেও অন্ধ। তারা দেখেও দেখছে না যে কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকার থাকা সত্ত্বেও আসামে ১৯ লক্ষ অবৈধভাবে ঘোষিত মানুষদের ১২ লক্ষই হিন্দু। আরো ৬ লক্ষ যে মানুষকে কার্যত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা দেওয়া হয়ে গেছে তাদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীই।

সিএএ, এনআরপি, এনআরসি - সর্বভারতীয় রাজনীতি

গত শতকের নয়ের দশকের শেষে যখন পরপর দু’বার প্রথমে ১৩ দিন ও পরে ১৩ মাসের অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের পতন ঘটে, তখন একটি সাক্ষাৎকারে এক আরএসএস কর্তা বলেছিলেন, আমরা ৯৬ বা ৯৮ নিয়ে ভাবছি না। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে ২০২৫ সালে যে বছরটি আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। আমরা সেই সময়ে ভারতে একটি হিন্দুত্বের শক্তির সরকার দেখতে চাই যারা আরএসএস-এর স্বপ্ন পূরণ করবে।

জন্মলগ্নের পর থেকেই আরএসএস ভারতকে 'হিন্দুরাষ্ট্র' হিসেবে গড়ে তুলতে চায় যেখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা হয় ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দুধর্মে ফিরবে আর নয়ত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে হিন্দুদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য মেনে নিয়ে বাস করবে। এ বিষয়ে তাদের আদর্শ ছিল ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের শাসন। আরএসএস নেতা স্বচক্ষে ফ্যাসিবাদী ও নাৎসীবাদী সমাজ দেখতে ইতালি ও জার্মানি সফরেও গিয়েছিলেন। জার্মান রক্তের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বন্দী শিবিরে প্রেরণ করতে ১৯৩৩ সালে 'সিটিজেনশিপ ও ডিন্যাচারেলাইজেশন ল' ও ১৯৩৫ সালে প্রণয়ন করা হয় 'ন্যুরেমবার্গ ল'।

গোলওয়ালকার তখন বলেছিলেন, “German national pride has now become the topic of the day. To keep up the purity of the nation and its culture, Germany shocked the world by her purging the country of the Semitic races - the Jews. National pride at its highest has been manifested here. Germany has also shown how well-nigh impossible it is for races and cultures, having differences going to the mot [?], to be assimilated into one united whole, a good lesson for us in Hindustan to learn and profit by. (Nagpur, 1939, p. 37).” তিনি আরো বলেছিলেন, “in one word, they [Muslims] must cease to be foreigners or may stay in the country wholly subordinated to the Hindu nation claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment, not even citizen’s rights. (opcit, p. 52). গত শতকের আটের দশকে আসামের ভাষিক সংঘাতের রাজনীতির মধ্যে আরএসএস তাদের সর্বভারতীয় লক্ষ্যপূরণের একটি পথ দেখতে পেয়েছিল। পরপর দু’বার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ী যখন পূর্ণ মেয়াদের সরকার চালান, তখনই আসামে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মুসলিমদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে সারা দেশে নানা স্তর থেকে হৈচৈ শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের অসত্য ও বিকৃত তথ্যের মাধ্যমে একটা কৃত্রিম আতঙ্কের সৃষ্টি করা হয়। আসাম সহ উত্তরপূর্ব ভারতের রাজনীতি বাংলাদেশী জুজুকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে দ্রুত এগোতে থাকে। আসামের নানা জায়গায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উপর শারীরিক হেনস্থা ও আক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের নানা শহরে বঙ্গভাষী মুসলিম মাত্রকেi বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করে হেনস্থার ঘটনা শুরু হয়। নানা স্থানে আক্রান্ত হতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, বীরভূম, ২৪ পরগণা, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে কাজের সন্ধানে যাওয়া মানুষেরা। এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশেই ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আনে বাজপেয়ী সরকার। একদিকে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির শর্তাবলীর মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর ধারণা যুক্ত করা এবং দেশে নাগরিক পরিচয়পত্র চালু করার জন্যে এনপিআর (জাতীয় জনপঞ্জী) ও এনআরআইসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী) তৈরির আইনী বিধি আনা হয়। ভারতীয় মূলের বিদেশি নাগরিকদের জন্যে সাগরপারের ভারতীয় নাগরিকপত্র বা 'ওভারসিজ সিটিজেন কার্ড' প্রবর্তন করা হয়।

দুঃখের বিষয়, এই আইন প্রণয়ন যে আরএসএস-এর দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গ সেটা সেদিন ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলই অনুধাবন করতে পারেনি। বামপন্থীরাও না। নাগরিকত্বের দু’টি ধরন আছে। একটি জন্মসূত্রে (Jui Soli) এবং অন্যটি রক্তসূত্রে (Jui Sanguinis)। প্রথমটি ধর্মনিরপেক্ষ বিধি, দ্বিতীয়টি ধর্ম বা গোত্রকেন্দ্রিক। ১৯৫০ সালের সংবিধান ও ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন ভারতের নাগরিকত্বের ধারণাটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের উপর স্থাপন করেছিল। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা স্বাধীনতার আগে থেকেই চেয়েছে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি নাৎসী আদর্শের জাতি বা ধর্মকেন্দ্রিক করতে। ভারতের সংবিধান গণপরিষদে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থাকা হিন্দুত্বপন্থীরাও নাগরিকত্বের প্রশ্নে মুসলিমদের সমতা দেওয়ার বিরোধিতা করেছিল। ১৯৮৭ ও ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নাগরিকত্বের আইনকে হিন্দুত্ববাদীদের মূল লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার পথকেই সুগম করেছে।

ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জায়নবাদীরাও নাগরিকত্বের প্রশ্নে হিটলারের নিয়ম মেনেই রক্তসূত্রে নাগরিকত্বের ধারণাকে গ্রহণ করেছে। বিশ্বের নানা দেশের ইহুদিদের ইজরায়েল রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নাগরিক হওয়ার অধিকার প্রদান আর ভারতের 'ওভারসিজ ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ কার্ড'-এর ধারণা অভিন্ন আদর্শেরই প্রতিফলন। আরএসএস-এর দ্বিচারিতার নীতি অদ্ভুত। ইহুদি হত্যকারী হিটলারও তাদের উপাস্য, আবার ইজরায়েল রাষ্ট্রও তাদের কাছে আদর্শ রাষ্ট্র। আসামের এনআরসি এবং ২০০৪ সালের আইনের এনআরআইসি সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি ধারণা। আসামে ১৯৫১ সালে এনআরসি হয়েছিল সেখানকার আইন, বিধি ও বাস্তবতা অনুযায়ী। সম্প্রতি যে এনআরসি তৈরি হয়েছে সেটা ১৯৫১ সালের এনআরসি-র নবীকরণ যা করা হয়েছে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্র ও আসামের আন্দোলনকারীদের মধ্যে সম্পাদিত আসাম চুক্তি ও ১৯৮৭ ও ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী। আসামে সমস্ত বাসিন্দাদের এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করতে হয়েছে। সেখানে ভিত্তিবর্ষ ও তারিখ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। নাগরিকত্ব নির্ধারণে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখকে ভিত্তি ধরার বিষয়টি একান্তভাবেই শুধুমাত্র আসামে সীমাবদ্ধ। এই তারিখটি নিয়ে আসাম চুক্তিতে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই তারিখ বেছে নেওয়ার কারণ ১৯৭২ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। সেই চুক্তিতে এটা ধরে নেওয়া হয় যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যারা ভারতে এসেছে তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আসা অস্থায়ী শরণার্থী যাদের যুদ্ধশেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন বাঞ্ছনীয়। এর আগে যারা এসেছে তারা ভারতে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নিতেই এসেছে তাই তাদের নাগরিকত্ব প্রাপ্য।

২০০৪-এর নাগরিকত্ব আইন পাকিস্তান থেকে আসা নথিপত্রহীন সমস্ত মানুষকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিয়েছে যা স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত সরকারের নীতিবিরুদ্ধ। সারা ভারতে এনআরআইসি তৈরি হবে প্রাথমিকভাবে ভোটার তালিকায় নাম থাকা মানুষদের নিয়ে তৈরি এনপিআর-এর ঝাড়াই বাছাইয়ের মাধ্যমে। আসামে যেমন প্রত্যেক ভোটারকে নথিপত্র জমা দিতে হয়েছে, সারা ভারতে এনআরআইসি তৈরিতে সমস্ত নাগরিককে নথিপত্র জমা দিতে হবে না। যাদের নামের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ বা জনগণের তরফ থেকে আপত্তি উঠবে শুধুমাত্র তাদেরকেই নথিপত্র জমা দিয়ে নিজের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ভিত্তিবর্ষ ও তারিখ ১৯৪৮-এর ১৯ জুলাই। ২০০৪-এর আইন প্রয়োগ করে যখন ঝাড়াই বাছাই হবে তখন নথির অভাবে বাদ যাওয়া মানুষেরা পরিণত হবে স্থায়ীভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে। শুধু তারাই নয় আইন অনুযায়ী তাদের পরবর্তী প্রজন্মও অবৈধই থেকে যাবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠলে আপত্তি জানানোর নিশানা হয়ে উঠবে দরিদ্র মুসলিম ও খ্রিস্টানরা যাদের অনেকেরই হয়ত জমিজমার দলিল বা শিক্ষাদীক্ষা সংক্রান্ত দলিল নেই নিজের ভৌগোলিক অবস্থান প্রমাণের। গুজরাট উত্তরপ্রদেশের দরিদ্র মুসলিম ও মনিপুরের কুকিরা হবে এর অসহায় শিকার। বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরাও বাদ যাবে না কারণ সিএএ-র জটিল প্রক্রিয়া তাদের পথেও বড় বাধা হয়ে আসবে।

সমাধান কোথায়

সমাধান সম্পর্কে ভাবতে গেলে আগে কোন সমস্যার মুখোমুখি আমরা সে বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। আমরা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে সামনে রেখে সমস্যার স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করতে পারি। পশ্চিমবঙ্গে বিষয়টি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের। আর আসামের রাজনীতির মূল প্রশ্ন বহিরাগমন বন্ধ করা ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা। দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক বিষয়। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা নয়। আসাম সহ উত্তরপূর্ব ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যে উদ্বাস্তুরা রয়েছে। উদ্বাস্তু মানে শুধু অ-মুসলিম বাঙালিও নয়, আর এই তিনটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষরাও নয়। ভারতে উদ্বাস্তুদের মধ্যে আছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চাকমারা, মায়ানমারের খ্রিস্টান কুকি বা চিন জনগোষ্ঠীর মানুষ, আরাকানের রোহিঙ্গিয়ারা সহ আরো অন্য দেশ থেকে আসা মানুষেরা। কেউ এসেছে আক্রান্ত হয়ে পালিয়ে, কেউ অর্থনৈতিক কারণে ভাগ্যান্বেষণে। জনবিন্যাসের পরিবর্তনের আতঙ্ক ও ভাষা সংস্কৃতি হারানোর ভয় বিভিন্ন দেশে জাতিবিদ্বেষী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। হিটলার মুসোলিনির উত্থানও এই রাজনীতি থেকে। গৃহযুদ্ধ বা আন্তঃসীমান্ত যুদ্ধের পরিস্থিতি ছাড়া ব্যাপকহারে বহিরাগমনের ঘটনা ঘটে না। সেই পরিস্থিতির অবসান হলে কোনো দেশেই দেশান্তরী মানুষের সমগ্র অংশ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে না। একটা অংশ থেকে যায়।

অখণ্ড ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে মানুষের স্থানান্তরের মত পশ্চিমী বিশ্বেও যদি অভিবাসনকে দেখা হতো, তবে কোনো এশীয় বা ভারতীয় উপমহাদেশ বংশোদ্ভূত বা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠীর বংশধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি কিংবা ইউরোপীয় দেশের সাংসদ, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতো না। প্রজন্মের পর প্রজন্মের স্থান হতো ডিটেনশন ক্যাম্পে বা ন্যূনতম মানবাধিকারবিহীন ভাসমান অবৈধ অধিবাসী হিসেবে।

আজকের বিশ্বে যখন পুঁজি ও পণ্য দেশ থেকে দেশান্তরে অবারিত হচ্ছে, তখন মানব সমাজের সঞ্চরণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করে শ্রমের বিশ্বায়ন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। উদারবাদী অর্থনীতির পরিমণ্ডলে পৃথিবীর দেশে দেশেই ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলন গড়ে উঠছে। আসামের ১৯ লক্ষ এনআরসি-ছুটদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এই দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করতে হবে। আমরা বৈধ অবৈধ নির্বিশেষে সকল রকমের ভারতীয়দের ইউরোপ আমেরিকায় অভিবাসনের বৈধতা চাইব, আর অখণ্ড ভারতের এক অংশের মানুষের উপমহাদেশের মধ্যেকার চলাচলকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করব, তা হতে পারে না। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনেই আশ্রয়প্রার্থী বহিরাগতদের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যবস্থা রয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করারও। আসামে অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতি তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বিপন্ন হয়নি, বরং তার বিচিত্রমুখী সমৃদ্ধি ঘটেছে। ভাষা সংস্কৃতির সংরক্ষণের সাথে জন চলাচলের বিষয়টিকে যুক্ত করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শরণার্থীদের প্রতি মানবিক হয়েও ভাষা সংস্কৃতি রক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। ফলে শুধু সিএএ-র মতো অকার্যকর অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক আইন প্রত্যাহার নয়, ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব আইনটিকে বাতিল করে নাগরিকদের সচিত্র পরিচয়পত্র প্রদানের নতুন ব্যবস্থা করতে হবে নতুন আইনের মাধ্যমে। সকল সভ্য দেশে অনুসৃত নীতির মত ভারতেও জন্মসূত্রে সকল শিশুর ভারতীয় নাগরিকত্বকে শর্তহীন করতে হবে। জন্মগ্রহণ করার আগেই একটি শিশুর উপর অপরাধী পরিচয় এঁকে দেওয়ার বর্বর নীতি বর্জন করতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।