আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০
সমসাময়িক
একটি মস্ত ও মেদপ্রবণ ভারতীয় বিবাহ
খেয়াল করলে দেখবেন, লাইক দিয়েছেন বা দেননি, কমেন্ট করেছেন বা করেননি, আপনার ফেসবুকের নিজস্ব পরিসর দেশের তথা এশিয়ার সর্ববৃহৎ ভারতীয় ধনী পরিবারের জাঁকালো বিয়ের রিলস ও ছবিতে উদ্বেলিত।
অবশ্য, এটি কোনো জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান নয়। প্রি-ওয়েডিং মাত্র। বিবাহ-পূর্ব অনুষ্ঠান।
ফেসবুক পেজ-এ রিলস ও ছবি, মুদ্রিত ও সমাজমাধ্যমে কেজি কেজি পাথর সহ (হিরা-পান্না) নিরাবয়ব মায়ের আভরণপূর্ণ মাপা হাসি, রাজপুত্রের 'জীবন সংগ্রাম' ও তার ভানতারা - একবিংশ শতকে মহারাজের দেশে নিজস্ব বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, পৃথিবীর ধনী ও খ্যাতনামাদের দেশের পশ্চিম উপকূলে আগমন - রাজপুত্রের ঘড়ি দেখে (নাকি) অভিভূত বিশ্বের সেরা ধনীরা, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো শান্ত ছোট্ট শহরে সদ্য গজিয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধনী ও খ্যাতনামাদের নিজস্ব বিমানে আগমন, তা নিয়ে কয়েক মাস জুড়ে সংবাদপত্রে ছোটো ছোটো প্রচার বিজ্ঞাপন - দেখেশুনে জনগণ বিহ্বল। মুখ একেবারে হাঁ হয়ে গেছে। আর সেই হাঁ-তে হিরে মানিক, হাতি, ঘড়ি, পূজা, লাড্ডু বিতরণ - সব ঢুকে যাচ্ছে।
৬০ কোটি স্মার্ট ফোনের অধিকারী ভারতীয় রাজবাড়ির বর্ণোজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো বিয়ে আনন্দের সঙ্গে দেখেছেন, নিজেরাও পরিবেশন করেছেন সেইসব মাপা হাসির, সাজানো কথার অনন্ত ছবির ভাণ্ডার। ফেসবুকে ঘুরছে কিছু ‘সংগৃহিত’ কপি-পেস্ট পোস্ট। হিংসে কোরো না, ক্ষুব্ধ হয়ো না, ঐশ্বরিক আশীর্বাদের অপেক্ষায় থাকো।
সাংবাদিকরাও মুগ্ধ; তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্কুপ খবর পরিবেশন করতে। অবশ্য এই সংবাদিকরাও অম্বানিদের টাকায় জামনগর গেছেন বিয়ের (থুড়ি, বিবাহ-পূর্ব) খবর পরিবেশনের জন্য। বড়ো মিডিয়া গ্রুপের মধ্যে 'দি হিন্দু' ছাড়া আর সব সংবাদ সংস্থা রাজার টাকায় কৌশলী বার্তা ও চুটকি লিখে রাজপরিবার এমনকী দেশের জনগণের মিনি মাগনায় মনোরঞ্জন করেছে। নকীব, ঘোষক - স্ক্রিপ্টেড লেখনি।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের চতুর্থ পিলার।
এত বেলাগাম জাঁক ও আড়ম্বর এই দরিদ্র দেশে দেখানোর প্রয়োজন আছে? বেশ করেছে দেখিয়েছে। ওদের আছে, দেখিয়েছে, তোমার মেয়ের বিয়েতে আড়ম্বর করো না? ওর বেশি আছে তাই বেশি আড়ম্বর করছে। তুমি কি গরীব মানুষের কথা ভেবে নুন দিয়ে ভাত খাও?
অনেকের কাছে প্রশ্ন রাখলে, আজ এই উত্তর আসছে। দেশ, সমাজ, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। ৬০ কোটি স্মার্ট ফোন ও নেটসমৃদ্ধ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়া হচ্ছে।
হয়তো একদিন আমারও হবে, ঈশ্বরের কৃপাতে সবই সম্ভব। অনন্ত অম্বানিও ঈশ্বরের মার থেকে রক্ষা পায় না। আপাতত নিজের বিয়েতেও যতটা সম্ভব মজা লুটে নিই। তিনদিনের বিয়ে সাত দিন ধরে করি।
পৃথিবীর বৃহৎ ধনীরা দেশের পশ্চিম কোণের শান্ত নির্জন নিরিবিলি শহরে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের পরশে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক জামনগর বিমানবন্দরে নিজস্ব বিমান থেকে অবতরণ করছে - এ এক দেখার মতো দৃশ্য। সাংবাদিকদের সময় কোথায় সেই আলাদিনের প্রদীপের খোঁজ করার। বরং সেই সময়ে নিজ হস্তে খাদ্য বিতরণ, ধনীর পারিবারিক সুখ, রানীর সাধারণের সঙ্গে কথা - এসব অনেক মজাদার, জবর লাগে দেখতে। সাধারণ কর্মী নারীদের বাড়ানো হাত রানী না ধরে সরিয়ে নিলেন নিজের হাত এই দৃশ্য কারো চোখে পড়ে না। বললে শুনতে হবে, বেশ করেছে ইত্যাদি।
সারা পৃথিবীর ৫০ শতাংশ সম্পদ আছে ১ শতাংশ ধনবানের কাছে। ২০২৩ সালে দেখা গেছে শেষ দুই বছরে যত সম্পদ তৈরি হয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশ গেছে ওই ১ শতাংশ ধনীর কাছে। এই সম্পদ আসলে নিচের ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদের সমান। এই অতি বৃহৎ ভারতীয় ধনীদের সম্পদ আমেরিকার বৃহৎ ধনীদের থেকেও বেশি। ওই ৯৯ শতাংশে আমিও আছি, আপনিও আছেন, 'বেশ করেছে'রাও আছেন। পৃথিবীর সম্পত্তিবানদের কাছে, আমি আর আপনি আর 'বেশ করেছে'রা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়দের সমগোত্রীয় অসম পৃথিবী। বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ভারতে এই অসাম্য আরো অনেক বেশি। আমেরিকাতে তবু বিপুল ধনীদের এক অংশ নিজের সম্পদের ৫০ শতাংশ পরহিতব্রতে দান করবার অঙ্গীকার নিয়েছেন। ভারতে সেই সংখ্যাও খুবই ক্ষুদ্র। সম্পদ আগেও ছিল মুষ্টিমেয়র হাতে, এখনো তাই আছে। ফারাক বেড়েছে, সেই কুৎসিত বৈষম্যকে ঢেকে দেয় জুলুশ, বিজ্ঞাপন, 'জীবন সংগ্রাম'। সঙ্গে আছে সংবাদপত্র, সঙ্গে আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। তাই আমি আপনি, দেশের মানুষ একাত্মতা বোধ করি তাদের সঙ্গে।
তারা খুশি। লাড্ডু খেয়ে পেল্লায় সম্পদ ও তার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাহীন জনগণ খুশি, দেশের অর্ধেক মানুষ খুশি। খেল খতম।