আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০
সমসাময়িক
প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে বহ্নিশিখা
মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা থেকে আউং সাং সু চি নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে। তখন হয়তো সামরিক জুন্টা সরকারের মনে হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী আন্দোলন কয়েক মাসের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়বে। জুন্টা সরকারের অনুমান ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত। ইতিমধ্যে তিন বছর অতিক্রান্ত। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের যৌথ অভিযানে সামরিক জুন্টা সরকারের আসন এখন টলমল করছে। বস্তুত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সীমান্তবর্তী বহু অঞ্চলই এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে। মায়ানমারের এ-হেন ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নিঃসন্দেহে ভারতেরও উদ্বেগের কারণ।
তিন বছর ধরে চলতে থাকা জুন্টা সরকারের এখন কোণঠাসা অবস্থা। মায়ানমারের বিদ্রোহী তিন গোষ্ঠীর জোট 'ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স', গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী আউং সান সু চি-র সমর্থক স্বঘোষিত সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’-এর সশস্ত্র বাহিনী ‘পিপলস্ ডিফেন্স ফোর্স’ (পিডিএফ) এবং রাখাইন প্রদেশে সক্রিয় সশস্ত্র জনজাতি বাহিনী 'আরাকান আর্মি'-র সাম্প্রতিক আক্রমণে বাংলাদেশের কক্সবাজার লাগোয়া মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা দখলের পাশাপাশি জুন্টা সরকারের বাহিনীর অন্তত ৮০ জন অফিসার এবং জওয়ান নিহত হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে বেশ কিছু সেনা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর। বিদ্রোহী আরাকান আর্মি এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, লড়াইয়ে নিহত সেনাদের পাশাপাশি বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করেছে তারা। দখল করেছে রামরি দ্বীপের মূল শহর এবং আশপাশের সব গ্রামগুলি। প্রসঙ্গত, মায়ানমারের তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী - ‘তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ), ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এবং ‘মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ)-র জোট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স’ নভেম্বর ২০২২ থেকে সে দেশের সামরিক জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। ওই অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন ১০২৭’।
পরবর্তী সময়ে জুন্টা-বিরোধী যুদ্ধে শামিল হয় আরাকান আর্মি, ‘চিন ন্যাশনাল আর্মি’ (সিএনএ) এবং ‘চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স’ (সিডিএফ), ‘কাচিন লিবারেশন ডিফেন্স ফোর্স’ (কেএলডিএফ)-এর মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিও। জুন্টা বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘শান স্টেট প্রোগ্রেস পার্টি’ বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বিদ্রোহীদের আক্রমণের জেরে ইতিমধ্যেই সে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা সরকারি সেনার হাতছাড়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সে দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’র সমর্থক পিডিএফ-এর ‘সক্রিয়তা’ জুন্টা সরকারের সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। তিন বছরের সেনা জুন্টার সরকার এই প্রথম এত বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হল।
পড়শি রাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের আঁচ ছড়িয়েছে মণিপুরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও। অশান্তির পর্বে মাদক, অস্ত্র চোরাচালানের পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্ত পেরিয়ে মায়ানমারের পলাতক সেনাবাহিনী সহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ প্রচারিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত - মায়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ ১,৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের বেড়ায় মুড়িয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি বাতিল করা হবে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ (এফআরএম)-ও।
দীর্ঘকাল ধরেই ভারত-মায়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তের উভয়দিকে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারীদের পারাপার করতে কোনও ভিসা লাগে না, যা 'এফআরএম' নামে পরিচিত। এইসব এলাকায় এমন অনেক বসতভিটা রয়েছে যার রান্নাঘর ও খাওয়ার ঘর দুই দেশের মাটিতে অবস্থিত। এছাড়া স্থানীয় বাণিজ্যে সহায়তার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার স্বার্থে দুই দেশের সম্মতিতেই 'এফআরএম' চালু করা হয়েছিল।
প্রধানত নাগা, কুকি-জো, মিজোদের অঞ্চলে এবং পূর্ব অরুণাচলে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বেড়া বসানোর কথা। এই জনজাতিরা বিষয়টিতে বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ। মণিপুর এবং মিজোরামের কুকি জনজাতিদের সঙ্গে মায়ানমারের চিন সম্প্রদায়ের জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে। সীমান্ত বন্ধের জেরে সেই যোগাযোগ ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলে আশঙ্কা। অন্যদিকে, এটি যদি শুধু মণিপুরে প্রয়োগ করা হয়, তবে সে রাজ্যে কুকি-জো সম্প্রদায়ের জমি অধিগ্রহণ বিতর্কাগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়তে পারে।
এরই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে দীর্ঘদিন ধরেই নাগাল্যান্ডও কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত নানান সমস্যায় জর্জরিত। বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ দিনের আলোচনার ফল এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া যায় যে যথাযথ সমাধান এখনও অধরা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন রাজ্য 'পূর্ব নাগাল্যান্ড' গড়ার দাবি। মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পূর্ব নাগাল্যান্ডের ছ’টি জেলা - মন, তুয়েনসাং, কিফিরে, নোকলক, লংলেং এবং শামাতোরকে নিয়ে নতুন রাজ্য গড়ার দাবিতে কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ওই এলাকায় বসবাসকারী সাতটি জনজাতি গোষ্ঠীর যুক্তমঞ্চ ‘ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন’ (ইএনপিও)। দাবি আদায়ের জন্য ‘জনতার জরুরি অবস্থা’ পালন করা হয়েছে। বন্ধের ডাকও দেওয়া হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে ইএনপিও হুঁশিয়ারি দিয়েছে তাদের দাবি না মানলে লোকসভা ভোট বয়কট করা হবে। তবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য ভাগের দাবিতে বিধানসভা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ইএনপিও নেতৃত্ব। তাঁদের ওই পদক্ষেপের কারণ ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। সে সময় নাগাল্যান্ডে ভোট প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এনডিপিপি-বিজেপি জোট ক্ষমতায় ফিরলে সমস্যার ‘ইতিবাচক সমাধান’ হবে। কিন্তু গত এক বছরে কোনও উদ্যোগ না দেখে নতুন করে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে পূর্ব নাগাল্যান্ডে। আন্দোলন পরিচালনা করছেন মায়ানমার ও পূর্ব নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী কন্যাখ নাগা জনগোষ্ঠীর নেতারা। অন্যদিকে, রাজধানী কোহিমা-সহ পশ্চিম ও মধ্য নাগাল্যান্ডের মূল বাসিন্দা টাংখুল নাগারা পৃথক রাজ্যের বিরোধী।
বিরোধীদের দাবি, নব্বইয়ের দশকে উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে জেলাভিত্তিক দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও গত দশ বছরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধু কোহিমা-ডিমাপুর অঞ্চলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর সেই বঞ্চনা থেকেই উঠে এসেছে পৃথক রাজ্যের দাবি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসাম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি মিললেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদেরও। এই পরিস্থিতিতে মণিপুরের পরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আর এক রাজ্যে হিংসা ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ছড়িয়েছে।
মায়ানমারে চিনের প্রভাব প্রশমিত করতে ভারত অনেকদিন ধরেই পরিকাঠামোগত বেশ কয়েকটি প্রকল্প গড়ে তুলতে চায়। যেসব অঞ্চল বিদ্রোহীদের কবলে, সেখানকার প্রকল্পগুলি এখন অনিশ্চয়তার মুখে। মিজোরামের কালাদান নদীর উৎস থেকে মায়ানমারের সিত্তোই বন্দর পর্যন্ত যে জলপথ উন্নয়ন প্রকল্প ২০০৫-এ ভারত সরকারের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত অসমাপ্ত। প্রকল্প ব্যয় নির্ধারিত হয়েছিল ৪ হাজার ৮৪০ লক্ষ ডলার। জলপথ উন্নয়নের টাকা শেষ পর্যন্ত জলে যাবে কিনা সেটাও এখন চিন্তার বিষয়। মায়ানমারের পূর্বাঞ্চলের অস্থির পরিস্থিতিতে এফআরএম বা সীমান্ত বন্ধের পদক্ষেপ এ পারের জনজাতি গোষ্ঠীকে যেন দেশের বিরুদ্ধে না দাঁড় করায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার।
গোষ্ঠী সংঘর্ষে জর্জরিত মণিপুরের মাটিতে গত এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাত্র একবার গেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দেশ-বিদেশে হাজারো কাজ। মণিপুরে যাওয়া তো দূরের কথা মণিপুরের বিষয়ে আলোচনা করারও সময় নেই। মন্ত্রীদের কথা বাদ দিলেও, সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? বরং শাসকদলের বিধায়কদের অনেকেই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে বিরক্ত। নাগাল্যান্ড সরকারিভাবে বেড়া বসানোর প্রস্তাবে আপত্তি না জানালেও ঠারেঠুরে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। মিজোরাম তো সরাসরিই আপত্তি জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারগুলি ও স্থানীয় জনজাতির সঙ্গে আলোচনা না করে ১,৬৪৩ কিলোমিটার বিস্তৃত ধসপ্রবণ পার্বত্য এবং জঙ্গলঘেরা অঞ্চলে বেড়া নির্মাণ শুরু করলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়ার বিষয়ে আগাম সতর্ক হওয়া দরকার। বেড়া বসানোর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। নিয়মকানুন মেনে নির্মাণকারী সংস্থাকে নিযুক্ত করতে পারে। দেশের নামী নির্মাণকারী সংস্থাও দায়িত্ব পালন করতে পারে। হাজার হলেও কয়েক লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প। অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বাছাই করা দক্ষ শ্রমিকদেরও হয়তো সীমান্তে পাঠানো হবে। সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে নিশ্চয়ই বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, আসাম রাইফেলস্ ইত্যাদি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নির্মাণ স্থলে মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হবে। ইস্পাত-সিমেন্ট ও আনুষঙ্গিক উপকরণ সীমান্তের দুর্গম এলাকায় পৌঁছে দেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তা-ও হয়তো হয়ে যাবে। এবং শেষ পর্যন্ত প্রকল্প হয়তো বাস্তবায়িতও হবে।
এমন একটি সুস্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকাঠামোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, নজরদারির জন্য এক দিকে যেমন অর্থক্ষয় হবে, তেমনই ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে অঞ্চলগুলি পরিবেশগত ক্ষতির শিকার হবে। তবে প্রকল্পে নিযুক্ত নির্মাণকারী সংস্থার সম্পদ-সমৃদ্ধি বেড়া বসানোর সুবাদে যে অনেকটাই বেড়ে যাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বেড়া বসিয়েও শেষ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান ঠেকানো যাবে কি না, সে প্রশ্নও থাকছে।
এ-যাবৎ নিজেদের স্বার্থেই জুন্টা সরকারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে ভারত সরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অঙ্কটিকে পুনরায় নতুন করে কষতে হবে। অন্যথায় বেড়া বাঁধার কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করে কাজের কাজ কিছুই হবে না।