আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৪ ● ৩-১৮ চৈত্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

অর্থ ও রাজনীতি


যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্র মৌলিক যে ধারণার উপরে অবস্থিত তা হল, ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’। অর্থাৎ, আপনি টাটা-বিড়লা-আম্বানি হলেও আপনার একটি ভোট, আবার অন্য কেউ গরীব কৃষক হলেও তারও একটি ভোট। অতএব সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে একটি সাম্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপিত হয় একটি দেশের সার্বিক অর্থব্যবস্থা ও সমাজের ভিত্তিতে, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই অসাম্য এবং বৈষম্য গভীরভাবে বর্তমান। ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে এই দেশে গরীব ও ধনীর মধ্যে ফারাক বেড়ে চলেছে, জাতিভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আজও প্রবলভাবে বিরাজমান। সংবিধান পরিষদে প্রদত্ত শেষ ভাষণে বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, এই নতুন সংবিধানের মাধ্যমে আমরা একটি দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থানে বসবাস করতে চলেছি। একদিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্য থাকবে যেখানে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতি গৃহীত হবে, কিন্তু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে বৈষম্যে থেকেই যাবে, যেখানে এক ব্যক্তি এক মূল্য নীতি লঙ্ঘিত হবে বারবার (বাবাসাহেবের বক্তৃতার সারসংক্ষেপ)।

অতএব আমরা যখন ভোট দিতে যাই, নিজেদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে ভোট দিই, আমাদের মনে একটি ধারণা থাকে যেন সমস্ত প্রার্থীই একই আসনে রয়েছে, কেউ আগে থেকে এগিয়ে নেই। বরং আমার ভোটের মাধ্যমেই কোনো প্রার্থী জিতবে বা হারবে। অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্বের যে ধারণা সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছে তা নিশ্চিত হতে পারে একমাত্র যদি সমস্ত প্রার্থী এবং দলই একই বিন্দু থেকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।

স্বাভাবিকভাবেই তা হয় না। দেশে যেহেতু শ্রেণি বিভাজন রয়েছে, অতএব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির নেপথ্যে কোনো না কোনো শ্রেণির সমর্থন রয়েছে, অর্থ রয়েছে। তাই বড় পুঁজিপতি বরাবরই দেশের শাসকদলগুলিকে সমর্থন করে এসেছে। তাদের টাকায় বলীয়ান হয়ে বরাবরই ভারতের শাসক দলগুলি মূলত শাসকশ্রেণির হয়েই তাদের নীতি প্রণয়ন করেছে। কোনো কোনো সময়ে ভোটের খাতিরে গরীবের জন্যও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু মৌলিকভাবে দেশের সরকারের নীতির অভিমুখ রয়ে গিয়েছে ধনীদের সুবিধাপ্রদানে নিয়োজিত।

কিন্তু নির্বাচনী বন্ড এই প্রচলিত বৈষম্যের মধ্যে নতুন উপাদান এনেছে। প্রথমত, যখন এক ব্যক্তি ভোট দিতে যাচ্ছে তখন সে বিভিন্ন দল তথা সরকারের নীতিসমূহের তুল্যমূল্য বিচার করে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে এটাই দস্তুর। কিন্তু যদি এমন হয় যে সেই নীতিগুলি তৈরি করা হচ্ছে টাকার বিনিময়ে? অর্থাৎ বড় বড় শিল্পপতিরা কোনো দলকে টাকা দিয়ে বলবে যে এই নীতি গ্রহণ করো এবং জনগণ তা জানতে না পেরে যদি ভোট দেয় তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই আঘাত হানা হয়। যেহেতু নির্বাচনী বন্ডের মধ্য দিয়ে সরকারীভাবে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দেওয়া যায়, সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে, তাহলে নীতিসমূহ তৈরির নেপথ্যে যে টাকার খেলা চলছে তা জনগণের থেকে গোপন রেখে তাদের বোকা বানানো যায়। দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলে যে নির্বাচনী বন্ড দেশের ভোটদাতাদের তথ্যের অধিকারকে লঙ্ঘন করছে অতএব তা সংবিধান বিরোধী। দেশের নীতিসমূহকে টাকার বিনিময়ে পরিবর্তন করা যায় মানুষের থেকে গোপন রেখে, এই ব্যবস্থা সরাসরি ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির বিরুদ্ধে যায়। বৃহৎ শিল্পপতিরা শাসকদলগুলিকে টাকা দিয়ে তাদের মতন করে নীতি প্রণয়ন করাবে সম্পূর্ণভাবে জনগণকে অন্ধকারে রেখে, এই ব্যবস্থা চলতে পারে না। অতএব সুপ্রিম কোর্ট মনে করে যে নির্বাচনী বন্ড ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতিকে লঙ্ঘন করে।

এই রায় ঘোষণার সময় সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেয় নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে ৬ মার্চের মধ্যে দিতে। কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্ক টালবাহানা করতে থাকে। তারা জানায় যে সব তথ্য দিতে আরো সময় চাই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ধমকের পরে তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তথ্য দেয় নির্বাচন কমিশনকে। তাও এই তথ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায় কারণ তারা কে কোন দলকে কত টাকা দিয়েছে তা জানায় না। আবারও সুপ্রিম কোর্ট তাদের নির্দেশ দিয়েছে সমস্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানানোর।

নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্যের গভীরে যাওয়ার আগে প্রশ্ন তোলা দরকার যে কেন স্টেট ব্যাঙ্কের মতন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে তথ্য দিতে টালবাহানা করছিল। যেহেতু স্টেট ব্যাঙ্কের মালিকানা দেশের সরকারের হাতে, অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে সরকারের কোনো উচ্চ মহল থেকে স্টেট ব্যাঙ্ককে টালাবাহানা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কে এই নির্দেশ দিয়েছে? কীসের উদ্দেশ্যে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা দরকার। কারণ যেই তথ্য উঠে আসছে তা চমকে দেওয়ার মতো, যদিও এখনও অনেক তথ্য আসা বাকি রয়েছে।

প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট ৬,০৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা মোট নির্বাচনী বন্ডের অর্থের প্রায় ৪৮ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস যাদের ঝুলিতে এসেছে ১,৬০৯ কোটি টাকা (প্রায় ১৩ শতাংশ), তৃতীয় স্থানে কংগ্রেস যার ঝুলিতে ১,৪২২ কোটি টাকা। কোন দলকে কে কত টাকা দিয়েছে সেই তথ্য এখনই পরিষ্কার হয়নি। তবু, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য থেকে কয়েকটি বিষয় বোঝা যাচ্ছে।

একটি গেমিং এবং লটারি কোম্পানি 'ফিউচার গেমিং' সর্বাধিক নির্বাচনী বন্ড কিনেছে, যার মূল্য ১,৩৬৮ কোটি টাকা। এই কোম্পানির বিরুদ্ধে দেশের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের ৪১০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার! কোম্পানিটি তাদের ক্রীত বন্ডের ৫০ শতাংশের বেশি কিনেছে এই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরেই। কেন? তাদেরকে কি বাধ্য করা হয়েছে বন্ড কিনতে? আপাতত এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। 'ফিউচার গেমিং' একমাত্র কোম্পানি নয় যারা ইডি-র ব্যবস্থা গ্রহণের পরে বন্ড কিনেছে। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত 'কেভেন্টার ফুড', 'মদনলাল এন্টারপ্রাইজ' ইত্যাদি (যারা একই কোম্পানির শাখা) তাদের বিরুদ্ধেও ইডি-র ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা কিনেছে ৫৭৩ কোটি টাকার বন্ড। 'অরবিন্দ ফার্মা' কোম্পানির ডিরেক্টরকে ইডি গ্রেপ্তার করে ২০২২ সালের ১০ই নভেম্বর। এই কোম্পানি ৫২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে, যার মধ্যে ৫ কোটি টাকার বন্ড তারা কিনেছে তাদের ডিরেক্টর গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচ দিন পরে, এবং তারপরে তারা আরো ২৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে এক বছরে। 'শিরডি সাঁই ইলেক্ট্রিকাল লিমিটেড'-এর বিরুদ্ধে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে। কোম্পানিটি ১১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ৪০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এরকম আরো উদাহরণ রয়েছে।

এই সবকটি উদাহরণ থেকে এই সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে ইডি-আয়কর দপ্তর ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে অথবা তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই বন্ডগুলি কোম্পানিগুলিকে কেনানো হয়েছে অথবা তারা কিনেছে। এখন ইডি-আয়কর দপ্তর কার হাতে রয়েছে আমরা তা জানি। অতএব এই সমস্ত কোম্পানির টাকা কাদের ঘরে ঢুকেছে তা একজন শিশুও বোঝে। সম্পূর্ণ তথ্য এলেই এই সত্য সামনে চলে আসবে! আমরা মনে করি যে দেশের শাসকদল তথা প্রধানমন্ত্রীকে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। শুধু তাই নয় সম্পূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে আসার পরে নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখতে হবে স্টেট ব্যাঙ্ককে টালবাহানা করার নির্দেশ কে দিল, ইডি ও অন্যন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করে কি শাসকদলের অর্থের যোগান নিশ্চিত করা হল? ভারতের গণতন্ত্রের জন্য এই প্রশ্ন অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে যেখানে লোকসভা নির্বাচন এসে গেছে।

এরপরেও দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনী বন্ড রাজনৈতিক দলগুলির অর্থসংগ্রহের একমাত্র উপায় নয়। ব্যক্তিগত তথা কর্পোরেট চাঁদার মাধ্যমে দলগুলি টাকা সংগ্রহ করে যার সবটা আবার নির্বাচন কমিশনের কাছে জানানোও হয় না। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে যেখানে বলেছে যে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি লঙ্ঘন করা হচ্ছে, সেখানে এই কথা বলাও বাঞ্ছনীয় যে শুধু নির্বাচনী বন্ড নয়, রাজনৈতিক দলগুলির সমস্ত অর্থ সংগ্রহের হিসেব জনগণের সামনে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সেই তথ্য রাজনৈতিক দলগুলি দিলেও, শিশুরাও জানে যে আসল টাকার হিসেব তার থেকে অনেক বেশি।

অর্থ ও রাজনীতির মেলবন্ধনের মূল কারণ অবশ্যই নির্বাচনী খরচ। বর্তমানে শুধু কয়েকদিনের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য বিজেপি গুগুলকে ৩০ কোটি টাকা দিয়েছে। এই ধরনের খরচ বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলি যেই পরিমাণ টাকা খরচ করেছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের থেকেও বেশি। এই টাকা যেখানে খরচ করা হচ্ছে, সেখানে সেই টাকা আদায়ও দাতারা করবে, এটাই স্বাভাবিক। অতএব, রাজনৈতিক দুর্নীতির নেপথ্যে রয়েছে অর্থ এবং রাজনীতির এই ভয়ঙ্কর যুগলবন্দী।

এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সহজ নয়। এর জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু বামপন্থীরা দীর্ঘদিন যে রাষ্ট্রের খরচে নির্বাচনের দাবি তুলে আসছেন তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা দরকার। রাষ্ট্র যদি রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনের খরচ দেয় একটি স্বচ্ছ সর্বজনগ্রাহ্য নীতির ভিত্তিতে তাহলে দলগুলির টাকার হিসেব স্বচ্ছ হবে এবং প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল একই বিন্দু থেকে তাদের প্রচার শুরু করতে পারবে। শুধুমাত্র টাকার জোরে নীতিসমূহকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা কমবে কর্পোরেটদের। ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে অর্থ ক্ষমতার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোট ভাঙতে হবে। একমাত্র বামপন্থী রাজনীতিই সেই দিশা দেখাতে পারে।