আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৪ ● ১৯ ফাল্গুন - ২ চৈত্র, ১৪৩০
প্রবন্ধ
মৃণাল সেনঃ এক অন্য বিশ্লেষণ
অঞ্জন দাস মজুমদার
মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষে নানাবিধ প্রকাশনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন সোমেশ্বর ভৌমিক রচিত এই পুস্তক - 'মৃণাল সেনঃ একটি ব্যক্তিগত পাঠ'। এর বইয়ের মুখবন্ধে লেখকের জবানিতে জানা যায় বইটি মৃণাল সেনের কাজকর্মের কোনো সার্বিক মূল্যায়ন নয় - লেখকের সঙ্গে মৃণালবাবুর চার দশকব্যাপী মোকাবিলার এক কালানুক্রমিক খতিয়ান। বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধগুলিকে লেখক তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম পাঠ-এর নিবন্ধগুলি মৃণালবাবুর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় পাঠ এবং পদাতিক-এর নিবন্ধগুলি তাঁর প্রয়াণের পরে লেখা।
প্রথম পাঠ-এ আছে ছটি প্রবন্ধ। লেখক নিজেই জানিয়েছেন যে বিভিন্ন সময়ের এই লেখাগুলিতে কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যায়নেরও তারতম্য ঘটেছে। সেই সূত্রেই মনে হয়েছে এই লেখাগুলির সময়কাল রচনার শেষে উল্লিখিত হলে পাঠক ঋদ্ধ হতেন, তার নিজের বিচার ও বোধকে ঝালিয়ে নিতে পারতেন।
প্রথম প্রবন্ধ ‘ছবি'। প্রেমচন্দের ‘কাফন’ থেকে মৃণাল সেনের ‘ওকা উরি কথা’-য় উত্তরণ নিয়ে আলোচনা করার সময় লেখক প্রেমচন্দের গল্পের চিত্রনাট্য করতে গিয়ে মৃণালবাবু ‘আইকোনোক্লাসম’-এর প্রসঙ্গ যে এনেছিলেন তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে প্রেমচন্দের গল্পের মূল কাঠামোকেই পুষ্ট করেছেন মৃণাল সেন তাঁর ছবির শরীরে। সেই প্রবন্ধের পরের অংশে ‘আকালের সন্ধানে’ ছবি প্রসঙ্গে মৃণাল সেন কথিত শিল্প-সঙ্কটের কথা বা শিল্পীর সমস্যা নিয়ে ছবির বহুমাত্রিক বহিরঙ্গ বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর অন্তরঙ্গতার কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেছেন সোমেশ্বর। স্বভাবকথক মৃণাল সেন তাঁর ছবি নিয়ে নিজেই বহু চর্চা করেছেন। সঙ্গত কারণেই, লেখক সোমেশ্বর ভৌমিকের এই অন্য বিশ্লেষণ মৃণাল চর্চায় এক মাত্রা দেবে।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘রাজনীতি, সিনেমা এবং মৃণাল সেন’। মূলত কলকাতা ত্রয়ী ছবি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক মনে করছেন সঠিক শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গীকে এড়িয়ে গিয়ে মৃণাল মধ্যবিত্ত অভিজ্ঞতাকে বিপ্লব-মূল্যায়নের নিরিখে দেখতে চেয়েছেন। ফলে বিপ্লবী আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারণে থেকে গেছে ত্রুটি। সোমেশ্বরের মতে, দারিদ্র্যের প্রতিফলন হিসাবেই ‘কলকাতা-৭১’ সার্থক হয়ে ওঠে, পরিচালকের রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলক হিসাবে নয়। পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন পরিচালকের রাজনৈতিক বক্তব্য কী। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আর কোনও পরিচালককেই এর থেকে বেশি রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও প্রেক্ষাপট নিয়ে চিত্রায়ন করতে দেখা যায়নি। তাছাড়া পরিচালকের কাজ নয় সঠিক রাজনৈতিক পথ বা দিশাকে চিহ্নিত করা। সেই সময়ের বিশ বা চল্লিশ বছর পরে এসে আমরা সূক্ষ্ম বিচার করে মন্তব্য করতে পারি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে, কিন্ত সেই সময়ের নিরিখে মৃণাল হয়ত চিন্তায় এগিয়ে থেকেছেন। লেখক অবশ্য আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্পষ্ট ভাষায় রাজনীতির কথা বললে তাঁর মধ্যবিত্ত পৃষ্ঠপোষক তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন দলীয় রাজনীতির প্রচারক এই অজুহাতে - এটা লেখকের অনুমান। এমন কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্য সত্ত্বেও এই প্রবন্ধ পাঠ করে পাঠক তাঁর নিজের বিশ্বাস ও দর্শনের আলোকে ভাববার অবকাশ পাবেন।
তৃতীয় প্রবন্ধটি একটি সাক্ষাৎকার - ১৯৮৭ সালে গৃহীত। মৃণাল সেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নানা ঘটনা, নানা কথা বলেছেন। একটি দুটি নতুন উপলব্ধি - যখন মৃণাল সেন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, "কবিতার জায়গায় পৌছতে পারে ছবি, ছবিও কবিতার মর্যাদা পেতে পারে" - তখন এক অন্য ভুবনের মৃণালকে পাঠক প্রত্যক্ষ করেন।
পরের প্রবন্ধ ‘অন্তহীন অন্বেষণ’ - এখানে মৃণালের সামগ্রিক সৃষ্টি সম্পর্কে লেখকের অনুভূতির প্রকাশ।
পঞ্চম প্রবন্ধ ‘আখ্যান থেকে কবিতার দিকে?’ অনেকটা যেন আগের সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে আসা সেই কথাদুটির অনুষঙ্গে। সোমেশ্বর ভৌমিক লিখছেন, "মতাদর্শের একটা অবলম্বন জড়িয়ে ছিল তাঁর অস্তিত্বের পাকে পাকে। আজ আর সেটা নেই। তাই মুখ ফেরানো কবিতার দিকে"। মৃণাল সেনের পরম বিশ্বাসে উচ্চারণ "সিনেমার বিকল্প সিনেমাই"-কে সুত্র ধরে লেখক সোমেশ্বর যখন শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার দুটি লাইন উদ্ধৃত করেন - "এক শতাব্দীর পরে আরেক শতাব্দী আরো এক/ আমি যদি না-ও থাকি তবুও আমিই পড়ে থাকে" - তখন যেন মৃণালের দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাণ যাত্রার এক না দেখা বা অনালোচিত দৃষ্টিকোণ খুঁজে পান পাঠক। প্রথম পাঠের শেষ লেখা ‘চ্যাপলিন, চ্যাপলিন আর চ্যাপলিন’। এই প্রবন্ধে মৃণাল সেনের চ্যাপলিন প্রীতি, গ্রন্থ রচনার কথা এবং প্রাসঙ্গিক বহু তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন লেখক। এত বিশদে এই বিষয় নিয়ে কেউ আলোকপাত করেছেন বলে জানা নেই।
দ্বিতীয় পাঠে আছে ছটি প্রবন্ধ। এই পর্বে এবং তার পরের ‘পদাতিক’ পর্বের সবকটি রচনাই মৃণাল সেন প্রয়াত হবার পর লেখা।
‘ধ্বস্ত স্বপ্নের ভুবন’ প্রবন্ধে তাঁর আগের লেখা প্রবন্ধগুলির নানা বিশ্লেষণকে তিনি সময়ের দাবিতে নতুন করে দেখেছেন, কাঁটাছেঁড়া করেছেন। পাঠককে মনোযোগী হতে হবে সেই তফাৎ উপলব্ধি করার জন্য।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘Always Being Born থেকে তৃতীয় ভুবন’ - মৃণালের দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের উপর আলোচনা। সতেরোটি অধ্যায়ের ইংরাজী আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায়ে মৃণাল লিখেছিলেন, "I never say I‘ll retire, for I am always being born"। প্রতিটি অধ্যায়ের শীর্ষক উদ্ধৃত করে সেই অধ্যায়ে কী লেখা আছে তা সংক্ষেপে লেখক জানিয়েছেন। সোমেশ্বর বলছেন "অনেক কথা উহ্য রেখেও নিজের শিল্পকেই নিজের অভিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করে গেলেন মৃণাল সেন। এই বই দুটি যদি কারও পড়া না থাকে, তবুও হয়ত এই আলোচনাটি পড়ে তিনি বই দুটি পড়ার কথা ভাববেন"।
তৃতীয় প্রবন্ধ ‘সিগনেচার’। আঙ্গিক নিয়ে সদা পরীক্ষারত মৃণাল সেন যে ‘ভুবন সোম’-এর পর নিজস্ব উপলব্ধি-নির্ভর সেই অবস্থানে অবিচল থেকেই ছবি করেছেন - সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে লেখক মনে করিয়ে দেন ‘ভুবন সোম’-এর আগে পর্যন্ত বেশ একটা গোছানো চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেছেন মৃণাল সেন। ‘ভুবন সোম’-এ তিনি অগোছালো হয়ে কাজ করলেন, কাজ শেষ হলে দেখলেন ‘স্ক্রিপ্টের মতো’ লেখাটার সঙ্গে ছবির বিশেষ মিল নেই, তৈরি হয়েছে এক ইন্সপায়ারড ননসেন্স-এর আবহ। এবং তাতেই বাজিমাত। এরপর থেকে মূল ভাবনাকে ঘিরে প্রাথমিক একটা খসড়ার বেশি কিছুর ভিত্তিতে শুটিং করেননি। লেখক মনে করেন, ‘ভুবন সোম’ থেকেই মৃণাল সেনের এক সিগনেচার শুরু হয়। 'ভুবন সোম' ছবি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও এই অনুধাবন ও বিশ্লেষণ কিছুটা ব্যতিক্রমী এবং প্রশংসনীয়।
পরের দুটি প্রবন্ধ নানা সময়ে মৃণাল সেনের বক্তব্যকে আশ্রয় করে কল্পিত সাক্ষাৎকার।
প্রথমটি ‘একটি সম্ভাব্য কথোপকথন’। লেখক শুরুতেই বলে রেখেছেন, "ছাপার অক্ষরে তাঁর অনবদ্য কথনভঙ্গীর প্রতিরুপ তৈরি করা অসম্ভব"। হয়তো নানা সাক্ষাৎকারে অনেকেই এই কল্পিত কথনের অনেক কথার সন্ধান পেয়ে যাবেন, তবু যখন 'জেনেসিস', 'অন্তরীণ' আর 'আমার ভুবন' নিয়ে মৃণাল সেনের জবানীতে লিখিত হয় - "They accentuate human resilience in diverse form", তখন পাঠক এই উক্তির ধরতাই পেয়ে যান এই পুস্তকেরই আগের এক প্রবন্ধ ‘ধ্বস্ত স্বপ্নের ভুবন’-এ লেখকের কথায়। “আমার চোখে শেষ ছবি পাঁচটি মৃণাল সেনের সৃষ্টি ভাণ্ডারে এক বিশিষ্ট অথচ ব্যতিক্রমী গুচ্ছ"। কল্পিত সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব পাঠক অনুধাবন করে ফেলেন।
পরেরটিও এক কল্পিত সাক্ষাৎকার - মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ভাবনা আর ছবি-করিয়ে হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার নির্যাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন লেখক। সাক্ষাৎকারটি যেন ২০০২ সালের ৩১ অক্টোবর নেওয়া - যেদিন তিনি ‘আমার ভুবন’ ছবির জন্য কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক নির্বাচিত হবার খবর পাবেন। ছবির কথা একটু বলেই সোমেশ্বর চলে যান তাঁর মার্ক্সবাদ অনুরাগ প্রসঙ্গে। তার আগে অবশ্য কলকাতার জীবনসঙ্গী নিয়ে নানা কথা আছে যা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার মারফৎ প্রায় সর্বজনবিদিত।
এর পরে তৃতীয় পর্ব - ‘পদাতিক’। এই পর্বের প্রথম রচনা ‘সংসদ ভবন থেকে আমার ভুবন - পদাতিক চলচ্চিত্রকারের আশ্চর্য সফরনামা'। সংসদে মৃণাল সেনের উপস্থিতি, বক্তৃতা এবং সাংসদ হিসাবে তাঁর ভুমিকা নিয়ে এর আগে কোনো লেখা চোখে পড়েনি। তথ্যের দিক থেকে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। সর্বোপরি সংসদে অনিয়মিত থাকলেও তিনি যে তাঁর দ্বায়িত্ব পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তাঁর আন্তরিকতা ও সততা দিয়ে, সে তথ্য অবশ্যই সম্পূর্ণ মৃণালকে জানতে সাহায্য করবে।
শেষ প্রবন্ধ ‘পদাতিক চলচ্চিত্রকার এবং আমরা’। এই প্রবন্ধের একটি বক্তব্যের সঙ্গে আমি সহমত নই। লেখক লিখেছেন, "সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে আমরা তাঁর জন্মশতবর্ষে অনেক কিছু করেছি। সেই আড়ম্বরের ছোঁয়া মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে নেই"। এই কথাটা বোধহয় ঠিক নয়, বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি, গণ সংগঠন থেকে মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষে যত অনুষ্ঠান, প্রকাশনা হয়েছে তা এক কথায় অভাবনীয়। এমনকী ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা বেঙ্গালুরু বা কেরালা চলচ্চিত্র উৎসবেও তাঁকে নিয়ে সুচিন্তিত প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান হয়েছে। মৃণাল সেন বেঁচে থাকলে তাঁর এই জনপ্রিয়তা দেখে হয়ত বিস্মিতই হতেন। এই প্রবন্ধের শেষে ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের মিছিলে মৃণাল সেনের যোগ দেওয়া এবং তাঁর পরদিনই বামফ্রন্টের ডাকা মিছিলে মৃণাল সেনের পথ চলার কথা মনে করিয়ে দেন লেখক। কলকাতা ত্রয়ী ছবিগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে লেখক সোমেশ্বর যে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরই এক এক্সটেনশন যেন এই দুই ভুমিকায় ধরা পড়ে। কোনো দলীয় আনুগত্য নেই বলে তাঁর সোচ্চার ঘোষণা যতটা সত্য ততটাই আবার সত্য নয়। তিনি আপন বিশ্বাসে, যুক্তিবোধে চলেছেন। তাঁর স্ক্রিপ্ট যেমন পূর্ব নির্ধারিত নয়, তেমনই বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানা কথার মাঝে কিছু অসংলগ্নতা, কিছু অনিবার্য ফাঁক থেকে যায়। সবারই হয়ত থাকে। তবু এই দ্বান্দ্বিক আচরণ যথাযথ মর্যাদায় সোমেশ্বর উপস্থাপিত করেন। পুস্তক পাঠ শেষে সেটি আর লেখকের ব্যক্তিগত পাঠ থাকে না - পাঠকের পাঠ হিসাবে ধরা দেয়।
সব শেষে কিছু অন্য কথা। বইটিতে কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে, যেটা না থাকলে পুস্তকটি সর্বাঙ্গসুন্দর হতো। মৃণালবাবু তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনে বাংলা ও ইংরাজি শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করতেন যত্রতত্র। লেখকও অনেকটা সেই রীতি অনুসরণ করেছেন। ইংরাজি শব্দের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হলে ভাল হতো।
মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষে লেখক সোমেশ্বর তাঁর এই ব্যক্তিগত পাঠকে পাঠকের দরবারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন সেকথা বলা বাহুল্য।
মৃণাল সেন – একটি ব্যক্তিগত পাঠ
সোমেশ্বর ভৌমিক
রীত প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪২৫ টাকা