আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৪ ● ১৯ ফাল্গুন - ২ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

জ্ঞানবিভাসিত সঙ্গীতচেতনা

শুভময় দত্ত


“গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন, তোর অতীত গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন” - এমন কথা যাঁর কলম দিয়ে বেরোয় তিনি যথার্থই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুবতারা। কথাটা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের (১৯১১-১৯৯৭)। তাঁরও জন্ম ২৫ বৈশাখ, কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত সাঙ্গীতিক পরিবারে। পিতামহ দ্বারিক ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত হারমোনিয়াম কোম্পানী 'Dwarkin and Sons'-এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম জীবনে তাঁর ফুটবল, হকি, পোলো, বিলিয়ার্ড প্রভৃতি খেলাধুলোর প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। একই সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ছবি আঁকা শিখতেন। কিন্তু একবার হকি খেলতে গিয়ে চোখে গুরুতর জখমের কারণে তাঁকে সব কিছু বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। ফলস্বরূপ তিনি সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকলেন; বাকিটা তো ইতিহাস।

তাঁর বিদ্যায়তনিক শিক্ষার বুনিয়াদটিও ছিল খুব মজবুত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্যে তিনি স্নাতকোত্তরে প্রথম হয়েছিলেন। হয়তো এক সুচর্চিত মননের অধিকারী ছিলেন বলেই নিজের সঙ্গীতশিক্ষার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালে ছাত্রছাত্রী তৈরির ক্ষেত্রে খোলা-মুখ বিশ্লেষণের ওপর অধিক জোর দিয়েছেন। কোনও সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা তাঁর আধুনিক মননকে স্পর্শ করতে পারেনি। সঙ্গীত আর আধ্যাত্মিকতা জড়ানো যে-ভাবালুতা চিরকাল গুণিমহলে প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে জ্ঞানপ্রকাশ তা থেকে লক্ষণীয়রূপে মুক্ত ছিলেন।

তাঁর মুক্তচিন্তার একটি উদাহরণ। এক, আমরা ধরে নিচ্ছি যে নানাবিধ পরম্পরার মধ্যে অথবা ঘরানায়, দেশ-কাল-পাত্র হিসেবে কিছু প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও রাগের এমন একটা পরিশুদ্ধ অপরিবর্তনশীল অচল স্থিতি আছে যা পান থেকে চুন খসার মতো অচিন্ত্যনীয়। যেন রাগের শুদ্ধতা অপরিবর্তনীয়, অমোঘ বস্তু। কিন্তু আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্যে রাগ-সঙ্গীতের একাধিক শিল্পীদের বহু রাগের শ্রেষ্ঠ পরিবেশন, উৎকৃষ্ট সঙ্গীতের উদাহরণ পাওয়া সত্ত্বেও, এইসব শিল্পীদের এইরকম রাগ-সঙ্গীতের অনবদ্য পরিবেশনের মধ্যেও রাগের তথাকথিত শুদ্ধতা কল্পনার কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনি। অর্থাৎ এইরকম ঐতিহ্য ও পরম্পরায় সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এমন বিভেদ যে, কোনো একজন শিল্পীর পরিবেশনকে যদি শুদ্ধ বলা হয়, বাকি সকলেই তবে অশুদ্ধ হয়ে যান। প্রশ্ন হতে পারে যে, তাহলে রাগসঙ্গীতের মধ্যে উন্নত মানের কোনো সংজ্ঞা নেই? আসল কথা হচ্ছে যে, objective দৃষ্টিতে রাগের গঠন, পরিকল্পনা ইত্যাদি সম্বন্ধে রীতি, নীতি, বিচার সবই থাকা সত্ত্বেও উঁচু মানের শিল্পী মানেই স্বতন্ত্র কল্পনা, বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়া এতই subjective, যেখানে object-এর সাথে subject-এর সম্পূর্ণ একাত্মতা থাকা সম্ভব নয়। [১] এরকম মননশীল যুক্তিঋদ্ধ ব্যাখ্যা গানবাজনার জগতে দুর্লভ।

হারমোনিয়াম ও জ্ঞানবাবু

জ্ঞানবাবুর হারমোনিয়াম বাদনের শিক্ষা উস্তাদ খুশী মহম্মদের কাছে। তাঁর একক হারমোনিয়াম বাদন ও সঙ্গত বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর রচিত গ্রন্থ 'কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী'-তে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। উস্তাদ আমীর খাঁর জটিল এবং অভাবিতপূর্ব নকশা ও তার সঙ্গে ছুটের তান অনেক সময় শ্রোতা ও সহশিল্পীদের জটিল গোলকধাঁধায় ফেলে দিত। কুমারপ্রসাদের ভাষায়,

"শ্রোতাদেরই মাথা কাজ করত না, যারা সাথসঙ্গত করত, তাঁরাও ওঁকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে ধ্যাড়াত। এই কারণে তিনি সারেঙ্গী নিতে চাইতেন না। আর হারমোনিয়ামে তিনি জ্ঞানবাবুকেই একমাত্র খুশি হয়ে সঙ্গে বসাতেন। কারণ জ্ঞানবাবু শুধু তেজ দিমাক্ অর্থাৎ তীক্ষ্ণধী মাত্র নন, তাঁর বহুকাল ধরে আমীর খাঁ সাহেবের গায়কীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। একবার তো লিলুয়ার এক ঘরোয়া আসরে বসন্ত-বাহার রাগে এমনই কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি করেছিলেন যে, আমাদের মতো দু-চারজন শ্রোতাদের খানিকক্ষণ পরে কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। জ্ঞানবাবুর হাত সমানে তখনো চলছে। আমীর খাঁ একটু মৃদুহাস্য করে বললেন, "ইয়ে বিস্‌ সালসে হামারে সাথ বজা রহে হ্যাঁয়, তব ইনকা কুছ কুছ দিখাই দেরাহা হ্যায়"। জ্ঞানবাবু জবাবে বললেন, "খাঁ সাহেব যা বলেছেন সত্যি কথা, এ বড়োই জটিল গোলকধাঁধা, মাথা সত্যি কাজ করতে চায় না। দিমাক থক্ যাতা হ্যায়”। [২]

কলকাতা, গয়া, বেনারস ও মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু হারমোনিয়ামবাদকের বাজনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল জ্ঞানবাবুর। কলকাতার পণ্ডিত মন্টু ব্যানার্জী, গয়ার পণ্ডিত মুনেশ্বর দয়াল, মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত গোবিন্দরাম তেম্বে, বাবুভাই ও বেনারসের পণ্ডিত ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের হারমোনিয়াম তাঁর খুব ভালো লাগত। এছাড়া উস্তাদ গুলাম রসুল খাঁ-র বাজনাও খুব খুঁটিয়ে ‘দেখেছেন’। তিনি যখন উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় 'হিন্দুস্তান'-এ রেকর্ড করতে আসতেন সে সময়ের কিছু রেকর্ড জ্ঞানবাবু সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার চর্চা করেছিলেন।

তবলাঃ ‘কলকাতা ঘরানা’

তবে তবলাই ছিল জ্ঞানবাবুর সঙ্গীতজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। তবলায় প্রাথমিক তালিম নেন টনিবাবুর (ভালো নাম জানা নেই) কাছে, পরে দীর্ঘদিন ফারুখাবাদ ঘরানার উস্তাদ মসীত খাঁ-র কাছে। পাঞ্জাব ঘরানার উস্তাদ ফিরোজ খাঁ সাহেবের কাছেও তিনি তবলার শিক্ষা নিয়েছিলেন। পণ্ডিত নবদ্বীপ ব্রজবাসীর নিকট শ্রীখোল এবং বিপিনবাবুর (ভালো নাম জানা নেই) কাছ থেকে পাখোয়াজ বাদনের শিক্ষালাভ করেন। মসীত খাঁ-র কাছ থেকে তিনি দীর্ঘদিন ওই ঘরানার বিশেষ জিনিসপত্র আহরণ করতে থাকেন। ‘বাণী সঙ্ঘ’ নামে জ্ঞানবাবুদের যে-পারিবারিক অর্কেস্ট্রা ছিল সেখানেই ছোটো বয়সের কেরামত খাঁ-র সঙ্গে তাঁর আলাপ। তখনও তিনি মসীত খাঁ-র কাছে তালিম নিতে আরম্ভ করেননি। এক অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে তিনি কেরামতের বাজনার ক্রমবিকাশ দেখে গেছেন সারাজীবন।

পরবর্তীকালে ফারুখাবাদ ঘরানার উস্তাদ আজিম খাঁ-র (উস্তাদ নিজামুদ্দিন খাঁ-র পিতা) কাছে এবং পঞ্জাব ঘরানার উস্তাদ ফিরোজ খাঁ-র কাছেও তবলার তালিম নিয়েছিলেন। কিন্তু কখনওই অর্জিত শিক্ষা নিয়ে আত্মতুষ্ট হননি। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার ফলে তিনি চেষ্টা করতেন তবলার অঙ্গুলি চালনায় কিছু পরিবর্তন আনতে, যার ফলে বোলগুলি দ্রুতলয়ে আরও স্পষ্ট শোনায়, কিন্তু তুলনামূলকভাবে পরিশ্রম হবে অনেক কম।

কানাই দত্ত, শ্যামল বসু, শঙ্কর ঘোষ, দিলীপ দাস-এর মতো কয়েকজন প্রতিভাধর ছাত্রদের নিয়ে কলকাতায় তাঁর ২৫ নম্বর ডিক্সন লেনের বাড়িতে সারারাত ধরে চলত তালিম ও বোল নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তিনি গুরুদক্ষিণা নিতেন না, বলতেন, তিনি শেখাচ্ছেন গুরু হিসেবে নয় একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। বোল নিয়ে তাঁর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলস্বরূপ একটি নতুন বাদনশৈলীর উদ্ভাবন হল। সেই নতুন বাদনশৈলী অনুসরণ করে এই ছাত্ররা তো বটেই, পরবর্তীকালে ছাত্রদের ছাত্ররাও খুবই উপকৃত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গোবিন্দ বসু, সঞ্জয় মুখার্জী, অনিন্দ্য চ্যাটার্জী, অভিজিত ব্যানার্জী প্রমুখ। এঁরা সকলেই জগৎবিখ্যাত।

জ্ঞানবাবুর নিজের সৃষ্ট অনেক উচ্চমার্গের কায়দা, টুকড়া, চলন, চক্রদার, ফরমায়েশী চক্রদার, কামালী চক্রদার, রেলা ছিল। তবলার জগতে কথাবাদ্যের জনক তিনি নিজে। উদাহরণ, ‘নগেনের গিন্নি...’, ‘নিতাই খুড়োর মুখে দিনরাত তত্ত্বকথা...’, ‘মুখ্যমন্ত্রীর বিয়ে কত খানাপিনা...’। এর মধ্য দিয়ে তাঁর নিজস্ব ধরণের রসিকতা-বোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়।

জ্ঞানবাবু, নিখিল ঘোষ, নয়ন ঘোষ ও ঈশান ঘোষ-কে ধরলে চার প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছে। মার্গসংগীত জগতের মান্য রীতি অনুযায়ী তাঁদের বাদনশৈলীকে 'ফারুখাবাদ ঘরানা'র অন্তর্ভুক্ত না বলে ‘কলকাতা ঘরানা’র অন্তর্গত বলা যেতেই পারে।

গানের ভুবন

জ্ঞানবাবু কণ্ঠসঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, উস্তাদ মহম্মদ সগীর খাঁ এবং উস্তাদ মহম্মদ দবীর খাঁ-র কাছ থেকে। সারা জীবনে খেয়াল, ভজন, রাগাশ্রয়ী গান, টপ্পা মিলিয়ে প্রায় ২,০০০ গান রচনা করেছেন। তাঁর ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, বহু বছর ধরে হিন্দুস্থানী কণ্ঠসঙ্গীত তার ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আলঙ্কারিক প্রয়োগ বা নৈপুণ্যর দিকে যতখানি উন্নত হয়েছে, ভাষা এবং সাহিত্যগত দিক থেকে তার ততখানিই অবনতি হয়েছে। খেয়াল, ঠুমরীতে ভাষার মূল্য নিয়ে ১৯৮৮-এ অক্টোবরে শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'রাজ্য সঙ্গীত একাডেমি'তে আয়োজিত হয়েছিল ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে কথার স্থান’ বিষয়ে একটি আলোচনাচক্র। সেখানে জ্ঞানবাবু ছাড়াও বক্তব্য পেশ করেছিলেন রাজ্যেশ্বর মিত্র, অজয় চক্রবর্তী, দীপালি নাগ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখ। এইসব আলোচনা পুস্তিকাকারে বেরিয়েছিল।

তিনি আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন, সবকিছুতেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাস রাখতেন। দিলীপকুমার রায়ের ‘ওই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম’ গানটিতে তবলার সুর মেলানোর হাতুরি সহযোগে তানপুরা বাজিয়েছিলেন। রাগাশ্রয়ী গানের জগতে ‘আমি সুরে সুরে ওগো’, ‘আনন্দভরা এই সুন্দর ভুবনে’ ইত্যাদি তাঁর রেখে যাওয়া কয়েকটি অমূল্য রতন।

জ্ঞানবাবু তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে সবসময় কম্পোজড্ গানের চেয়ে ইম্প্রোভাইজেশন-এর ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর ছাত্ররা এক একটি গানকে ১৫-২০ রকমের ইম্প্রোভাইজেশন করে গাইতে পারেন। ভৈরবী, মালকোষ, বৃন্দাবনী সারং প্রভৃতি রাগে তাঁর এইচ. এম. ভি. থেকে খেয়াল গানের রেকর্ড আছে। 'বিলাসী টোড়ি' নামক একটি রাগ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন বি. ভি. কেশকার (১৯০৩-১৯৮৪)। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের এই রসজ্ঞ শ্রোতার মনে হয়েছিল ফিল্মি গানের দাপটে রেডিওতে অন্য সমস্ত গান নিম্নমানের হয়ে যাচ্ছে। তাঁর অনুরোধে জ্ঞানবাবু রেডিওর ‘লাইট মিউজিক ইউনিট’-এর প্রযোজক হন এবং ‘সুগম-সঙ্গীত’ বলে এক ধরনের গান সৃষ্টি করেন যা ক্লাসিকাল ও হালকা গানের মধ্যবর্তী স্থান নিয়ে নিজগুণে স্বতন্ত্র হয়েছিল।

বিজ্ঞানসম্মত সঙ্গীতচিন্তার প্রসার

জ্ঞানবাবুর এত প্রসারের মূলে ছিল তাঁর objective thinking, যা তাঁর যুগের সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে দুর্লভ। কোনো একজন শিল্পীর বিচার কীভাবে করা উচিত সেটা তাঁর মতো আর কেউ দেখাতে পারেননি। দু-একটি উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

"বিলায়াতের শিক্ষা-দীক্ষা সব অন্য লোকের কাছে, রবিশঙ্করের অন্য লোকের কাছে, কাজেই তফাৎ হতে পারে। তাছাড়া ব্যক্তিগত রুচি আছে, ব্যক্তিগত জীবনের ধারা, শিক্ষা-দীক্ষা, তার চিন্তা, অবজারভেশন ইত্যাদি অনেকরকম হতে পারে, তাই সেখানে তো তফাৎ হবেই, হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। রবিশঙ্কর একটা personality, এ বিষয়ে কোনো কথা নেই, কিন্তু রবিশঙ্করের যাঁরা ভক্ত তাঁরা যদি বলেন, রবিশঙ্করের বাজনার যে দায়রা, সেটা অনেকখানি বড়ো - সেকথা বলা যেতেও পারে। সেটা আমার বলবার দরকার নেই, কেননা বিলায়েত খাঁ যতটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল, যে দায়রার মধ্যে সে কাজ করেছে, সেখানে সে পেরেছে। সেখানে সে সফল। আমি যদি পৃথিবীর সব ভাষা শিখি, কারণ ঐ সব ভাষার প্রতি আমার অনুরাগ আছে, আবার কোনো একজন যদি একটিমাত্র ভাষার বিশেষজ্ঞ হতে চান, সেটা নিয়ে চিন্তা করেন এবং সেইটি নিয়ে জীবনযাপন করেন এবং তাঁর প্রতিভা তাঁকে ঊর্ধ্বে তুলে দেয়, তাঁকে আমার অস্বীকার করবার কিছু নেই, তুলনা করার দরকার নেই"। [৫]

তাঁর এই objective চিন্তার আরেকটা উদাহরণ হল বড়ে গোলাম-আমীর খাঁ মূল্যায়ন। এঁদের গায়কীর কথা উঠলেই লোকে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো একটা শিবির বেছে নেয়। জ্ঞানবাবুও বলেছিলেন, তিনি বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের গলায় যেসব অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ ক্রিয়াকলাপ দেখেছেন তা আর কারও গানে পাননি। তাঁর মতে বড়ে গোলাম আলী ছিলেন একজন সংস্কারক; পাতিয়ালার পূর্ব-প্রচলিত গায়কীর এক নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও সাঙ্গীতিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জ্ঞানবাবু একই সঙ্গে একথাও বলতেন, আমীর খাঁ-র গানের মধ্যে যে মর্যাদা (dignity) তিনি পেয়েছেন তা অনস্বীকার্য। তাঁর কথায়, "একটা ভালো, অপরের থেকে পৃথক হলেও ভালো হতে পারে - এই সামান্য জিনিসটা আমরা ভুলে যাই"। [৬]

সব মিলিয়ে জ্ঞানবাবুর মতো মননশীল, সৃজনশীল সঙ্গীতজ্ঞ ভারতীয় সঙ্গীতে অনন্য।

সূত্রনির্দেশঃ

১) জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তহজীব-এ-মৌসিকী; বাউলমন প্রকাশন; পৃষ্ঠা-৫০।
২) কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী; আনন্দ; পৃষ্ঠা-২১৫।
৩) তহজীব-এ-মৌসিকী; পৃষ্ঠা-১৯৩।
৪) ওই, পৃষ্ঠা-৩৭।
৫) ওই, পৃষ্ঠা-৮৩।
৬) ওই, পৃষ্ঠা-৫০।
৭) ওই, পৃষ্ঠা-১৩৪।